Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

কেইলর নাভাস: সর্বদা প্রাপ্য সম্মান বঞ্চিত এক যোদ্ধা

৫ মে, ২০১৮। রিয়াল মাদ্রিদ নিজেদের মাঠ সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে বায়ার্নের সাথে সেমি ফাইনালের দ্বিতীয় লেগের ম্যাচে খেলছে। খেলছে বললে সত্যটায় সোহাগা লাগানো হয়। সত্য কথা বলতে ধুঁকছে। ওদিকে জিদান তথা রিয়াল মাদ্রিদের গোটা মৌসুমই তখন সেই ৯০ মিনিটের উপর নির্ভর হয়ে আছে। লিগে শোচনীয়ভাবে বার্সার কাছে হার আর লিগ কাপে আগেই অপ্রত্যাশিত বিদায়- সব মিলিয়ে সমস্ত প্রত্যাশা একই বিন্দুতে, চ্যাম্পিয়ন্স লিগ। রিয়ালের মাঠেও রিয়ালকে প্রায় তলোয়ারের ডগায় বসিয়ে রেখেছে বায়ার্ন। সেই ম্যাচে রিয়াল মাদ্রিদের ‘নাম্বার ওয়ান’ কেইলর নাভাস নিজের গোলবারকে এক প্রাচীর বানিয়ে রাখেন। ম্যাচশেষে সবাই যখন উল্লাসে ব্যস্ত, সেই আসল নায়ক তখন হাঁটুগেড়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ঈশ্বর বন্দনায় ব্যস্ত। আজ এমন একজন গোলরক্ষকের জীবনী দেখবো, যার গোটা জীবনই নাটকীয়তায় ভরা, চূড়ান্ত সাফল্যের পরেও যেন তিনি বিজয়ের কৃতিত্ব ভাগাভাগিতে নিষ্প্রভ।

প্রায় একা হাতে রিয়ালকে ফাইনালে তোলার পর কেইলর নাভাস; Image Source:The Australian

নাভাসের জন্ম কোস্টারিকার সান ইদিদ্রো নামে এক ছোট্ট শহরে। শহরটা ছোট হলেও এখানে একটি আন্তর্জাতিক স্টেডিয়াম ছিল। ফলে এই শহরে ফুটবল অনুরাগীর সংখ্যা একদম কম ছিল না। তাঁর পিতামহ ছিলেন প্রচন্ড ফুটবলানুরাগী। তিনিই পুরনো একটি মোটরবাইকে করে নিয়ে যেতেন স্টেডিয়ামে। প্রথম শহরের ক্লাবে নাভাসকে বাতিল করা হয়, বলা হয় এমন শারীরিক গঠন নিয়ে কেউ ফুটবলার হতে পারেন না। ভাগ্যের কী লীলা! এই ক্লাবেরই বর্তমান নাম কেইলর নাভাসের নামে!

যা-ই হোক, কোস্টারিকান লিগে মোটামুটি খেলছিলেন নাভাস। এক মৌসুম পর বেশ নাম ডাকও হয়ে যায় তাঁর। উত্তর আমেরিকার চ্যাম্পিয়ন্স লিগকে বলা হয় কনকাকাফ কাপ। নাভাসের ক্লাব যখন এই কাপ জেতে, তখন এক এজেন্সি মারফত স্পেনের এক ক্লাব পেয়ে যান তিনি। দ্বিতীয় বিভাগের এমন এক দলের হয়ে খেলা শুরু করেন স্পেনে, যে দল মৌসুম শেষে হলো ২০তম! কিন্তু নিজের পারফর্মেন্সের বদৌলতে নাভাস সুযোগ পেয়ে যান মূল লিগের ক্লাব লেভান্তেতে।

লেভান্তে মূলত নাভাসকে কিনেছিল তাদের বিকল্প গোলরক্ষক হিসেবে। কিন্তু নাভাসের ক্যারিয়ারটাই এমন যে, কেউ তাঁকে প্রথম পছন্দ হিসেবে না নিলেও যোগ্যতা আর ভাগ্য তাঁকে বরাবরই তাঁর প্রাপ্য সাফল্য দিয়েছে। মোটামুটি বছরখানেক বেঞ্চে বসে থেকে গোটা পাঁচেক মাত্র ম্যাচ খেললেন। লেভান্তেও তাঁকে নিয়ে এত সন্তুষ্ট না। পাঠানো হলো দ্বিতীয় বিভাগের গুস্তাভো মুনুয়া নামের এক ক্লাবে। দুই বছর সেখানে ছিলেন তিনি। নীরবে উত্থান হচ্ছিল নাভাসের। লেভান্তের মূল গোলরক্ষক চলে যাওয়ার পর ক্লাব তাঁকে ধার থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। আর্থিক অবস্থা সঙ্গিন বিধায় নতুন গোলরক্ষক কেনার সামর্থ্য নেই ক্লাবের, আর নাভাসও মোটামুটি ভালই খেলছিলেন ধারে- এ সব বিবেচনায় লেভান্তে ২০১৩-১৪ মৌসুমের জন্য ভরসা রাখল তাঁর উপর। প্রত্যেক সফল ব্যক্তির জীবনেই একটা ব্রেকথ্রু থাকে। এই মৌসুমটিই ছিল নাভাসের টার্নিং পয়েন্ট।

কেইলরের উত্থানটা ছিল দারুণ নাটকীয়; Image Source:beinsports.com

লা লিগায় শুরু হয় নাভাসের প্রদর্শনী। সেই মৌসুমে এককভাবে সবচেয়ে বেশি সেভ করেন নাভাস, যদিও তিনি খেলছিলেন দুর্বল এক ক্লাবের হয়ে, যাদের রক্ষণ দুর্বল। গোলরক্ষককে বলা হয় ‘লাস্ট লাইন অব ডিফেন্স’। লেভান্তে রক্ষণভাগের এই শেষ লাইনই হয়ে ওঠে আসল শক্তিতে। সেই মৌসুমে স্প্যানিশ লিগের সেরা গোলরক্ষক এর তালিকায় উঠে যায় তাঁর নাম। এরপর শুরু হয় ব্রাজিল বিশ্বকাপ। বিশ্বকাপ এমন এক মঞ্চ, যেখানে অখ্যাতরা খ্যাতি পায়, খ্যাতিমানরা পরিণত হয় খলনায়কে। নাভাসের জন্য এটা হয়ে আসে এক সুবর্ণ সুযোগ হয়ে। উরুগুয়ে ম্যাচ দিয়ে তাঁর বিশ্বকাপ শুরু। সবাইকে অবাক করে দিয়ে উরুগুয়েকে ৩-১ গোলে হারায় কোস্টারিকা। সেই ম্যাচে বেশ কিছু অসাধারণ সেভ করে দলকে অবাক করে দেন নাভাস। গ্রুপপর্বের বাকি দুই ম্যাচে আর কোনো গোল হজম করেননি নাভাস। কোস্টারিকার মতো দলের গোলরক্ষকের জন্য এটা বিশাল ব্যাপার।

শেষ ১৬-তে নাভাস গ্রিসের সাথে অতিমানবিক এক প্রদর্শনী দেন। পেনাল্টি সেভ থেকে শুরু করে অলরাউন্ডিং এক খেলায় কোস্টারিকাকে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো তোলেন বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে। হল্যান্ডের সাথে আর শেষরক্ষা হয়নি। তবুও রোবেন, পার্সিদের ১২০ মিনিট গোলবঞ্চিত রেখেছিলেন। টাইব্রেকারে আর পেরে ওঠেননি। কিন্তু করে ফেলেন এক রেকর্ড। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোনো গোলরক্ষক টানা তিনবার ম্যান অব দ্য ম্যাচ পুরষ্কার জিতে নেন। বিশ্বকাপের নায়ক জনঢলের মধ্যেই দেশে ফেরেন। কিন্তু সবচেয়ে বড় আশ্চর্যের ব্যাপারটা হয়ে এলো তাঁর কাছে, যখন তিনি শুনলেন, তাঁর শহরের স্টেডিয়ামের নামকরণ করা হয়েছে তাঁর নামে। অথচ এই স্টেডিয়াম থেকেই একদিন ‘অযোগ্য’ বলে ঘোষিত হয়েছিলেন!

এরপর ডাক এলো রিয়াল মাদ্রিদ থেকে। লেভান্তে কখনো ভাবেনি যে নাভাস এত ভাল হয়ে উঠবেন, তাই মাত্র ১০ মিলিয়নেই রিয়াল তাঁকে পেয়ে যায়। রিয়ালও তাঁকে কিনেছিল মূলত ক্যাসিয়াসের বিকল্প হিসেবে। প্রথম মৌসুমও কাটে বেঞ্চে। এর পরের মৌসুমে ক্যাসিয়াস মাদ্রিদ ছাড়েন। এবার রিয়ালের নজর পড়লো ডি হেয়ার উপর। আর যা-ই হোক, রিয়ালের মতো ক্লাব নাভাসকে নিয়ে তুষ্ট থাকবে এটা ভাবা যায় না! ট্রান্সফার মার্কেটের শেষ দিন সব কিছু সম্পন্ন। নাভাস তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে বসে আছেন এয়ারপোর্টে, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে যোগ দেবেন তিনি, আর উল্টো দিক থেকে ডি হেয়া আসবেন রিয়ালে। সেই ট্রান্সফার আটকে যায় কাগজের জটিলতায়। এয়ারপোর্টে বসে থাকা নাভাস কান্নায় ভেঙে পড়লেন। কে জানে এটা লজ্জার কান্না নাকি খুশির?

অপমানজনক দলবদল ব্যর্থ হবার পরদিনই পেনাল্টি ঠেকিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন নাভাস; Image Source:Stuff.co.nz

উপায়ান্তর ছিল না, দলে আর কেউ নেইও তেমন, তাই নাভাসকেই রিয়াল মাদ্রিদ বানাল মূল গোলরক্ষক। এই ব্যর্থ ট্রান্সফারের পরের দিনই রিয়ালের ঘরের মাঠে ম্যাচ। ৫-০ তে উড়িয়ে দেয় রিয়াল এটলেটিকো বিলবাওকে। মারাত্মক কিছু সেভ করেন নাভাস। ম্যাচের শেষদিকে যখন নাভাস একটি পেনাল্টি ঠেকিয়ে দিয়ে চিরাচরিতভাবে আকাশের দিকে তাকালেন, তখন গোটা স্টেডিয়াম দাঁড়িয়ে তাঁকে অভিবাদন জানালো। শুরু হলো মাদ্রিদে তাঁর অধ্যায়।

সেই মৌসুমে রিয়াল চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতে। সেই জয়ে ১১ ম্যাচে ৯ ম্যাচেই কোনো গোল হজম করেননি নাভাস। রামোস-ভারানেদের সাথে তাঁর রসায়ন জমে ওঠে। নাভাসকে কেউ বলতে পারবেন না যে তিনি ‘নির্ভুল’। মাঝেমাঝেই ভুল করেন, অনেকগুলো ভুল হাস্যকর, কিন্তু ঠিক একইভাবে সেই ভুলগুলো শুধরে দিয়ে এমন কিছু সেভ করেন যেগুলো বাঁধিয়ে রাখার মতো। পরের মৌসুমে লিগ ও চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতে রিয়াল। আর গত মৌসুমে খুব বিশেষভাবে বলতে গেলে রিয়ালের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের অন্যতম নায়ক তিনিই। জুভেন্টাস, পিএসজি বা বিশেষ করে বায়ার্নের সাথে বিশ্ব দেখেছিল অতিমানব এক নাভাসকে, যে নাভাসের সাথে নয়ের বা স্টেগান যে কেউই হার মানবে।

নাভাস রিয়ালের সমর্থকদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। কিন্তু এই নাভাসও দর্শকদের দুয়ো পেয়েছেন। কারণ লিগের নাভাস সত্যিই মাঝে মাঝে নিষ্প্রভ, কিন্তু চ্যাম্পিয়ন্স লিগের নাভাস বিশ্বসেরাদের একজন। কীভাবে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সুর বেজে উঠলেই তাঁর মধ্যে পরিবর্তন চলে আসে এ আসলেই এক রহস্য। নাভাস অনবদ্য, কারণ প্রয়োজনের সময় তিনি সত্যিই ভাস্বর। যেবার রিয়াল লিগ জিতলো, লিগের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তাঁর সেভগুলো ছিল অসাধারণ। কিন্তু যখনই রিয়াল লিগ দৌড় থেকে দূরে সটকে যায়, নাভাসের পারফর্মেন্সও তখন যেন মিইয়ে যায়। কোনো এক শনিবার লিগের কম গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে নাভাস হাস্যকর ভুল করলেও তিনদিন পর চ্যাম্পিয়ন্স লিগের জুভেন্টাসের বিপক্ষে ম্যাচেই চোখ ধাঁধানো পারফর্মেন্স- এটাই আসলে নাভাসের সারমর্ম। যে গোলরক্ষককে রিয়াল রাখতেই চায়নি, কাগজের ঝামেলার জন্য সেই গোলরক্ষকের হাত ধরেই রিয়ালের ফুটবল ইতিহাসের সেরা রেকর্ড, টানা তিন চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়!

টানা তিনবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের রেকর্ড আর কোন গোলরক্ষক আছে? Image Source: The Tico Times

অথচ নাভাস ক্লাবে স্বল্পনন্দিত। রোনালদো-বেঞ্জেমা-রামোসদের অর্ধেক বন্দনাও তাঁর কপালে জোটে না, কিন্ত একবার সেই চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ম্যাচগুলার হাইলাইটস দেখুন, দেখা যাবে আসলে নাভাস কী! হ্যাঁ, চাইলেই ২০১৭-তে বায়ার্নের সাথে তাঁর করা হাস্যকর ভুলে হজম করা গোল দেখানো যায়, কিন্তু এরই ঠিক মিনিট ছয়েক পর ম্যাচ বাঁচানো অসাধারণ সেভও তাঁকে একইভাবে মহিমান্বিত করে। শহুরে ক্লাবে নাভাস ছিলেন ‘অযোগ্য’, লেভান্তেতে নাভাস ছিলেন ‘ঠেকা কাজ’ চালানোর লোক, আর রিয়ালে ছিলেন কেবলই এক ‘সস্তা বিকল্প’। অথচ এই ২০১৮-তে দাঁড়িয়ে এসে নাভাস সমসাময়িক গোলকিপারদের মধ্যে সফলতম, আধুনিক ইতিহাসের একমাত্র গোলরক্ষক, যিনি টানা ৩টি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতেন। ব্যক্তিগত জীবনে প্রচন্ড ধার্মিক নাভাস বাস্তবেই যেন ঈশ্বরের কোলে শুয়ে আছেন। প্রাপ্য সম্মান পান কি না, তা তর্কসাপেক্ষ, কিন্তু প্রাপ্য সাফল্য ঠিকই তাঁর করায়ত্ত হয়েছে।

Keylor Navas is a Costa Rican goalkeeper who plays for Real Madrid. This Bangla article is on the glorious career of Keylor Navas. Necessary references have been hyperlinked.

Feature Image: Eurosport

Related Articles