১.
সময়টা ২০০৪ সাল। ইংল্যান্ডে, আরও ভালো করে বললে ইপিএলে তখন চলছে আর্সেনালের জয়গান। একটার পর একটা দলকে নাস্তানাবুদ করছে তারা, সেই সাথে বাড়িয়ে নিচ্ছে নিজেদের অপরাজিত থাকার সংখ্যাও। সেই সংখ্যাটা এখন ৪৯, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সাথে জিতলেই ‘হাফ সেঞ্চুরি’ পূর্ণ করবে গানার্সরা।
কিন্তু বিধি বাম! সেই ম্যাচেই হোঁচট খেয়ে বসলো আর্সেনাল, ইউনাইটেডের সাথে তারা হেরে গেল ২ - ০ ব্যবধানে। তাই ৪৯ ম্যাচেই থেমে গেল তাদের জয়যাত্রা। তারপরও ‘দ্য ইনভিন্সিবলস’ নাম পেতে বিন্দুমাত্র অসুবিধে হয়নি তাদের।
গানারদের ম্যানেজার তখন আর্সেন ওয়েঙ্গার। আর্সেনাল দলে তখন খেলেন থিয়েরি অঁরি, রবার্ট পিরেস, রবিন ফন পার্সি, ডেনিস বার্গক্যাম্পদের মতো তারকারা। সে দলে ছিলেন ২১ বছরের একজন স্প্যানিশ তরুণও। তার নাম হোসে অ্যান্টনিও রেয়েস।
গত ১লা জুন এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়ে সেই তরুণ পাড়ি জমিয়েছেন না ফেরার দেশে!
২.
১লা জুন, ২০১৯। আর কিছুক্ষণ পরেই ওয়ান্ডা মেট্রোপলিটানোতে চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনাল খেলতে নামার কথা লিভারপুল আর টটেনহ্যাম হটস্পার্সের। আর ঠিক তখনই এল সেই দুঃসংবাদ। সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন হোসে অ্যান্টনিও রেয়েস! রেয়েসের প্রতি সম্মান দেখিয়ে খেলার শুরুতে ১ মিনিট নীরবতা পালন করলো দুই দলই।
আসলে কী ঘটেছিল সেদিন?
দুই কাজিনকে সাথে নিয়ে নিজের জন্মস্থান উত্রেরাতে যাচ্ছিলেন রেয়েস, ড্রাইভিং সিটে ছিলেন তিনিই। প্রচণ্ড গতিতে গাড়ি চালাচ্ছিলেন, দুর্ঘটনার সময় গাড়ির গতি ছিল ঘন্টায় ২২০ কিলোমিটার। এত জোরে গাড়ি চালানোর এক পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণ হারান তিনি। উল্টে যায় গাড়ি, ডিগবাজি খেতে খেতে দুর্ঘটনাস্থল থেকে ২০০ গজ দূরে গিয়ে থামে। ঘটনাস্থলেই মারা যান রেয়েস আর তার এক কাজিন, মারাত্মক আহত অবস্থায় হাসপাতালে নেয়া হয় তৃতীয়জনকে।
৩.
এরকম একজন ফুটবলারের মৃত্যুর পরে শোকে মুহ্যমান হয়ে আছেন তার সাবেক সতীর্থ ও কোচরা। টুইটারে শোক প্রকাশ করতে ভোলেনি কোনো ক্লাবই। শৈশবের ক্লাব সেভিয়া যেমন লিখেছে,
‘এর চাইতে খারাপ খবর দেয়া আর সম্ভব ছিল না। আমাদের সবার প্রিয় হোসে অ্যান্টনিও রেয়েস এক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়ে পরলোকগমন করেছেন। ওপারে শান্তিতে থাকুন।’
আর্সেনাল লিখেছে,
‘আর্সেনালের প্রত্যেকে রেয়েসের মৃত্যুর সংবাদে মর্মাহত। রেস্ট ইন পিস, হোসে।’
বাদ যায়নি অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদও। এই ক্লাবের হয়ে দুইবার ইউরোপা লিগ জিতেছেন রেয়েস। সাবেক এই খেলোয়াড়ের মৃত্যুতে ক্লাবটি টুইট করেছে,
‘অ্যাটলেটিকো পরিবার আজ শোকস্তব্ধ। রেয়েস চিরকাল আমাদের হৃদয়ে থাকবেন।’
তার শেষ ক্লাব এক্সট্রেমাদুরাও বিবৃতি দিয়েছে। টুইটারে তারা লিখেছে,
‘ভগ্ন হৃদয়ে জানানো যাচ্ছে যে, আমাদের খেলোয়াড় হোসে অ্যান্টনিও রেয়েস এক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন।’
খেলোয়াড়রাও বাদ যাননি। আর্সেনাল লিজেন্ড থিয়েরি অঁরি যেমন রেয়েসকে অভিহিত করেছেন চমৎকার একজন মানুষ ও দুর্দান্ত একজন ফুটবলার হিসেবে। তার পরিবার যেন খুব তাড়াতাড়ি এই শোক কাটিয়ে উঠতে পারে, সেজন্য সমবেদনাও জানিয়েছেন।
সেস ফ্যাব্রেগাসের জন্য আবার ব্যাপারটা খুবই বেদনাদায়ক। ফ্যাব্রেগাস যখন আর্সেনালের হয়ে খেলা শুরু করেন, তার আর রেয়েসের জাতীয়তা এক হওয়ায় দু'জন রুমমেট ছিলেন।
‘আমরা তোমাকে কখনোই ভুলবো না, হোসে। সারাজীবন আমাদের হৃদয়ে থাকবে তুমি। শান্তিতে ঘুমাও। তোমাকে অনেক ভালোবাসা।’
বলেছেন সেস ফ্যাব্রেগাস।
উনাই এমেরির অবস্থাও একইরকম। ভদ্রলোক সেভিয়াকে ইউরোপা লিগ জিতিয়েছেন তিনবার, জেতানোর সেই অভিযানে তার অন্যতম সারথি ছিলেন রেয়েস। এমেরি তাই বলেছেন,
‘চমৎকার একজন খেলোয়াড়, সেই সাথে খুব ভালো একজন মানুষ ছিল ও। একসঙ্গে ইউরোপা লিগ জিতেছি আমরা। তার কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। ফুটবলের জন্য খুব, খুব দুঃখজনক একটা দিন আজ।’
৪.
হোসে অ্যান্টনিও রেয়েস জন্মেছিলেন ১৯৮৩ সালে, স্পেনের উত্রেরা নামের জায়গায়। জায়গাটা সেভিয়ার এক প্রদেশ। ১০ বছর বয়সে সেভিয়ার যুব দলে যোগ দেন তিনি। সেখানে ৫ বছর কাটানোর পরে সেভিয়া ‘বি’ দলে স্থান মেলে তার, সেখানে ১ বছর কাটানোর পরেই সেভিয়ার মূল দলে পদোন্নতি পেয়ে যান। ২০০৪ সাল পর্যন্ত সেখানেই ছিলেন।
২০০৪ সালের জানুয়ারি মাসে ১৭ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে রেয়েসকে কিনে নেয় আর্সেনাল। পরের ৩ মৌসুমে গানারদের হয়ে ৬৯ ম্যাচ খেলেন তিনি, করেন ১৬ গোল। এর মধ্যে আছে এফএ কাপে চেলসির বিরুদ্ধে করা জোড়া গোলও।
রেয়েস ঘরকাতুরে ছিলেন খুব, নিজের দেশ স্পেন থেকে সুদূর ইংল্যান্ডে এসে ভালো লাগছিল না তার। এই নিয়ে আর্সেন ওয়েঙ্গারের সাথে মনোমালিন্যও হয়, পরে সেটা বড় আকারে রূপ নেয়। বিরক্ত হয়ে রেয়েসকে রিয়াল মাদ্রিদের কাছে ধারে দিয়ে দেয় আর্সেনাল।
রিয়ালে এসে ৩০ ম্যাচে করেন মাত্র ৬ গোল। কিন্তু রিয়াল তার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে ৩০তম লিগ জয়ের জন্য।
লিগের শেষ ম্যাচে মায়োর্কার বিরুদ্ধে লড়ছিল রিয়াল, লিগ জিততে হলে জয়ের বিকল্প ছিল না হাতে। কারণ বার্সেলোনার পয়েন্টও তখন 'লস ব্লাঙ্কোস'দের সমান, রিয়াল শুধুমাত্র এগিয়ে আছে হেড টু হেড ব্যবধানে।
সেই ম্যাচে জ্বলে উঠলেন রেয়েস, জোড়া গোল করে জয় এনে দিলেন রিয়ালকে। আর এর ফলেই ৩০তম লিগ জয় নিশ্চিত হল রিয়ালের।
ধারের মেয়াদ শেষ হয়ে গেল। এবার রেয়েসকে পাকাপাকিভাবেই ছেড়ে দিল আর্সেনাল। ছাড়া পেয়ে এবার তিনি যোগ দিলেন রিয়ালেরই নগর প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদে। ২০১১ সাল পর্যন্ত এখানে ছিলেন, মাঝে এক মৌসুম পর্তুগালে গিয়ে খেলে আসেন বেনফিকার হয়ে। ২০১২ সালে আবার ক্লাব পাল্টান, ফিরে যান শৈশবের ক্লাব সেভিয়াতে। ২০১৬ সাল পর্যন্ত সেখানেই ছিলেন। এরপর প্রতি বছরই ক্লাব বদলেছেন একবার করে। সেভিয়ার পরে এস্পানিওল, তারপরে কর্দোবা, এমনকি চাইনিজ লিগেও খেলেছেন এক মৌসুম। এই বছরের প্রথমে আবার ফিরে এসেছিলেন স্পেনে, সেগুন্ডা ডিভিশনের এক্সট্রেমাদুরা’র হয়ে খেলার জন্য। পাঁচ মাসের চুক্তিও হয়েছিল ক্লাবটির সাথে। এরপরে হয়তো আবারও চুক্তিতে যেতেন অন্য কোনো ক্লাবের সাথে, কিন্তু তার আগেই জীবনের সকল লেনাদেনা চুকালেন তিনি।
স্পেন জাতীয় দলের হয়েও খেলেছেন রেয়েস। ২০০৩ সালে পর্তুগালের সাথে ম্যাচ দিয়ে অভিষেক হয় তার, শেষ ম্যাচ খেলেছেন ২০০৬ সালে। জাতীয় দলের হয়ে ২১ ম্যাচে ৪ গোল করেছেন তিনি।
৫.
প্রায় তিন সপ্তাহ হয়ে গেল, চিরনিদ্রায় শায়িত হয়েছেন রেয়েস। তার মৃত্যুর পর শোক প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেয় উত্রেরা সিটি কাউন্সিল, দু'দিন অর্ধনমিত রাখা হয় পতাকা।
বয়স হয়েছিল মাত্র ছত্রিশ। কী'ই বা এমন বয়স? এই বয়সেও কত ফুটবলার বীরদর্পে খেলে যাচ্ছেন। তিনিও হয়তো খেলতেন আরও কয়েক বছর। আর না খেললেও ফুটবলের সাথে জড়িয়ে থাকতে তো কোনো বাধা ছিল না। এখন তো কত রকম পদের কথা শোনা যায়। হেড কোচ, অ্যাসিস্ট্যান্ট কোচ, স্পোর্টিং ডিরেক্টর, টেকনিক্যাল ডিরেক্টর, আরও কত কী! কিন্তু হলো না আর কিছুই। মর্মান্তিক এক সড়ক দুর্ঘটনা থামিয়ে দিল তার মতো এক টগবগে তরুণের প্রাণকে।
জীবননদীর ওপারের রহস্যময় জগতে ভালো থাকবেন, হোসে অ্যান্টনিও রেয়েস!
This is a Bangla article about a footballer named Jose Antonio Reyes. He passed away by a fatal car accident. This article is an obituary for him. The references are hyperlinked in the article.
Featured Image: bbc.com