Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মরিনহো এবং বার্সেলোনা: বন্ধু তুমি, শত্রু তুমি

মাঠের ভিতরে কিংবা বাইরে – দুই জায়গায়ই আলোচিত এক নাম জোসে মরিনহো। দুর্দান্ত সব ট্যাকটিকস দিয়ে প্রতিপক্ষকে কাবু করার পাশাপাশি ডাগআউটে তার আক্রমণাত্মক ভঙ্গি বহুবার আলোচনার জন্ম দিয়েছে। আর খেলাশেষে মরিনহোর প্রেস ব্রিফিং এতটাই আলোচনার খোরাক যোগায় যে, সাংবাদিকরা তার সাক্ষাৎকার নেয়ার জন্য মুখিয়ে থাকেন। শেষ কয়েক বছর সেভাবে সাফল্য না পেলেও পুরো ক্যারিয়ারজুড়ে যেভাবে ইতিহাস গড়েছেন, তাতে তিনি ইতঃমধ্যেই ইতিহাসের এক অংশ হয়ে গেছেন। স্বঘোষিত এই স্পেশাল ওয়ানের কোচ হওয়ার রাস্তাটা অবশ্য মসৃণ ছিল না, বেশ কিছু বছর কাজ করেছিলেন অনুবাদক হিসেবে।

শুরুর দিকে বড় একটা সময় বার্সেলোনায় কাটিয়েছিলেন মরিনহো, ঐতিহ্যবাহী এই কাতালান ক্লাবে কাজ করাটা তার ক্যারিয়ারে বেশ বড় প্রভাব রেখেছিল। অথচ পরবর্তীতে বার্সেলোনার বন্ধু হিসেবে দেখা যায়নি তো বটেই, উপরন্তু বার্সেলোনার বিপক্ষেই তাকে বেশি সরব হতে দেখা গেছে! বিশেষ করে রিয়াল মাদ্রিদের কোচ থাকাকালীন ডাগআউটে বার্সেলোনার কোচিং স্টাফদের সাথে মরিনহোর উত্তপ্ত বাকবিতণ্ডা মিডিয়ায় বেশ আলোচনার জন্মই দিয়েছিল বৈকি।

নিজের পুরনো ক্লাবের সাথে মরিনহোর এমন দা-কুমড়ো সম্পর্কের কারণটা ঠিক কী? জানতে হলে অতীতের বেশ কিছু কথা জানতে হবে। 

বর্তমান সময়ের অন্যতম সেরা কোচ জোসে মরিনহো; Photo Credit: Dave Winter / Icon Sport

পেশাদার ক্লাবের সাথে মরিনহোর পথচলা শুরু হয় ১৯৯২ সালে। পর্তুগিজ ক্লাব স্পোর্টিং লিসবনের দায়িত্ব নেন বিখ্যাত ইংলিশ কোচ ববি রবসন। একজন ইংরেজের পক্ষে পর্তুগিজ ভাষা শেখা কিছুটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার, তাই রবসনকে সাহায্য করার জন্য বিভিন্ন ভাষায় পারদর্শী জোসে মরিনহোকে তার অনুবাদক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। অবশ্য শুধু ভাষায় পারদর্শিতার কারণেই মরিনহোকে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল, এমনটা বললে ভুল হবে। বেশ কিছু ক্লাবে স্কাউটের দায়িত্ব পালন করা মরিনহোর ফুটবলজ্ঞানও এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছিল।

রবসনের অধীনে লিগে বেশ ভালোই খেলছিল স্পোর্টিং লিসবন। কিন্তু ১৯৯৩ সালের উয়েফা কাপে ক্যাসিনো সালজবার্গের কাছে হারার কারণে তাকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। এরপর আরেক পর্তুগিজ ক্লাব পোর্তোর দায়িত্ব নেন রবসন, এবার অবশ্য অনুবাদকের বদলে মরিনহোকে সহকারী কোচ হিসেবে যুক্ত করেন তিনি। মূলত মরিনহোর স্কাউটিং দক্ষতায় মুগ্ধ হয়েই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। রবসন-মরিনহো জুটি বেশ জমে উঠেছিল, ফুটবলের বিভিন্ন ট্যাকটিকস নিয়ে রবসনের সাথে আলোচনা করে দীর্ঘ সময় পার করতেন মরিনহো। রবসনের আক্রমণভাগের ট্যাকটিকস দুর্দান্ত হলেও রক্ষণভাগ সামলানোর ট্যাকটিকস অতটা ভালো ছিল না, সেদিকের দায়িত্ব মরিনহোর কাঁধেই ছিল। 

পোর্তোর কোচ থাকাকালীন সহকারী মরিনহোকে নিয়ে প্রেস কনফারেন্সে রবসন; Photo by Steve Morton/EMPICS via Getty Images

১৯৯৬ সালে বার্সেলোনার মতো বড় ক্লাবের কোচ হওয়ার প্রস্তাব পান বব রবসন। মরিনহোর সাথে পরামর্শ করে বার্সার প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান তিনি। বার্সেলোনা অবশ্য রবসনের সাথে মরিনহোকে ক্লাবে আনার ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহী ছিল না। ক্লাবের হয়ে দীর্ঘদিন খেলা রোমান অ্যালেক্সাঙ্কোকে রবসনের সহকারী হিসেবে নিয়োগ দেয় বার্সেলোনা। তবে চার বছরের সঙ্গী মরিনহোকে ছেড়ে দেয়ার ব্যাপারে রবসন রাজি ছিলেন না, তাই মরিনহোকে কোচিং স্টাফের একজন হিসেবেই দলের সাথে রেখে দেন তিনি। মরিনহোর পদ নিয়ে বেশ একটা ধোঁয়াশা ছিল। বাইরের সবার কাছে তিনি ছিলেন একজন সাধারণ অনুবাদক, কিন্তু ক্লাবের ভিতরে একজন অনুবাদকের চেয়ে রবসনের সহকারী হিসেবেই বেশি সক্রিয় ছিলেন মরিনহো। এ ব্যাপারে বার্সার একজন সিনিয়র স্টাফ বলেছিলেন,

‘অনুবাদক হিসেবে বার্সেলোনায় এলেও দলের সহকারী কোচের দায়িত্বটা মরিনহোই পালন করতেন। প্রথম কয়েকটি প্রেস কনফারেন্সের পর এ ব্যাপারটা সবার কাছেই পরিষ্কার হয়ে গেছিল। রবসনের কথাগুলো হুবহু অনুবাদ করার পরিবর্তে মরিনহো সেখানে নিজের মতামত জুড়ে দিতেন, এবং রবসনকে রক্ষা করার জন্য সাংবাদিকদের সাথে তর্কে জড়িয়ে পড়তেন।’

বার্সেলোনায় রবসনের পূর্বসূরি ইয়োহান ক্রুয়েফ দলটিকে এমন দারুণভাবে গুছিয়েছিলেন যে, রবসনদের কাজ কিছুটা হলেও সহজ হয়ে গেছিল। অবশ্য একটা সমস্যা ছিল, কোচ হিসেবে বার্সা ম্যানেজমেন্টের প্রথম পছন্দ ছিলেন তৎকালীন আয়াক্স কোচ লুইস ফন হাল, তাকে পেলে রবসনকে ছাঁটাই করার সিদ্ধান্ত নিতে পারে বার্সেলোনা – এ সংশয়ের কথাটা রবসন বেশ ভালোভাবেই জানতেন।

অবশ্য এ অনিশ্চয়তা মরিনহোর ওপর তেমন প্রভাব ফেলেনি, বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণের কারণে তিনি বার্সার তারকা খেলোয়াড়দের সাথে বেশ ভালোভাবেই মিশে গিয়েছিলেন। দু’জনেরই মাতৃভাষা পর্তুগিজ হওয়ায় সে সময়ের বিশ্বসেরা খেলোয়াড় রোনালদো লিমা’র থেকে সেরা পারফরম্যান্স বের করে আনার ক্ষেত্রে মরিনহো বেশ বড় ভূমিকা রেখেছিলেন। তাছাড়া তৎকালীন বার্সা অধিনায়ক পেপ গার্দিওলার (বর্তমান সময়ের অন্যতম সেরা কোচ) সাথেও মরিনহোর রসায়ন বেশ জমে উঠেছিল। খেলা শুরুর আগে প্রতিপক্ষের শক্তিমত্তা আর দুর্বলতা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করতেন মরিনহো – এ ব্যাপারটা বার্সার অধিকাংশ খেলোয়াড়কেই আকৃষ্ট করেছিল। 

কাপ উইনার্স কাপের শিরোপা নিয়ে উল্লসিত রোনালদো ও নিজের গুরু রবসনের সাথে মরিনহো; Photo Credit: Alain Gadoffre / Onze / Icon Sport 

বার্সেলোনায় নিজের প্রথম মৌসুমে স্প্যানিশ কাপ, সুপার কাপ ও ইউরোপিয়ান কাপ উইনার্স কাপ – এ তিনটি শিরোপা জিতেছিলেন বব রবসন। কিন্তু লিগ জিততে না পারায় তাকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। তবে এ ব্যর্থতার চেয়ে ফন হালকে কোচ হিসেবে পাওয়াটাই হয়তো বড় কারণ হিসেবে কাজ করেছিল। রবসন চলে গেলেও মরিনহোকে বার্সেলোনায় থাকার পরামর্শ দেন এবং ফন হালের কাছে মরিনহোর ব্যাপারে সুপারিশ করে যান। মরিনহোর একরোখা স্বভাব নজরে আসা সত্ত্বেও ট্যাকটিকসের ব্যাপারে এ পর্তুগিজের অসাধারণ জ্ঞানে মুগ্ধ হয়ে নিজের সহকারী হিসেবে রেখে দেন ফন হাল।

মরিনহোর কাজে মুগ্ধ হয়ে তাকে আরো বেশি সুযোগ দিতে থাকেন ফন হাল, বড় ম্যাচের আগে প্রতিপক্ষকে স্কাউটিং করার জন্য মরিনহোকে একাই পাঠাতেন তিনি। এমনকি বেশ কিছু প্রীতি ম্যাচে মরিনহোকে কোচিং করানোর সুযোগও দিয়েছিলেন এই ডাচ কোচ, সেদিক থেকে বার্সেলোনাই ছিল কোচ হিসেবে মরিনহোর প্রথম ক্লাব! বার্সার কোচ হিসেবে ফন হালের প্রথম দুই মৌসুম অবশ্য ভালোই কেটেছিল, দু’টি লিগ শিরোপা জয়ের পাশাপাশি একটি কোপা দেল রে’র শিরোপাও জিতেছিল তার দল। কিন্তু চ্যাম্পিয়নস লিগ জিততে ব্যর্থ হওয়ায় ফন হালের ওপর চাপ দিনদিন বেড়েই যাচ্ছিল। 

লুইস ফন হালের সাথে জোসে মরিনহো; Photo by Jon Buckle – PA Images via Getty Images

এদিকে নিজের গুরু রবসনকে তড়িঘড়ি করে বিদায় দেয়ায় বার্সা ম্যানেজমেন্টের প্রতি আগে থেকেই চটে ছিলেন মরিনহো, ফন হালের সাথে ফুটবলীয় দর্শন নিয়েও তার দ্বন্দ্ব চলছিল। তাছাড়া মরিনহো তখন মূল কোচ হওয়ার প্রস্তাবও পাচ্ছিলেন, তাই সব মিলিয়ে ২০০০ সালে বার্সেলোনা ছেড়ে দেন মরিনহো। পর্তুগিজ ক্লাব বেনফিকার কোচ হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে প্রধান কোচ হিসেবে নিজের ক্যারিয়ার শুরু করেন মরিনহো।

এরপরের গল্পটা তো মোটামুটি সবারই জানা, ২০০৪ সালে পোর্তোর মতো মাঝারি মানের দলকে চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতে রীতিমতো তাক লাগিয়ে দেন মরিনহো। এরপর চেলসির দায়িত্ব নিয়ে দু’বার ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা জিতে নেন। তবে কোনো ক্লাবেই সেভাবে থিতু হতে পারতেন না মরিনহো, কয়েক মৌসুম পরেই ম্যানেজমেন্টের সাথে তার দূরত্ব সৃষ্টি হতো। এ কারণে চেলসির কোচ হিসেবে তিন মৌসুমের বেশি টিকতে পারেননি। এখান থেকে অব্যাহতি পাওয়ার পরই আবারো নিজের পুরনো ক্লাব বার্সেলোনায় ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে একটি সম্ভাবনা তৈরি হয়। 

পোর্তোর হয়ে চ্যম্পিয়নস লিগ জয়ের পর মরিনহো; Matthew Ashton/EMPICS via Getty Images)

২০০৮ সালে ফ্রাঙ্ক রাইকার্ডকে বিদায় করে নতুন কোচের সন্ধানে ছিল বার্সেলোনা, তখন কোচ হওয়ার দৌড়ে সবচেয়ে এগিয়ে ছিলেন জোসে মরিনহো। এ ব্যাপারে তৎকালীন বার্সেলোনা প্রেসিডেন্ট হুয়ান লাপোর্তা বলেছিলেন,

‘বোর্ড মেম্বারদের অনেকেই মরিনহোকে কোচ হিসেবে নিয়োগ দেয়ার ব্যাপারে আগ্রহী ছিল, এ কারণে মরিনহোর সাথে একটি বৈঠকের আয়োজন করা হয়েছিল। ৪-৩-৩ ফর্মেশনে তিনি কীভাবে বার্সার খেলোয়াড়দের খেলাবেন, এ ব্যাপারটি পরিষ্কার করার জন্য তিনি পাওয়ারপয়েন্ট স্লাইডও তৈরি করে এনেছিলেন।’ 

তবে বার্সেলোনা কিংবদন্তি কোচ ইয়োহান ক্রুয়েফের হস্তক্ষেপে সব হিসাবনিকাশ পাল্টে যায়। তার মতে, বার্সা কোচ হিসেবে এমন কাউকেই নিয়োগ দেয়া উচিত, যিনি ক্লাবটির ঐতিহ্য ও দর্শনকে মনেপ্রাণে ধারণ করেন। এক্ষেত্রে বেশ কিছুটা পিছিয়ে ছিলেন মরিনহো। আসলে বার্সায় চার বছর কাটিয়ে গেলেও পরবর্তী সময়ে মরিনহোর ফুটবল দর্শনের সাথে বার্সার ফুটবল দর্শনের বিশাল ব্যবধান তৈরি হয়ে গিয়েছিল। ক্রুয়েফের বার্সা সবসময়ই সুন্দর ও আক্রমণাত্মক ফুটবলে বিশ্বাসী ছিল, সেখানে পোর্তো ও চেলসিকে নিয়ে মরিনহো যা সাফল্য পেয়েছিলেন, তার মূলমন্ত্র ছিল রক্ষণাত্মক ফুটবল। তাই সবকিছু মিলিয়ে তৎকালীন বার্সেলোনা ‘বি’ দলের কোচ পেপ গার্দিওলাকে প্রধান কোচ হিসেবে নিয়োগ দেয়ার ব্যাপারে পরামর্শ দেন ক্রুয়েফ, এবং বার্সা ম্যানেজমেন্টও সে পরামর্শ মেনে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

সবকিছু ঠিক হয়ে যাওয়ার পরও শেষ মুহূর্তের এ পটবদল হয়তো মরিনহোর মনে কিছুটা প্রভাব রেখেছিল। ২০০৯-১০ মৌসুমের চ্যাম্পিয়নস লিগে বার্সাকে টপকে ইন্টার মিলানকে ফাইনালে নেয়ার পর মরিনহোর উচ্ছ্বাসের মাত্রা দেখলে এমনটা মনে হওয়াই স্বাভাবিক। অবশ্য এতে কিছু বার্সা ভক্তেরও দায় আছে। চ্যাম্পিয়নস লিগের ম্যাচ খেলতে যতবারই মরিনহো বার্সার মাঠে গেছেন, ততবারই নানা ধরনের বিদ্রুপ তাকে সহ্য করতে হয়েছে। আর ২০১০ সালে মরিনহো রিয়াল মাদ্রিদের কোচ হওয়ার পর যেন ষোলকলা পূর্ণ হয়ে যায়। এভাবেই বার্সার ঘরের মানুষ থেকে এক পর্যায়ে ক্লাবটির শত্রুতে পরিণত হন জোসে মরিনহো। 

This article is in Bangla language. It's about a strange transformation of relationship between Jose Mourinho and FC Barcelona. References are hyperlinked inside the article.

Featured Image: Four Four Two

Related Articles