গৌতম ভট্টাচার্যের ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না। মোহাম্মদ আজহারউদ্দীন আর হ্যানসি ক্রনিয়ে টস করতে মাঠে নেমে যাবেন খানিকক্ষণ পরই, এমন অবস্থায় অজিত টেন্ডুলকারের সঙ্গে তার দেখা গেটের বাইরে টিকিটপ্রার্থীদের জটলাতে। তিনি ভেতরে না গেলে খেলা শুরু হবে না, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। তবে পুরো পৃথিবী যার নামে 'নমঃ, নমঃ' ধ্বনি তুলছে, তার ভাইকে অমনভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখাটা একটু রহস্যেরই জন্ম দেয়।
একে তো সাংবাদিক, উপরি হিসেবে পূর্বপরিচয়ও আছে কিছুটা। দুয়ের মিশ্রণে গৌতম ভট্টাচার্য এগিয়ে গিয়েছিলেন কারণ জানতে। অজিত যে কারণ বললেন, তা শুনে তো আনন্দবাজার পত্রিকার সাংবাদিক রীতিমতো বিস্ময় বিমূঢ়। শচীন চাইলে এমন গণ্ডাখানেক হোভ স্টেডিয়াম যার নামে কিনে দিতেও কার্পণ্য করবে না ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড, শচীনের সেই 'ফ্রেন্ড, ফিলোসফার অ্যান্ড গাইড' কি না টিকিট আসতে দেরি হচ্ছে বলে দাঁড়িয়ে আছেন বাইরে! গৌতম ভট্টাচার্য ভেবেছিলেন, ভারতীয় ম্যানেজারকে গিয়ে জানিয়ে অজিতের পাস এনে দেবেন এক্ষুণি। যে আইডিয়া শোনামাত্র অজিত প্রচন্ড আতঙ্কিত স্বরে জানিয়েছিলেন,
'একদম ওসব করবেন না। শচীনের কাছে এ খবর গেলে ওর মনে এফেক্ট পড়বে। ভারত প্রথমে ব্যাট করবে শুনেছি। ব্যাট করতে যাবার আগে সেটা হোক, আমি চাই না।'
কে জানতো, ওই ঘটনার দিনকয়েকের মধ্যে শচীনের মনের ওপরে ঠিক-ই বজ্রাঘাত পড়বে, তা-ও পরিবারের লোকের কারণেই!
***
ভারত থেকে অজিত যখন অঞ্জলি টেন্ডুলকারকে খবরটি জানান, লন্ডনে তখন মাঝরাত। সন্তানসম্ভবা অঞ্জলি সে রাতেই গাড়ি চালিয়ে লন্ডন থেকে পাড়ি দেন লেস্টারে ভারতের টিম হোটেলে। এত রাতে অঞ্জলিকে ঘরের বাইরে দেখতে পেয়ে শচীন খারাপ কিছুর শঙ্কাই করেছিলেন। অঞ্জলি জানালেন, 'বাবা নেই।'
পরদিন ভারতের ম্যাচ ছিল জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। শচীন অবশ্য ম্যাচ শুরু হতে হতেই চড়ে গিয়েছেন ভারতের বিমানে। গোটা বিশ্বকাপেই শচীন আর খেলবেন কি না, খেললেও অমন মানসিকভাবে ভঙ্গুর অবস্থায় কতটা ভালো খেলতে পারবেন, ভারতজুড়ে তখন প্রশ্নের অভাব নেই।
উত্তর দিলেন শচীন নিজেই। মাঝে অবশ্য সময় নিয়েছিলেন তিনদিন। বাবাকে শেষ দেখা দেখে আর মাকে তাৎক্ষণিক সান্ত্বনা জুগিয়ে বিশ্বকাপে ফেরত এসেছিলেন ২১ তারিখ সকালেই। কেনিয়ার বিপক্ষে পরদিন ম্যাচ খেলবেন, তা ততক্ষণে মধ্যদুপুরের গনগনে সূর্যের মতোই স্পষ্ট। পুরোটা পরিষ্কার হলো আরেকটু পরেই; সকালে হিথ্রো এয়ারপোর্টে নেমে যখন খানিক পরেই পৌঁছে গেলেন ব্রিস্টলে দলীয় অনুশীলনে।
রোদচশমার আড়ালে চোখ লুকিয়ে বিশ্বকাপে লড়াই শুরু সেদিনই। শোকস্তব্ধ শচীন সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে জানালেন,
'মা-ই আমাকে পাঠিয়েছেন।'
***
পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছিল, সুপার সিক্সে পৌঁছাতে ভারতের সে ম্যাচে জিততেই হতো। টেন্ডুলকারকে নিয়েও পারা যায়নি দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে, আর টেন্ডুলকার ছাড়া ভারত অঘটনের শিকার হয়ে হেরে গিয়েছিল জিম্বাবুয়ের বিপক্ষেও। ভারতের জন্যে সমীকরণ তাই খুব সোজা তখন, গ্রুপপর্বে বাকি তিন ম্যাচের একটি হারলেও 'বাপি বাড়ি যা'!
এমন বিরুদ্ধ পরিবেশে টেন্ডুলকার যখন ক্রিজে এসেছিলেন, ম্যাচের বয়স তখন ১২৫ বল। সৌরভ-সদাগোপান শুরুটা বেশ ভালোই করেছিলেন, দুজনে মিলে উদ্বোধনী জুটিতে এনে দিয়েছিলেন দলীয় অর্ধশত। অবশ্য ষষ্ঠ ওভারের পর থেকে রান রেট পাঁচ ছোঁয়নি কখনোই; এমনকি শচীন যখন নেমেছেন, তখন তা ঘোরাঘুরি করছে ৪.৪০ বা এর আশেপাশে।
মাঠে থাকা দর্শকেরা শচীনকে স্বাগত জানাচ্ছিলেন 'ওয়েলকাম ব্যাক হিরো' জাতীয় পোস্টার উঁচিয়ে। কেনিয়ান ক্রিকেটারদের সঙ্গে শচীনের দেখা হয়েছিল আগের দিনই, বোধহয় সেখানেই 'আমরা শোক জানাই' বলেই দায়িত্ব শেষ ভেবেছিলেন তারা। শচীন তাই ক্রিজে পৌঁছাতেই কেনিয়া অধিনায়ক সিলি পয়েন্টে দাঁড় করিয়ে দিলেন দুজনকে। যেন প্রচণ্ড ঔদ্ধত্যের সুরে বলতে চাইলেন, বিদায়ী টেস্টের আবেগে থরহরিকম্প হয়ে স্যার ডন ব্র্যাডম্যানই বিদায় নিয়েছেন শূন্য রানে, পিতার শোক বুকে চেপে শচীন তুমি কতক্ষণই বা থাকবে? কাল রাতে পর্যন্ত যার মুখ থেকে বের হলো,'বাবা নেই, ভাবতেই পারছি না। মনে হচ্ছে, তিনি এখানেই আছেন, এখনই হাসিমুখে তাকাবেন আমার দিকে', অমন ভঙ্গুর মন নিয়ে বল দেখতে পাবে ঠিকমতো? লড়াইটা তখন তো 'কেনিয়া বনাম শচীন' ছাপিয়ে 'শচীন বনাম শচীন'!
শচীন সময় নিলেন। আসিফ করিমের ওই সিলি পয়েন্টে দৃষ্টি দিলেন না। আসিফের ঔদ্ধত্যের জবাব দিতে ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে এসে তাকে উড়িয়ে মারবেন প্রথম বলেই, এমন সিনেম্যাটিক চিত্রনাট্যও মানলেন না তখন।
তীর্থে প্রবেশের পরে কি আর জগতের হাতে নিজেকে সঁপে দেয়া চলে?
***
ব্যাট থেকে প্রথম রান এলো তৃতীয় বলে, প্রথম চারের মার নবম বলে। শচীনকে ঘিরে আকাশে-বাতাসে উড়তে থাকা সমস্ত প্রশ্নের উত্তর যেন মিলে গেল ওই শটেই, চারটি যে এসেছিল স্ট্রেইট ড্রাইভে।
যে আসিফ আরেকটু হলে ঢুকে যাচ্ছিলেন এরিক হলিসের মতো 'হল অব ফেমে', প্রথম ছয়ের মারটি এলো তারই বলে। লং অনের উপর দিয়ে বলকে পাঠিয়ে দিতে দিতে বোধহয় জানিয়ে গেলেন, প্রাচীন ভারতীয় সমাজের মতো ক্রিকেটেও জাত-পাত ভেদ আছে। বুদ্ধিমানেরা তা মেনে চলে।
ওই ছয়ে পূর্ণ হয়েছিল দ্রাবিড়ের সঙ্গে তার জুটির অর্ধশত। ভারতীয় ইনিংসের ওভারপ্রতি রান তোলার হার দ্বিতীয়বার পাঁচ ছুঁলো সে ওভারেই, ইনিংসের শেষ অব্দি যা বেড়েছে বৈ কমেনি।
শচীনের ক্রিজে আগমনের সময় দ্রাবিড়ের রান ছিল ২২, সেই দ্রাবিড়কে শচীন ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন ৪৮ রানের সময়। দ্রাবিড়ের আগে পঞ্চাশে পৌঁছালেন স্বাভাবিক নিয়মেই, ৫৪ বল খেলে। পরের পঞ্চাশের দেখা পেতে অবশ্য বল খরচা হলো এর প্রায় অর্ধেক। পঞ্চাশের আগে যেখানে চার মেরেছিলেন চারটি, পঞ্চাশ থেকে একশ'তে পৌঁছাতে সেখানে চার মারলেন আরও ছয়টি। স্টিভ টিকোলোর বল লং অফে ঠেলে দুই রান নিতেই দেখা পেয়েছিলেন একদিনের ক্রিকেটে ২২ তম শতকের।
***
পঞ্চাশে পৌঁছাবার সময়ও এই উদযাপন দেখা গিয়েছিল, যেমন দেখা গিয়েছিল আগের প্রতিবার শতক কিংবা অর্ধশতকের দেখা পেলে। তবুও যেন দুই উদযাপনে কত পার্থক্য! এর আগে প্রতিবার তো আকাশের পানে চাইতেন সিদ্ধিদাতা গণেশের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে, এবার যেন মেঘেদের ভেতরে খুঁজে নিতে চাইলেন নিজের জন্মদাতাকে। ম্যাচ শেষে সাংবাদিকদের যা জানিয়েছিলেন নিজেই,
"হ্যাঁ, বাবাকে প্রণাম করলাম। সেঞ্চুরিটাও তাকেই উৎসর্গ করছি।"
***
শতকের পরে শচীন খেলেছিলেন আরও ১৮ বল। শেষ অব্দি ১০১ বল খেলে রান করেছিলেন ১৪০, ১৬ চারের পাশাপাশি যাতে ছয়ও ছিল ৩টি। সেঞ্চুরি করেছিলেন দ্রাবিড়ও। দুজনে মিলে তৃতীয় উইকেটে অবিচ্ছিন্ন জুটি গড়েছিলেন ২৩৭ রানের, সৌরভ-শচীনের ৩১২ রানকে একপাশে রাখলে যা কেনিয়ার বিপক্ষে ভারতের পক্ষে সর্বোচ্চ। ম্যাচ নিয়ে যাবতীয় আগ্রহ তো শেষ হয়ে গিয়েছিল প্রথম ইনিংস শেষেই; ভারতের ৩২৯ রান কেনিয়া পেরিয়ে যাবে, এমন কিছু তো রূপকথার বইতেই কেবল সম্ভব হতে পারে। কেনিয়া অবশ্য তুলে ফেলেছিল ২৩৫ রান, তবে এতেও পরাজয়ের ব্যবধানটা বিরাটই। দেবাশিস মোহান্তির ৪ উইকেটে ভারত জিতেছিল ৯৪ রানে।
অবশ্য এই ম্যাচের ফল নিয়ে আগ্রহ কবেই বা আর ছিল! আগ্রহ বলুন, কিংবা এত বছর বাদে ওই ম্যাচের ইতিহাস কপচানোর কারণ, সব তো ম্যাচসেরার পুরস্কার নিতে নিতে শচীনের বলা ঐ কথাতেই সীমাবদ্ধ,
'এই শতকটা বাবার জন্য...!'
This article is in Bangla language. This article is on Sachin's century against Kenya in 1999 WC. Necessary hyperlinks are attached inside.
Featured image © Rajan Gaikwad
তথ্যসূত্র:
১. কাপমহলা। লেখক- গৌতম ভট্টাচার্য।
২. Playing it my way. My autobiography. লেখক- শচীন টেন্ডুলকার।