Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বিশ্বকাপ ২০১৮- ব্রাজিল: সেভেন আপ, অন্ধকার দশা ও ক্রমউত্তরণের পথযাত্রা

জুলাই ০৯, ২০১৪; বেলো হরিজন্তে। মাঠে লুটিয়ে পড়ে আছেন লুইজ, মার্সেলোরা। ইতিহাসের সফলতম দল ব্রাজিলের দর্পও একইসাথে মাটিতে! যেটাকে ‘সেভেন আপ’ নামে জানে অধিকাংশ মানুষ, সেই সাত গোলের রাতে যা হয়েছিল তা ফুটবল ইতিহাসে আর কখনো হয়নি। ফুটবলপ্রাণ দেশটির মানুষের কাছে এর চেয়ে বড় ধাক্কা মারাকানা ট্র্যাজেডিও ছিল না। সেই রাতের ধাক্কা কাটতে অনেক সময় লেগেছে, উল্টো জিজ্ঞাসা করা যায়, আদৌ পুরো কেটেছে কি? তাই ২০১৮ বিশ্বকাপ ব্রাজিলের কাছে কেবল নতুন একটা ট্রফি রেপ্লিকা ট্রফিকেসে রাখা নয়, ভূলুণ্ঠিত সন্মান ফিরে পাওয়ার লড়াই। আমরা লেখাটি দুই পর্বে ভাগ করে প্রথম পর্বে সাত গোল পরবর্তী ব্রাজিলের সবকিছু নিয়ে লিখবো।

পুনরায় পশ্চাদপসরণ

ব্রাজিলের যখন সামনে এগোনোর কথা তখন আনা হয় দুঙ্গাকে; Image Source:NDTV Sports

৭-১ গোলে হারার পর ভাবা হচ্ছিল ব্রাজিলের অনেক কিছুই খোলনলচে পালটে ফেলা হবে। ২০১৪ বিশ্বকাপে ব্রাজিল জিতবেই- এমনটা খুব কম বিশ্লেষকই সরাসরি বলতেন, কারণ ফেডারেশন ২০১০ এর পর এমন একজনকে নিয়োগ দেন যার নিজের কাজের খোঁজ বোধহয় নিজেই জানতেন না, মানো মেনেজেস। তাঁর বরখাস্তের পর স্কলারি স্বল্পসময়ে যথাসাধ্য করেছেন, জিতিয়েছেন কনফেডারেশন কাপও। কিন্তু বড় ধরনের পরিবর্তনের প্রধান ধাপ হলো কোচ। তখন জার্মানির সাথে হারের পর মিডিয়া মোটামুটি নিশ্চিত টিটেই কোচ হচ্ছেন। কিন্তু ফেডারেশন বেছে নিল দুঙ্গাকে, নেতিবাচক খেলার ধরনের জন্য যার অনেক দুর্নাম। ‘জেনারেল’ দুঙ্গা এসেই যুদ্ধ মেজাজে প্রীতি ম্যাচগুলা খেলানো শুরু করলেন! যখন প্রীতি ম্যাচের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত নেড়েচেড়ে প্রতিভা যাচাই করা, দুঙ্গা প্রতিটি প্রীতি ম্যাচ খেলালেন বিশ্বকাপ মেজাজে। জিতেও গেলেন টানা ১০ ম্যাচ।

অতি আত্মবিশ্বাসে দুঙ্গা নিম্নমানের আর কেবল শারীরিক শক্তির খেলোয়াড়দের বাছতে লাগলেন। এরপর আসল পশ্চাদযাত্রা শুরু। ২০১৫ কোপা আমেরিকায় আগে আগেই বিদায়, বাছাইপর্বে দুর্দশা- সব মিলিয়ে ‘দুঙ্গা হঠাও’ রব উঠে গেল। বাছাইপর্বে ব্রাজিল তলানীতে, সামনে যে দুই ম্যাচ ছিল তা হারলে ১০ দলের মধ্যে ৯ এ চলে আসতো! ২০১৮ বিশ্বকাপ খেলা নিয়েই শঙ্কা। কোথায় ব্রাজিল সেই গ্লানি কাটিয়ে উঠবে, উল্টো আরো বেশী গ্লানিতে নিমজ্জিত হতে লাগলো। দুঙ্গার আশা ছিল ২০১৬ অলিম্পিক দিয়ে হৃত সন্মান ফিরিয়ে আনবেন। তখনই ব্রাজিলকে বড় এক উপকার করে দিয়ে যায় পেরু! ২০১৬ কোপা আমেরিকায় ব্রাজিলকে হারিয়ে গ্রুপপর্ব থেকেই ছিটকে দেয় ব্রাজিলকে! ফেডারেশন এবার দুঙ্গার উপর খড়্গহস্ত হলো। নিয়ে আসা হলো টিটেকে।

একনজরে টিটে

যে লোকের জন্য ব্রাজিল আজ আবার স্বপ্ন দেখছে; Source:Goal.com

সংক্ষেপে বলা যাক। বেশ অনেককাল ব্রাজিলের ঘরোয়া লিগে কোচিং করালেও তার আসল সাফল্য আসে করিন্থিয়ান্সকে নিয়ে। করিন্থিয়ান্সকে সাথে নিয়ে কোপা লিবার্তাদোরেস (লাতিন শ্রেষ্ঠত্বের টুর্নামেন্ট) ও ব্রাজিলিয়ান লিগ জেতেন। তখন টিটের বিশেষত্ব ছিল তার প্রচন্ড শক্ত ডিফেন্স। টিটের দল ১ গোল হলেই ম্যাচ জিতে যেত, এত রক্ষণাত্মক খুব কম দলই ছিল ব্রাজিলে। ব্রাজিলে তার সুনাম বাড়ছিল সাফল্যের জন্য। ২০১৪ সালে ব্রাজিল বাদ পড়ার দিনই টিটে প্রস্তুত ছিলেন যে, এবার তার ডাক আসবে। ডাক এলো দুঙ্গার। টিটে নিজেই বললেন, “এ নিয়ে আমি প্রচন্ড হতাশ হয়ে গেলাম, আমি বিষণ্ন ছিলাম বেশ অনেকদিন।”

এভাবেই মনমরা হয়ে না থেকে চলে এলেন ইউরোপে। আঞ্চেলত্তিসহ বেশ কয়েকজন বড় বড় কোচের সাথে সময় কাটালেন। সবচেয়ে উপকার পেলেন আঞ্চেলত্তির কাছ থেকে। তার কাছে এসে শিখলেন খেলায় আক্রমণের প্রাধান্য রেখেও কীভাবে রক্ষণের কাঠিন্য বজায় রাখা যায়। ডিফেন্সিভ অর্গানাইজেশন, বিল্ড ফ্রম ব্যাক বা নিচে থেকে খেলা গড়ে তোলা নিয়ে তার মানসিকতায় পরিবর্তন এলো। ২০১৫ সালে আবার করিন্থিয়ান্সে ফিরে এসে লিগ জেতান। এবার আর কেবল রক্ষণ নিয়ে না, সেই করিন্থিয়ান্স ছিল ব্রাজিলিয়ান লিগে একখন্ড পেপ গার্দিওলার বায়ার্ন বা লো’র জার্মানির ধাঁচের। ধারুণ সুন্দর আক্রমণ এবং জমাট রক্ষণ মিলিয়ে সেই দল ছিল নতুন এক মাত্রায়। দুঙ্গা যখন ধুঁকছিলেন ব্রাজিলের কোচ হিসেবে, টিটে তখন নিজেকে আবিষ্কার করছিলেন নতুনভাবে। ২০১৬ সালে এলো সেই ডাক, নতুনভাবে নিজেকে খুঁজে পাওয়া টিটে ব্রাজিলে এলেন ডুবন্ত এক দলকে উদ্ধারের জন্য।

অন্ধকার থেকে উত্তরণের পথে

২০১৮ বিশ্বকাপের জন্য হাতে দুই বছরেরও কম সময়। শুধু সময় কম বলা কটু ঠেকে, বিশ্বকাপে যাওয়াই তখন সংশয়। পরবর্তী ম্যাচ ইকুয়েডরের মাঠে, যেখানে দুই যুগ জয় পায়নি ব্রাজিল, আর এরপর কলম্বিয়ার সাথে। টিটে ডাকলেন অলিম্পিকে ফ্লপ তরুণ গ্যাব্রিয়েল জেসুসকে, তার করিন্থিয়ান্সে প্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় পাওলিনহোকে, জাতীয় দলে যাকে তখন ভাবাই হতো না। দায়িত্ব নিয়েই নিজে সবাইকে ফোন করেন, যেটা ‘ফার্স্ট ইম্প্রেশন’ সফলভাবেই এনে দেয়।

অদ্ভুত কিছু কারণে মার্সেলোকে দুঙ্গা ডাকতেন না। সেই মার্সেলো বলেছিলেন, “হঠাৎ টিটে ফোন করে বললেন, “তোমার কি ইনজুরি? তোমাকে দলে ডাকে না কেন? তোমার প্যাশন আমার দরকার!আমি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লাম।” এরপর কম সময়ের মাঝে এই ম্যাচগুলোর প্রস্তুতি কিভাবে নেবেন- এই ভাবনা থেকে প্রতি খেলোয়াড়ের জন্য আলাদা ভিডিও ক্লিপস রেডি করলেন মাঠে তার কী করতে হবে তা নিয়ে, একদম খুঁটিনাটি সব। হোয়াটস অ্যাপে পাঠিয়েও দিলেন। বিমান থেকে নামার আগেই সবাই যার যার ভূমিকা জানতেন! এছাড়াও কে কেন খেলবে আর কেন তাকে বসিয়ে রাখা হচ্ছে- তা সৎ সাহস নিয়ে সরাসরি খেলোয়াড়দের সামনাসামনি বললেন। এভাবে ড্রেসিংরুমের শ্রদ্ধাটা জিতে নিলেন।

যাদের কাঁধে ব্রাজিলের আশা; Image Source: Dhaka Tribune

ইকুয়েডরের সাথে সেই ম্যাচে অনভিজ্ঞ এক গ্যাব্রিয়েল জেসুসকে নামান নাম্বার নাইন হিসেবে। বাচ্চা বয়েসী, খর্বশক্তির জেসুস তখন ক্লাবেও অধিকাংশ ম্যাচ লেফট উইংয়ে খেলেন। সেই ইকুয়েডরের প্রতিকূল অবস্থায় জেসুস গোল করে ও করিয়ে ব্রাজিলকে ৩-০ গোলে জেতান। এরপর কলম্বিয়াকে ব্রাজিল হারায় ২-১ গোলে। এই ১৮০ মিনিটে ব্রাজিল এমন কিছু দেখে যা দুঙ্গার দুই বছরে দেখেনি। রক্ষণ জমাট, নিচ থেকে ছোট পাসে খেলা গড়ছে ব্রাজিল, আক্রমণের খেলোয়াড়দের নিজেদের স্কিল দেখাতে কোনো বাঁধা নেই, মুক্ত আনন্দে খেলছে। ব্রাজিল একটু প্রাণ ফিরে পেল। এরপর আর পিছে ফিরে তাকাতে হয়নি। টানা জয়ে ব্রাজিল চার ম্যাচ হাতে রেখেই বিশ্বকাপ নিশ্চিত করে ফেলে। দাপটের সাথে হারায় আর্জেন্টিনাকে ৩-০ গোলে, উরুগুয়েকে তাদের মাঠে ৪-১ গোলে। তরুণ জেসুস গোল তালিকার শীর্ষের দিকে উঠে আসতে থাকেন, পাওলিনহো হন ব্রাজিলের সেরা গোলদাতা, গোল বানানোয় কৌতিনহো নেতৃত্ব দিতে থাকেন। হঠাতই দিশাভ্রষ্ট ব্রাজিল স্বপ্ন ফিরে পায়।

দলীয় গুরুত্ব

শত সমালোচনা সত্ত্বেও টিটের পাওলিনহোর প্রতি বিশ্বাস অটুট; Image Source:Sports Illustrated

টিটে যখন দায়িত্ব নেন, প্রথম দিন ড্রেসিংরুমেই সবাইকে একটি ভিডিও ক্লিপ দেখান। বাস্কেটবলের সেরা লিগ এনবিএ-তে এক দলের এক বিখ্যাত খেলোয়াড় যিনি বিশ্বসেরা, তিনি আনকোড়া এক খেলোয়াড়কে বল ঠেলে দেন। সেই খেলোয়ারটি সহজ সুযোগটি মিস করে। কিন্তু লিজেন্ডারি খেলোয়াড়টি মাঠে প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে দৌড়ে বল উদ্ধার করলেন আর আবারো সেই আনকোড়া খেলোয়াড়কে ঠেলে দেন, এবার স্কোর হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল দলকে বোঝানো যে, তুমি যতই বিখ্যাত হও না কেন, অন্যের জন্য খেটে খেলো, তাহলে একটা দল হয়ে দাঁড়াতে পারবে। আশ্চর্য ব্যাপার হলো, টিটের অধীনে প্রথম ম্যাচেই নেইমার এমনই একটি বল বানিয়ে দেন তরুণ জেসুসকে। এর দুই ম্যাচ পর নিশ্চিত সুযোগ থাকার পরেও জেসুস ফাঁকায় দাঁড়ানো নেইমারকে দিয়ে গোল করান। ব্যস, দলে অন্যের জন্য খেলার মানসিকতাটা গড়ে ওঠে। ব্রাজিল খেলতে থাকে দলগতভাবে, মোটামুটি একটি কাঠামো গড়ে তোলেন টিটে।

বহু অধিনায়ক

দলে কোনো কারণে যেন অধিনায়কত্ব নিয়ে বা নেতৃত্ব নিয়ে সমস্যা না হয় সেজন্য ঘুরে ফিরে সবাইকে অধিনায়ক বানাতে থাকেন টিটে। নেইমার, সিলভা, আলভেস বা পাউলিনহো সবাই ক্যাপ্টেন আর্মব্যান্ড পান একে একে। এমনকি মাত্র ২০ বছরের জেসুসও পান ক্যাপ্টেন্সির গৌরব। এর উদ্দেশ্য ছিল, দলে সবার ভেতরেই দায়িত্ববোধ গড়ে তোলা, যেন কেবল নেইমারের দিকে তাকিয়ে না থাকতে হয়। দলে যে সবার দায়িত্ব আছে- এই বোধ তাদের মধ্যে পৌঁছে দেয়াও ছিল এর এক লক্ষ্য। ফলে অভ্যন্তরীণ রসায়নের দিক দিয়ে ব্রাজিল অন্য যেকোনোবারের চেয়ে বেশী ঘনিষ্ঠ হয় একে অপরের।

সমালোচনার তীর

সবচেয়ে বেশী সমালোচনা হজম করতে হয় রেনাতোর জন্য!; Image Source:Daily Mail

স্কলারির একটা কথা আছে যে, ব্রাজিল এমন একটা দেশ যে দেশের প্রত্যেক ব্যক্তিই একজন করে কোচ! ব্রাজিলের জনতাকে পুরো তুষ্ট করা প্রায় অসম্ভব কাজ। যখন সেই ভগ্নদশা পেরিয়ে এলো ব্রাজিল, তখনই শুরু পরবর্তী ধাপের সমালোচনা। মাঝমাঠের রেনাতো-পাউলিনহো জুটি নিয়ে মানুষ সন্দিহান যে ইউরোপের জায়ান্টদের সাথে পারবে কি না। কৌতিনহোকে রাইট উইংয়ে খেলানো নিয়েও অসন্তোষ; ফ্যাবিনহো, আলানের মতো পারফর্মিং খেলোয়াড়রা দলের বাইরে, দলের দুই উইংয়ে দুই আক্রমণাত্মক উইংব্যাক- মার্সেলো ও আলভেজ, পারবেন কি তারা জমাট ডিফেন্স ফর্ম করতে- ইত্যাদি নানা সমালোচনা ধেয়ে আসতে লাগলো। এরই মাঝে ইংল্যান্ডের সাথে ম্যাচে ব্রাজিলের ম্যাড়ম্যাড়ে ড্র-তে সমালোচনা আরো প্রকট হয়। এই মাঝমাঠ কি ইউরোপিয়ানদের সাথে প্রতিযোগিতায় পারবে? লাতিন দলগুলোর সাথে ব্রাজিল প্রায় অপ্রতিরোধ্য ঠিক, কিন্তু ইউরোপিয়ানদের সাথে কি পারবে- এমন সমালোচনা শুরু হয়ে গেল। এত ভালো কাজ করার পরেও টিটে পারেননি সমালোচনার তীর থেকে বাঁচতে। বরং টিটে নিজেও বদলালেন।

পরবর্তী লেখায় কিভাবে দ্বিতীয় দফায় বদল আনলেন তা সহ ব্রাজিলের দলের প্রত্যেক সদস্যের শক্তি-দুর্বলতা ও ট্যাকটিক্স এবং সত্যিই কি ব্রাজিল প্রস্তুত কি না- তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা করা হবে।

ফিচার ছবিসত্ত্ব: thebddaily.com

Related Articles