Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

খ্যাপাটে রোমেরোর দুর্ভাগ্য

পরিবারের লোকেরা তাকে আদর করে ডাকে ‘চিকুইতো’, মানে ‘বেটে ছেলে’!

অথচ উচ্চতা তার ৬ ফুট ৩ ইঞ্চি। এত লম্বা হওয়ার পরও ‘বেটে’ ডাক নামের রহস্য হলো, তার ভাইয়েরা সব ৭ ফুটের কাছাকাছি লম্বা।

সার্জিও রোমেরোর জীবনের গল্প, ক্যারিয়ারের গল্প; সবকিছুর প্রতীক এই একটা ব্যাপার। সাধারণের চেয়ে লম্বা হয়েও তার নাম হয়ে থাকে ‘বেটে’। সাধারণের চেয়ে ভালো গোলরক্ষক হয়েও তিনি একটি ভালো ক্লাবে নিয়মিত একাদশে খেলার সুযোগ পান না। সাধারণের চেয়ে ভালো হয়েও তিনি শেষমুহুর্তে বিতর্কিত এক ইনজুরিতে মিস করেন বিশ্বকাপ!

রোমেরোর জন্ম আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল সীমান্তের বার্নাডো ডি ইরিগোয়েন নামের শহরে। পরিবারের সবাই ছিলেন বাস্কেটবল ভক্ত। কিন্তু রোমেরো ঝুঁকলেন ফুটবলের দিকে। শুরুতে আর দশটা বাচ্চার মতো স্ট্রাইকার হওয়ারই চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু কোচরাই ধরে গোলরক্ষক বানিয়ে দেন। যুবদলের ক্যারিয়ার শুরু হয় আলমিরান্তে ব্রাউন নামের এক দলের হয়ে। এরপর ‘সিএআই’ দলের হয়েও যুব ক্যারিয়ারে কিছু ম্যাচ খেলেন। আর আর্জেন্টিনার প্রিমিয়ার ডিভিশনে অভিষেক হয় রেসিং ক্লাবের হয়ে।

ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে রোমেরো; সোর্স: গেটি ইমেজ

যুবদলে থাকতেই আর্জেন্টিনার যুবদলেও ডাক পেয়ে যান। ২০০৭ সালে দক্ষিণ আমেরিকান যুব চ্যাম্পিয়নশিপে জাতীয় দলের জার্সি গায়ে চড়ান। সেখানে দারুন সাফল্যের পর একই বছর ফিফা অনুর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপে জাতীয় দলের প্রতিনিধিত্ব করেন। আর সেরা সুযোগটা আসে সার্জিও বাতিস্তা যখন তাকে ২০০৮ অলিম্পিকের দলে ডাকেন। অস্কার উতারিকে হটিয়ে অলিম্পিকের যুব দলে তিনি হয়ে ওঠেন এক নম্বর কিপার।

এর মধ্যে রোমেরোর জীবনে একটা বিপ্লব ঘটে যায়। তাকে পছন্দ করে এ জেড অ্যালকমারে নিয়ে আসেন স্কাউটরা। সেখানে লুই ফন গলের চোখে ও হাতে পড়ে বেশ ভালোই করছিলেন। অ্যালকমারের প্রথম পছন্দের গোলরক্ষক রয় ওয়াটারম্যান ইনজুরিতে পড়ায় কপালও খুলে যায় তার। ফন গল রোমেরোকে নিয়মিত ম্যাচ খেলাতে শুরু করেন। যদিও মূল দলের হয়ে শুরুতেই পেনাল্টি হজম করে বেশ সমালোচনার শিকার হয়েছিলেন। কিন্তু এক মৌসুম যেতে না যেতেই রোমেরো অ্যালকমারে নিজেকে প্রথম পছন্দের গোলরক্ষক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেন।

এর মধ্যে আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের কোচ হয়ে আসেন ডিয়েগো ম্যারাডোনা। গোলপোস্টের নিচে তিনি খুব দ্রুত ম্যারাডোনার আস্থা অর্জন করে নেন। ২০১০ বিশ্বকাপে খেলাটা তার অবশ্য একটু সংশয়ে পড়ে গিয়েছিলো। ক্লাবের হয়ে খেলতে গিয়ে পাওয়া এক ইনজুরি তাকে আটকে দিয়েছিলো। কিন্তু শেষাবধি ইনজুরি থেকে সেরে বিশ্বকাপের স্কোয়াডে জায়গা করে নেন। বিশ্বকাপে সবগুলো ম্যাচই অত্যন্ত আস্থার সাথে খেলেন একটু পাগলাটে বলে পরিচিত এই গোলরক্ষক। জাতীয় দলের হয়ে নিয়মিত পারফরম্যান্স অবশ্য ক্লাবে ম্লান হয়ে পড়ে।

নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে পেনাল্টি আটকানোর পর; সোর্স: গেটি ইমেজ

কপালটা পোড়ে তার ২০১১ সালে সিরি-বি দল সাম্পদোরিয়ায় যাওয়ার পর। প্রথম মৌসুমটা বেশ কিছু ম্যাচ পেয়েছিলেন। কিন্তু এর মধ্যেই ক্লাব ও জাতীয় দলে বেশ নবীশসুলভ কিছু গোল হজম করে সমালোচনার পাত্র হয়ে পড়েন। তাকে নিয়ে অনেক হাসিঠাট্টাও হয়েছে এই সময়। ফলে একাদশে অনিয়মিত হয়ে পড়েন এই আর্জেন্টাইন।

সাম্পদোরিয়া ২০১৩ সালে তাকে মোনাকোতে ধারে দিয়ে দেয়। মোনাকোও সাইড বেঞ্চে বসিয়ে রাখে। সব মিলিয়ে সে মৌসুমে ৩টি মাত্র ম্যাচ খেলেছেন। এই ম্যাচ অনুশীলন ছাড়াই হাজির হয়েছিলেন ২০১৪ বিশ্বকাপে। আর সেখানেই বীরত্ব দেখিয়ে নিজেকে নিয়ে স্বপ্ন তৈরি করেছিলেন। নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে দু-দুটো পেনাল্টি ঠেকিয়ে দেওয়া, টানা চার ম্যাচ গোলপোস্ট অক্ষত রাখা, কয়েকটি চোখধাঁধানো সেভ করা- এসব কীর্তি তখন রোমেরোকে বিশ্বের আলোচিত এক গোলরক্ষকে পরিণত করে।

কিন্তু রোমেরোর সুদিন আসলে ফেরে না।

ক্লাবে কিছুতেই প্রথম একাদশে জায়গা করে নিতে পারেন না তিনি। তার প্রতি আগ্রহই হারিয়ে ফেলে ক্লাবগুলো। সাম্পদোরিয়ায় ফেরার পর একইভাবে বেঞ্চ গরম করতে থাকেন। এই সময় বাজারে গুঞ্জন রটে, তাকে কেনার জন্য চেষ্টা করছে বেনফিকা ও ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। এদিকে সাম্পদোরিয়ার সাথে তার চুক্তিও শেষ। রোমেরো কাতর কণ্ঠে বলেন, তিনি যে কোনো ক্লাবে যেতে রাজী আছেন, কিন্তু তাকে শুধু একটু খেলার সুযোগ করে দিতে হবে।

অবশেষে সেই সুযোগটা আসে পুরোনো গুরু লুই ফন গলের কাছ থেকেই। ফন গল তখন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের কোচ। রোমেরোকে ফ্রি ট্রান্সফারে তিন বছরের জন্য ইউনাইটেডে নিয়ে আসেন ফন গল। লিগে না হলেও কাপের খেলাগুলোতে সুযোগ পেতে শুরু করেন রোমেরো। একটু একটু করে কপাল খুলতে থাকে তার। এমনকি নতুন কোচ হোসে মরিনহোও তাকে কাপ ও ইউরোপা লিগের ম্যাচে সুযোগ দেন। সেখানে কয়েকটা ম্যাচে ক্লিন শিট ধরে রেখে বেশ আলোচনায় আসেন। ফেনউরডের বিপক্ষে তার পারফরম্যান্স সে সময় সমালোচকদেরও মুগ্ধ করেছিলো।

আরেকটি গোল আটকানোর পর; সোর্স: স্পোর্টস ক্রীড়া

এই সময় রোমেরোর স্বপ্ন শুধু লিগে নিয়মিত হওয়া এবং আরেকটি বিশ্বকাপে মেসিবাহিনীর হয়ে অন্যরকম কিছু করে দেখানো। কারণ, জাতীয় দলের হয়েও দারুণ কাটছিলো তার সময়টা। স্বপ্ন তো তিনি দেখতেই পারতেন। কিন্তু কোত্থেকে এক ভুতুড়ে ইনজুরি এসে সব এলোমেলো করে দিলো।

অনুশীলনে হঠাৎ করেই হাঁটুর ইনজুরিতে পড়লেন। কেবল রোমেরো নয়, বিশ্বজুড়ে আর্জেন্টিনার সমর্থকরাও কেঁপে উঠলেন। প্রথমে একটু অপেক্ষা করবে বলে মনে করেছিলো আর্জেন্টাইন ফুটবল ফেডারেশন। কিন্তু খুব দ্রুততার সাথে জানিয়ে দেওয়া হয়, রোমেরোর পক্ষে বিশ্বকাপের মধ্যে সেরে ওঠা সম্ভব নয়। ভেঙে যায় তার স্বপ্ন। জানিয়ে দেওয়া হয়, রোমেরোর বিশ্বকাপ শেষ।

গল্পটা এখানেই শেষ হলে কথা ছিলো। তাহলে ট্রাজেডির গল্প বলে চালিয়ে দেওয়া যেত। কিন্তু এরপর আসে নতুন এক বিতর্ক।

আর্জেন্টাইন এই গোলরক্ষকের স্ত্রী ইলিয়ানা গার্সিয়া ভিন্ন এক কথা নিয়ে হাজির হন। তার দাবি, রোমেরোকে ষড়যন্ত্র করে দল থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।

তিনি জানান, রোমেরোর ইনজুরি গুরুতর নয়। বিশ্বকাপের আগেই ফিট হয়ে যাবেন। লস অ্যাঞ্জেলসের একটি টেলিভিশন শোতে সাবেক এই মডেল বলেন, “আর্জেন্টিনা তাকে দলে চায় না। কিছুই ভাঙেনি ওর। হাঁড় সামান্য সরে গেছে।

টেলিভিশনের পর্দায় রীতিমত বোমাই ফাটান রোমেরোর স্ত্রী। তিনি আরো বলেন, “চিকিত্সকরা তাকে বলেছে যে সে বিশ্বকাপের জন্য ঠিক আছে। সর্বোচ্চ দুই বা তিন সপ্তাহ লাগতে পারে সেরে উঠতে। এটাই আমার স্বামীর অবস্থা। প্রথম ম্যাচের জন্য ফিট হয়ে যেতে পারতো সে। অনেক মানুষই তাকে দলে চায়নি। নিজেদের কথার জোর বাড়াতেই ওরা বলেছে যে হাঁড় ভেঙেছে। এই মিথ্যে শুনতে শুনতে আমি ক্লান্ত।

মাঠে নামার অপেক্ষায়; সোর্স: উইকিমিডিয়া কমন্স

সরাসরি কারো নাম বলেননি ইলিয়ানা। তবে তিনি আঙুল তুলছেন টিম ম্যানেজমেন্টের দিকে, “আমি জানি না যারা এসব কথা বলছে তা উটকো; তারা জানে না নাকি কাপুরুষের মতো বলছে কিংবা ব্যক্তিগত স্বার্থে। যেটাই হোক, এর চেয়ে বাজে কিছু হতে পারে না।

মানে, বেটে ছেলেটাকে নিয়ে একটা সন্দেহ থেকেই গেলো!

কপালটাই যেন তার এমন। একদিকে সব ঠিকঠাক হয়ে উঠতে থাকবে। অন্যদিকে নিয়তি কিংবা কারো ষড়যন্ত্রে কপাল পুড়বে তার। লোকে বলে খেপাটে রোমেরো; এখন আমরা বলতে পারি, কপাল পোড়া রোমেরো!

Related Articles