Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বিশ্বকাপে আন্ডারডগ দলগুলোর সাফল্যের সাতকাহন

বিশ্বকাপ ফুটবলকে বলা হয় দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ, বিশ্বকাপ এলে এর উন্মাদনার জোয়ার বিশ্বের প্রায় সমস্ত দেশেই ছড়িয়ে যায়। বিশ্বকাপের বর্তমান ফরম্যাটে ৩২টি দল বিশ্বকাপের চূড়ান্ত আসরে অংশ নিতে পারে। আর সব আসর মিলিয়ে হিসাব করলে সব মিলিয়ে মোট ৭৯টি দল বিশ্বকাপে অংশ নিয়েছে (এই বিশ্বকাপে অভিষেক হতে যাওয়া পানামা ও আইসল্যান্ড সহ)। কিন্তু এই ৭৯টি দলের মধ্যে চ্যাম্পিয়ন হতে পেরেছে মাত্র ৮টি দল! এর মধ্যে বেশ কিছু দেশ দল হিসেবে বেশ সমীহ জাগানিয়া হলেও বিশ্ব আসরে কখনোই চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি, যেমন- নেদারল্যান্ডস।

এছাড়া প্রতি আসরে বেশ কিছু দল থাকে যাদের ইতিহাস অতটা সমৃদ্ধ না হলেও একঝাঁক ভালো প্লেয়ার হুট করে পেয়ে যাওয়ায় তারাও বিশ্বকাপ জয়ের দাবীদার হয়ে ওঠে। এসব দলকে সাধারণত ডার্কহর্স হিসেবেই অভিহিত করা হয়, যেমন- এই আসরের বেলজিয়াম। এসব দলের বাইরে প্রতি বিশ্বকাপেই এমন কিছু দল থাকে যাদের ফুটবলের ইতিহাস অতটা সমৃদ্ধ নয়, আবার দল হিসেবে তারা অতটা শক্তিশালীও নয়। এসব দলকে সাধারণত আন্ডারডগ হিসেবেই অভিহিত করা হয়। বলা বাহুল্য, প্রতি বিশ্বকাপে পরাশক্তি ও ডার্ক হর্স – এই দুই ধরনের দলের যোগফলের চেয়ে আন্ডারডগ দলের সংখ্যাটাই বেশি থাকে। তবে এই আন্ডারডগ দলগুলোকে হেলাফেলা করার কিন্তু কোনো সুযোগ নেই। এসব দল হয়তো কখনো বিশ্বকাপ জেতেনি, কিন্তু বেশ কিছু আসরে এমন চমক দেখিয়েছিল যা রূপকথার গল্পকেও হার মানায়। আজ আমরা এসব আন্ডারডগ দলগুলোর সাফল্য নিয়েই জানবো, জানবো কিভাবে এসব দল বিভিন্ন পরাশক্তির স্বপ্ন ভেঙ্গেছিল।

১৯৫৮ বিশ্বকাপ: নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের চমক

১৯৫৮ বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ খেলতে আসে নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড। সেসময়ে সবচেয়ে কম জনসংখ্যার দেশ হিসেবে কোয়ালিফাই করার রেকর্ড গড়ে দেশটি। ছোট্ট এই দেশটি প্রথমবার অংশ নিয়েই চমকে দেয় পুরো বিশ্বকে। সেবার গ্রুপ ১ এ নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের প্রতিপক্ষ ছিল আগের আসরের চ্যাম্পিয়ন তৎকালীন পশ্চিম জার্মানি, চেকোস্লোভাকিয়া ও আর্জেন্টিনা। এই তিন বড় দলের মাঝে নর্দান আয়ারল্যান্ড খড়কুটোর মতো উড়ে যাবে এটাই সবাই ভেবেছিলো। কিন্তু নিজেদের প্রথম ম্যাচেই চেকোস্লোভাকিয়াকে ১-০  গোলে হারিয়ে দেয় তারা। পরের ম্যাচে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ৩-১ গোলে হারলেও গ্রুপপর্বের শেষম্যাচে পশ্চিম জার্মানির সাথে ২-২ গোলে ড্র করায় তাদের পয়েন্ট ও চেকোস্লোভাকিয়ার পয়েন্ট সমান হয়।

১৯৫৮ বিশ্বকাপে নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড দল; Image Source : World Soccer

সেই সময়ে পয়েন্ট সমান হলে প্লে-অফ খেলে নির্ধারিত হতো কারা পরের রাউন্ডে যাবে। প্লে অফে পিটার ম্যাকপারল্যান্ডের জোড়া গোলে চেকোস্লোভাকিয়াকে অতিরিক্ত সময়ে ২-১ গোলে হারিয়ে প্রথমবার অংশ নিয়েই কোয়ার্টার ফাইনালের টিকিট পেয়ে যায় নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড। তবে কোয়ার্টার ফাইনালে তারা আর প্রতিরোধ গড়তে পারেনি। ফ্রান্সের কাছে ৪-০ গোলে হেরে থামে তাদের স্বপ্নযাত্রা। এরপর জর্জ বেস্টের মতো তারকার উত্থান হলেও নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড সেই ১৯৫৮ বিশ্বকাপের সাফল্যকে আর ছাড়িয়ে যেতে পারেনি।

১৯৬৬ বিশ্বকাপ: পর্তুগাল ও উত্তর কোরিয়ার ইতিহাস সৃষ্টি

১৯৬৬ বিশ্বকাপে একটি নয়, দুটি আন্ডারডগ দল অঘটনের জন্ম দেয়। একটি হচ্ছে পর্তুগাল ও অপরটি উত্তর কোরিয়া। দুই দলই সেবার প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ খেলতে এসেছিলো। পর্তুগাল ছিলো গ্রুপ ৩ এ যেখানে তাদের সঙ্গী ছিল আগের দুই আসরের চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল, সেসময়ের ইউরোপিয়ান পাওয়ার হাউজ হাঙ্গেরি ও বুলগেরিয়া। প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ খেলতে এলেও পর্তুগাল দলে একজন ইউসেবিও থাকায় সেবার শুরু থেকেই পর্তুগালকে সমীহ করা হচ্ছিলো। নিজেদের প্রথম ম্যাচেই হাঙ্গেরিকে ৩-১ গোলে হারিয়ে নিজেদের শক্তিমত্তার জানান দেয় পর্তুগাল। পরের ম্যাচে বুলগেরিয়াকে ৩-০ গোলে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনাল মোটামুটি নিশ্চিত করে ফেলে তারা। তবে বড় চমক অপেক্ষা করছিলো এরপরের ম্যাচে। ইউসেবিওর জোড়া গোলে ব্রাজিলকে ৩-১ গোলে হারিয়ে আগের দুই আসরের চ্যাম্পিয়নকে গ্রুপপর্বেই বিদায় করে দিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে চলে যায় তারা, যেখানে তাদের জন্য অপেক্ষা করছিলো টুর্নামেন্টের আরেক চমক উত্তর কোরিয়া।

১৯৬৬ বিশ্বকাপের পর্তুগাল দল; Image Source : PES

গ্রুপ ৪ এ ইতালির মতো পরাশক্তিকে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালের টিকিট কেটেছিল উত্তর কোরিয়া। চমক জাগানিয়া দুই দলের লড়াইটাও ছিল বেশ নাটকীয়। খেলার ২৫ মিনিটের মধ্যে পার্ক সিউং জিন, লি ডং উন ও ইয়াং সিউং কুকের গোলে ৩-০ গোলে এগিয়ে যায় উত্তর কোরিয়া। এরপরেই শুরু হয় ইউসেবিও ম্যাজিক, ২৭-৫৯ মিনিটের মধ্যে ইউসেবিও একাই চার গোল করলে ৩-০ তে পিছিয়ে থেকেও উলটো ৪-৩ গোলে এগিয়ে যায় পর্তুগাল। পরে ৮০ মিনিটে আগুস্তোর গোলে ৫-৩ গোলের জয়ে সেমিফাইনালে চলে যায় পর্তুগাল আর দুর্দান্ত খেলেও উত্তর কোরিয়ার জয়যাত্রা কোয়ার্টার ফাইনালেই থেমে যায়।

উত্তর কোরিয়ার বিপক্ষে সেই ঐতিহাসিক কোয়ার্টার ফাইনালে গোল করছেন ইউসেবিও; Image Source : Sportsnet

সেমিফাইনালে অবশ্য পর্তুগাল আর পেরে ওঠেনি। ইংল্যান্ডের কাছে ২-১ গোলে হেরে যায় পর্তুগিজরা। তবে তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নকে ২-১ গোলে হারিয়ে তৃতীয় হয় তারা। এরপর বেশ কয়েক বছর পর্তুগিজ ফুটবলে খরা চললেও লুইস ফিগো ও ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর হাত ধরে সাম্প্রতিক সময়ে ডার্ক হর্সে পরিণত হয়েছে পর্তুগাল। তবে ১৯৬৬ বিশ্বকাপের সেই সাফল্যকে এখনো টপকাতে পারেনি তারা। আর ১৯৬৬ বিশ্বকাপের পর উত্তর কোরিয়া বিশ্বকাপে সুযোগ পেয়েছেই মাত্র একবার, সেখানেও তাদের পারফর্মেন্স ছিল বেশ হতাশাজনক।

১৯৯০ বিশ্বকাপ: রজার মিলার সেই উদযাপন

১৯৯০ বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচে এর আগের আসরের চ্যাম্পিয়ন ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনার মুখোমুখি হয় ক্যামেরুন। নয়জনের দল নিয়েও আর্জেন্টিনাকে ১-০ গোলে হারিয়ে পুরো বিশ্বে সাড়া ফেলে দেয় ক্যামেরুন! পরের ম্যাচে ৩৮ বছর বয়সী রজার মিলার জোড়া গোলে রোমানিয়াকে ২-১ গোলে হারিয়ে রাউন্ড অফ সিক্সটিনের টিকিট পেয়ে যায় তারা। এ ম্যাচে গোল করার পর কর্নার ফ্ল্যাগের সামনে গিয়ে রজার মিলার অদ্ভুত গোল উদযাপন সারা বিশ্বে ভীষণ সাড়া ফেলে দেয়। গ্রুপপর্বের শেষম্যাচে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে ৪-০ গোলে হেরেও ক্যামেরুন গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়।

রজার মিলার সেই ঐতিহাসিক গোল উদযাপন; Image Source : Pinterest

রাউন্ড অফ সিক্সটিনে আবারো রজার মিলার ঝলক। অতিরিক্ত সময়ে মিলার জোড়া গোলে কলম্বিয়াকে ২-১ গোলে হারিয়ে প্রথম আফ্রিকান দেশ হিসেবে কোয়ার্টার ফাইনাল খেলার গৌরব অর্জন করে ক্যামেরুন। কিন্তু কোয়ার্টার ফাইনালে তারা আর পেরে ওঠেনি। অতিরিক্ত সময়ে ইংল্যান্ডের কাছে ৩-২ গোলে হেরে শেষ হয় ক্যামেরুনের সেই স্বপ্নযাত্রা। তবে কোয়ার্টার ফাইনালে বিদায় নিলেও ১৯৯০ বিশ্বকাপের কথা উঠলেই সবাই এখনো বলে ওঠে আফ্রিকার অদম্য সিংহদের সেই অদম্য পারফর্মেন্সের কথা। তাছাড়া তাদের এই পারফর্মেন্সের কারণেই আফ্রিকা জোন থেকে পরের আসরে বেশি দল নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ফিফা।

১৯৯৪ বিশ্বকাপ: বুলগেরিয়া ও রোমানিয়ার জায়ান্ট কিলিং

১৯৯৪ বিশ্বকাপে পুরো বিশ্বকে বড়সড় চমক উপহার দেয় রোমানিয়া ও বুলগেরিয়া। গ্রুপ এ-তে রোমানিয়ার প্রতিপক্ষ ছিল সেসময়ের সাড়া জাগানিয়া দল কলম্বিয়া, স্বাগতিক যুক্তরাষ্ট্র ও সুইজারল্যান্ড। গ্রুপপর্বে দুই জয় নিয়ে বাকিদের টপকে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়েই পরের রাউন্ডে যায় রোমানিয়া। রাউন্ড অফ সিক্সটিনে রোমানিয়ার প্রতিপক্ষ ছিল আগের দুই আসরে ফাইনাল খেলা দুবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা। ডোপ কেলেঙ্কারিতে ম্যারাডোনাকে হারালেও রোমানিয়ার কাছে আর্জেন্টিনা হেরে যাবে এটা হয়তো অনেকেই ভাবতে পারেনি। কিন্তু বাস্তবে সেটাই হলো! দুমেত্রিস্কুর জোড়া গোলে আর্জেন্টিনাকে ৩-২ গোলে হারিয়ে নিজেদের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোয়ার্টার ফাইনালে চলে যায় রোমানিয়া। কিন্তু সুইডেনের কাছে ৩-২ গোলে হেরে গেলে রোমান রূপকথা থেমে যায় কোয়ার্টার ফাইনালেই।

১৯৯৪ বিশ্বকাপের রোমানিয়া দল; Image Source : PES

সেই আসরের আরেক চমক বুলগেরিয়ার স্বপ্নযাত্রাটা অবশ্য আরো দীর্ঘ ছিল। প্রথম ম্যাচে নাইজেরিয়ার কাছে ৩-২ গোলে হারলেও পরের ম্যাচে স্টইচকভের জোড়া গোলে গ্রিসকে ৪-০ গোলে হারিয়ে টুর্নামেন্টে পুরোপুরি ফিরে আসে বুলগেরিয়া। গ্রুপপর্বের শেষম্যাচে আবারো স্টইচকভের জোড়া গোলে পরাশক্তি আর্জেন্টিনাকে ২-০ গোলে হারিয়ে নক আউট রাউন্ডের টিকিট কাটে বুলগেরিয়া। রাউন্ড অফ সিক্সটিনে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ম্যাচে মেক্সিকোকে টাইব্রেকারে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে চলে যায় বুলগেরিয়া। কোয়ার্টার ফাইনালে আগের আসরের চ্যাম্পিয়ন জার্মানিকে ২-১ গোলে হারিয়ে টুর্নামেন্টে সবচেয়ে বড় অঘটনের জন্ম দেয় বুলগেরিয়া। কিন্তু সেমিফাইনালে ইতালির কাছে ২-১ গোলে হেরে গেলে সেমিফাইনালেই থামে তাদের স্বপ্নের অভিযান। তবে ছয় গোল করে রাশিয়ার ওলেগ সালেঙ্কোর সাথে যৌথভাবে গোল্ডেন বুট জিতে নেন বুলগেরিয়ান স্ট্রাইকার রিস্টো স্টইচকভ। রোমানিয়া কিংবা বুলগেরিয়া পরবর্তীতে ১৯৯৪ বিশ্বকাপের এই সাফল্য আর স্পর্শ করতে পারেনি।

ছয় গোল করে গোল্ডেন বুট জিতেন বুলগেরিয়ান স্ট্রাইকার রিস্টো স্টইচকভ; Image Source : fifa.com

১৯৯৮ বিশ্বকাপ: স্বাধীনতা পেয়েই ক্রোয়েশিয়ার নিজেদের প্রমাণ করা

যুগোস্লাভিয়ার অধীনে থাকাকালীনই সার্বদের সাথে ফুটবল নিয়ে নানা ধরনের দ্বন্দ্বে ক্রোয়াটরা জড়িয়েছিল। ক্রোয়াটরা সবসময় মনে করতো সার্বদের কারণে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও অনেক ক্রোয়াট ফুটবলার জাতীয় দলে সুযোগ পাচ্ছিলো না। ১৯৯০ সালে যুগোস্লাভিয়ার কাছ থেকে ক্রোয়েশিয়া স্বাধীনতা পেলে ফুটবলে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণের বড় সুযোগ ক্রোয়াটদের সামনে চলে আসে। ১৯৯৩ সালে ফিফার অনুমোদন পাওয়ার পর ১৯৯৮ সালে নিজেদের ইতিহাসে প্রথমবারের মতন বিশ্বকাপে সুযোগ পায় ক্রোয়েশিয়া আর সুযোগ পেয়েই প্রমাণ করে দেয় একক দেশ হিসেবে ক্রোয়েশিয়াও সক্ষম ফুটবল বিশ্বে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলতে। গ্রুপ এইচে জ্যামাইকা ও জাপানকে হারিয়ে রাউন্ড অফ সিক্সটিনের টিকিট নিশ্চিত করে ক্রোয়েশিয়া। রাউন্ড অফ সিক্সটিনে ডেভর সুকারের গোলে আগের আসরে চমকে দেওয়া দল রোমানিয়াকে বিদায় করে কোয়ার্টার ফাইনালে চলে যায় ক্রোয়েশিয়া।

ছয় গোল করে গোল্ডেন বুট জেতার সাথে ক্রোয়েশিয়ার তৃতীয় হওয়ার পিছনে বড় অবদান রাখেন ডেভর সুকার; Image Source : sqawka.com

ক্রোয়াটরা সবচেয়ে বড় অঘটন ঘটায় কোয়ার্টার ফাইনালেই, তিনবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন জার্মানিকে ৩-০ গোলে উড়িয়ে দিয়ে পুরো বিশ্বকে বিশাল এক ধাক্কা দেয় ক্রোয়েশিয়া। সেমিফাইনালেও স্বাগতিক ফ্রান্সের বিপক্ষে সূচনাটা ভালো হয় ক্রোয়াটদের, ৪০ মিনিটে ডেভর সুকারের গোলে এগিয়েও গিয়েছিলো তারা! কিন্তু লিলিয়ান থুরামের জোড়া গোলে সেমিফাইনালেই থামতে হয় ক্রোয়েশিয়াকে। তবে নেদারল্যান্ডসকে ২-১ গোলে হারিয়ে টুর্নামেন্টে তৃতীয় হয় ক্রোয়েশিয়াই। আর ছয় গোল করে সে বিশ্বকাপের গোল্ডেন বুট জিতে নেন ডেভর সুকার। এই নিয়ে টানা দুবার আন্ডারডগ দলের কোনো স্ট্রাইকার গোল্ডেন বুট জেতার নজির গড়ে।

২০০২ বিশ্বকাপ: অঘটনে ভরপুর এক বিশ্বকাপ

এখন পর্যন্ত যতগুলো বিশ্বকাপ হয়েছে এর মধ্যে আন্ডারডগ দলগুলো সবচেয়ে বেশি আধিপত্য দেখিয়েছে ২০০২ বিশ্বকাপে। এর আগে সর্বোচ্চ দুটো আন্ডারডগ দলকে একটা আসরে চমকে দিতে দেখা গিয়েছিলো। কিন্তু এই আসরে চমক দেখিয়েছিল তিন তিনটি আন্ডারডগ দল। History repeats itself কথার প্রমাণ দেয় সেনেগাল। ১৯৯০ বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচে আফ্রিকার দেশ ক্যামেরুন ১-০ গোলে হারিয়েছিল সেসময়ের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনাকে। আর ২০০২ বিশ্বকাপে সেসময়ের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সকেও ঠিক একই ব্যবধানে উদ্বোধনী ম্যাচে হারায় সেনেগাল!

ফ্রান্সের বিপক্ষে ঐতিহাসিক জয়ের পর উল্লসিত সেনেগাল অধিনায়ক আলিয়ু সিসে; Image Source : Goal.com

পরের দুই ম্যাচে ডেনমার্ক ও উরুগুয়ের সাথে ড্র করে রাউন্ড অফ সিক্সটিন নিশ্চিত করে সেনেগাল। রাউন্ড অফ সিক্সটিনে কামারার গোল্ডেন গোলে সুইডেনকে ২-১ গোলে হারিয়ে ক্যামেরুনের পর দ্বিতীয় আফ্রিকান দেশ হিসেবে কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠার নজির গড়ে সেনেগাল, যেখানে তাদের প্রতিপক্ষ ছিল টুর্নামেন্টের আরেক সাড়া জাগানো আন্ডারডগ তুরস্ক। কোয়ার্টারে ওঠার পথে গ্রুপ সি-তে নিজেদের প্রথম ম্যাচে শক্তিশালী ব্রাজিলের কাছে ২-১ গোলে হারলেও কোস্টারিকার সাথে ড্র ও চীনকে হারিয়ে তুরস্কও পেয়ে যায় পরের রাউন্ডের টিকিট। আর রাউন্ড অফ সিক্সটিনে স্বাগতিক জাপানকে ১-০ গোলে হারিয়ে তুরস্ক পৌঁছায় কোয়ার্টার ফাইনালে। দুই আন্ডারডগ দল কোয়ার্টার ফাইনালে তুমুল এক লড়াই গড়ে তোলে। নির্ধারিত সময়েও কোনো দল গোল করতে না পারলে খেলা গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। আর সেখানে ইহান মানসিজের গোল্ডেন গোলে সেনেগালের স্বপ্ন ভেঙ্গে সেমিফাইনালে চলে যায় তুরস্ক।

সেনেগালের বিপক্ষে ইহান মানসিজের সেই ঐতিহাসিক গোল্ডেন গোল; Image Source : gettyimages

ওদিকে গ্রুপ ডি-তে পর্তুগাল, পোল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্রকে টপকে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হিসেবেই রাউন্ড অফ সিক্সটিনে যায় দক্ষিণ কোরিয়া। তবে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়েও রাউন্ড অফ সিক্সটিনে সেসময়ে তিনবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ইতালির মুখোমুখি হতে হয় দক্ষিণ কোরিয়াকে। চূড়ান্ত নাটকীয় ম্যাচে ইতালিকে গোল্ডেন গোলে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে যায় কোরিয়ানরা আর সেখানেও প্রতিপক্ষ হিসেবে পায় স্পেনের মতো কঠিন প্রতিপক্ষকে। কোয়ার্টার ফাইনালেও দুর্দান্ত খেলে কোরিয়া। পাক্কা ১২০ মিনিট স্প্যানিশ আক্রমণভাগকে আটকে রেখে খেলা নিয়ে যায় টাইব্রেকারে। টাইব্রেকারে স্পেনকে ৫-৩ গোলে হারিয়ে প্রথম এশিয়ান দল হিসেবে সেমিফাইনালে ওঠার অনন্য এক কীর্তি গড়ে দক্ষিণ কোরিয়া। যদিও এই দুই ম্যাচেই রেফারি বেশ দৃষ্টিকটুভাবে দক্ষিণ কোরিয়ার পক্ষে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন, তা-ও এশিয়ান কোনো দল হিসেবে দক্ষিণ কোরিয়ার বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে খেলাটা অবশ্যই বিশাল এক অর্জন ছিল।

স্পেনকে টাইব্রেকারে হারিয়ে প্রথম এশীয় দল হিসেবে সেমিফাইনালে যাওয়ায় উল্লসিত দক্ষিণ কোরিয়ার ফুটবলাররা; Image Source : hindustantimes.com

একই বিশ্বকাপে দুই আন্ডারডগ সেমিফাইনালে- এমন অদ্ভুত ঘটনা এর আগে কখনোই হয়নি। ফুটবল বিশ্বে তখন জোর গুঞ্জন, তবে কি এবার বিশ্বকাপ কোনো আন্ডারডগ দলের ঘরেই যাবে? কিন্তু তা আর হয়নি, সাইতামায় মাইকেল বালাকের গোলে জার্মানির কাছে ১-০ গোলে হারে দক্ষিণ কোরিয়া। আরেক সেমিফাইনালে রোনালদোর অসাধারণ এক গোলে বিদায় নিতে হয় তুর্কিদের। দুই আন্ডারডগ মুখোমুখি হয় তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে, সেখানে দক্ষিণ কোরিয়াকে ৩-২ গোলে হারায় তুরস্ক। তবে দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, এই বিশ্বকাপের পর আর কোনো বিশ্বকাপে তুরস্ক কোয়ালিফাই-ই করতে পারেনি!

২০১৪ বিশ্বকাপ: মৃত্যকূপ থেকে কোস্টারিকার উত্থান

২০১৪ বিশ্বকাপের গ্রুপিং যখন হলো তখন গ্রুপ ডি কে সবাই গ্রুপ অফ ডেথ  বলে আখ্যায়িত করে ফেললো। আর করবে না-ই বা কেন? একই গ্রুপে যদি চারবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ইতালি, দুইবারের বিশ্বজয়ী উরুগুয়ে ও ১৯৬৬ বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ড থাকে তবে সেই গ্রুপকে মৃত্যুকূপ ছাড়া আর কী-ই বা বলা যায়। এই গ্রুপের অপর দল কোস্টারিকাকে কেউ তেমন পাত্তাই দিচ্ছিল না। সবার মতে এই মৃত্যুকূপে কোস্টারিকা থাকবে শুধুমাত্র কম ব্যবধানে হারার লক্ষ্যেই!

খেলা শুরুর আগে যদি কেউ বলতো যে, এই গ্রুপ ডি’র চ্যাম্পিয়ন হবে কোস্টারিকা, তবে সবাই তার দিকে হা-রে-রে-রে করেই ধেয়ে আসতো। কিন্তু বাস্তবে এটাই হয়েছিলো! গ্রুপপর্বে নিজেদের প্রথম ম্যাচে উরুগুয়ের বিপক্ষে ২৪ মিনিটেই এডিনসন কাভানির গোলে ১-০ গোলে পিছিয়ে যায় কোস্টারিকা। তবে দ্বিতীয়ার্ধে সমস্ত পাশার দান উল্টে দেয় কোস্টারিকা। ক্যাম্পবেল, দ্যুরাতে ও উরেনার গোলে উরুগুয়েকে ৩-১ গোলে হারিয়ে ওই বিশ্বকাপের প্রথম অঘটনটি ঘটায় তারা।

২০১৪ বিশ্বকাপের সবচেয়ে বড় চমক ছিল সবচেয়ে কঠিন গ্রুপে পড়েও কোস্টারিকার দাপুটে পারফর্মেন্স; Image Source : Thewinin

পরের ম্যাচে আবারো কোস্টারিকার চমক। অধিনায়ক ব্রায়ান রুইজের একমাত্র গোলে ইতালিকে ১-০ গোলে হারিয়ে মৃত্যুকূপ থেকে সবার আগে রাউন্ড অফ সিক্সটিন নিশ্চিত করে কোস্টারিকা। গ্রুপপর্বের শেষ ম্যাচে ইংল্যান্ডের সাথে গোলশূন্য ড্র করে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হিসেবেই পরের রাউন্ডে যায় তারা। গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় রাউন্ড অফ সিক্সটিনে কোস্টারিকা পায় অপেক্ষাকৃত দুর্বল দল গ্রিসকে। দুই দলের মধ্যে লড়াইটাও বেশ জমে ওঠে, ৫২ মিনিটে অধিনায়ক রুইজের গোলে কোস্টারিকার কোয়ার্টার ফাইনালের সম্ভাবনা বেশ উজ্জ্বল হয়। কিন্তু ৬৬ মিনিটে কোস্টারিকার অস্কার দ্যুরাতে লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়লে দশজনের দলে পরিণত হয় কোস্টারিকা।

এই সুযোগে কোস্টারিকার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে গ্রিস, দ্বিতীয়ার্ধের ইনজুরি টাইমে গোল করে খেলায় ১-১ গোলে সমতা নিয়ে আসে গ্রিস। অতিরিক্ত সময়েও দশজনের কোস্টারিকার উপর দাপট অব্যাহত রাখে তারা। কিন্তু কোস্টারিকার গোলরক্ষক কেইলর নাভাসের দৃঢ়তায় গ্রিসকে আটকে রাখে কোস্টারিকা, খেলা চলে যায় টাইব্রেকারে। টাইব্রেকারে আবারো নায়ক হিসেবে আবির্ভূত হন নাভাস। তার নৈপুণ্যে গ্রিসকে টাইব্রেকারে হারিয়ে নিজেদের বিশ্বকাপ ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোয়ার্টার ফাইনালে পাড়ি জমায় কোস্টারিকা। কোয়ার্টার ফাইনালে শক্তিশালী নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষেও দাঁতে দাঁত চেপে লড়ে যায় কোস্টারিকা। ১২০ মিনিট ডাচদের কোনো গোল করতে না দিয়ে খেলা নিয়ে যায় টাইব্রেকারে। কিন্তু এবার ভাগ্য কোস্টারিকার সহায় ছিল না। নেদারল্যান্ডসের কাছে টাইব্রেকারে হেরে থামে কোস্টারিকানদের স্বপ্নযাত্রা। তবে মৃত্যকূপে পড়েও কোস্টারিকার এমন রূপকথা সৃষ্টি ফুটবল বিশ্ব মনে রাখবে বহুদিন।

কেন আন্ডারডগদের অভিযান সেমিফাইনালের বেশি যায় না?

এখানে যতগুলো আন্ডারডগের রূপকথা বলা হলো খেয়াল করলে দেখা যাবে যে এদের সবার স্বপ্নযাত্রা সর্বোচ্চ সেমিফাইনালে গিয়েই আটকে গিয়েছে। এখন স্বভাবতই প্রশ্ন উঠবে, কেন আন্ডারডগরা এর চেয়ে বেশিদূর যেতে পারছে না? কিংবা আরো বড় করে যদি আমরা ভাবি, তাহলে বলা যায়, সেমিফাইনালে যাওয়ার পর বিশ্বকাপজয় থেকে একেকটা দল মাত্র দুটো ম্যাচ জয় থেকে দূরে থাকে। তাহলে কেন কোনো আন্ডারডগ দল এখনো বিশ্বকাপ জিততে পারলো না? এর মূল কারণ কঠিন পরিস্থিতিতে চাপ জয় করতে পারার সামর্থ্য না থাকা। আন্ডারডগরা একটা ভালো দল নিয়ে এলে হয়তো কোয়ার্টার কিংবা সেমিতে পৌঁছে যেতেই পারে, কিন্তু এতদূর আসার পর যখনই তারা বুঝতে পারে যে, বিশ্বকাপ জয় থেকে আর মাত্র অল্প কিছু পথ দূরে তারা দাঁড়িয়ে আছে তখন, আর সেই চাপ তারা সামলে উঠতে পারে না। তাছাড়া কঠিন পরিস্থিতিতে ব্যবধান গড়ে তুলতে ব্যক্তিগত নৈপুণ্য অনেক বড় একটা ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়ায়। এদিক থেকে আন্ডারডগরা পরাশক্তিদের চেয়ে পিছিয়ে থাকায় বড়মঞ্চে গিয়ে আর তালটা ঠিক তারা রাখতে পারে না। এসব কারণেই হয়তো কোনো আন্ডারডগ দল এখনো বিশ্বকাপ জিততে পারেনি।

এছাড়াও আন্ডারডগদের সাফল্য পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, এসব দল একটা বিশ্বকাপে সাফল্যের যে চূড়ায় পৌঁছায় পরবর্তীতে তারা আর সেই সাফল্যের ধারা ধরে রাখতে পারে না। বুলগেরিয়া, তুরস্কের মতো কিছু দল তো সে সাফল্য ধরে রাখা দূরে থাক, এরপর আর বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই-ই করতে পারেনি। এর মূল কারণ ফুটবল ঐতিহ্যে এসব দলের পিছিয়ে থাকা, হুট করে একটা সোনালী প্রজন্ম পেয়ে হয়তো এই সাফল্য এসব আন্ডারডগ দল পেয়েছিলো। কিন্তু ফুটবলের শক্ত কাঠামো এসব দেশে না থাকায় পরবর্তী প্রজন্ম আর সেই সাফল্য ধরে রাখতে পারেনি। আন্ডারডগদের সাফল্যের মেয়াদ স্বল্পমেয়াদী হওয়ার এটাই সবচেয়ে বড় কারণ।

তবে আন্ডারডগ দল বিশ্বকাপ জিতুক কিংবা না-ই জিতুক, তাদের সাফল্য স্বল্পমেয়াদী হোক বা দীর্ঘমেয়াদী, বিশ্বকাপকে রঙিন করে তুলতে আন্ডারডগদের এসব চমক জাগানিয়া কীর্তি যে বড় একটা অবদান রেখে যাচ্ছে এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। এবারের বিশ্বকাপেও অনেকগুলো আন্ডারডগ দল এসেছে যাদের হারানোর কিছু নেই, কিন্তু পাওয়ার আছে অনেক কিছু। মিশর, ইরান, আইসল্যান্ড, পানামা, সেনেগালের মতো দল ইতিহাস তৈরির জন্যে নিজেদের সবটুকু দিয়ে দিবে এটা বলাই বাহুল্য। আমরাও চাই এসব দল নিজেদের সেরাটা দিক, তাহলে ৩২ দলের বিশ্বকাপ হবে আরো জমজমাট, ফুটবল হবে আরো বেশি বৈচিত্র্যময়।

ফিচার ইমেজ: vice sports

Related Articles