১.
ম্যাচটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল দুই দলের জন্যেই। অবশ্য ফাইনাল ম্যাচ যে গুরুত্বপূর্ণ হয়, সেটা বোঝার জন্য তো কারো বিশেষজ্ঞ হবার প্রয়োজন নেই। আর সেটা ছিল চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল, ক্লাব ফুটবলের সবচাইতে মর্যাদাসম্পন্ন আসর। হয়তো এই কারণেই দুই দলের দুই কোচকে ডাগ আউটে চিন্তিত মুখে পায়চারি করতে দেখা যাচ্ছিল। রিয়ালের কোচ আনচেলোত্তির কাছে কোচ হিসেবে তখন পর্যন্ত অ্যাথলেটিকোর কোচ সিমিওনে শিশুতুল্যই। কিন্তু এত কাছে এসে হাল ছেড়ে দেওয়ার পক্ষেও তিনি নন।
তবে টুর্নামেন্ট জেতার চাইতেও ম্যাচটা দুই দলের জন্য আরো কিছু দিক থেকে গুরুত্ব বয়ে আনছিল।
তখন পর্যন্ত চ্যাম্পিয়নস লিগের সবচাইতে বেশি (৯ বার) শিরোপাজয়ী দল রিয়াল মাদ্রিদই ছিল। তবে তাদের সর্বশেষ শিরোপা জেতার ১২ বছর হয়ে গিয়েছিল। অনেকবার বড় বড় বাজেটের দল গড়েও চ্যাম্পিয়ন হওয়া তো দূরে থাক, ফাইনালেই ওঠা হয়ে উঠছিল না তাদের।
অন্যদিকে, অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদের তখন পর্যন্ত চ্যাম্পিয়নস লিগের শিরোপা জয়ের সৌভাগ্য হয়ে ওঠেনি। ক্লাবের ইতিহাসে এর আগে মাত্র একবারই তারা ফাইনাল খেলতে পেরেছিল। সুযোগটাকে হাতছাড়া করতে চাওয়ার মতো বোকামি তারা করতে চাইবে না, সেটাই স্বাভাবিক ছিল।
ঐতিহ্য কিংবা নামের ভারে রিয়াল বড় হলেও সেই মৌসুমে অ্যাথলেটিকোর পারফরম্যান্সও খারাপ ছিল না। ম্যাচের শুরুতেই অ্যাথলেটিকো একটা হোঁচট খায়। ৯ম মিনিটেই অ্যাথলেটিকোর স্ট্রাইকার ডিয়েগো কস্তাকে ইনজুরির জন্য মাঠ ছাড়তে হয়, যিনি কি না সেই মৌসুমে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে অ্যাথলেটিকোর হয়ে সবচাইতে বেশি গোল করেছিলেন। এই ধাক্কার পরও ৩৬তম মিনিটে ম্যাচের প্রথম গোলটা অ্যাথলেটিকোই করে।
সবাই যখন মোটামুটি নিশ্চিত যে ম্যাচটা অ্যাথলেটকোই জিততে যাচ্ছে, ঠিক তখনই রামোস-জাদুতে মাদ্রিদ ঘুরে দাঁড়ায়। ইনজুরি টাইমে গোল করে ম্যাচটাকে অতিরিক্ত সময়ে নিয়ে গিয়ে শেষ পর্যন্ত টুর্নামেন্টটা জিতে নেয় রিয়াল মাদ্রিদই।
ম্যাচটা আসলে আনচেলোত্তির কাছে নয়, একপ্রকার ভাগ্যের কাছেই হেরে যান সিমিওনে।
২.
ফুটবলে সবচেয়ে কঠিন কাজ আসলে কোনটি?
বিষয়টা আসলে আপেক্ষিক। দলভেদে এক একজনের কাছে বিষয়টা এক এক রকম। জার্মান কিংবা ব্রাজিলের কাছে বিশ্বকাপ জেতা যতটা কঠিন, মালাগার মতো দলের স্প্যানিশ লিগ জেতা তার চেয়েও বেশি কঠিন। আর শুধু মালাগাই কেন, বার্সেলোনা আর রিয়াল মাদ্রিদের মতো দল যে লিগে খেলে, সেই লিগে তৃতীয় স্থান পেলেই সবাই যেন খুশি থাকে। সত্যিকার অর্থে, রিয়াল মাদ্রিদ আর বার্সেলোনার সাথে বাকি দলগুলোর শক্তির ব্যবধান এতটাই বেশি থাকে যে, তাদের সাথে টক্কর দেওয়ার ইচ্ছে থাকলেও দেওয়া যায় না।
তবে একজন হয়তো ভিন্নভাবে বিষয়টাকে ভেবেছিলেন। সেই 'একজন'টা হচ্ছেন ডিয়েগো সিমিওনে।
কোচ হিসেবে সিমিওনে আদতে মরিনহো, ফন হাল, ফার্গির মতো হাই-প্রোফাইল ছিলেন না, কিন্তু অ্যাটলেটিকোতে আসার আগে তার কোচিং ক্যারিয়ার একেবারে খারাপও ছিল না। ২০০৬ সালে তিনি এস্তুদিয়ান্তেস দে লা প্লাতার প্রধান কোচ হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন, এবং খুব দ্রুতই দলটিকে ২৩ বছরের মধ্যে তাদের প্রথম লিগ শিরোপা জেতান। সেই বছরই ডেইলি ওলে কর্তৃক আয়োজিত ভোটে সিমিওনে আর্জেন্টাইন লীগের সেরা ম্যানেজার নির্বাচিত হন।
মাঝে রিভারপ্লেট, সান লরেঞ্জো, ক্যাটানিয়া, রেসিং ক্লাবের মতো ক্লাবের ম্যানেজার হলেও সেই ক্লাবগুলোতে উল্লেখ করার মতো সফলতা পাননি। তবে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদে যোগ দেওয়ার পরেই তার নতুন পর্ব শুরু হয়।
৩.
সিমিওনে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদে কোচ হিসেবে যোগ দেন ২০১১ সালে। এর আগের কয়েকটি মৌসুমে লিগে অ্যাটলেটিকোর অবস্থান খুব নাজুক ছিল। ২০০৫-০৬ মৌসুমে দশম, ২০০৬-০৭ মৌসুমে সপ্তম, ২০০৭-০৮ মৌসুমে চতুর্থ, ২০০৮-০৯ মৌসুমে চতুর্থ, ২০০৯-১০ মৌসুমে নবম, ২০১০-১১ মৌসুমে সপ্তম।
দায়িত্ব পাওয়ার সাথে সাথেই খুব বেশি কিছু করে ফেলেননি। প্রথম মৌসুমে ৫ম স্থান নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল। হয়তো শিখরে উঠার রাস্তাটা চেনার চেষ্টা করছিলেন। খুব বেশি সময় নেননি। ২০১২-১৩ মৌসুমেই লিগে তৃতীয় করেন দলকে, তবে কোপা দেল রে চ্যাম্পিয়নও করেন। রিয়ালের মাঠেই ফাইনালে রিয়ালের বিরুদ্ধে ১ গোল খাওয়ার পরও ২ গোল করে শিরোপা জেতে অ্যাটলেটিকো।
অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের দল বিবেচনায় এই অবস্থান বেশ সফলই বলা যায়। কিন্তু ২০১৩-১৪তে লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়ে বুঝিয়ে দিলেন, এত অল্পে সন্তুষ্ট হবার মানুষ তিনি নন। সেই মৌসুমে লিগের ২১তম রাউন্ড পর্যন্ত বার্সেলোনা ছিল ১ নম্বরে, এবং ২৬তম রাউন্ড পর্যন্ত অ্যাটলেটিকো ছিল ৩ নম্বরে। কিন্তু মৌসুমশেষে বার্সা আর রিয়ালকে পেছনে ফেলে শিরোপাটা অ্যাথলেটিকোই জিতে নেয়।
এত সহজে বোধহয় অ্যাথলেটিকোর শিরোপা জয়ের মাহাত্ম্যটা বোঝা যাচ্ছে না। একটা তথ্য দিলে কিছুটা বুঝতে পারা যাবে। ২০০৫ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত এই ১৫ বছরে কেবল এই একটিবারই লা লিগার শিরোপা রিয়াল-বার্সার বাইরে গিয়েছে।
২০১৪ এর সুপার কোপাও জিতে নেন রিয়ালকে হারিয়ে। ২০১৩-১৪ মৌসুমে শুধু স্প্যানিশ লিগ আর সুপার কোপাই নয়, চ্যাম্পিয়নস লিগেও অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ দুর্দান্ত করে। পোর্তোর মতো দল গ্রুপে থাকার পরেও গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়েই পরের পর্বে ওঠে। তুলনামূলকভাবে দুর্বল দল নিয়েও নকআউট স্টেজে মিলান (২০০৭ এর চ্যাম্পিয়ন), বার্সেলোনা ( ২০১১ এর চ্যাম্পিয়ন) আর চেলসির ( ২০১২ এর চ্যাম্পিয়ন) মতো দলকে হারিয়ে ফাইনালে ওঠে। ফাইনালের কথা তো আগেই বলা হলো।
সত্যিকার অর্থে, একেই হয়তো বলে দুর্ভাগ্য; নিজের যথাসাধ্য চেষ্টার পরও ভাগ্য সহযোগিতা করেনি। ২০১৫-১৬তেও কিন্তু মোটামুটি একই অবস্থা। কোয়ার্টারে বার্সা আর সেমিতে বায়ার্নকে পরাজিত করে ফাইনালে রিয়ালের কাছে হারে টাইব্রেকারে।
নকআউট পর্বে তিন সাবেক চ্যাম্পিয়নকে পরাজিত করে শুধুমাত্র ২০১৯ সালে ক্লপের ম্যাজিকাল লিভারপুল বাদে ইদানিং কোনো দলই চ্যাম্পিয়ন হয়নি। গত কয়েক মৌসুমে চ্যাম্পিয়ন দলগুলোকে ফাইনালের আগে এত বেশি শক্ত পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়নি। একটু লক্ষ্য করা যাক:
২০১১ সালে বার্সার নকআউট পর্বের প্রতিপক্ষ আর্সেনাল, শাখতার, রিয়াল মাদ্রিদ।
২০১২ সালে চেলসির নকআউট পর্বের প্রতিপক্ষ নাপোলি, বেনফিকা আর বার্সেলোনা।
২০১৩ সালে বায়ার্নের নকআউট পর্বের প্রতিপক্ষ আর্সেনাল, জুভেন্টাস আর বার্সেলোনা।
২০১৪ সালে রিয়ালের নকআউট পর্বের প্রতিপক্ষ শালকে ০৪, বরুশিয়া ডর্টমুন্ড, বায়ার্ন মিউনিখ।
২০১৫ সালে বার্সার নকআউট পর্বের প্রতিপক্ষ ম্যানসিটি, পিএসজি, বায়ার্ন।
২০১৬ সালে রিয়ালের নকআউট পর্বের প্রতিপক্ষ রোমা, উলফসবার্গ, ম্যানসিটি।
২০১৭ সালে রিয়ালের নকআউট পর্বের প্রতিপক্ষ নাপোলি, বায়ার্ন মিউনিখ, অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ।
২০১৮ সালে রিয়ালের নকআউট স্টেজে প্রতিপক্ষ পিএসজি, জুভেন্টাস আর বায়ার্ন মিউনিখ।
২০১৯ সালে লিভারপুলের নকআউট স্টেজে প্রতিপক্ষ বায়ার্ন মিউনিখ, পোর্তো আর বার্সেলোনা।
বিগত দশ বছরের কথা ভাবলে শক্তির দিক থেকে বার্সা, রিয়াল কিংবা বায়ার্নের দিক থেকে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ নিশ্চিতভাবেই অনেক পিছিয়ে। এই সময়ে বেশিরভাগ ম্যাচেই রিয়াল, বার্সা কিংবা বায়ার্নের মতো দলগুলো নিজেদের শতভাগ দিতে পারলে তাদেরকে হারানো সত্যিকার অর্থেই প্রায় অসম্ভব ছিল। এই জন্য প্রতিপক্ষরা সবসময়ই চেষ্টা করে, যাতে অন্য দল তার নিজের স্বাভাবিক খেলাটা খেলতে না পারে। অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদ আর রিয়াল দুই দলই যদি কোনো ম্যাচে তাদের সামর্থ্যের শতভাগ দিতে পারে, তাহলে হয়তো নিশ্চিতভাবেই রিয়াল জিতবে। বায়ার্ন বা বার্সার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এদের হারাতে হলে অ্যাথলেটিকোকে শুধু নিজের সামর্থ্যের শতভাগ খেললেই হবে না, বরং বার্সা-রিয়াল কিংবা বায়ার্ন যেন তার সামর্থ্যের ৭০ ভাগও খেলতে না পারে, সেই চেষ্টাটা করতে হবে।
নিশ্চিতভাবেই কাজটা সহজ নয়। আর এই কঠিন কাজটাই অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদকে করতে হয়েছে, যা কি না বিগত কয়েক বছরের চ্যাম্পিয়ন দলগুলোকেও করতে হয়নি। ২০১৫-১৬ মৌসুমের কথাই চিন্তা করুন, রিয়াল মাদ্রিদ পুরো টুর্নামেন্টেই তেমন কোনো শক্ত পরীক্ষার মুখোমুখি হয়নি। উলফসবার্গের বিপক্ষে ২ গোল খেয়ে একটু চাপে পড়েছিল, ঘরের মাঠে ক্রিস্টিয়ানো ৩ গোল করলে ভালোভাবে ফিরেও এসেছে। কিন্তু উলফসবার্গের পরিবর্তে বায়ার্ন অথবা বার্সা থাকলেও কি ২ গোল খেয়ে ক্রিস্টিয়ানো একই কাজ করতে পারতো? একেবারে সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া না গেলেও সেটা যে খুব সহজ ব্যাপার হতো না, সেটা বলাই বাহুল্য।
পথভ্রষ্ট রিয়ালকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার জন্য জিদানের ভুমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু এটা তো স্বীকার করতেই হবে, রিয়াল আর জিদান সেই টুর্নামেন্টে অ্যাটলেটিকো কিংবা সিমিওনের তুলনায় ভাগ্যের সহায়তা একটু বেশিই পেয়েছেন।
৪.
সিমিওনের আরেকটা উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব হচ্ছে মেসি-রোনালদো-নেইমারের মতো কোনো সুপারস্টারের উপর নির্ভরশীল না হওয়া। বরং ফ্যালকাও-কস্তাদের মতো খেলোয়াড়দেরকেও স্টার বানিয়েছেন, যারা কি না আবার সিমিওনেবিহীন অন্য ক্লাবে অতটা উজ্জ্বলতা ছড়াতে পারেনি। গ্রিজমানকে কয়েক বছর আগেও কেউ চিনতো না, এখন সেই তিনিই সুপারস্টার।
সীমিত শক্তি নিয়ে সিমিওনের এই চ্যালেঞ্জ করার মানসিকতার জন্যই তাকে স্যালুট জানানো উচিত। এক-দুই মৌসুম কোনোভাবে ভালো খেলাই যায়, কিন্তু ধারাবাহিকভাবে এইভাবে ভালো করার এই চেষ্টাটা সিমিওনের তুলনায় কাছাকাছি অন্য কোন কোচ করতে পারেননি, তা নিঃসন্দেহেই বলা যায়।
সত্যি বলতে, কেবলমাত্র চ্যাম্পিয়ন হওয়াটাকে শ্রেষ্ঠত্বের মূল মাপকাঠি ভাবা উচিত নয়। বিষয় হচ্ছে একজন খেলোয়াড় বা কোচ তার মতো করে কতটা চেষ্টা করেছেন। এই চেষ্টাটা সিমিওনেই সবচেয়ে বেশি দেখিয়েছেন।
অবশ্য দলগত সফলতা সেভাবে না পেলেও ব্যক্তিগত সফলতায় একেবারে পিছিয়ে নেই সিমিওনে। লা লিগার সেরা ম্যানেজার নির্বাচিত হয়েছেন ৩ বার; ২০১২-১৩, ২০১৩-১৪ আর ২০১৫-১৬ মৌসুমে। এছাড়া ২০১১-১২ মৌসুমে নির্বাচিত হয়েছেন ইউরোপের সেরা কোচ হিসেবে, আর ২০১৬ সালে IFFHS দ্বারা নির্বাচিত হয়েছেন বিশ্বের সেরা ক্লাব কোচ।
বিগত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, সিমিওনে বাদে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ হয়তো এমন সাফল্য পেত না। আধুনিক যুগে আর কতজন কোচই বা এককভাবে এমন ধারাবাহিক সাফল্য দেখাতে পেরেছেন?
This article is in Bangla language. This article is about Atletico Madrid's coach Diago Simione. This feature describes how he fights with limited resources. References are given inside as hyperlinks.
Feature Image: Getty Images