স্পেনের বিলবাও শহরের এক ছাত্র জুয়ান এলোরদু। ১৯০৯ সালে সাউদাম্পটন থেকে জাহাজ ধরার আগে স্থানীয় এক ফুটবল ক্লাবের জন্য ৫০টি জার্সি নিয়ে বিলবাওতে ফিরেন তিনি। নিজেদের কাছে কিছু জার্সি রেখে বাকিগুলো একই ক্লাবের যুব একাডেমি এটলেটিকো ডি মাদ্রিদে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেই থেকে সাউদাম্পটনের লাল-সাদা জার্সিটি হয়ে ওঠে দুই স্প্যানিশ ক্লাব এথলেটিক বিলবাও ও এটলেটিকো মাদ্রিদের জার্সিও। ১১০ বছর পরে এখন স্পেনের সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলা এই দুই ক্লাবেরই বর্তমানে ডাকনাম রোজিব্লাঙ্কোস, যার মানেও হচ্ছে লাল-সাদা।
প্রতিটি জার্সির রঙের পেছনেও রয়েছে একটি করে মজার ইতিহাস কিংবা গল্প। যে রংগুলো এখন ক্লাবের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সাথে মিশে গেছে সেই জার্সির রংগুলোর গল্পই আমরা জানবো আজ।
লিওনেল মেসিরা বার্সেলোনায় খেলেন বিখ্যাত লাল-নীল কিংবা অনেকের মতে মেরুন-নীল জার্সিতে। অনেকের মতে, মূলত বার্সেলোনার জার্সিতে এই রং এসেছে সুইস থেকে। এই বিখ্যাত ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতার নাম কম বেশ অনেকেই জানেন। জোয়ান গাম্পার নামের এক ভদ্রলোক প্রথম গোড়াপত্তন করেছিলেন বার্সেলোনার। গাম্পার ছিলেন একজন সুইস। জন্ম সুইজারল্যান্ডের বাসেলে। এখন লক্ষ্য করলে দেখা যায়, বাসেল সেই সময় থেকেই লাল-নীল জার্সি পরে খেলে এসেছে। সেই সম্পর্ক থেকে অনেকের মতে বার্সেলোনার জার্সিটি বাসেলের কথা ভেবেই তৈরি করেছেন গাম্পার। যদিও এর শতভাগ নিশ্চয়তা দেওয়া যায়নি কখনো। তবে বার্সেলোনার দেখাদেখি ব্লুগ্রানা জার্সি বেছে নেওয়া ক্লাবের সংখ্যা স্পেনে চারটি।
সর্বপ্রথম এইবার ক্লাব বার্সেলোনার লাল-নীল জার্সিটি ব্যবহার করে ১৯৪৪ সালে। স্থানীয় ফেডারেশন সেবার এইবারকে বার্সেলোনা কিছু জার্সি ধার দেয়। একইভাবে লেভান্তে ও হুয়েস্কা ক্লাবও কাতালান প্রীতি থেকে ব্লুগ্রানা জার্সি পরেই খেলে থাকে। অন্যদিকে রিয়াল বেটিসের সবুজ-সাদা জার্সির পেছনে অনেকে আন্দালুসিয়ান পতাকার ছাপ খুঁজে পেলেও পেছনের গল্প ও ইতিহাস আরো চমৎকার। রিয়াল বেটিসের প্রতিষ্ঠাতা ম্যানুয়েল এসেনসিও ছোটবেলায় ইংরেজি শেখার জন্য স্কটল্যান্ডে ছিলেন। সেখানকার ডাম্প্রিসে সেন্ট জোসেফ স্কুলে পড়ার সময় প্রায়ই সেল্টিকের ম্যাচ দেখতে যেতেন তিনি। সেল্টিকের সাদা-সবুজ সমাহার থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে ভারডিব্লাঙ্কোসদের জন্ম। ব্রিটিশ ফুটবলের এই প্রভাব শুধু স্পেনে নয়, ছড়িয়ে পড়েছিলো পুরো ইউরোপেই।
এমনকি জুভেন্টাসের মতো ক্লাবও অনুসরণ করেছিলো এক অখ্যাত ক্লাবকে। ১৯০৩ সালে জুভেন্টাস জার্সির জন্য ক্লাবেরই এক ইংলিশ খেলোয়াড় জন স্যাভেজকে জিজ্ঞাসা করেছিলো ইংল্যান্ড থেকে তিনি কি কিছু নতুন জার্সি আমদানি করতে পারবেন কি না। জন স্যাভেজ নটিংহ্যামে থাকা তারই এক বন্ধুর সাথে যোগাযোগ করে। সেই বন্ধু আদতে ছিলেন কাউন্টি সমর্থক। তাই নটিংহ্যামের জার্সিই পাঠিয়ে দিলেন বন্ধুর জন্য। তারপরেরটুকু ইতিহাসই। এখনো সাদা-কালো সেই ঐতিহ্যবাহী জার্সি পরেই খেলে আসছেন তুরিনের বুড়িরা।
তবে সবক্ষেত্রেই যে ব্রিটিশরাই অনুপ্রাণিত করে গেছে তা নয়। এর উল্টোটাও দেখা গিয়েছে। ব্ল্যাকপুল তাদের বিখ্যাত ট্যাঙ্গারিন জার্সিতে রুপান্তরিত হয়েছে নেদারল্যান্ডের জার্সি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে। ১৯২৩ সালে রেফারি আলবার্ট হারগ্রিভস ব্ল্যাকপুলকে ট্যাঙ্গারিন জার্সি পড়ে খেলতে পরামর্শ দেন, যিনি এর ঠিক কিছুদিন আগেই নেদারল্যান্ড ও বেলজিয়ামের একটি ম্যাচ পরিচালনা করতে গিয়ে নেদারল্যান্ডের জার্সি দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন।
ইতালিয়ান ক্লাবগুলোর রঙের পেছনের ইতিহাস আরো আকর্ষণীয় ও দার্শনিক। ইন্টার মিলানের কালো ও নীল জার্সি দ্বারা বোঝানো হয় রাত ও আকাশ। অন্যদিকে নগর প্রতিদ্বন্দ্বী এসি মিলানের কালো চিত্রিত করে প্রতিপক্ষের ভীতি আর লাল রং হচ্ছে ক্লাবের প্রতি খেলোয়াড়দের ভালোবাসা ও আবেগের প্রকাশ। অন্যদিকে নাপোলি তাদের হালকা নীল দিয়ে আজুরে অবস্থিত গালফ অফ নেপলসকে তুলে ধরে। তবে পালের্মোর রঙের ইতিহাস কিছুটা রসাত্মকও। তাদের গোলাপি ও কালো রং দ্বারা ক্লাবের অধারাবাহিক পারফরম্যান্স বোঝায়। যেখানে গোলাপি রং মানে মিষ্টি মধুর সময় আর কালো রং মানে খারাপ সময়।
অনেকসময় বিপক্ষ দলের সাথে জার্সি না মেলার জন্য চিরকালের জন্যই জার্সি বদলে ফেলেছে অনেক ক্লাব। ডাচ ক্লাব আয়াক্সের কথাই ধরা যাক। ১৯১১ সালে প্রথমবারের মতো ডাচ লিগে উত্তীর্ণ হয় আয়াক্স। প্রথম ম্যাচেই তাদের মুখোমুখি হয় স্পার্টা রটেরডাম। দুই দলেরই জার্সি ছিলো লাল-সাদা ডোরাকাটা। তাই সেদিনই জার্সি বদলে ফেলে আয়াক্স। ডোরাকাটার বদলে মাঝে একটি মাত্র লাল ডোরা ব্যবহার শুরু করে। তবে পিএসভি আইন্দহোফেনের লাল-সাদা জার্সির ধারণা আসে হুট করেই। সেই সময়ের পিএসভি চেয়ারম্যান জান উইলিয়াম হফকিস যখন জার্সি বিষয়ক মিটিংয়ে ছিলেন তখন তার সামনে ছিলো লাল রঙের রাপ্সবেরি জুস ও সাদা নোটপ্যাড। সেই সমন্বয়টি জুতসই মনে হয় চেয়ারম্যানের কাছে।
তবে জার্সি নির্বাচনে সবচেয়ে মজার ঘটনাটি সম্ভবত আর্জেন্টাইন ক্লাব বোকা জুনিয়র্সের। ১৯০৬ সালের ঘটনা। বোকা জুনিয়র্সের মুখোমুখি হয় আরেক আর্জেন্টাইন ক্লাব নটিংহ্যাম ডি আলমাগ্রো। কিন্তু দুই দলের জার্সি ছিলো একইরকম। তখন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় দুই দলের ম্যাচে যে জিতবে সে নিজের জার্সিটি রেখে দিতে পারবে। অন্যদিকে হেরে যাওয়া দলকে জার্সি পরিবর্তন করতে হবে। বোকা জুনিয়র্স সেই ম্যাচটি হেরে যায়। ক্লাবের কর্মকর্তারা সিদ্ধান্ত নেয় বন্দরে যে জাহাজটি সবার আগে ভিড়বে সেই জাহাজের পতাকার রঙের করা হবে পরবর্তী জার্সি। সবার প্রথমে সেদিন বন্দরে ভেড়ে সুইডিশ এক জাহাজ। সেই জাহাজের নীল-হলুদ রঙের আদলেই করা হয় বোকার জার্সি। যে নীল-হলুদ জার্সি পরে মাঠ মাতিয়েছেন ম্যারাডোনা, রিকুয়েমে, তেভেজসহ আরো অনেক বিখ্যাত ফুটবলার।
রঙিন জার্সির জন্য তার্কিশ লিগের চেয়ে জুতসই কোনো লিগ নেই। গ্যালতাসারেই কিংবা ফেনেরবাচ- সব ক্লাবেরই রয়েছে বেশ কিছু চোখে লাগার মতো রঙের মিশেল। গ্যালতাসারেই এর বিখ্যাত লাল-হলুদ জার্সি এসেছে ১৯০৮ সালে। ক্লাবটির প্রতিষ্ঠাতা আলি সামি ইয়েন ও তার দুই সতীর্থ ক্লাবের জন্য জার্সি খুঁজতে ইস্তাম্বুল শহরে নামেন। বেশ কিছু দোকানে ঘুরার পর এক দোকানের দুটি ফ্যাব্রিক ভালো লাগে তার। যার মধ্যে ছিলো চেরির মতো গাঢ় লাল। আরেকটি হলুদের সাথে কমলার মিশেল। দোকানদার যখন দুটি জার্সি একসাথে দেখাতে লাগলো তখন লাল আর হলুদের সমন্বয়টি মনে ধরে যায় আলি সামি ইয়েনের। পরবর্তীতে এটিই হয়ে ওঠে ক্লাবটির জার্সি।
ক্লাবের জার্সিতে বিভিন্ন ইতিহাস কিংবা মজার কাহিনী জড়িত থাকলেও দেশের জার্সিগুলো অনেকটা সোজাসাপ্টা। দেশের পতাকার রংই ধারণ করে জার্সিটি। ইংল্যান্ডের সাদা, স্পেনের লাল, ব্রাজিলের হলুদ-নীল কিংবা আর্জেন্টিনার আকাশী-সাদা সবগুলো রং পতাকা থেকে নেওয়া। তবে তারপরও কিছু দেশের জার্সির সাথে ঐতিহ্য ও ইতিহাস রয়েছে। যেমন- নেদারল্যান্ডের কমলা রংটি এসেছে তাদের জাতীয় রং থেকে। আবার জার্মানির কালো রঙের ব্যবহার এসেছে প্রুসিয়ানদের পতাকা থেকে। অস্ট্রেলিয়ার সোনালি কিংবা নিউ জিল্যান্ডের কালো রঙের আগমনও জাতীয় রং থেকে।
একটি ক্লাবের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে ক্লাব কিংবা দেশের জার্সির রং। আন্তর্জাতিক ফুটবলে যেমন হলুদ কিংবা আকাশী-সাদা মানেই ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার রণ, তেমনি ক্লাবগুলোতেও জার্সির রং অনেক বড় প্রভাব ফেলে। তাই সাধারণত বর্তমানে কোনো ক্লাবকেই জার্সির রং বদল করতে দেখা যায় না। শিকড় গজানোর সময়ের রংই ব্যবহার করে আসছে ক্লাব ও দেশগুলো, যেটি কি না তাদের শৌর্য ও ঐতিহ্যের প্রতীকও।
খেলাধুলার চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/
ফুটবল নিয়ে আরও জানতে পড়তে পারেন এই বইগুলোঃ
This Bangla article is about the history and incedents behind the color of the football jersies. Necessary references are hyperlinked in the articles.
Feature Image: Pinterest