Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

রোমান সানা: অলিম্পিকে আমাদের নতুন স্বপ্নসারথী

২০০২ সাল। ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টারে বসেছিলো কমনওয়েলথ গেমসের আসর। বরাবরের মতোই আমাদের অ্যাথলেটরা অংশ নিয়েছিলেন শুধুই নিয়মরক্ষার জন্য। কিন্তু একদিন আসে এক সুখবর। আসিফ হোসেন খান নামের পাবনার এক তরুণ শ্যুটিং ইভেন্ট ১০ মিটার এয়ার রাইফেলে জেতেন স্বর্ণপদক।

চারদিকে হইচই পড়ে যায়। রাতারাতি তারকা বনে যাওয়া আসিফকে নিয়ে দেশ স্বপ্ন দেখতে শুরু করে অলিম্পিক পদকের। কিন্তু যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তাকে অলিম্পিকের জন্য তৈরি করার কথা ছিলো তার কিছুই দেয়া হয়নি। উল্টো ২০০৬ সালে অনুশীলনের জন্য স্টেডিয়ামে ঢোকার পথে পুলিশ তাকে মারধর করে, জখম হয় তার হাত দুটো। সুস্থ হয়ে আবার খেলা শুরু করলেও আস্তে আস্তে হারিয়ে যান। এখন খেলা ছেড়ে তিনি কোচিং করছেন বিকেএসপিতে। সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হলো আসিফ হোসেন খান ভারতের শ্যুটার যে অভিনব বিন্দ্রাকে হারিয়ে কমনওয়েলথে স্বর্ণ জিতেছিলেন, সেই বিন্দ্রা ২০০৮ বেইজিং অলিম্পিকে স্বর্ণ জিতে তার দেশকে গর্বিত করলেও আসিফ হারিয়ে যান কালের অতল গহবরে!

অলিম্পিক বরাবরই আমাদের কাছে স্বপ্নের এক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। আমাদের দেশে খেলাধুলা একটা সময় বিলাসিতা ছিলো। ফুটবল ছাড়া অন্যান্য খেলাধুলায় আমরা মূলত অংশগ্রহণ করার জন্যই খেলতাম। আস্তে আস্তে ক্রিকেট উঠে এলো, ফুটবলের জোয়ারটাও ভাটার দিকে চলে গেলো। আর অন্যান্য খেলাধুলায় আমাদের অংশগ্রহণ, পদক জয় সর্বোচ্চ দক্ষিণ ‘এশিয়ার অলিম্পিক’ হিসেবে খ্যাত সাফ গেমসেই (বর্তমানে এসএ গেমস) সীমাবদ্ধ ছিলো। কালের বিবর্তনে ক্রিকেট এখন দেশের এক নাম্বার খেলা। ফুটবলটা মাঝখানে খাদের কিনারায় চলে গেলেও এখন আবার উঠে আসার চেষ্টা করছে। বিশেষ করে বয়সভিত্তিক নারী ফুটবলে এখন আমাদের মেয়েরা দারুণভাবে উঠে আসছে।

বিশ্বকাপে জেতা পদক হাতে রোমান সানা; Image Source: The Daily Star

রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়লেও, বাজেটের আকার ফুলে-ফেঁপে অনেক বড় হলেও পর্যাপ্ত পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে খেলাধুলা এখনও আমাদের দেশে বিলাসিতার পর্যায়ে রয়ে গেছে। অলিম্পিক কেন, এসএ গেমসেই আমরা এখন সাত দেশের মধ্যে ৪/৫ নাম্বার পজিশনে থাকি। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রীড়াযজ্ঞ, গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ হিসেবে পরিচিত অলিম্পিকে পাশের দেশ ভারত, এমনকি পাকিস্তানও স্বর্ণপদক জিতেছে। কিন্তু আমাদের ৪৮ বছরের ইতিহাসে একটা ব্রোঞ্জও জিততে পারিনি কখনও। পদক জেতা দূরের কথা, এখনও কোনো ইভেন্টে আমরা সরাসরি অলিম্পিকে খেলার যোগ্যতাও অর্জন করতে পারি না। গত অলিম্পিকে একাধিকবার এশিয়ান ট্যুর জয়ী দেশসেরা গলফার সিদ্দিকুর রহমান সরাসরি অংশগ্রহণ করলেও তেমন ভালো ফলাফল করতে পারেননি। আমরা বরাবরই ওয়াইল্ড কার্ড নামক দয়া বা দাক্ষিণ্যে অলিম্পিক খেলার সুযোগ পাই। তার ওপর একসময় অলিম্পিকে খেলতে গিয়ে আমাদের অ্যাথলেটদের ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার ইতিহাস যোগ করলে অলম্পিক আমাদের জন্য লজ্জা ছাড়া কিছুই বয়ে আনেনি কখনও।

নেদারল্যান্ডসে কিছুদিন আগে বসেছিলো আর্চারি বিশ্বকাপের আসর। আর্চারি নামক তীর-ধনুকের খেলাটির নামও জানেন না আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষ। এই আর্চারি বিশ্বকাপেই আমাদের তীরন্দাজ মানে আর্চার রোমান সানা সেমিফাইনালে খেলেছেন বিশ্বের ৯২টি দেশের ২০০ প্রতিযোগীর সাথে লড়াই করে। সেমিফাইনালে মালয়েশিয়ার খাইরুল আনোয়ারের বিপক্ষে হেরে গেলেও গত রবিবার (১৬ জুন) ব্রোঞ্জের লড়াইয়ে বিশ্বের ছয় নাম্বার তারকা ইতালির মাউরো নেসপোলিকে হারিয়ে তৃতীয় স্থান অধিকারের গৌরব অর্জন করেন। সেই সাথে বিশ্ব আর্চারিতে জেতেন দেশের প্রথম পদক, যদিও রোমান সানা বিদেশের মাটিতে এর আগে দুটি স্বর্ণপদক জিতেছিলেন। ২০১৪ সালে ‘প্রথম এশিয়ান আর্চারি গ্রাঁ প্রি’ এবং ২০১৭ সালে কিরগিজস্তানে ‘আন্তর্জাতিক আর্চারি টুর্নামেন্ট’-এ স্বর্ণ জিতেছিলেন। কিন্তু বিশ্বকাপে পদক জেতার মাহাত্মই তো আলাদা। তাছাড়া বিশ্বকাপে সেমিফাইনাল নিশ্চিত করে তিনি আগামী অলিম্পিকে (টোকিও, ২০২০) সরাসরি খেলার যোগ্যতা অর্জনও করে ফেলেছেন। গলফার সিদ্দিকুর রহমানের পর অলিম্পিকে সরাসরি খেলার যোগ্যতা অর্জন করা দ্বিতীয় বাংলাদেশি অ্যাথলেট হচ্ছেন রোমান সানা।

Image Source: bdnews24.com

ইতিমধ্যে রোমান সানা দেশে ফিরেছেন। আর্চারি ফেডারেশন থেকে তাকে দেয়া হয়েছে সংবর্ধনা। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, “এই সংবর্ধনা আমাকে টোকিও অলিম্পিকে খেলায় অনুপ্রাণিত করবে। আশা করি আমাদের পুরুষ রিকার্ভ দলটিও খেলার যোগ্যতা অর্জন করবে। আগামী বছরের জুনে অলিম্পিকের আগের জার্মানির বার্লিনে ওয়ার্ল্ড আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপেই যোগ্যতা যাচাই হবে।

আর্চারির পৃষ্ঠপোষক সিটি গ্রুপ থেকে রোমান সানা পেয়েছেন দুই লক্ষ টাকা নগদ অর্থমূল্যের পুরস্কারও। হয়তো সামনে তার জন্য আরও পুরস্কার অপেক্ষা করছে। কিন্তু পুরস্কারের চেয়ে তার এখন বেশি প্রয়োজন পর্যাপ্ত গাইডলাইন, ভালো কোচ ও নিবিড় অনুশীলন। নইলে অতীতের আসিফ হোসেন খানদের মতো হতাশ হতে হবে আমাদের আবারও।

বিশ্বকাপে ব্রোঞ্জ জিতে দেশে ফেরার পর রোমান সানাকে সংবর্ধনা; Image Source: sportsmail24.com

আর্চারিকে বাংলায় ধনুর্বিদ্যা বলা হয়। প্রাচীনকাল থেকেই যুদ্ধক্ষেত্র ও পশু শিকারের জন্য এই বিদ্যা শেখানো হতো। ধারণা করা হয়, পাঁচ হাজারেরও বেশি বছর আগে ধনুর্বিদ্যার প্রচলন ঘটেছিলো। শুরুতে ধনুক দিয়ে শিকার করা হতো। পরে হস্তনির্মিত অস্ত্র হিসেবে এর প্রচলন ঘটে। আধুনিক সভ্যতায় রোমান, পারস্য, ভারত, চীন, কোরিয়া প্রভৃতি দেশের সরকার ব্যবস্থায় তীর-ধনুক ছিলো সেনাবাহিনীর অন্যতম প্রধান অস্ত্র।

আমাদের মেয়েরাও উঠে আসছেন আর্চারিতে; Image Source: somoynews.tv

আর্চারি আমাদের দেশে অপ্রচলিত খেলা হলেও বিনোদনমূলক খেলা হিসেবে এর প্রচলন হয়েছিলো বহু আগে। বাংলাদেশ আর্চারি ফেডারেশন ২০০৩ সালে গঠিত হয়েছে। কিন্তু ওয়ার্ল্ড আর্চারি ফেডারেশন গঠিত হয়েছে ১৯৩১ সালে। বর্তমানে ১৫৭টি দেশ এই ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত। সুইজারল্যান্ডের লোজানে এর সদরদপ্তর অবস্থিত। আর্চারি অলিম্পিকে অন্তর্ভুত হয় ১৯০০ সালে। কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কোনো নিয়মকানুন না থাকায় ১৯২০ সালের পর এটি অলিম্পিক থেকে বাদ পড়ে। পরবর্তীতে ১৯৩০ সালে আর্চারির আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘ফিটা’ গঠিত হয়। নিয়মকানুন তৈরি করা হয় সেই সংস্থার মাধ্যমে। সেই ফিটাই আজকের ওয়ার্ল্ড আর্চারি ফেডারেশন বা ডব্লিউএ নামে পরিচিত। পরবর্তীতে ১৯৭২ সালে আর্চারিকে আবারও অলিম্পিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। শুরুতে ব্যক্তিগত ইভেন্ট ও পরে দলগত ইভেন্টও যোগ করা হয়, যা আজও চলমান।

আর্চারি ফেডারেশনের নিয়োগপ্রাপ্ত জার্মান কোচ মার্টিন ফ্রেডরিক; Image Source: banglatribune.com

বাংলাদেশ আর্চারি ফেডারেশন গঠিত হওয়ার পর আস্তে আস্তে প্রচুর ছেলে-মেয়ে আর্চারিতে আসে। রোমান সানা তাদেরই একজন। বাংলাদেশ আনসার থেকে উঠে আসা রোমান সানাকে দেখে আরও ছেলে-মেয়ে আর্চারিতে আগ্রহী হবে এটা বলে দেয়াই যায়। রোমান সানা কিংবা অন্য কারও হাত ধরেই অলিম্পিকে আমরা হয়তো প্রথম পদকটা আর্চারি থেকেই পেয়ে যেতে পারি। এক্ষেত্রে আশার ভেলাটা ভাসিয়েই রাখবো আমরা।

Related Articles