Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

রোমারিও: খামখেয়ালি এক ফুটবল সম্রাট

.

‘প্রতিভা’ বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন মানুষের মধ্যে চিন্তা ও মতের পার্থক্য রয়েছে। অনেকের ধারণা, প্রতিভা আসলে খুব গুরুত্বপূর্ণ কোনো ব্যাপার নয়, অধ্যবসায় করলে যে কোনো জিনিসই পায়ের তলায় লুটতে বাধ্য। অনেকেই আবার এ কথাটি ভুল মনে করেন। তাদের মতে, প্রতিভা অনেক বড় একটি বিষয়, একে অগ্রাহ্য করা উচিত নয়। তাদের মতে, যদি নিয়ম মেনে চলা আর অধ্যবসায়ের কারণেই সবকিছু হয়ে যেত, তাহলে দেশ জুড়ে রবীন্দ্রনাথ বানানোর ট্রেনিং সেন্টার খোলা হতো। অনেকেই চেষ্টা করেছেন জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদের মতো করে লিখতে, কিন্তু সবাই কি তার মতো জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পেরেছেন? এই পক্ষের মতে, অধ্যবস্যায় করলেই কেউ শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের মতো হতে পারবেন না।

দু’পক্ষের কথারই গুরুত্ব আছে। তবে যেকোনো ব্যাপারেই পরিশ্রম অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ, এটি সতত প্রমাণিত। শুধু প্রতিভা দিয়ে কেউ বেশিদিন টিকে থাকতে পারে না, এটাই সত্য। অনেক প্রতিভাবান মানুষ খামখেয়ালি স্বভাবের কারণে ঝরে গিয়েছেন অকালে কিংবা সুযোগ পেয়েও সর্বোচ্চ অর্জনটুকু করতে পারেননি। ভারতীয় ক্রিকেটার বিনোদ কাম্বলী এর বড় একটি উদাহরণ। এককালে শচীনের সাথে একই কাতারে উচ্চারিত হতো তার নাম এবং অনেকে তাকে শচীনের চেয়েও বেশি প্রতিভাবান মনে করতো। এমনকি ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে তার পারফর্মেন্সও শচীনের চেয়ে ভালো ছিল। কিন্তু প্রতিভার সাথে পরিশ্রমের সমন্বয় ঘটিয়ে শচীন নিজেকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন, আর কাম্বলীকে ইতিহাসে স্মরণ করা হয় হারিয়ে যাওয়া প্রতিভা হিসেবেই।

তাহলে প্রতিভা থাকা আর না থাকার মাঝে পার্থক্য কোথায়? একটি উদাহরণ দিলে ব্যাপারটি বোঝা যাবে। বাংলাদেশের কোচদের কথা অনুযায়ী, সাকিব আল হাসান ট্রেনিংয়ে যতটা পরিশ্রম করেন, তার চেয়ে বেশি পরিশ্রম করেন অন্য খেলোয়াড়েরা। কিন্তু এরপরও তুলনামূলক বিচারে সাকিব বেশি সফল। এর কারণটা কী? কারণ হলো, সাকিব যথেষ্ট স্মার্ট খেলোয়াড়। অন্য খেলোয়াড়দের যে বিষয়টি আয়ত্ত করতে এক সপ্তাহ সময় লাগে, তাতে হয়তো সাকিবের সময় লাগে মাত্র ১৫ মিনিট। প্রতিভা না থাকলে এমনটি সম্ভব নয়।

সব মিলিয়ে, কোনো অসম্ভব প্রতিভাবান ব্যক্তি যদি অসম্ভব পরিশ্রমী হয়, তাহলে মানুষ অভাবনীয় কিছু দেখার সুযোগ পাবে। এই লেখায় আজ যাকে নিয়ে আলোচনা করা হবে, তিনি প্রতিভাবান ছিলেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই, খুব পরিশ্রমী ছিলেন তা বলা যাবে না, তবে খামখেয়ালি ছিলেন- সেটি নিশ্চিত করেই বলা যায়। অথচ আপনি যখন জানবেন, ক্যারিয়ার নিয়ে সিরিয়াস না হয়েও ফুটবল ইতিহাসে অফিশিয়ালি গোল সংখ্যায় দ্বিতীয় স্থানে আছেন তিনি, তখন কিছুটা অবাক হলে আপনাকে দোষ দেওয়া যাবে না। ইতিহাসের সেই উদাসীন মানুষটির নাম রোমারিও।

রোমারিও, বিশ্বকাপ জয়ের পর; source: Vbet News

খামখেয়ালি স্বভাবের কারণে যতটা পিছিয়েছেন, প্রতিভা দিয়ে সেটিকে পূরণ করে দিতে চেয়েছিলেন তিনি। ক্যারিয়ার নিয়ে সিরিয়াস হলে হয়তো আজ তিনি ফুটবল ইতিহাসে সর্বকালের সেরা বলেই বিবেচিত হতেন। চলুন জেনে আসা যাক, কেমন ছিল এই দুর্দান্ত প্রতিভাধর ফুটবলারের খেলোয়াড়ি জীবন।

২.

জন্মেছিলেন খুব দরিদ্র একটি এলাকায়, পরিবারও ছিল খুব দরিদ্র। ফুটবল নিয়ে চিন্তাভাবনা করাটা হয়তো তার জন্য একটু বিলাসিতার কাতারেই পড়ে। কিন্তু স্বপ্ন যার থাকে আকাশ ছোঁয়ার, তাকে কি বেঁধে রাখা যায়? রোমারিওর এমন স্বপ্ন দেখেই তার বাবা তাকে একজন পেশাদার ফুটবলার হবার জন্য উৎসাহিত করেন।

শৈশবে নিজ শহরের Olaria Football Club এ খেলা শুরু করেন রোমারিও। তার পারফর্মেন্সে মুগ্ধ হয়ে ক্লাব তার সাথে চুক্তি করে ফেলে, সেসময় তার বয়স ছিল মাত্র ১৩ বছর। কিন্তু রোমারিও সবার নজরে আসেন ভাস্কো দা গামা ক্লাবের বিপক্ষে একটি ম্যাচে। সেই ম্যাচে তিনি ৪ গোল করে ভাস্কো দা গামার ম্যানেজমেন্টকে হতভম্ব করে দেন। এই পারফর্মেন্সে তারা এতটাই মুগ্ধ হন যে, ১৯৮৫ সালেই তারা রোমারিওকে চুক্তিবদ্ধ করে নেন। ভাস্কো দা গামাতে থাকা অবস্থায় রোমারিও লিগ জেতেন ২ বার, সাথে দুটো কাপও জেতেন; আর সর্বোচ্চ গোলদাতা হন দু’বার।

এখান থেকে তিনি চলে যান নেদারল্যান্ডে। সেখানে ডাচ ক্লাব PSV Eindhoven এর হয়ে পাঁচটি মৌসুম খেলেন তিনি। এর মাঝে তিনি ডাচ লিগ জেতেন তিনবার এবং তিনবারই লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা হন। এছাড়াও ডাচ কাপ জেতেন দু’বার এবং দু’বারই ডাচ কাপের সর্বোচ্চ গোলদাতা হন রোমারিও।

পিএসভি এর জার্সি গায়ে; source: The Sun

এই পাঁচ বছরে তিনি দলকে ইউরোপের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ শিরোপা উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ (তৎকালীন ইউরোপিয়ান কাপ) জেতাতে না পারলেও সর্বোচ্চ গোলদাতা হন দুই বার, ১৯৮৯-৯০ আর ১৯৯২-৯৩ সিজনে।

৩.

১৯৮৮ সালের গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে ব্রাজিল দলের হয়ে অংশ নেন রোমারিও। তিনি এই টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতা হবার পরেও ব্রাজিল ফাইনালে হেরে যায়। এরপর ১৯৯০ এর বিশ্বকাপেও ফিটনেস সমস্যার কারণে সব ম্যাচ খেলতে পারেননি। শুধুমাত্র স্কটল্যান্ডের বিপক্ষের ম্যাচে ৬৬ মিনিট খেলার সুযোগ পান তিনি। দ্বিতীয় পর্বে আর্জেন্টিনার কাছে হেরে ব্রাজিল টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নেয়।

১৯৯২ সালে যখন ডাচ লিগে সফল মৌসুম কাটাচ্ছিলেন রোমারিও, তখন জার্মানির বিপক্ষে একটি প্রীতি ম্যাচে জাতীয় দলে ডাক পান তিনি। কিন্তু শেষপর্যন্ত ম্যাচটিতে তিনি খেলার সুযোগ পাননি। হতাশ রোমারিও মন্তব্য করেন, “আমার যদি জানা থাকত যে আমি ম্যাচে সুযোগ পাব না, তাহলে আমি এখানে আসতাম না।” তার এই মন্তব্যে তৎকালীন কোচ আলবার্তো পেরেইরা প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হন এবং ব্রাজিলের জাতীয় দল থেকে তাকে বাদ দিয়ে দেন।

কিন্তু অচিরেই কোচকে মত পাল্টাতে হয়। ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপ বাছাই পর্বের প্রথম ৭টি ম্যাচে রোমারিও দলে ছিলেন না। বলিভিয়ার সাথে ঐতিহাসিক পরাজয়ের পর সমীকরণ এমন দাঁড়ায় যে, বিশ্বকাপে যেতে হলে শেষ ম্যাচে উরুগুয়েকে ২ গোলের ব্যবধানে হারাতে হবে। কোচ প্রথমে রোমারিওকে দলে নিতে চাননি, কিন্তু সাংবাদিক আর দর্শকদের প্রবল চাপের মুখে রোমারিওকে দলে ডাকতে বাধ্য হন তিনি। দলে সুযোগ পেয়ে রোমারিও বলেন, “আমি জানি কী হতে যাচ্ছে। আমি উরুগুয়েকে শেষ করতে যাচ্ছি।” সেই ম্যাচে ব্রাজিল ২-০ গোলে জয় পায় এবং দুটো গোলই করেন রোমারিও।

এতে মোটেও অবাক হবার কোনো কিছু নেই, কারণ অতীতেও অগ্রীম ঘোষণা দিয়ে সেটা পূরণ করে দেখিয়েছেন রোমারিও। নিজের প্রতি অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস ছিল তার। পিএসভিতে থাকা অবস্থায় তার কোচ ছিলেন গাস হিডিঙ্ক। সেই গাস হিডিঙ্ক একবার বলেছিলেন, “যে কোনো বড় ম্যাচের আগে আমি যখন নার্ভাস থাকতাম, তখন রোমারিও আমাকে বলতো, চাপ নেবার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি গোল করবো আর ম্যাচটা আমরাই জিতবো। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ১০ বারের মাঝে ৮ বারই সে এটা করে দেখাতো আর আমরা সত্যি সত্যিই ম্যাচটা জিততাম!

এদিকে উরুগুয়ের বিপক্ষে ম্যাচটির পর ব্রাজিলিয়ান কোচ মন্তব্য করেন, “ঈশ্বর রোমারিওকে পাঠিয়েছেন আমাদের উদ্ধার করতে।” এরপরেই শুরু হয় রোমারিওর বিশ্বকাপ যাত্রা।

১৯৯৪ বিশ্বকাপ

দল হিসেবে ব্রাজিল বরাবরই সেরাদের কাতারে প্রথম দিকেই থাকতো। কিন্তু পেলে পরবর্তী যুগে অনেক ভালো দল নিয়েও বিশ্বকাপ জেতা হয়নি তাদের। সবচেয়ে সেরা দলের একটি ছিল ১৯৮২ আর ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ খেলা দলটি। কিন্তু জিকো-সক্রেটিস থাকার পরেও বিশ্বকাপ জেতা সম্ভব হয়নি তাদের। যারা ১৯৯৪ বিশ্বকাপ নিজ চোখে দেখেছেন তারা জানেন, ২৪ বছর পর ব্রাজিলের বিশ্বকাপ জয়ে রোমারিওর অবদান কতটা ছিল।

গ্রুপ পর্বের তিনটি ম্যাচেই রোমারিও গোল করেন। দ্বিতীয় পর্বে যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে ১-০ গোলে জেতা ম্যাচে অ্যাসিস্ট করেন। সেই গোলের পরেই ছিল বেবেতো-রোমারিওর সেই বিখ্যাত উদযাপন।

১৯৯৪ সালে সতীর্থদের সাথে রোমারিওর গোল উদযাপন; source: Goal.com

কোয়ার্টার ফাইনালে নেদারল্যান্ডের বিপক্ষে ৩-২ গোলে জেতা ম্যাচে ১টি গোল করেন রোমারিও। সেমিতে সুইডেনের বিপক্ষে ১-০ গোলে জেতা ম্যাচেও গোল করেন তিনি। ফাইনালে ইতালি আর ব্রাজিল দুই দলই রক্ষনাত্মক নীতি নিয়ে খেলায় সেই ম্যাচে কোনো গোল হয়নি। তবে টাইব্রেকারে ব্রাজিলের পক্ষে দ্বিতীয় গোলটি করেন রোমারিও। সেই টুর্নামেন্টে রোমারিও সেরা খেলোয়াড়ের পুরষ্কার পান। বিশ্বজয়ী দল থেকে সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার পাওয়ার রেকর্ড সেটাই সর্বশেষ। এই পারফর্মেন্সের জন্যেই ১৯৯৪ সালে ফিফা বর্ষসেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারও পান তিনি।

বিশ্বকাপে রোমারিওর সেই পাঁচটি গোল দেখুন:

১৯৯৮ বিশ্বকাপ

ফর্মের তুঙ্গে থাকা অবস্থাতেও ইনজুরির কারণে রোমারিও দল থেকে বাদ পড়েন সেবারে। অবশ্য পরবর্তীতে রোমারিও অভিযোগ করেন, তিনি টুর্নামেন্টে খেলার জন্য সুস্থ ছিলেন। সেই বিশ্বকাপের ফাইনালে ফ্রান্সের বিপক্ষে ব্রাজিল হেরে যায়। রোমারিওকে দলে না নেওয়ার জন্য জাগালো সমালোচিত হন।

২০০২ বিশ্বকাপ

৩৫ বছর বয়সী রোমারিও দুর্দান্ত ফর্মে ছিলেন এবারেও এবং বিশ্বকাপের পরিকল্পনাতেও ছিলেন। কিন্তু কোচের সাথে তার আবার বিবাদ হয়। ২০০১ সালে তৎকালীন কোচ লুই ফিলিপ স্কলারিকে তিনি বলেছিলেন, চোখের অপারেশনের কারণে তিনি কোপা আমেরিকা খেলতে পারবেন না। কিন্তু অপারেশন না করিয়ে তিনি ক্লাব ভাস্কো ডা গামার হয়ে মেক্সিকোর বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচ খেলেন এবং সেখানে ছুটি কাটান। এই ঘটনার কারণে স্কলারি পরবর্তীতে তাকে আর স্কোয়াডে নেননি । ২০০২ বিশ্বকাপের স্কোয়াড নির্বাচনের সময় পুরো দেশ রোমারিওকে নেওয়ার জন্য আন্দোলন করে, এমনকি ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট Fernando Henrique Cardoso পর্যন্ত রোমারিওকে স্কোয়াডে নেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন।

রোমারিও একটি সংবাদ সম্মেলন করেন তখন। সেখানে তিনি তার কাজের জন্য অনুতপ্ত হন এবং ক্ষমা প্রার্থনা করে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তার কান্না ভক্তদের আবেগকে আরো বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু স্কলারি তার সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন। স্কলারি বলেন, “লোকজন সম্ভবত ভুলে গিয়েছে, কিন্তু আমি ভুলিনি। কোপায় হন্ডুরাসের বিপক্ষে কোয়ার্টারে বাদ পড়ার পর জাতীয় দল থেকে আমাকে প্রায় বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

স্কলারিকেও খুব একট দোষ দেওয়া যায় না সে ঘটনার জন্য। তিনি সেবার রোমারিওকে বাদ দিয়ে রোনালদিনহোকে নেন এবং জন্ম হয় আরেকজন লিজেন্ডের।

 ৪.

কোপা আমেরিকা

জাতীয় দলের হয়ে রোমারিও কোপা জিতেছেন ১৯৮৯ আর ১৯৯৭ সালে। ১৯৮৯ সালের ফাইনাল রাউন্ডের ফিক্সচার ছিল লিগ ভিত্তিক। নিয়ম ছিল, দুই গ্রুপ থেকে সেরা দুটো দল এসে চার দল নিয়ে আরেকটি লিগ হবে। সেখানকার সেরা দল টুর্নামেন্ট চ্যাম্পিয়ন হবে। বাকি তিনটি দল ছিল আর্জেন্টিনা, প্যারাগুয়ে আর উরুগুয়ে। ব্রাজিল আর উরুগুয়ে দুটো করে ম্যাচ জিতেই শেষ ম্যাচে মুখোমুখি হয়। দুই ম্যাচেই রোমারিও গোল করেন। শেষ ম্যাচে সমীকরণ ছিল এমন, যে দল জিতবে সে দলই চ্যাম্পিয়ন হবে। ১-০ গোলে জেতা ম্যাচের গোলটি করেন রোমারিও।

রোনালদোর সাথে রোমারিও; source: These Football Times

১৯৯৭ সালের কোপা আমেরিকাতেও রোমারিও দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন। ব্রাজিলকে চ্যাম্পিয়ন করানো সেই টুর্নামেন্টের সেমিফাইনালের ২ গোল সহ মোট ৩ গোল করে টুর্নামেন্টের ৩য় সর্বোচ্চ গোলদাতা হন তিনি।

কনফেডারেশন কাপ

১৯৯৭ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম কনফেডারেশন কাপে চ্যাম্পিয়ন হয় ব্রাজিল। ৭ গোল করে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়ে ‘গোল্ডেন শু’ জিতে নেন রোমারিও। এছাড়া টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন তিনি। ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে রোনালদো আর রোমারিও দুজনেই হ্যাট্রিক করেন।

রোমারিওর কিছু অসাধারণ স্কিল দেখে নিন:

এগুলো ছাড়াও ব্রাজিলের হয়ে ১৯৮৮ সালে অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত চার জাতির (যাতে আর্জেন্টিনাও অংশ নিয়েছিল) Australia Bicentenary Gold cup এ অংশ নেন রোমারিও। ব্রাজিলের শিরোপা জেতা এই টুর্নামেন্টের ফাইনাল ম্যাচেও তিনি ১টি গোল করেন। ব্রাজিলের হয়ে মোট ৭০টি ম্যাচ খেলে ৫৫টি গোল করেন রোমারিও।

ব্রাজিলের হয়ে করা রোমারিওর গোলগুলো দেখে নিতে পারেন একনজরে:

৫.

ইউরোপ মাতানো

ফুটবলে সেরা হবার জন্য একটি অলিখিত নিয়ম হচ্ছে ইউরোপের সেরা লিগগুলোতে ভালো পারফর্ম করা। ডাচ লিগ মাতানোর পর ১৯৯৩-৯৪ মৌসুমে রোমারিও সেই লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে যোগ দিলেন ক্রুয়েফের বিখ্যাত ড্রিম টিম বার্সেলোনায়। সেই মৌসুমেই বার্সা উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে ওঠে। কিন্তু ফেভারিট হওয়া সত্ত্বেও মিলানের বিপক্ষে হেরে যায়। বার্সার হয়ে মাত্র দুটো মৌসুম খেলেন রোমারিও, যার মাঝে একবার লিগ শিরোপা জেতেন আর লা লিগার সর্বোচ্চ গোলদাতা হন। এক মৌসুমে ফিফা বর্ষসেরায় দ্বিতীয় হন, আরেক বছর হন বর্ষসেরা।

বার্সার হয়ে করা রোমারিওর গোলগুলো দেখে নিন:

লা লিগায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ ধরা হয় এল ক্লাসিকোকে। অনেক ক্ষেত্রে লিগ না জিতলেও যদি এল ক্লাসিকোতে জয় পাওয়া যায়, তাহলেও খুশি থাকে বার্সা-রিয়াল। কিন্তু কখনো যদি লিগ জয়ের সাথে সাথে এল ক্লাসিকোতেও জয় পাওয়া যায়, তাহলে সেটা হয় সোনায় সোহাগা। রোমারিওর হ্যাট্রিকের কল্যাণে সেই মৌসুমের এল ক্লাসিকোতে ৫-০ গোলের বড় জয় পায় বার্সেলোনা।

রিয়াল-বার্সার সেই ম্যাচ:

বার্সায় থাকা অবস্থায় রোমারিওর সবচেয়ে কঠিন দ্বৈরথ হয় সেই সময়ের সেরা গোলকিপার পিটার স্মাইকেলের সাথে। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে দুই লেগেই গোল করেন রোমারিও। সেই ম্যাচের পর ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের অধিনায়ক স্টিভ ব্রুস বলেন, “আমার ক্যারিয়ারে যত উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছে, তার মাঝে আজকের রাতটাতেই আমার উপর ছড়ি ঘুরানো হয়েছে। স্টইচকোভ আর রোমারিও এখনো আমার মাথায় গেঁথে আছে। বিশেষ করে রোমারিও, আমি যাদের মুখোমুখি হয়েছে তাদের মাঝে তর্কাতীতভাবে সে সেরা।

এরপর রোমারিও চলে যান ব্রাজিলে। ১৯৯৬-৯৭ মৌসুমে ভ্যালেন্সিয়ার হয়ে মাত্র ৫ ম্যাচ বাদ দিলে ইউরোপের ক্লাবের হয়ে আর কখনো খেলেননি তিনি।

৬.

ব্রাজিলের খেলোয়াড়দের একটি বৈশিষ্ট্য হলো, তাদের অধিকাংশই অনেক অল্প বয়সে খেলা শুরু করলেও ফর্ম শেষও হয়ে যায় অনেক অল্প বয়সেই। এই দিক থেকে রোমারিও ছিলেন এক অনন্য ব্যতিক্রম। ২০০৫ সালে ৩৯ বছর বয়সে ব্রাজিলিয়ান লিগে ২২ গোল করে সর্বোচ্চ গোলদাতা হন তিনি! ২০০৭ সালে ভাস্কো দা গামার হয়ে খেলে ৪১ বছর বয়সেও ১৯ ম্যাচে ১৫ গোল করেন তিনি। রোমারিও ব্রাজিলিয়ান লিগ ইতিহাসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা।

বার্সালোনার জার্সি গায়ে; source: YouTube

২০০৭ সালে Sport Recife-র বিপক্ষে পেনাল্টি থেকে গোল করে রোমারিও ক্যারিয়ারে হাজারতম গোল পূর্ণ করেন। রোমারিও বাদে এই রেকর্ড আছে শুধু পেলে আর পুসকাসের (যদিও এই রেকর্ড নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক আছে)। ফিফা রোমারিওর অর্জনের জন্য তাকে অভিনন্দন জানায়। কিন্তু এরপরও তাদের রেকর্ডে দেখানো হয় যে, রোমারিওর গোল সংখ্যা ৯২৯টি। ২০০৮ সালে রোমারিও একটি ডিভিডি বের করেন, যেখানে তার ৯০০টি গোল রাখা হয়েছে।

দীর্ঘ ক্যারিয়ারে পরিপূর্ণ রূপে একটি মাত্র বিশ্বকাপ খেলেছেন রোমারিও। অথচ এরপরও দর্শকদের মাঝে তার জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী। ২০০২ সালে দর্শকদের ভোটে ফিফার বিশ্বকাপের ড্রিম টিম তৈরি করা হয়, সেখানে রোমারিও জায়গা পান, স্কলারির সিদ্ধান্তের কারণে সেবারে তার না খেলার গল্প তো আগেই বলা হয়েছে।

সেই একাদশটি ছিল এমন: ইয়াশিন-পাওলো মালদিনি, বেকেনবাওয়ার, রবার্তো কার্লোস-ম্যারাডোনা, জিদান, ক্রুয়েফ, প্লাতিনি-রবার্তো ব্যাজিও, পেলে, রোমারিও।

এরপর ২০১৪ সালে স্পেনিশ পত্রিকা মার্কার তত্ত্বাবধানে আরেকটি নির্বাচন হয়, যেখানে দুই লক্ষ ভোটার ভোটের মাধ্যমে সর্বকালের সেরা বিশ্বকাপ একাদশ নির্বাচন করেন; সেখানেও রোমারিও সুযোগ পান।

সেই একাদশটি ছিল এমন: ক্যাসিয়াস-পাওলো মালদিনি, বেকেনবাওয়ার, রবার্তো কার্লোস-ক্রুয়েফ, জিদান, ইনিয়েস্তা, ম্যারাডোনা-রোমারিও, রোনালদো, পেলে।

আমাদের মাথায় রাখতে হবে, রোমারিও মাত্র একটি বিশ্বকাপে তার পারফর্মেন্স দেখানোর সুযোগ পেয়েছিলেন এবং পরবর্তী দুটি বিশ্বকাপে তুখোড় ফর্মে থাকা সত্ত্বেও তিনি খেলতে পারেননি। এই একাদশগুলো দিয়ে আসলে কাউকে সেরা বলা যাবে না কারণ, এই নির্বাচনগুলো সাধারণ মানুষের ভোটে করা। এখানে শুধু দেখানো হয়েছে যে, একটি মাত্র বিশ্বকাপ খেলেও রোমারিওর জনপ্রিয়তা কী অবিশ্বাস্য রকমের তুঙ্গে ছিল।

৭.

২০০৮ সালে এক সাক্ষাৎকারে ম্যারাডোনাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, তার দেখা সেরা খেলোয়াড় কে? উত্তরে ম্যারাডোনা বলেছিলেন, “রোমারিও এবং ভ্যান ভাস্তেনের মাঝে একজন।” এছাড়া ম্যারাডোনা তার আত্মজীবনীতে বলেছেন, “রোমারিও একজন অবিশ্বাস্য ফিনিশার। তার মতো স্ট্রাইকার আমি কখনো দেখিনি। সর্বকালের সেরা ফুটবলারদের যে কোনো দলেই অনায়াসে জায়গা পাবেন রোমারিও।

ম্যারাডোনার সাথে রোমারিও; source: Mirror Sports

তবে রোমারিও নিজের একটি সাক্ষাৎকারে সর্বকালের সেরা পাঁচের দ্বিতীয় অবস্থানে নিজেকে রেখেছেন। তার উপরে তিনি রেখেছেন কেবলমাত্র পেলেকে। পুরো ক্যারিয়ারে রোমারিও যে ধরনের আত্মবিশ্বাসী ছিলেন, তাতে তার দাবিকে একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তার খেলা দেখে মনে হতো, ডি বক্সের ভেতর সুঁই পরিমাণ জায়গাও যেন তার কাছে এক একরের সমান।

ফুটবল সম্রাট পেলের সাথে রোমারিও; source: Aprokocity

ক্যারিয়ারে সম্ভাব্য সব কিছু জিতেছেন রোমারিও, শুধুমাত্র অলিম্পিকে স্বর্ণ আর চ্যাম্পিয়ন্স লিগ বাদে। তবে এই দুই টুর্নামেন্টেই সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছিলেন এবং ফাইনালও খেলেছিলেন। হয়তো ক্যারিয়ার নিয়ে সিরিয়াস হলে সর্বকালের সেরাও হয়ে যেতে পারতেন। রোমারিও যে তার স্কিল পুরোপুরি দেখানোর মঞ্চ পাননি, সেটি নিয়ে ফুটবলপ্রেমীদের মাঝে আক্ষেপ রয়েই যাবে। তবে ইতিহাস তাকে নিশ্চয়ই মনে রাখবে ফুটবলের এক অবিস্মরণীয় প্রতিভা হিসেবে।

ফিচার ইমেজ- Getty Images

Related Articles