ক্রিকেট খেলাটাই গৌরবময় অনিশ্চয়তার। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যান সৌম্য সরকারের ‘ফর্ম’ যেন আরও বেশি অনিশ্চয়তায় ভরা। বছরে অন্তত ২-১ বার দেশের ক্রিকেটের মুখরোচক আলোচনার বিষয় হিসেবে ধরা দেয় কথাগুলো... সৌম্য ফর্মে নাই, সৌম্যর ব্যাটে রান নেই।
বাঁহাতি এই ব্যাটসম্যানের ব্যাটিং সবসময় মুগ্ধতা ছড়ায়। তার ব্যাটিংয়ের সৌন্দর্য চোখের প্রশান্তি বয়ে আনে, যার কারণেই তার প্রতি গণমানুষের প্রত্যাশা বেশি। যার ছিঁটেফোটা অনেক সময় পূরণ করেছেন সৌম্য। কিন্তু মোটাদাগে এই তরুণের ব্যাট আশাহতই করেছে বেশি। সামর্থ্য, প্রতিভার সঠিক অনুবাদ তিনি ধারাবাহিকভাবে করতে পারেননি প্রায় পাঁচ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে।
তবে তাকে আগলে রাখার কাজটা স্বযত্নেই করে আসছে বাংলাদেশের টিম ম্যানেজমেন্ট। টানা দ্বিতীয়বার বাংলাদেশের বিশ্বকাপ দলে সুযোগ পেয়েছেন সৌম্য। চার বছর আগে অস্ট্রেলিয়া-নিউ জিল্যান্ডে খেলেছেন তিনি। বড় ইনিংস না খেললেও বেশ কিছু ইনিংসে তার ব্যাটিং জেগে ওঠার, আত্মবিশ্বাসী শাসন করার রসদ পাইয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশকে। এবার ৪১ ওয়ানডে খেলার অভিজ্ঞতা নিয়ে বিশ্বকাপে যাচ্ছেন এই তরুণ ব্যাটসম্যান।
যদিও ঢাকা প্রিমিয়ার ক্রিকেট লিগে তার ব্যাটের নিষ্প্রভতা সমালোচনা উসকে দিচ্ছিল। বিশ্বকাপ দলে তার অন্তর্ভুক্তি নিয়েও কথা উঠেছে। সর্বশেষ নিউজিল্যান্ড সফরেও টেস্টে সেঞ্চুরি করেছেন। ওয়ানডেতে ভালো শুরু করেছেন দু'টি ইনিংসে, কিন্তু বড় করতে পারেননি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট বিবেচনায় খুব একটা অফ ফর্মে ছিলেন না সৌম্য। কিন্তু প্রিমিয়ার লিগে রানখরা ভুলিয়ে দিচ্ছিল তার নিউ জিল্যান্ডে করা রান।
সাময়িক এই ছন্দহীনতাকে মনে ধারণ করে বিশ্বকাপে যেতে চান না সৌম্য। বিশ্বকাপটা তার মনের মন্দিরে বিশেষ স্থানেই মূল্যায়িত হয়। একান্ত আলাপে ২৬ বছর বয়সী এই ক্রিকেটার বলেছেন, তার বিশ্বকাপ ভাবনা, ব্যাটিংয়ের নানা দিক নিয়ে।
ক্রিকেটে এখন শুধুই বিশ্বকাপ নিয়ে আলোচনা। সৌম্যর মনে বিশ্বকাপ বিষয়টা কতটা কাজ করে?
বিশ্বকাপ তো একটা স্বপ্নের জিনিস। চেষ্টা করবো স্বপ্নটা যেন ভালো হয়, খারাপ স্বপ্ন না হয়। ওইটা ভালো করার চিন্তাই করি। এখন প্রিমিয়ার লিগ খেলার মাঝে আছি। ভালো হচ্ছে না, রান হচ্ছে না। চেষ্টা করবো, বিশ্বকাপে যেন এই বিষয়টা না থাকে। যেন বিশ্বকাপে বিপরীত হয়।
গত বিশ্বকাপ খেলতে গেছেন একটা ওয়ানডে খেলে ও প্রিমিয়ার লিগে রান করে। এবার বিশ্বকাপের আগে প্রিমিয়ার লিগে ধারাবাহিকতা নেই ব্যাটে। এটা মানসিকভাবে চিন্তায় চলে আসছে কি না?
একটু তো রেশ থাকেই। কিন্তু চেষ্টা করছি, যেহেতু প্রিমিয়ার লিগ শেষেই বিশ্বকাপের প্রস্তুতি শুরু হবে, মানে অনুশীলন শুরু হবে, তো ওখানে যেন এটা ভুলে যেতে পারি। যত দ্রুত ভুলতে পারবো, আমার জন্য মনে হয় ততই ভালো। আর এখনও প্রিমিয়ার লিগে দু'টি ম্যাচ বাকি আছে। এখানে যদি ভালো করতে পারি, তাহলে অবশ্যই এটা ভুলে যাওয়া সম্ভব। যেন ভালো কিছু নিয়ে বিশ্বকাপে যাত্রা করতে পারি। (বলা বাহুল্য, সে মিশনে তিনি যারপরনাই সফল। শেষ দুই ম্যাচে জোড়া সেঞ্চুরি করেছেন, একটিকে রূপ দিয়েছেন বাংলাদেশের যেকোনো পর্যায়ের স্বীকৃত একদিবসী ক্রিকেটে একমাত্র ডাবলে।)
বড় রান না করলেই বলা হয়, ব্যাটসম্যান ছন্দে নাই। কিন্তু দেখা যায়, ১৫ রান করলেও অনেক সময় ব্যাটসম্যানরা নিজের ছন্দ নিয়ে তৃপ্ত থাকে। আপনি কখন বোধ করেন যে, রান না করলেও আমি ঠিক অবস্থানে আছি?
এটা দুই রকম। ধরেন, এখন আমি রান করছি না। কিন্তু আমার কাছে মনে হচ্ছে না যে, আমার ব্যাটে লাগছে না, বা এটা হচ্ছে না। আমি আউট হয়ে যাচ্ছি দ্রুত। যদিও আমার যে খেলার ধরন, ওইটা রাখার চেষ্টা করছি। ওইটা থেকে যেন না বের হই, তখন নিজের ক্ষতি হবে। চেষ্টা করছি, আমার ইন্টেন্টের ভেতরে থাকি। যদি হয় আমার এইভাবেই হবে। চেষ্টা থাকছে রানে ফেরার।
আগেরবার যখন বিশ্বকাপে গেছিলাম, তখন প্রিমিয়ার লিগে রান করছি। একটা ওয়ানডে খেলছি। এবার একটু ভিন্ন। দ্বিতীয় বিশ্বকাপ। চেষ্টা করছি, যেহেতু প্রিমিয়ার লিগ খারাপ হয়েছে, ওখানে গিয়ে যেন জিনিসটা খারাপ না হয়। একটা ভালো কিছু করতে পারি। এবং সবাই যেন সেটা অনেক ভালোভাবে নেয়। ভালো কিছু যেন হয়, এবং ভালো কিছু উপহার দিতে পারি।
গত বিশ্বকাপের আগে জাতীয় দলেও নবীন ছিলেন। এবার অনেকগুলো ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা নিয়ে যাচ্ছেন। এই অভিজ্ঞতা আসলে কতটা আত্মবিশ্বাস যোগায়?
অবশ্যই চেষ্টা করবো, যতটুকু খেলেছি বা আগের বিশ্বকাপের অভিজ্ঞতা, যত ওয়ানডে ম্যাচ খেলেছি, ওই আত্মবিশ্বাস নিয়েই যাবো। যতটুকু অভিজ্ঞতা আছে, সেটা নিয়েই খেলার চেষ্টা করবো। যেন খেলাটা আমি দ্রুত ধরতে পারি। বিশ্বকাপ অনেক বড় আসর, অনেকগুলো ম্যাচ। বড় আসরে যেন সেইভাবে ভালো করতে পারি।
গতবার বিশ্বকাপে আপনার একটি হাফসেঞ্চুরি ছিল। কিন্তু বেশ কিছু ছোট ছোট ভালো ইনিংস ছিল। দ্রুত রান তুলেছেন, যা অনেক সময় চাপ কমিয়েছে দলের উপর থেকে। এমন আক্রমণাত্মক ব্যাটিংই কি সৌম্যকে বেশি মানসিক স্বস্তি দেয়?
হ্যাঁ, অবশ্যই। আমি সবসময় ওই রকম ক্রিকেটই পছন্দ করি, আক্রমণাত্মক খেলাটা। এবং চেষ্টা করি, অল্প রান করলেও সেটা যেন দলের জন্য প্রয়োজনীয় রান হয়। সেটা যেন পেছনের ব্যাটসম্যানদের চাপ কমাতে পারে। ওই রানটা যেন দলের কাজে দেয়। এমন নয় যে, আমি অনেক ডট বল খেলে রান করলাম, দলেরও কাজে দিবে না, উল্টো চাপ হয়ে যাবে। চেষ্টা থাকে এটাই যে, অল্প বা বেশি যতই রান করি, তা যেন দলের জন্য শতভাগ কাজে দেয়।
সবসময় এই প্রশ্ন আপনাকে করা হয়। আপনি কবে বড় বড় ইনিংস খেলবেন? নিউ জিল্যান্ডে টেস্টে একটা বড় ইনিংস খেলেছেন। এখন ওয়ানডেতে বড় ইনিংস আসলে কবে দেখা যাবে?
আমার কাছে মনে হয়েছে, নিউ জিল্যান্ডে যে তিনটা ওয়ানডে খেলেছি, ওখানে আমি একটু তাড়াহুড়ো করে ফেলেছিলাম। ৩০ রান করার পর আমি যদি একটু স্লো করতাম, তাহলে হয়তো বা আরও একটু ভালো হতো। উইকেটেও থাকতাম আমি, দলেরও বাকি রানগুলো আরও আসতো ভালোভাবে। ওই জায়গাটা যদি আমি একটু পরিবর্তন করতে পারি যে, আমার দ্রুত ৩০ হয়ে গেছে, এখন আবার একটু দেখেশুনে খেলি, তাতে আমার রানটাও বড় হবে, এবং দলেরও কাজে লাগবে।
আপনার ২টি ওয়ানডে সেঞ্চুরিই দেশের মাটিতে। কিন্তু বলা হয়, আপনি দেশের বাইরে বাউন্সি উইকেট, তথা যেখানে বল ভালো ওঠে, সেখানে ভালো করেন। আপনার নিজের কী মনে হয়? আপনি কি এই ধারণার সঙ্গে একমত?
না। চেষ্টা করি তো সব জায়গায় খেলার জন্য। ওখানে উইকেটে বল ভালো ব্যাটে আসে বলে হয়তো আমার ব্যাটে ভালো লাগে। আমি চেষ্টা করি, যেমন উইকেট থাকে, ওইরকম খেলার জন্য। আমি হয়তো একটু দ্রুত রান করি। আমি দেশে, দেশের বাইরে আলাদাভাবে উইকেট নিয়ে ভাবি না। যেমন উইকেট পাই, ওরকমভাবে খেলার চেষ্টা করি।
মাশরাফি বলছিলেন, আপনার যে গতি বোলিংয়ে, তা দিয়েও খুব কার্যকর বোলিং করার সম্ভব, যদি সিমটাকে কাজে লাগিয়ে ঠিক জায়গায় বল ফেলতে পারেন। বিশ্বকাপে বোলিংয়েও আপনার ডাক পড়তে পারে। নিজের প্রস্তুতি কতটুকু?
হ্যাঁ, আমি চেষ্টা করছি আমার বোলিংটা যেন দলের জন্য অনেক কাজে দেয়। যখনই সুযোগ পাবো, তখন যেন দলকে সাহায্য করতে পারি। আমার উপর তারাও যেন বিশ্বাস রাখতে পারে যে, আমাকে দিয়ে তারা বোলিং করাতে পারবে। প্রয়োজনে আমার ব্যাটিং, বোলিং দুইটাই দলের কাজে লাগবে। এটা নিয়েই চেষ্টা করছি, এবং বাড়তি কাজ করছি।
এবার সাত ক্রিকেটার প্রথমবার বিশ্বকাপ খেলতে যাচ্ছে। আপনার তো দ্বিতীয় বিশ্বকাপ। আপনার চোখে এই নতুনদের মাঝে কে বিশ্বকাপের তারকা হবেন?
আমার কাছে মনে হয়, যারা তরুণ, তারা কিন্তু অনেকগুলো আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছে। ওরা সবাই ভালো করার সামর্থ্য রাখে। তো আমার মনে হয়, যে কেউ যখন-তখন জ্বলে উঠতে পারে। তাদের উপর দলের সেই ভরসাও আছে।
পাদটীকা
এই আলাপের দিন পর্যন্ত ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে ১১ ম্যাচে ১৯৭ রান করেছিলেন সৌম্য। ঠিক পরের ম্যাচেই বিকেএসপিতে স্বরূপে ফিরেছিল এই ওপেনারের ব্যাট। স্বভাবসুলভ আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ে লিস্ট-এ ক্রিকেটে পঞ্চম সেঞ্চুরি তুলে নিয়েছিলেন তিনি। ৭৯ বলে ১০৬ রানের ইনিংসটাতে খুনে ব্যাটিং করেছেন, উইকেটের চারপাশে শটগুলোতে ছিল আত্মবিশ্বাসের বহ্নিছটা। আর শিরোপা নির্ধারণী শেষ ম্যাচে তো তার ব্যাট হয়ে উঠেছিল উন্মত্ত তরবারি! শেষ পর্যন্ত তুলে নিয়েছিলেন নিজের এবং বাংলাদেশী যেকোনো ব্যাটসম্যানের পক্ষে ৫০ ওভারের ম্যাচে প্রথম দ্বিশতক। বিশ্বকাপের মঞ্চেও সৌম্য'র ব্যাটে যে এমন দিগন্তবিস্তৃত হাসি দেখতে চায় বাংলাদেশ, সেটা বলাই বাহুল্য।
This article is in Bangla language. It is about Soumya Sarkar & his dream for the upcoming world cup.
Featured Image: BCB