"হোয়াট আ স্টানিং রেজাল্ট ইট ইজ! ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স হ্যাভ লস্ট ১-০ টু সেনেগাল...!"
সিউল স্টেডিয়ামে রেফারির শেষ বাঁশি বাজার পর ধারাভাষ্যকারদের কণ্ঠে তখন রাজ্যের বিস্ময়। স্টেডিয়ামের ৬২,০০০ দর্শককে স্তব্ধ করে দিয়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সকে হারিয়ে দিয়েছে 'পুঁচকে' সেনেগাল, ধারাভাষ্যকাররা তো আর এমনিতেই বিস্মিত হননি!
২০০২ সালে যেবার সেনেগাল ফুটবল বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো অংশগ্রহণ করল, তখন ফ্রান্স আগের বিশ্বকাপেই বিশ্বসেরার মুকুট পরা দুর্দান্ত এক দল। থিয়েরি অঁরি কিংবা জিনেদিন জিদানদের নিয়ে গড়া ফ্রান্স সে বিশ্বকাপে অনেকেরই ট্রাম্পকার্ড ছিল। গ্রুপপর্বের প্রথম ম্যাচে মুখোমুখি হওয়া ফ্রান্স এবং সেনেগালের ম্যাচটিকে পুরো ফুটবল ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা অঘটন হিসেবে ধরা হয়।
ফ্রান্সের বিপক্ষে সেনেগালের সেই ঐতিহাসিক জয় খুব কাছ থেকে দেখেছিল সেনেগালের দশ বছর বয়সী এক কিশোর, যার ধ্যানজ্ঞানই ছিল ফুটবল। এই জয় তার ফুটবলার হওয়ার ইচ্ছাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে, বড় হয়ে সে ফুটবলারই হবে। সেদিনকার সেই দশ বছর বয়সী ছোট্ট কিশোরই আজকের লিভারপুল তারকা সাদিও মানে, বর্তমান ফুটবলের অন্যতম সেরা অ্যাটাকার।
১৯৯২ সালে সেনেগালে জন্ম নেওয়া সাদিও মানের ছোটবেলাটা খুব মধুর ছিল না। বেড়ে উঠেছিলেন দক্ষিণ সেনেগালের বাম্বালি নামের একটি গ্রামে। পরিবারের আর্থিক অবস্থা একদমই ভালো ছিল না।
"আমাকে স্কুলে পাঠানোর মতো অর্থ আমার পরিবারের কখনোই ছিল না", এক সাক্ষাৎকারে একবার বলেছিলেন মানে। অনেকগুলো ভাইবোন থাকায় তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় তার চাচার কাছে। শৈশবের বড় অংশটি চাচার কাছেই কেটেছে।
খুব ছোট থেকেই ফুটবলের নেশা পেয়ে বসে মানেকে। তিন বছর বয়সী 'পিচ্চি' মানের শরীরে সবসময় কাপড় না থাকলেও পায়ে ফুটবল থাকত। রাস্তায় সমবয়সীদের দেখলেই মানেকে আর আটকে রাখা যেত না, বাসা থেকে বেরিয়ে যেতেন খেলার উদ্দেশ্যে।
ফুটবলের প্রতি মানের প্রভূত আকর্ষণ থাকলেও প্রথমদিকে পরিবারের কাছ থেকে পর্যাপ্ত সাহায্য পাননি। তার ভাষ্যমতে,
'বিশ্বকাপের পরে আমি ও আমার বন্ধুরা মিলে গ্রামে ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন করলাম। আমি প্রতিটা ম্যাচ জিততে চাইতাম। সবাই আমার প্রশংসা করত, কিন্তু আমার পরিবার আসলে তেমন ফুটবল-সহায়ক ছিল না। তারা আমার জন্য অন্য কিছু পছন্দ করে রেখেছিল, কিন্তু আমার হৃদয়ে ছিল শুধু ফুটবল।'
পরিবার চেয়েছিল, মানে ধর্মের সাথে সম্পর্কিত কোনো পেশায় নিয়োজিত হোক। মানের বাবা ছিলেন একটি স্থানীয় মসজিদের ইমাম। কিন্তু ফুটবল থেকে মানেকে কোনোভাবেই সরানো যাচ্ছিল না। তাই শেষ পর্যন্ত উপায়ান্তর না দেখে পরিবার তার স্বপ্নপূরণে সর্বোচ্চ সহযোগিতার সিদ্ধান্ত নেয়।
মানে অবশ্য তার পরিবার, তার চাচা, গ্রামের মানুষজন এমনকি রাজধানী ডাকারে গিয়ে যে পরিবারে আশ্রয় নিয়েছিলেন, সবার প্রতিই কৃতজ্ঞ। তার চাচার সেই সময়ের সহযোগিতাকে খুব বড় করে দেখেন মানে। তার যাবতীয় খরচ বহনের জন্য গ্রামের সবাই চাঁদা দিয়েছিল, তার চাচা ও পরিবার জমির ফসল বিক্রি করে পাওয়া অর্থের একটি বড় অংশ খরচ করেছিলেনন মানের স্বপ্নপূরণে। এসব কথা মানে অকপটেই বলেছেন। ডাকারে গিয়ে যে বাড়িতে ওঠেন, সে বাড়ির লোকজন তার একদমই পরিচিত ছিল না। কিন্তু মানের স্বপ্নের কথা শুনে তারা সাহায্য করতে রাজি হয়ে যান, তার থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেন।
সেনেগালের রাজধানী ডাকারে নিয়ে গিয়ে 'জেনারেশন ফুট' নামের এক ফুটবল অ্যাকাডেমিতে ভর্তি করানো হয় মানেকে। জেনারেশন ফুটে ভর্তির ট্রায়ালের সময় শুরুতেই বুড়ো কোচ তার পুরনো বুট, ছেড়া শর্টস্ নিয়ে খোঁচা দিয়েছিল। খোঁচার বিপরীতে মানের সোজাসাপ্টা জবাব, "এসব নিয়ে খোঁচা দিয়ে লাভ নেই, আমি মাঠেই দেখাব আমি কে।" ট্রায়ালের সময় খোঁচা দেয়া সেই বুড়ো কোচ ট্রায়ালের পর মানের প্রতিভায় এতটাই মুগ্ধ হন যে, সেদিনই তাকে অ্যাকাডেমিতে ভর্তি করে নেন।
জেনারেশন ফুটে প্র্যাকটিস করার সময় মানে ফরাসি স্কাউটদের সুনজরে আসেন। তাকে ফরাসি ক্লাব 'মেজ'-এ নিয়ে যাওয়া হয়। মাত্র পনের বছর বয়সেই মানের পেশাদার ফুটবলার হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু হয়। মেজে খুব একটা ভালো করতে পারেননি, ১৯ ম্যাচ খেলে ১ গোল করেন। আসলে এই ক্লাবটিতে তাকে মাঠে পর্যাপ্ত সাহায্য করার মতো দক্ষ খেলোয়াড় ছিল না। তাই মেজ থেকে চার মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে অস্ট্রিয়ান ক্লাব রেড বুল স্যাল্জবার্গে চলে যান।
রেড বুল স্যাল্জবার্গে মানে দুর্দান্ত পারফর্ম করেন। এই ক্লাবের হয়ে মানে অস্ট্রিয়ান কাপ, অস্ট্রিয়ান বুন্দেসলিগা জেতেন। ৮০ ম্যাচে করা ৪২ গোলই প্রমাণ করে, মানে কতটা কার্যকরী ছিলেন। নিজেকে আরও বড় চ্যালেঞ্জের জন্য প্রস্তুত করা মানে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ খেলার জন্য সাউদাম্পটনের সাথে চার বছরের চুক্তিতে সই করেন। ১২ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে রেড বুল স্যাল্জবার্গ থেকে সাউদাম্পটনে চলে আসেন।
সাউদাম্পটনে এসে তার অভিষেক হয় আর্সেনালের বিপক্ষে। অভিষেক ম্যাচে সাউদাম্পটন ২-১ গোলে আর্সেনালকে হারায়, মানে আর্সেনালের বিপক্ষে পেনাল্টি আদায় করে দলকে প্রথম গোলে সাহায্য করেছিলেন। এরপর কুইন্স পার্ক রেঞ্জার্সের বিপক্ষে তার ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে অভিষেক হয়। সেই ম্যাচে মানে প্রথম গোলে অ্যাসিস্ট করেছিলেন। সাউদাম্পটনের হয়ে তিনি নিয়মিত পারফর্ম করতে থাকেন।
২০১৫ সালের ১৬ মে তারিখে অ্যাস্টন ভিলার বিপক্ষে ৬-১ গোলে জয় পায় সাউদাম্পটন। এই ম্যাচটিকে সাদিও মানের জীবনের অন্যতম সেরা ম্যাচ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মাত্র দুই মিনিট ছাপ্পান্ন সেকেন্ডের মধ্যেই তিনটি গোল করেন, যেটি এখন পর্যন্ত প্রিমিয়ার লিগের ইতিহাসে দ্রুততম হ্যাটট্রিক হিসেবে অক্ষত আছে। ২০১৫-১৭ মৌসুমে বিভিন্ন ম্যাচে ১৫টি গোল করে সাউদাম্পটনের সর্বোচ্চ গোলদাতা হন।
আরও বড় চ্যালেঞ্জের জন্য ২০১৬ সালের গ্রীষ্মে রেকর্ড ৩৪ মিলিয়ন ইউরো ট্রান্সফার ফি'র বিনিময়ে লিভারপুলে চলে আসেন সাদিও মানে। লিভারপুলের সাথে তার পাঁচ বছরের চুক্তি হয়। লিভারপুলে আসার পর ২০১৭ সালে মৌসুমে প্রিমিয়ার লীগে ১৩টি গোল করেন, যা তাকে 'টিম অব দ্য ইয়ার'-এ জায়গা করে দেয়।
২০১৮ সাল মানে কৌতিনহো, সালাহ এবং ফিরমিনোর সাথে লিভারপুলের ভয়ংকর আক্রমণভাগ গড়ে তোলেন। জানুয়ারিতে কৌতিনহো বার্সেলোনায় চলে আসলে মানে-সালাহ-ফিরমিনো হয়ে ওঠে বিশ্বের অন্যতম ভয়ংকর 'অ্যাটাকিং ট্রায়ো'। ২০১৮ সালে লিভারপুল চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে ওঠে। সেখানে রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে ফাইনালে হারলেও সেনেগালের প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে গোল করার কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন মানে।
মানে এ বছরের মার্চে বার্নলির বিপক্ষে গোল করার মাধ্যমে প্রতিযোগিতামূলক খেলায় লিভারপুলের হয়ে ৫০টি গোল করার গৌরব অর্জন করেন। তার তিনদিন পরেই বায়ার্ন মিউনিখের বিরুদ্ধে দু'টি গোল করে দলকে নিয়ে যান চ্যাম্পিয়ন্স লিগের কোয়ার্টার ফাইনালে। ২২টি গোল করে প্রিমিয়ার লিগ শেষ করেন। অবামেয়াং ও সালাহর সাথে যৌথভাবে গোল্ডেন বুট লাভ করেন। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে টটেনহ্যামের বিপক্ষে শুরুতেই একটি পেনাল্টি আদায় করেছিলেন মানে। ফাইনালে লিভারপুল ২-০ গোলে টটেনহ্যাম হটস্পারকে হারিয়ে ইউরোপসেরার মুকুট মাথায় তোলে।
ব্যক্তিগত জীবনে মানে অত্যন্ত বিনয়ী একজন মানুষ। ইউরোপের অন্যতম সেরা একটি ক্লাবের খেলোয়াড়, কিংবা বিশ্বের অন্যতম সেরা অ্যাটাকার হওয়া, এসব বিষয় নিয়ে মোটেও ভাবেন না তিনি। মানে কতটা বিনয়ী, তা বোঝা যায় তার প্রথমদিকের একটি ঘটনার মাধ্যমে। ফরাসি ক্লাব মেজে থাকার সময়ে এক সাংবাদিককে অনুরোধ করেছিলেন তার একটি ছবি তুলে দেওয়ার জন্য, যাতে তার মাকে দেখাতে পারেন। সাংবাদিক ছবি তোলার পর তাকে ছবিটা দেওয়ার জন্য ই-মেইল অ্যাড্রেস জিজ্ঞাসা করেন। কিন্তু মানে তার ক্লাবের ই-মেইল অ্যাড্রেসটি দেন, এবং সাংবাদিককে জিজ্ঞাসা করেন, "আচ্ছা এটা তুমি ফ্রিতে দিচ্ছ, তাই না?"
অন্যান্য আফ্রিকান ফুটবলারদের মতো সাদিও মানেও আফ্রিকার আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে প্রচুর সাহায্য করেন। তার বাবা যে মসজিদের ইমাম ছিল, সে মসজিদের সংস্কারের জন্য অর্থ দিয়েছেন। তার গ্রামের দরিদ্র মানুষদের সহায়তা করেন সাধ্যমতো। এ বছরের জুলাইয়ে তার শৈশবের গ্রাম বাম্বালিতে স্কুল ও হাসপাতাল স্থাপনের জন্য আড়াই লাখ ইউরো দান করেছেন।
বর্তমান ক্লাব লিভারপুলকে নিজের পরিবারের মতো মনে করেন মানে। ইয়ুর্গেন ক্লপের কোচিংয়ে প্রতিনিয়তই উন্নতি করছেন, অর্জনের খাতায় যুক্ত হচ্ছে নতুন অনেক কিছু। গত বছরেই লিভারপুলের সাথে একটি লম্বা চুক্তি করেছেন, লিভারপুলেই ক্যারিয়ার শেষ করতে চান।
খেলাধুলার চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/
ফুটবল নিয়ে আরও জানতে পড়তে পারেন এই বইগুলোঃ
Sadio Mané is a Senegalese professional footballer who plays as a winger for Premier League club Liverpool and the Senegal national team.
Reference:
- Sadio Mané Biography Facts, Childhood, Career, Net Worth, Life – SportyTell
- Sadio Mane’s story: How I went from torn boots and shorts on Senegal's streets to Liverpool sensation | Goal.com
- Sadio Mane Childhood Story Plus Untold Biography Facts
- The Story Behind This Sadio Mane Picture Shows How Far He's Come - SPORTbible
- Sadio Mane recounts incredible childhood story
- Story behind Mane's first picture at Metz after leaving Senegal
- Player Sadio Mane story their struggle to get to lead the reds
- Sadio Mané - History