Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

সার্জিও রামোস: ফুটবলের গ্ল্যাডিয়েটর

২০১৪ সালের চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালের কথা নিশ্চয়ই মনে আছে? লিসবনের সবুজ গালিচায় ইকার ক্যাসিয়াসের ভুলে সেদিন ০-১ গোলের ব্যবধানে পিছিয়ে ছিল রিয়াল মাদ্রিদ। ম্যাচের ৯০ মিনিটের সময় সাইডলাইনে কার্লো আনচেলত্তি থেকে শুরু করে রিয়ালের সকল খেলোয়াড় এবং ভিআইপি বক্সে স্বয়ং প্রেসিডেন্ট ফ্লোরেন্তিনো পেরেজের চিন্তার ছাপমাখা দৃশ্যগুলো তখন বারবার দেখাচ্ছিলেন ক্যামেরাম্যান। অতিরিক্ত ৩ মিনিটের খেলাও তখন শেষের দিকে।

রিয়ালের খেলোয়াড়েরা যখন হতাশাগ্রস্থ হয়ে অলৌকিকতার আশা করছিলেন, তখন অন্য পাশে উদযাপনের জন্য প্রস্তুতি নেন দিয়েগো সিমিওনের শিষ্যরা। অতঃপর শেষ মিনিটে কর্নার পেয়ে দৌঁড়ে বল প্রস্তুত করে শট নেন লুকা মদ্রিচ। ডি-বক্সে শূন্যে ভেসে হেডের মাধ্যমে অসাধারণ একটি গোল করেন রিয়ালের চার নম্বর জার্সি পরিহিত একজন ডিফেন্ডার। তার গোলেই ম্যাচে ফেরে রিয়াল মাদ্রিদ। অতঃপর শেষ ৩০ মিনিটে অ্যাটলেটিকোর জালে আরো ৩টি গোল জড়িয়ে রিয়ালের জয় সুনিশ্চিত করেন রোনালদো, মার্সেলো এবং গ্যারেথ বেল। সেদিন রিয়ালকে বহুল প্রত্যাশিত ‘লা ডেসিমা’ জেতানোর পেছনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করায় ভক্তদের নিকট আরো বেশি প্রিয় হয়ে ওঠেন ৯২ মিনিট ৪৮ সেকেন্ডের সময় গোল করা সেই ডিফেন্ডার।

শুধু সেদিনই নয়, ক্যাসিয়াস পরবর্তী রিয়ালের নেতৃত্ব যখন তার হাতে দেয়া হয়, তখন থেকেই বিভিন্ন ম্যাচে রিয়ালকে জয় এনে দেন তিনি। একজন জাত ডিফেন্ডার হিসেবে তিনি যেমন নাম কুড়িয়েছেন, তেমনই ক্যারিয়ারে গোলের সেঞ্চুরি পূরণ করে নতুন মাইলফলকও স্পর্শ করেছেন এই স্প্যানিয়ার্ড। যদি ফুটবল ইতিহাসের বিভিন্ন ডিফেন্ডারদের ব্যক্তিত্ব এবং খেলার ধরণ পর্যালোচনা করা হয়, তবে তার মতো পরিপূর্ণ ডিফেন্ডার দ্বিতীয়টি হয়তো পাওয়া দুষ্করই হবে। তার অ্যাগ্রেসিভ খেলার ধরন তাকে সফলতম ডিফেন্ডারদের কাতারে পৌঁছাতে সাহায্য করেছে।

ক্লাব ফুটবলে সফলতার পাশাপাশি তিনি জাতীয় দলের হয়েও উল্লেখযোগ্য সফলতা অর্জন করেছেন। জিতেছেন ২টি ইউরো এবং ১টি বিশ্বকাপ। সেই সাথে স্পেনের সোনালি প্রজন্মের অন্যতম একজন হিসেবে নিজের নামকে ‘লা রোহা’দের ফুটবল ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখিয়েছেন এই কিংবদন্তি ডিফেন্ডার।

চ্যাম্পিয়নস লিগের শিরোপা হাতে রামোস; Image Source: UCL Photo Archive

বলছিলাম ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা ডিফেন্ডার সার্জিও রামোসের কথা। ভক্তকুল থেকে শুরু করে সমালোচক, সবার নিকটই তিনি পরিচিত ‘দ্য গ্ল্যাডিয়েটর’ নামে। কার্লোস পুয়োলের ক্যারিয়ারের শেষদিকে স্প্যানিশ সমর্থকরা যখন ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব এবং রক্ষণভাগে একজন পরিপূর্ণ ডিফেন্ডারের অভাব বোধ করছিলেন, ঠিক তখনই স্পেনের রক্ষণভাগের দায়িত্ব নেন রামোস। একইভাবে রিয়ালের নেতৃত্বও হাতে পেয়েছিলেন তিনি। জাতীয় দল কিংবা ক্লাব ফুটবল, সবখানেই নিজের সামর্থ্যের প্রমাণ দিয়ে এখন অবধি সফলতা অর্জন করে যাচ্ছেন এই ডিফেন্ডার। আর ফুটবলে যার এত এত অর্জন, সেই সার্জিও রামোস সম্পর্কে আমরা কতটুকুই বা জানি?

চলুন জেনে নেয়া যাক তার শৈশব, কৈশোর, ফুটবল ক্যারিয়ার এবং ব্যক্তিগত জীবনের জানা-অজানা তথ্যাদি।

শৈশব

স্পেনের দক্ষিণের অঙ্গরাজ্য আন্দালুসিয়ার রাজধানী সেভিয়ার ক্যামাস শহরে ১৯৮৬ সালের ৩০ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন রামোস। তার বাবার নাম হোসে মারিয়া রামোস এবং মায়ের নাম পাকুই রামোস। ছোটবেলা থেকে রামোস তার এক ভাই এবং এক বোনের সঙ্গেই বড় হন। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হওয়ার কারণে তেমন অভাব-অনটনের মুখোমুখি হননি রামোস।

Image Source: lifeblooger

সেভিয়া শহরের ইতিহাসের সঙ্গে ষাঁড়ের লড়াই ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সেই সুবাদে ছোটবেলা থেকেই এই ঐতিহাসিক খেলা দেখে বড় হতে থাকেন রামোস। শহরের অন্যান্য পিতামাতার মতো তার পিতামাতাও চেয়েছিলেন, ছেলে ষাঁড়ের লড়াইয়ের একজন পেশাদার খেলোয়াড় হোক। তাদের ইচ্ছার পরিপ্রেক্ষিতে কিছুদিন প্রশিক্ষণও নেন রামোস। যদিও ষাঁড়ের লড়াইয়ের প্রশিক্ষণে বেশিদিন থাকতে হয়নি তাকে। পরবর্তীতে তার বড় ভাই রেনের সাহায্যে ফুটবলের প্রতি ঝুঁকে পড়েন রামোস। সেই সময় তার বাবা-মা’কেও রাজি করান রেনে।

ফুটবল ক্যারিয়ার

ষাঁড়ের লড়াই ছেড়ে রামোস যখন ফুটবল চর্চা শুরু করেন, তখন পরিবারের সকলের সমর্থন পেতে শুরু করেন রামোস। কিছুকাল বড় ভাইয়ের সান্নিধ্যে ফুটবল শেখার পর পরিপূর্ণ ফুটবলচর্চার নিমিত্তে তাকে ভর্তি করানো হয় শহরের ক্লাব ‘এফসি ক্যামাস’-এর অ্যাকাডেমিতে। সেখানে প্রথম থেকেই বেশ আলো ছড়ান রামোস। বয়সভিত্তিক দলে অসংখ্যবার ম্যাচসেরার পুরস্কারও জেতেন তিনি। এতে করে খুব তাড়াতাড়ি সংবাদমাধ্যমের নজরে পড়তে শুরু করেন।

১৪ বছর বয়সে স্থানীয় ক্লাব সেভিয়ার একাডেমিতে খেলার জন্য ডাক পান রামোস। দলটি তরুণ ফুটবলার তৈরিতে দীর্ঘদিন যাবৎ কাজ করছে। সেই কারণে রামোসও তার ক্যারিয়ারের উন্নতির জন্য সেভিয়াকেই বেছে নেন। একাডেমিতে রামোস খ্যাতি অর্জন করতে বেশিদিন সময় নেননি। দ্রুত উন্নতি করার কারণে মাত্র ১৮ বছর বয়সেই সেভিয়া মূল দলে ডাক পান তিনি।

সেভিয়ার জার্সি গায়ে রামোস; Image Source: Givemesport.com

মূল দলে নিজের প্রথম মৌসুমে মোট ৪১টি ম্যাচ খেলেন তরুণ রামোস। ২০০৪-০৫ মৌসুমটিতে রামোস দলের সিনিয়র সদস্যদের মতোই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তার অসাধারণ পারফরম্যান্সের কল্যাণে সেভিয়া সেবার ষষ্ঠ স্থান অর্জন করে মৌসুম শেষ করে, সেই সাথে ইউরোপা লিগের জন্যেও কোয়ালিফাই করে। সেবার রামোস মোট ৩টি গোলও করেন।

সেভিয়ার তরুণ রামোসের পারফরম্যান্সে মুগ্ধ হয়ে তাকে দলে নিতে উঠেপড়ে লাগে দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রিয়াল মাদ্রিদ ও বার্সেলোনা। যদিও রামোস নিজের পছন্দ অনুসারে রিয়ালকেই বেছে নেন। ২০০৫ সালের মার্চে রিয়াল মাদ্রিদ এবং সেভিয়ার মধ্যে ২৭ মিলিয়ন ইউরোর চুক্তি স্বাক্ষর হয়। ২০০৫-০৬ মৌসুমে রিয়ালের হয়ে নিজের প্রথম মৌসুম পার করেন রামোস। ২০০৫ সালের ডিসেম্বরে তিনি রিয়ালের হয়ে নিজের প্রথম গোলটি করেন। যদিও চ্যাম্পিয়নস লিগের গ্রুপপর্বের সেই ম্যাচটিতে রিয়াল পরাজিত হয়। তবে তার পারফরম্যান্সে সেদিন মুগ্ধ হয়েছিলেন সমর্থকরা।

রিয়াদ মাদ্রিদের সাথে সাইন করার পর © RAFA CASALMARCA

রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে রামোসের প্রথম চারটি মৌসুম তেমন ভালো কাটেনি। শুধু তারই নয়, দলীয়ভাবেও তখন দুঃসময় পার করছিল দলটি। সেই সময় রামোস একাধিকবার নিজের অবস্থান বদল করে খেলেন। কখনো কখনো দলের প্রয়োজনে ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার, আবার কখনো কখনো রাইটব্যাক পজিশনেও খেলেছেন তিনি। দলের অন্য ডিফেন্ডাররা গোল করতে ব্যর্থ হলেও রামোস ঠিকই তার গোল আদায় করে নিতেন। যার ফলে প্রথম চার মৌসুমে সর্বমোট ২০টি গোল করেন রামোস।

তবে রামোসের উগ্র আচরণের কারণে বেশ কয়েকবার বিপদে পড়ে রিয়াল মাদ্রিদ। প্রথম মৌসুমেই চারটি লাল কার্ড দেখেন তিনি। পরের তিন বছরে আরো ৫টি লাল কার্ড দেখার পর নড়েচড়ে বসে রিয়ালের কর্তারা। তখন তাকে বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও তা বাস্তবায়ন করতে সম্মতি দেননি প্রেসিডেন্ট। বস্তুত, রামোস এখন অবধি তার উগ্র আচরণ ধরে রেখেছেন এবং কয়েকশ’ কার্ডের মুখোমুখি হয়েছেন। সর্বশেষ হিসেব অনুযায়ী, রামোস তার ক্যারিয়ারে মোট ২৭৪টি কার্ড দেখেছেন। এর মধ্যে লা লিগায় ১৭১টি, চ্যাম্পিয়নস লিগে ৩৬টি এবং স্পেনের হয়ে ২০টি কার্ড দেখেন তিনি। এত সংখ্যক কার্ডের মধ্যে তিনি শুধু লাল কার্ডই দেখেছেন ২৫ বার। মূলত উগ্র আচরণের কারণে কার্ড দেখায় তিনি ইতিহাসের সকল রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছেন।

২০১০-১১ মৌসুমের এল ক্লাসিকোতে রামোসের রেড কার্ড; Image Source: AFP/Getty Images

২০০৮-০৯ মৌসুমে রামোস আবারও দুর্দান্ত ফর্মে ফেরেন। সেবার অসাধারণ একটি মৌসুম পার করার সুবাদে ইউরোপিয়ান বর্ষসেরা খেলোয়াড়ের তালিকায় ২১তম স্থান অর্জন করেন তিনি, জায়গা পান উয়েফার বর্ষসেরা একাদশে। একই বছর ফিফা’র ফিফপ্রো বিশ্ব একাদশেও জায়গা করে নেন রামোস।

২০০৯-১০ মৌসুমটি রিয়ালের তেমন একটা ভালো কাটেনি। তবে সেবারও রামোস ব্যক্তিগত সেরা পারফরম্যান্স উপহার দেন। পেপে’র ইনজুরির কারণে মৌসুমের বেশিরভাগ সময়ে নিজের অবস্থান বদল করে সেন্টারব্যাক হিসেবে খেলতে হয়েছিল তাকে। তিনি পুরো মৌসুমে ৩৩ ম্যাচ খেলে গোল করেন ৩টি।

২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে রামোস রিয়ালের হয়ে ২০০তম ম্যাচ খেলার মাইলফলক স্পর্শ করেন। সেই মৌসুমে রিয়ালের চারজন অধিনায়কের একজন মনোনীত হন তিনি। সেবারই নিজের রাইটব্যাক পজিশন ছেড়ে স্থায়ীভাবে সেন্টারব্যাক হিসেবে খেলতে শুরু করেন রামোস।

সেভিয়ার বিপক্ষে গোল উদযাপন © Denis Doyle/Getty Images)

পরের বছর রিয়াল মাদ্রিদ তার সঙ্গে নতুন করে চুক্তি নবায়ন করে এবং তার রিলিজ ক্লজ বৃদ্ধি করে। কারণ সেই সময় ইউরোপের কয়েকটি বড় দল তাকে দলে নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলো।২০১২-১৩ মৌসুমে মরিনহোর নির্দেশে দলের প্রথম অধিনায়ক ইকার ক্যাসিয়াস বেশিরভাগ সময়েই বেঞ্চে বসে কাটান। আর সেই সময় রিয়ালকে নেতৃত্ব দেন সার্জিও রামোস। তার নেতৃত্বগুণে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে জয়লাভ করে দলটি।

অতঃপর ২০১৩-১৪ মৌসুমটি ছিল রিয়াল মাদ্রিদ এবং রামোসের জন্য অত্যন্ত স্মরণীয় একটি মৌসুম। কার্লো আনচেলত্তির নেতৃত্বে রোনালদোর ‘কল্যাণে’ সেবার চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে কোয়ালিফাই করে রিয়াল। আর সেবারের ফাইনাল ম্যাচে রামোসের অবদান প্রায় সবারই জানা। শেষ মিনিটে গোল করে রিয়ালকে ১২ বছর পর দশম চ্যাম্পিয়নস লিগ উপহার দেন তিনি। সেই মৌসুমে সকল ধরনের প্রতিযোগিতায় গোল করে মৌসুম শেষ করেন রামোস।

১৫/১৬ মৌসুমের এল ক্লাসিকোতে রেড কার্ড দেখার পর অধিনায়কের আর্মব্যান্ড পরিয়ে দিচ্ছেন মার্সেলোকে © Paul Gilham/Getty Images

২০১৫ সালে রিয়াল মাদ্রিদ রামোসের সঙ্গে আবারও চুক্তি নবায়ন করে। যদিও চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতার পরের সেই মৌসুমটি একেবারেই ভালো যায়নি দলটির। হতাশাজনকভাবে একটি শিরোপাহীন মৌসুম পার করে রিয়াল। পরের মৌসুমে ক্যাসিয়াসের বিদায়ের পর রিয়ালের অধিনায়কত্ব পান রামোস। আর সেই থেকে রিয়াল মাদ্রিদে শুরু হয় ক্যাপ্টেন রামোসের ক্যারিয়ারের নতুন অধ্যায়।

জিদানের আগমনের পরের মৌসুমটি ছিল রিয়ালের হয়ে রামোসের ক্যারিয়ারের সেরা মৌসুম। সেবার শুধুমাত্র কোপা দেল রে ব্যতিত প্রায় সকল শিরোপাই জেতে রিয়াল মাদ্রিদ, আর পুরো মৌসুমে রামোস ছিলেন ব্যক্তিগতভাবে সেরা ফর্মে। রক্ষণভাগে নিজের দায়িত্ব শতভাগ পূরণ করে গোলও করেন ১০টি।

২০১৭/১৮ মৌসুমের চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা হাতে রামোস © Paul Gilham/Getty Images

২০১৬ এবং ২০১৭ সালে টানা দুইবার চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতানোর পর ২০১৮ সালে রিয়ালকে টানা তৃতীয় চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতান জিনেদিন জিদান। আর সেই দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে রামোস তার দায়িত্ব শতভাগ পূরণ করেন। গত মৌসুমের শুরুতে জিদান এবং রোনালদোর বিদায়ে আবারও শিরোপাহীন একটি বছর পার করে রিয়াল। আর সেই সময় রামোসের অভাব খুব ভালোভাবেই টের পেয়েছিলেন দলের কর্তারা। চ্যাম্পিয়নস লিগের রাউন্ড অব সিক্সটিনের প্রথম লেগে আয়াক্সের মাঠে জয় নিয়ে ফিরলেও হলুদ কার্ডের কারণে দ্বিতীয় লেগে খেলতে পারেননি রামোস। অতঃপর, ফলাফল যা হওয়ার তাই হয়েছিলো। নিজেদের মাঠে আয়াক্সের বিরুদ্ধে ১-৪ গোলের ব্যবধানে পরাজিত হয়ে বাদ পড়ে দলটি।

পেশাদার ফুটবলে রামোসের মতো সফলতা অর্জন করা ডিফেন্ডার জগতে আর দু’জন নেই, কিংবা ছিলেনও না। এখন অবধি রিয়ালের হয়ে ৪টি লিগ শিরোপা, ৪টি চ্যাম্পিয়নস লিগ, ৪টি ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপসহ জিতেছেন সর্বমোট ২০টি শিরোপা। শুধু তা-ই নয়, ৬০৬টি ম্যাচ খেলে রিয়ালের হয়ে এখন পর্যন্ত রামোসের গোল সংখ্যা ৮৪টি। একজন ডিফেন্ডার হয়ে এতসংখ্যক গোল এর আগে কেউ কখনও করেনি।

সার্জিও রামোস, সাল ২০০৯; Image Source: Getty Images

ব্যক্তিগত অর্জনের দিক দিয়েও রামোসের ধারেকাছে কেউ নেই। টানা তিনটি চ্যাম্পিয়নস লিগজয়ী দলকে নেতৃত্ব দেয়ার পাশাপাশি মোট ৭ বার উয়েফার বর্ষসেরা একাদশে জায়গা পেয়েছেন তিনি, যা এখন অবধি ফুটবল ইতিহাসে সর্বোচ্চ। রক্ষণাত্মক ভূমিকায় রামোস যেমনভাবে তার ক্যারিয়ারের অধিক সময় সফলতা পেয়েছেন, তেমনই এতগুলো গোল করে নিজেকে সামর্থ্যের চেয়েও বেশি প্রমাণ করেছেন। এ কারণে মোট ৫ বার ‘লা লিগা’র বর্ষসেরা ডিফেন্ডারও নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। শুধুমাত্র মাঠে তার উগ্র আচরণ কিংবা শত শত হলুদ কার্ড দিয়ে কেউ কখনও তাকে বিচার করতে পারবে না, কারণ দিনশেষে পেশাদার ফুটবলে অগণিত ব্যক্তিগত এবং দলীয় অর্জন তার পক্ষে কথা বলে।

আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার

স্পেন জাতীয় দলের হয়ে অভিষেকের আগে অনূর্ধ্ব-১৭, অনূর্ধ্ব-১৯ এবং অনূর্ধ্ব-২১ দলের হয়ে কিছু ম্যাচ খেলেছেন রামোস। ২০০৪ সালে অনূর্ধ্ব-১৯ ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ জেতার পর পরের বছরই স্পেন জাতীয় দলের হয়ে ডাক পান তিনি। ২০০৫ সালের ২৬ মার্চ চীনের বিপক্ষে একটি আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচে তার অভিষেক হয়। আর সেই অভিষেকের মধ্য দিয়ে রামোস সবচেয়ে কম বয়সী খেলোয়াড় হিসেবে স্পেনের জার্সি গায়ে জড়িয়ে ৫৫ বছরের রেকর্ড ভেঙে নিজের করে নেন।

রাশিয়া বিশ্বকাপে রামোস © Dan Mullan/Getty Images

অভিষেকের পর থেকে এখন অবধি রামোস স্পেনের জার্সিতে ৪টি বিশ্বকাপ খেলেছেন। ২০০৬, ২০১০, ২০১৪ সালে দলের অন্যতম একজন সদস্য হিসেবে অংশগ্রহণ করলেও ২০১৮ সালে রাশিয়া বিশ্বকাপে স্পেনের নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। ২০১০ সালে স্পেনের বিশ্বকাপজয়ী দলে রাইটব্যাক হিসেবেও খেলেছেন রামোস। বিশ্বকাপের পাশাপাশি এখন পর্যন্ত ৩টি ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপেও অংশগ্রহণ করেছেন এই কিংবদন্তি ডিফেন্ডার। তবে ২০০৮ এবং ২০১২ সালে ইউরো শিরোপাজয়ী দলের সদস্য হিসেবে রূপালি শিরোপাতে চুমুও খেয়েছিলেন রামোস।

শুধুমাত্র ৩টি মেজর শিরোপা জিতেই ক্ষান্ত হননি দ্য গ্ল্যাডিয়েটর রামোস। স্পেনের হয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ম্যাচ খেলার রেকর্ডটি নিজের করে নিয়েছেন তিনি। আর মাত্র ২টি ম্যাচ খেলতে পারলে ইকার ক্যাসিয়াসের ১৬৭টি ম্যাচের মাইলফলকও স্পর্শ করতে পারবেন রামোস। আর ৩টি ম্যাচ খেলতে পারলে স্পেনের জার্সিতে সর্বোচ্চ ম্যাচ খেলার রেকর্ডটিই নিজের করে নিতে পারবেন তিনি।

ইউরোপিয়ান কাপ হাতে রামোস; Image Source: irishmirror

শুধু ম্যাচের সংখ্যায় নয়, গোলের পরিসংখ্যানেও অভাবনীয় সাফল্য পেয়েছেন এই কিংবদন্তি। স্পেনের হয়ে ১৬৫ ম্যাচে রামোসের গোল সংখ্যা সর্বমোট ২০টি। একজন ডিফেন্ডার হয়েও জাতীয় দলের হয়ে এত এত গোল এবং রেকর্ডের মালিক রামোস এখন অবধি ফিফার বর্ষসেরা একাদশে জায়গা পেয়েছেন মোট ৯ বার। এর আগে কোনো ডিফেন্ডার এতবার ফিফার বর্ষসেরা একাদশে জায়গা পাননি।

ব্যক্তিগত জীবন

৯০ মিনিটের ফুটবলে রামোসকে যতটা হিংস্র মনে হয়, ব্যক্তিগত জীবনে রামোস মোটেও ততটা হিংস্র এবং উগ্র নন। ২০১২ সালে তিনি তার বর্তমান স্ত্রী পিলার রুবিও সঙ্গে প্রথমবার সাক্ষাত করেন। পিলার স্পেনের একজন বিখ্যাত উপস্থাপিকা। চলতি বছরের জুনে দু’জন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তবে সম্পর্কের শুরু থেকে এখন অবধি তাদের ঘর আলোকিত করেছে ৩ জন পুত্রসন্তান। বিবাহকালে রামোসের বয়স ৩৩ হলেও পিলার রুবিওর বয়স হয়েছিল ৪১।

অবসর সময়ে তিনি গিটার বাজাতে পছন্দ করেন রামোস; Image Source: Irishmirror

সার্জিও রামোস ফুটবলের পাশাপাশি ষাঁড়ের লড়াইয়ের একজন বড় ভক্ত। তিনি ষাঁড়ের লড়াইয়ের একাধিক ফ্র্যাঞ্চাইজির সঙ্গেও যুক্ত রয়েছেন। তবে অবসর সময়ে তিনি গিটার বাজাতে পছন্দ করেন। ইউটিউবে তার গিটার বাজানোর অনেক ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়। এছাড়াও সর্বশেষ হিসেব অনুযায়ী, তার বাৎসরিক আয় ৬০ মিলিয়ন ডলার। আর এই অর্থের বেশিরভাগই আসে ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে। তবে রামোসের ব্যক্তিমালিকানাধীন কিছু ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে।

এত এত অর্থ আয় করলেও রামোস তার অর্থের কিছু অংশ বিভিন্ন সেবামূলক সংস্থায় দান করেন। তিনি নিজেও একটি সংস্থা পরিচালনা করেন। বিভিন্ন সময় কয়েকটি দুর্গম জায়গায় ইউনিসেফের শুভেচ্ছাদূত হিসেবে কাজ করেছেন রামোস। খেলোয়াড় রামোসকে অনেকে হয়তো তার উগ্র আচরণের জন্য ঘৃণা করে থাকেন, কিন্তু তার যোগ্যতাকে কোনোভাবে অস্বীকার করার উপায় নেই। তেমনিভাবে ব্যক্তিজীবনে সবসময় একজন ভালো মানুষের গুণাগুণ বহন করে নিজেকে কিংবদন্তি ফুটবলারদের মাঝে প্রথম সারিতে রেখেছেন ‘দ্য গ্ল্যাডিয়েটর’ রামোস।

This article is about Sergio Ramos. He is a Spanish professional footballer who plays for and captains both Real Madrid and the Spain national team as a centre back. He has also played as a right back. After emerging through Sevilla's youth academy, Ramos moved to Madrid in the summer of 2005. 

Featured Image: Gerrar Julien/AP

Related Articles