Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

রবার্তো কার্লোস: দ্য বুলেটম্যান অফ ফুটবল

– বাবা, এখন একটু খেলতে যাই?

সারাদিন ঘন্টার পর ঘন্টা ছেলে এবং স্ত্রীর সাথে ক্ষেতে হাড়ভাঙা খাটুনির পর ছেলের মুখে একথা শুনে একটু অবাকই হলেন বাবা। তবুও এত কাজ করার পরও ছেলের আগ্রহ দেখে আর বাধা দিলেন না তিনি। উত্তরটা পাওয়ার সাথে সাথেই ছেলেটি আর অপেক্ষা করলো না। কিছুক্ষণ পরেই ব্রাজিলের সাও পাওলো রাজ্যের গার্সা শহরের এক মাঠে ধুলো উড়িয়ে ফুটবল খেলতে দেখা গেল একদল ছেলের সাথে। গায়ে শুধু একটি হাফপ্যান্ট পরা, জামা বা খেলার বুট নেই তার পায়ে, কিন্তু ফুটবলের প্রতি তার আগ্রহের কাছে দরিদ্র্যতা ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছে। তার চোখেমুখে দরিদ্রতার লেশমাত্র দেখা যাচ্ছে না। বরং খেলতে পারার আনন্দটুকুই উপচে পড়ছে মুখ ঠিকরে।

আকাশে গোধূলির আলো তখনো জ্বলজ্বল করছে। এমন সময় ছেলেটির চোখ পড়ল মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক ব্যক্তির উপর। চোখ পড়তেই ছেলেটিকে ডাক দিলেন ভদ্রলোক। জিজ্ঞাসা করতেই জানা গেল, লোকটি সাও পাওলো রাজ্যের আঞ্চলিক এক ক্লাব ‘উনিয়াও সাও জোয়াও’ এর এক স্কাউট। লোকটি ছেলেটিকে সাও জোয়াও এর অ্যাকাডেমিতে ট্রায়াল দেওয়ার পরামর্শ দিলেন। আশা দিলেন যে, অচিরেই সে একজন বড় মাপের ফুটবলারে পরিণত হবে। কিন্তু ছেলেটির দুর্ভাগ্য, ক্লাবের অ্যাকাডেমি পর্যন্ত যাওয়ার মতো বাস ভাড়া ছিল না তার কাছে। কিন্তু যার বুকে ফুটবলার হওয়ার আশা সেই ছোটবেলা থেকে তাকে কি আর শুধু বাস ভাড়া দমিয়ে রাখতে পারে? ছেলেটি হেঁটে পাড়ি দিল সাও পাওলো রাজ্যের অন্য মাথায়!

ছেলেটির অসাধারণ দম, শক্তি, গতি, টেকনিকাল দক্ষতা আর পায়ের জোর দেখে যারপরনাই মুগ্ধ হয়ে গেলেন ক্লাব কোচ। মুহূর্তেই ইয়ুথ অ্যাকাডেমিতে যোগ দেওয়ার জন্য প্রস্তাব করলেন তিনি। আর এই সুযোগ কি কখনো হাতছাড়া করতে চায় ছেলেটি? বলা যায় হাত থেকে কেড়ে নিয়েই স্বাক্ষর করে দিল সে। ছেলেটির নাম বলার সময় হয়ে এসেছে বোধহয়। নামের চেয়ে সম্ভবত ‘দ্য বুলেট ম্যান’ নামেই বেশি পরিচিত তিনি। আর তার নামটি হলো রবার্তো কার্লোস।

তার পায়ের ছোঁয়া লাগতেই বুলেটের গতিতে ছুটে যেত ফুটবল; Source: The 18

১৯৯১ সাল। রবার্তো কার্লোস সাও জোয়াও-এ পেশাদার ফুটবলার হিসেবে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। এক মৌসুম পার হতে না হতেই ক্লাবের হয়ে অসাধারণ পারফর্মেন্সের কারণে মাত্র ১৯ বছর বয়সেই ব্রাজিলের জাতীয় দলে ডাক পেলেন তিনি। প্রথম বছরেই জাতীয় দলের হয়ে খেলে ফেলেন ৭টি ম্যাচ। সাও জোয়াও-এ দুই বছর কাটানোর পর নাম লেখালেন ব্রাজিলের পালমেইরাস ক্লাবে। আর তার পরেরটুকুকে কী বলা যায়? ইতিহাসই বলা ভাল।

পালমেইরাসে ২ মৌসুম কাটিয়ে জিতলেন ২টি ব্রাজিলিয়ান লিগ সহ ৫টি শিরোপা। এরপর পাড়ি জমালেন ফুটবলের পাওয়ারহাউজ ইউরোপের উদ্দেশ্যে। ইংলিশ ক্লাব মিডলসবোরোতে চুক্তি হওয়ার আগেই কী ভেবে যোগ দিলেন ইতালিয়ান ক্লাব ইন্টার মিলানে। নেরাজ্জুরিদের হয়ে অভিষেক ম্যাচেই ৩০ গজ দূর থেকে ফ্রি কিকে এক অসাধারণ দৃষ্টিনন্দন গোল! যদিও ঐ মৌসুমে দলের হয়ে তেমন কিছু জিততে পারেননি তিনি।

ইতালিয়ান ক্লাব ইন্টার মিলানের জার্সি গায়ে রবার্তো কার্লোস; Source: FC Inter 1908

এদিকে তৎকালীন ইন্টার কোচ রয় হজসন চাইছেন রবার্তো কার্লোস উইঙ্গার হিসেবে খেলবেন, কিন্তু কার্লোস লেফট ব্যাক হিসেবেই মাঠের বাম পাশে রাজত্ব করতে পছন্দ করেন। কার্লোসকে বেশি চাপ দিতে গিয়েই ফল হলো উল্টো। কার্লোস পাড়ি জমালেন স্পেনের উদ্দেশ্যে, গন্তব্য রাজধানী মাদ্রিদের ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদে। প্রবেশ করলেন জীবনের নতুন এক অধ্যায়ে, গ্যালাক্টিকো অধ্যায়।

১৯৯৭ সালের এক ফ্রেন্ডলি টুর্নামেন্টে ফ্রান্সের বিপক্ষে করা কার্লোসের সেই অসাধারণ বাঁকানো গোল; Source: Four Four Two

মাদ্রিদে যখন যোগ দিলেন তখন প্রথম গ্যালাক্টিকো প্রজন্মের সূচনা হয়েছে মাত্র। ১৯৯৭ সালে লা লিগা ও সুপারকোপা জিতে ফর্মের তুঙ্গে রয়েছেন তিনি। এর সাথে যোগ হলো জাতীয় দলের হয়ে কোপা আমেরিকা এবং কনফেডারেশনস কাপ, সাথে ফ্রান্সের বিপক্ষে ফুটবল ইতিহাসের সেরা ব্যানানা শট তাকে নিয়ে গেল খ্যাতির চূড়ান্ত সীমানায়।

হলেন ফিফা কর্তৃক ঘোষিত ১৯৯৭ সালের বিশ্বের সেরা ২য় খেলোয়াড়। পরের বছরও ধরে রাখলেন পারফর্মেন্সের ধারাবাহিকতা। ইউরোপের সর্বোচ্চ শিরোপা উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ এবং ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপ জ্বলে উঠল তার হাতে। পরের বছরও আবারো তার হাতে দেখা গেল ব্রাজিলের হয়ে দুই বছর আগে জয় করা কোপা আমেরিকা।

বাম পায়ের অসাধারণ জোরালো ফ্রি কিকে গোল দেওয়ার পর উদযাপনরত কার্লোস; Source: Sport Bible

একবিংশ শতাব্দীর প্রথম বছরেই গ্যালাক্টিকোসদের হয়ে ২য় বারের মতো জিতলেন উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ। পাওলো মালদিনির সাথে তাকেও ইতিহাসের সেরা লেফট ব্যাক হিসেবে পরিগণিত করা হয়। আক্রমণভাগেও তার দুর্দান্ত ফর্ম তাকে পরিচিত করে ফুটবলের সবচেয়ে আক্রমন্মুখো ডিফেন্ডার হিসেবে। একজন ডিফেন্ডার হয়েও তার গোল সংখ্যা ১১৭। এছাড়াও তার বল কিক করার গতি অবিশ্বাস্য প্রতি ঘন্টায় ১৬৯ কি.মি.!

২০০২ সাল তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বর্ণিল বছর। এই বছর তিনি ছোঁয়া পেয়েছেন একই সাথে বিশ্বকাপ এবং উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের। দুইটি শিরোপা জয়েই দলে তার ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া সেই বছরেই ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপ ও উয়েফা সুপার কাপ জেতায় জায়গা পেয়েছিলেন উয়েফা টিম অফ দ্য ইয়ারে। উয়েফা ডিফেন্ডার অফ দ্য ইয়ার হিসেবেও নির্বাচিত হয়েছিলেন কার্লোস।

২০০২ বিশ্বকাপ জেতার পর উদযাপনরত কার্লোস; Source: The Sun

২০০৭ সালে যখন রিয়াল মাদ্রিদ ছাড়লেন ততদিনে লা লিগায় বিদেশি খেলোয়াড় হিসেবে আলফ্রেদো ডি স্টেফানোর সর্বোচ্চ ম্যাচ খেলার রেকর্ড ভেঙ্গে ফেলেছেন তিনি। জায়গা পেয়েছেন রিয়াল মাদ্রিদের ইতিহাসের সেরা বিদেশি দলে। জিতেছেন ৩টি উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা ও ৪টি লিগ শিরোপাসহ মোট ১৩টি ট্রফি।

১৯৯৮, ২০০০, ২০০২ রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে ৩টি উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা জিতেছেন কার্লোস; Source: prensalibre

এরপর তুরস্কের ক্লাব ফেনেরবাখে কিছুদিন কাটানোর পর ১৫ বছর পর ফিরে আসেন দেশের মাটিতে। ২০১০ সালে ব্রাজিলিয়ান ক্লাব করিন্থিয়ান্সে যোগ দেন তিনি। মাত্র ১ মৌসুম কাটিয়েই আবারো চলে যান ইউরোপে, রাশিয়ান ক্লাব আনঝি মাখাচকালার হয়ে খেলতে। আনঝিতে খেলার সময় কোচ পদত্যাগ করায় তিনি কিছুদিন কেয়ারটেকারের দায়িত্ব পালন করেন। ঐ মৌসুমে ২৮ ম্যাচে ৫ গোল করে অবশেষে ২২ বছরের দীর্ঘ প্রোফেশনাল ক্যারিয়ারের সমাপ্তি ঘোষণা করেন রবার্তো ‘দ্য বুলেটম্যান’ কার্লোস।

৩৭ বছর বয়সে এসেও পায়ের জোর খুব একটা কমেনি কার্লোসের; Source: fussball.ch

২০১৫ সালে অবসর ভেঙে ইন্ডিয়ান সুপার লিগে দিল্লী ডায়নামোস ক্লাবে যোগ দেন তিনি, একইসাথে হেড কোচ এবং খেলোয়াড় হিসেবে। কিন্তু মাত্র দুইটি ম্যাচে মাঠে নামেন ৪২ বছর বয়সী এই ব্রাজিলিয়ান, বাকি ম্যাচগুলোতে ডাগআউটে থেকেই কোচের ভূমিকা পালন করেন। পরবর্তী মৌসুমেও দিল্লীর কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালনের কথা থাকলেও তা আর হয়ে ওঠেনি। তার পর এখনো পর্যন্ত কোচিং ক্যারিয়ারে নতুন কিছু যুক্ত হয়নি।

ফিচার ইমেজ: ESPN

Related Articles