এমন একটা রাতে…

ওই ম্যাচটাই ক্লাসিক হতো নিশ্চিত। কিংবা ওই সেটটা, শেষ গেমটা।

এই অ্যান্ডি মারে এগিয়ে যাচ্ছেন তো অ্যালেক্স ডি মিনার তাকে টেনে ধরছেন, কয়েকবার হলো উল্টোটাও। প্রথম সেট নিষ্পত্তির গেমটাই চলল মিনিট পনেরো ধরে। ডি মিনারের র‍্যাকেটে দেখা মিলল ব্যাকস্পিনিং ফোরহ্যান্ডের, মারে বোকা বনে গেলেন চূড়ান্ত রকমে। পিছিয়ে পড়েও ম্যাচ জেতার পরে ডি মিনারের কণ্ঠেই সিংহের গর্জন। অন্য যেকোনো রাতে এই দৃশ্যগুলোই বোধ হয় মায়াবী, তবে এ রাতে এই সব কিছুই বিরক্তি ধরিয়ে ছাড়ল চূড়ান্ত। আজ কে-ই বা তাদের ধ্রুপদী লড়াই লড়তে বলেছে!

অ্যালেক্স ডি মিনার, হারিয়ে দিয়েছেন অ্যান্ডি মারেকে। Image credit: Laver Cup

এসবের জন্য তো আজ মঞ্চ সাজেনি, চোখের ঘুম উবে যায়নি এক পৃথিবীর; পরদিনের মহাগুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষাকে বিপদসীমার ওপারে ঠেলতে দু’বার ভাবা লাগেনি, ‘কাল আটটার অফিস চুলোয় যাক’ বলে টিভি-পর্দায় দৃষ্টি আটকে রাখেননি আপনিসহ আরও অনেকে।

যার জন্য তামাম দুনিয়া বিসর্জনের লগ্ন নামাল মহামায়া পূজোর সপ্তাহ দুয়েক আগেই, বহু যুদ্ধের প্রতিপক্ষকে সঙ্গী করে তিনি কোর্টে এলেন যখন, লন্ডনের ঘড়িতে তখন ৯:৫০। টিভির পর্দায় চোখের সঙ্গে কানটাও সঁপে দিলে আপনি তখন শুনেছেন পরিষ্কার, এই সেই সুইস মায়েস্ত্রো, অ্যাথলেট হতে কোর্টে এসে যিনি ‘আর্টিস্ট’ হয়ে ফেরত যাচ্ছেন।

শেষবার… Image credit: Roger Federer

এই তিনি যে রজার ফেদেরার, সেটা আপনি জানেন। এটাও জানেন, ‘আরও বেশি বেশি সিডি’ কেনার স্বপ্ন নিয়ে শুরু যে পেশাদার ক্যারিয়ার, ২৪ বছর বাদে সেটারই সমাপ্তি হলো লন্ডনের ওটু অ্যারেনায়। বয়সের ভার কিংবা হাঁটুর অস্ত্রোপচার, কারণ যেটাই হোক, দুই ঘণ্টা স্থায়িত্ব পাওয়া ম্যাচে কখনোই দৌড়াতে দেখা গেল না পূর্ণ গতিতে। ম্যাচটাও তো মানল না রূপকথার গল্পের ধারা। ক্যারিয়ারের ৮২ শতাংশ ম্যাচই জিতেছেন যিনি, জীবনের শেষ প্রতিযোগিতামূলক লড়াইটা দুই সেটে ৪-৬, ৭-৬ স্কোরের পর শেষমেষ হেরে গেলেন ১১-৯ এর টাইব্রেকারে।

অবশ্য, এই রাতে কে-ই বা মনে রাখতে গেছে ওই কাঠখোট্টা সংখ্যার স্কোরলাইন? কে-ই বা মনে রাখল, এই ম্যাচ জিতেই এবারের লেভার কাপে ইউরোপের সাথে হিসাব বরাবর করেছে অবশিষ্ট বিশ্ব? ভরা গ্যালারির সোল্লাসের কানাকড়িও এ রাতে বরাদ্দ রইলো না জ্যাক সক আর ফ্রান্সিস টিয়েফোর জন্য। বরং, শক্তিটুকু জমা থাকল সেই কিংবদন্তির জন্য, সবার অলক্ষ্যেই যিনি খেলে ফেললেন ক্রসকোর্ট ফোরহ্যান্ড কিংবা চোখে মায়াঞ্জন বুলিয়ে যাওয়া ব্যাকহ্যান্ড, শেষবারের মতো।

প্রায় সোয়া এক বছর বাদে কোর্টে ফিরে সেরা ছন্দে দেখা দেননি স্বাভাবিকভাবেই, তবে এই রাতেও তো ঠিকই দেখা গেল সেই জাদুকরি মুহূর্তগুলো। এই যেমন প্রথম উইনারেই মিশে থাকল দারুণ রিফ্লেক্সের ছাপ। সেট নিষ্পত্তির গেমে আবার দেখা গেল চিরপরিচিত সেই ফোরহ্যান্ড। যে শট হিপ্পোক্যাম্পাসে টোকা মেরে বের করে আনল ২০০৫ সালের ইউএস ওপেনের ফাইনালের মুহূর্তটা। আন্দ্রে আগাসির বিপক্ষেও এমনই এক ফোরহ্যান্ডে স্তব্ধ করে দিয়েছিলেন তাকে, সঙ্গে পৃথিবীকেও।

এক হাতের ব্যাকহ্যান্ড, তার ট্রেডমার্ক। Image credit: Laver Cup

প্রথম সেটেই একটা বল বেরিয়ে গেল নেটের একদম সূক্ষ্ম ফাঁক গলে। ফেদেরারের নিশ্চিত করেই অমন কিছুর কল্পনা করেননি, তবে বেঞ্চে বসা থাকা নোভাক জোকোভিচের মুগ্ধতামাখা চোখ তাতে আটকাবে কেন? ধারাভাষ্যকারই বা স্তুতি গাইবার এই সুযোগ হাতছাড়া করেন কী করে? বলে বসেন, ‘২৪ বছরে তো অনেক কিছুই দেখালেন ফেদেরার, শুধু এই ট্রিকটা দেখানোই বোধ হয় বাকি ছিল।’

এ রাতে সবচেয়ে বেশি প্রার্থিত অবশ্য ছিল তার র‍্যাকেট থেকে বেরোনো এইস। তার সার্ভটা বাতাসে দিক বদলে বলটা বেসলাইন পেরিয়ে যাচ্ছে প্রতিপক্ষকে সুযোগ না দিয়েই, এমন বিবশ করে দেওয়া দৃশ্য তো কম জন্ম দেননি গত দুই যুগে। সুযোগ এসেছিল গত রাতেও। তবে উপলক্ষটা রঙিন করতে পারেননি একবারও। ‘খেলার মঞ্চে সাজানো চিত্রনাট্য বলে তো কিছু নেই, নিজের রাস্তা নিজেকেই খুঁজে নিতে হয়’, ওই ক্ষণে ধারাভাষ্যকার খুব করে মনে করিয়ে দেন সেই ধ্রুব সত্যিটাই।

অমোঘ সত্যি তো সেই উথাল-পাথাল আবেগটাও। ম্যাচ চলাকালীন তার হাসিমুখটাই ধরা পড়েছে বারবার, পাশে রাফায়েল নাদালকে রাখা যে ছবিগুলোর দাম বোধ হয় এখন কোটির অঙ্ক ছোঁবে। ম্যাচ শেষ হতেই অবশ্য আর পারলেন না হাসি-হাসি অভিনয়টা চালিয়ে যেতে। বুকের ভেতর ভার হয়ে চেপে থাকা বিষাদপাথরটা গলে গেল ঝর্ণার জলে। লোকে তাকে কান্না বলে।

বিদায়ক্ষণে… Image credit: Roger Federer

 

তার ওপর থেকে দৃষ্টিটা সরালেই দেখতে পাওয়ার কথা, চোখটা তখন ছলছল সবারই। জোকোভিচ তো তা-ও চেষ্টা করলেন লুকোতে, নাদালের সেরকম কোনো আকাঙ্ক্ষাই দেখা গেল না। কোর্টে দুজনে মুখোমুখি দাঁড়িয়েছেন ৪০ বার, নাদালকে বিষাদের সাগরে ডুবিয়ে ফেদেরার বড় ট্রফিটা নিয়ে ঘরে ফিরেছেন, এমন ঘটনাও ১৬ বার দেখা। যুক্তি তো এটাই বলে, দ্য মাইটি ফেদেরার না থাকলে স্প্যানিশ ম্যাটাডোরের ট্রফি বেশি থাকত গণ্ডাখানেক, ব্যাংক-ব্যালেন্স ফুলে-ফেঁপে উঠত আরও কিছু বেশি। নাদাল ভাবতেই পারতেন, ‘যাক, আপদ বিদায় হলো অবশেষে।’

অশ্রুসিক্ত ফেদাল; Image credit: Tennis TV

 

কিন্তু এসবের কিছুই না হয়ে যে নাদালের দু’গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল এক সমুদ্র দুর্বোধ্য, যে দুর্বোধ্য মহামারীর চেয়েও দ্রুতবেগে সংক্রামিত হয়ে পড়ল ধরাধামের আনাচে-কানাচে, তা তো প্রমাণ করল, নাদাল আসলে ওই প্রজন্মেরই অংশ। তাই তো ম্যাচ শেষে এক সাক্ষাৎকারে বলে বসলেন, “আমার জীবন থেকে বড় একটা কিছু যেন চলে যাবে ফেদেরারের সাথে সাথে।”

সেই প্রজন্ম, যারা এমন একটা রাত ‘একদিন না একদিন আসবেই’ জেনেও না দেখার স্বপ্নই দেখেছিল।

This article is in Bangla language. This article is a tribute to Roger Federer and his incredible career. Necessary images are attached inside.

Featured image © Getty Images

Related Articles

Exit mobile version