Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

রায়ান টেন ডেসকাট: সদস্যদেশের যে ব্যাটসম্যান হতে পারতেন বিশ্বসেরা

খেলাধুলার ইতিহাসে তিনি বিচিত্র এক চরিত্র। তাকে ‘বিচিত্র’ বলার অনেক কারণই আছে। তিনি সহযোগী ক্রিকেট দলের খেলোয়াড় হয়েও বিশ্বজুড়ে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন ব্যাট হাতে, এটুকু বললেই তার সক্ষমতার প্রমাণ দেওয়া যায়। কেবল টেস্ট খেলা বাদে ক্রিকেটে যা যা করা সম্ভব, ব্যাট হাতে সবই করেছেন। তিনি হলেন রায়ান টেন ডেসকাট, ভালোবাসার ‘টেনডো’। আধুনিক ক্রিকেটে তার মতো কার্যকর ক্রিকেটারের সংখ্যাটা খুব বেশি নয়।

বিশ্বজুড়ে ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট খেলে বেড়িয়েছেন। এই ক’দিন আগেও তিনি টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে বিশ্বজুড়ে নানারকম লিগে ছিলেন রীতিমত ‘হটকেক’। ইংলিশ কাউন্টি ক্রিকেটে টিকে আছেন কিংবদন্তিতুল্য হয়ে। জাতীয় দল নেদারল্যান্ডসের হয়ে তিনি খেলেছেন খুবই অল্প কিছুদিন। তাতেও তার যা অর্জন, তা রীতিমতো ঈর্ষণীয়।

সহযোগী ক্রিকেটের ইতিহাসে তার মানের ব্যাটসম্যান আগে কখনোই আসেনি। আবার কবে আসবেন, কিংবা আদৌ আসবেন কি না, সে কথা হলফ করে বলা যায় না। তার সবচেয়ে কাছাকাছি আসতে পেরেছিলেন কেনিয়ার স্টিভ টিকোলো। কিন্তু, সাবেক এই কেনিয়ান অধিনায়কের চেয়ে ক্রিকেটীয় অর্জন আর পরিসংখ্যানে হাজার হাজার গুন এগিয়েই থাকবেন ডেসকাট।

তার গল্পটা বলতে হলে একদম গোড়া থেকেই শুরু করতে হয়।

নেদারল্যান্ডসের কমলা জার্সি শরীরে চাপিয়ে তিনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেললেও তিনি আদতে ডাচ নন, পুরোদস্তর একজন ‘প্রোটিয়া’। জন্ম, বেড়ে ওঠা কিংবা ক্রিকেট খেলার সূচনা – সবই হয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকায়।

দক্ষিণ আফ্রিকায় বঞ্চিত মানুষটিই নেদারল্যান্ডস ও ইংলিশ কাউন্টি ক্রিকেটের কিংবদন্তি হয়েছেন কালক্রমে © Getty Images

১৯৮০ সালের ৩০ জুন তার জন্ম হয় পোর্ট এলিজাবেথে। ক্রিকেটের খোঁজখবর যারা রাখেন, তারা দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ প্রোভিন্সের এই শহরটির সাথে পরিচিত। এখানেই তার ক্রিকেট খেলাটির সাথে পরিচয় হয়।

দক্ষিণ আফ্রিকার আর দশজন শিশুর মতোই শৈশবে সব রকম খেলাই খেলেছেন ডেসকাট। ক্রিকেট তো খেলেছেনই, সাথে খেলেছেন রাগবি আর গলফ। স্কুলে পড়ার সময় ক্রিকেট ও রাগবি – দু’টো দলেই তার জায়গা ছিল অবধারিত। গলফটা তিনি এখনও খেলেন। তিনি মনে করেন, অবসর কাটানোর জন্য গলফ থেকে ভালো কিছু আর হতেই পারে না।

মজার ব্যাপার হলো, ক্রিকেটে তার উত্থানটা হয়েছে একটু অন্যরকম উপায়ে। এখানে কোনোভাবেই তাকে অন্য কারো সাথে মেলানো যাবে না। তার প্রতিভার ফুলটা একটু দেরি করেই প্রস্ফুটিত হয়েছে। যখন বয়স ২০ বছর ছাড়িয়ে গেছে, তখন তিনি সত্যিকারের ক্রিকেট খেলা শুরু করেন।

তখন অবশ্য চাইতেন দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে খেলতে। জন্টি রোডসকে আদর্শ মানতেন, ওয়েস্টার্ন প্রোভিন্সের হয়ে খেলতেন। তবে ডেসকাটের সেই আশা আদৌ পূরণ হয়নি। আর এটা তো বলে না দিলেও চলে যে, বর্ণবাদ প্রথার কারণে প্রোটিয়া দলে জায়গা পাওয়াটা অন্য যেকোনো দলের চেয়েই শক্ত।

ডেসকাটের ডাচ পাসপোর্ট ছিল। তাই, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নেদারল্যান্ডসের হয়ে খেলার জন্য যোগ্য ছিলেন তিনি। যখন বুঝতে পারলেন প্রোটিয়াদের হয়ে খেলাটা সম্ভবই না, তখন তিনি ছুটলেন নেদারল্যান্ডসকে। যে করেই হোক, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খেলার স্বপ্নটা পূরণ করা চাই।

২০১১ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করার পর © Getty Images

আর নেদারল্যান্ডসের হয়ে খেলা শুরু করার পরই বোঝা গেল, দক্ষিণ আফ্রিকা কি বিরাট এক রত্ন হারিয়েছে। ৫০ ওভারের ক্রিকেটে কমপক্ষে এক হাজার রান করেছেন, এমন ব্যাটসম্যানদের মধ্যে ডেসকাটের গড়ই সবচেয়ে বেশি।

তিনি ৩৩টি ওয়ানডে খেলেছেন। তাতে ৬৭ গড়ে করেছেন ১,৫৪১ রান। রীতিমত বিস্ময়কর এক পরিসংখ্যান! এর মধ্যে আছে পাঁচটি সেঞ্চুরি ও নয়টি হাফসেঞ্চুরি। ২০১১ সালের বিশ্বকাপে তিনি করেছেন দু’টি সেঞ্চুরি।

ওয়ানডে ক্রিকেটে ডেসকাটের বোলিংটাও ছিল কার্যকর। মিডিয়াম ফাস্ট বোলিংয়ে তিনি পেয়েছেন ৫৫টি উইকেট। ২৪.১২ গড়ে তিনি তিনবার করে ম্যাচে চারটি করে উইকেট পেয়েছেন। এই পরিসংখ্যান বলে, তাকে আসলে সত্যিকারের অলরাউন্ডারই বলা যায়।

এমন পরিসংখ্যান যার, তাকে আসলে সহযোগী দেশের সর্বকালের সেরা বললেও বাড়িয়ে বলা হয় না। সেই স্বীকৃতিও তিনি পেয়েছেন। ২০০৮, ২০১০ ও ২০১১ – তিনবার তিনি আইসিসির বিবেচনায় সহযোগী দেশের বর্ষসেরা ক্রিকেটারের পুরস্কার পান। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি তিনি খেলেছেন ২২টি। সেখানে আছে ৫৩৩ রান ও ১৩ উইকেট। ২০০৯ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে দিয়েছিল নেদারল্যান্ডস। জিতেছিল শেষ বলে গিয়ে। সেই ম্যাচে ১৭ বলে ২২ রান করেন ডেসকাট।

একটা সময় ছিল যখন ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (আইপিএল) সহযোগী দেশের ক্রিকেটাররা একেবারেই সুযোগ পেতেন না। তবে সেই অচলায়তনটা প্রথম ভাঙেন ডেসকাট। আসলে ২০১১ সালের বিশ্বকাপটাই তাঁর জীবন পাল্টে দেয়। ওই বছর থেকে শুরু করে ২০১৫ সাল অবধি তিনি খেলেন কলকাতা নাইট রাইডার্সে।

কলকাতা নাইট রাইডার্সের অনুশীলনে © Getty Images

২০১১ বিশ্বকাপের অনেকগুলো ম্যাচই ডেসকাট খেলেন ভারতে। খেলেন আইপিএলও। তাই ক্রিকেট খেলার জন্য বরাবরই তার প্রিয় জায়গা। অনেকবারই তিনি সেই কথাটা স্বীকার করেছেন অকপটে। ভারতের সংস্কৃতি, স্ট্রিট ফুড – সবই তার পছন্দ।

এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন,

‘ভারতের ব্যাপারে প্রথম যে কথাটা মনে আসে, তা হলো ওরা খেলাটাকে খুবই ভালবাসে। বড় স্টেডিয়ামে যখন খেলা হয়, দর্শকরা খেলোয়াড়দের নাম ধরে চিৎকার। এখানে ক্রিকেটাররা সুপারস্টারডম উপভোগ করে। ভারতে ক্রিকেট খেলাটা সবসময়ই বিরাট সম্মানের ব্যাপারে। ভারতে খেলতে আসলে অন্য যেকোনো জায়গার চেয়ে দর্শকদের মধ্যে বেশি আগ্রহ দেখি। ইংল্যান্ডের দর্শকরা অনেক বেশি সংযত। তবে এটা ঠিক যে, অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডের ক্রিকেট সংস্কৃতিরও ইতিবাচক দিক আছে। তবে ক্রিকেট খেলার জন্য আমার মতে সবচেয়ে সেরা জায়গা হলো ভারত।’

শুধু ভারতই নয়, আসলে তিনি বিশ্বজুড়ে অনেকগুলো ফ্র্যাঞ্চাইজি দলের হয়েও খেলেছেন। তিনি খেলেছেন বাংলাদেশেও। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের (বিপিএল) নিয়মিত মুখ তিনি। খেলেছেন চারটা মৌসুম, সেটাও চারটা ভিন্ন ভিন্ন দলের হয়ে।

২০১৩ সালে তিনি প্রথম খেলেন চিটাগং কিংস দলের হয়ে। ২০১৫ সালে তার দল ছিল ঢাকা ডায়নামাইটস। এরপর ২০১৬ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স ও ২০১৮ সালে রাজশাহী কিংসে খেলেন তিনি। শুধু বিপিএল নয়, তিনি খেলেছেন ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেটও খেলেছেন। এখানে কখনও তিনি খেলেছেন গাজী ট্যাংক ক্রিকেটার্সের হয়ে, কখনও বা লেজেন্ডস অব রূপগঞ্জের হয়ে। পাকিস্তান সুপার লিগ (পিএসএল) কিংবা অস্ট্রেলিয়ার বিগ ব্যাশ – কোনোটাই বাদ যায়নি। ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট খেলতে জিম্বাবুয়েও গেছেন তিনি। এতটাই চাহিদা তার!

আক্ষরিক অর্থেই ভবঘুরে এক ক্রিকেটার ছিলেন তিনি। দক্ষিণ আফ্রিকার পোর্ট এলিজাবেথকে তিনি নিজের বাড়ি মানেন। অথচ সেই দেশে তার সুযোগই হয়নি। তিনি ভাগ্যের অন্বেষণে পেশাদার ক্রিকেট খেলেছেন অস্ট্রেলিয়া, নিউ জিল্যান্ড, কিংবা ইংল্যান্ডে।

লম্বা সময় ছিলেন এসেক্সের অধিনায়ক, সাফল্যও কম নয় © Getty Images

তবে ডেসকাট সবচেয়ে বেশি খেলেছেন ইংল্যান্ডে। আরো নির্দিষ্ট করে বললে, তার আরেকটা বাড়ি হলো কাউন্টি ক্রিকেটের দল এসেক্স। এই দলটিতে তিনি খেলছেন সেই ২০০৩ সাল থেকে। সেই যাত্রা আজও চলছে। এই তো, ক’দিন আগেও তিনি ছিলেন এই দলটির অধিনায়ক। আসলে তাকে ‘নেদারল্যান্ডসের ডেসকাট’ না বলে ‘এসেক্সের ডেসকাট’ বলাই শ্রেয়।

তিনি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেছেন ১৮৮টি, করেছেন প্রায় ১১ হাজার রান। এর মধ্যে আছে ২৯টি সেঞ্চুরি আর ৪৯টি হাফ সেঞ্চুরি। বল হাতেও অর্জনটা নেহায়েৎ কম নয়, পেয়েছেন ২১২টি উইকেট। অথচ ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, এমন এক ব্যাটসম্যান কি না কোনোদিন সুযোগই পেলেন না সাদা পোশাকে খেলার! টেস্ট ক্রিকেটার হিসেবে তিনি কেমন হতেন, সেটা জানারই সুযোগ পাওয়া গেল না।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ডেসকাটের সবচেয়ে স্মরণীয় সময়টা আসে সেই ২০১১ বিশ্বকাপেই। অথচ, এরপর তিনি আর ওয়ানডেই খেলেননি তিনি। বিশ্বকাপের শেষ ম্যাচেও সেঞ্চুরি করেছিলেন। তখনও কেউ জানতো না, এটাই হতে যাচ্ছে ডেসকাটের শেষ ওয়ানডে ম্যাচ। ২০১১ সালের পর থেকে শুরু করে ছয়-সাত বছর তিনি নেদারল্যান্ডসকে সময়ই দেননি। ছয় বছর পর ২০১৭ সালে তিনি জাতীয় দলের ডাকে সাড়া দেন। ২০১৮ সালে ত্রিদেশীয় সিরিজ দিয়ে ফেরেন, নেপালের বিপক্ষে ম্যাচটা ছিল লর্ডসে।

সুযোগ পেলে আরো খেলবেন, তিনিই নিজেই চান অন্তত আরো একটা টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলতে। তবে একটা কথা খুবই সত্যি যে, নেদারল্যান্ডসের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার ব্যাপারে ডেসকাট কখনোই খুব একটা সিরিয়াস ছিলেন না।

ভবঘুরের মতো এদেশ ওদেশ ঘুরে ক্রিকেট খেলাটাকেই তিনি নিজের ধ্যানজ্ঞান মেনেছেন। সাফল্যও পেয়েছেন বিস্তর। ৩৬০ টি-টোয়েন্টি খেলে সাত হাজারের ওপর রান করেছেন, ১১৪টি উইকেট পেয়েছেন।

সর্বশেষ জাতীয় দল নেদারল্যান্ডসের হয়ে খেলেছেন ২০১৯ সালে © Getty Images

ডেসকাটের বয়স এখন ৪০ ছাড়িয়ে গেছে। এই বয়সেও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে টিকে থাকার বেশ কিছু দৃষ্টান্ত তো চোখের সামনে আছেই। আর দলটার নাম যখন নেদারল্যান্ডস, তখন আশায় বুক বাঁধাই যায়। আর নেদারল্যান্ডসের প্রতিও তার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। তিনি বলেন,

‘নেদারল্যান্ডসের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতে পারাটা আমার জন্য দারুণ একটা ব্যাপার ছিল। বিশেষ করে ২০০৯ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডকে হারাতে পারাটা আমার জন্য বিশেষ তৃপ্তিদায়ক অভিজ্ঞতা। ২০১১ বিশ্বকাপটাও স্মরণীয়। নেদারল্যান্ডসের হয়ে খেলতে পারা আমার জন্য বিরাট সম্মানের ব্যাপার।’

This Bangla article is about the eventful cricket career of Netherlands and Essex legend Ryan ten Doeschate. References are hyperlinked inside.

Featured Image © The Statesman

Related Articles