গত কয়েক মৌসুম ধরেই দলবদলের বাজার আগুন গরম। কোনো একজন ভালো কিংবা প্রতিভাবান খেলোয়াড়ের পেছনে ক্লাবগুলোকে সত্যিকার অর্থেই টাকার বস্তা নিয়েই দৌড়াতে হচ্ছে। তবে মাঝেমাঝে কাকতাল ব্যাপারও ঘটে। ফ্রিতেই পাওয়া যায় চুক্তি ফুরানো নামীদামী প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের।
একজন খেলোয়াড়কে চুক্তি শেষ হওয়ার আগেই বেচে দেওয়ার পূর্ণ স্বাধীনতা রাখে একটি ক্লাব। কিন্তু চুক্তি শেষ হওয়ার পর যদি ওই খেলোয়াড়টি নতুন কোনো চুক্তিতে স্বাক্ষর না করে, তাহলে সে হয়ে যায় ফ্রি এজেন্ট। ফ্রিতেই তাকে ভেড়াতে পারে যেকোনো ক্লাব। এই প্রথা সর্বপ্রথম প্রস্তাব করেন জাঁ মার্ক বসম্যান। সেই থেকে ফ্রি ট্রান্সফারের আরেক নাম বসম্যান সুইচ। চলুন দেখে আসা যাক ট্রান্সফারের ইতিহাসে কয়েকটি চমক জাগানিয়া ফ্রি সাইনিং।
হেনরিক লারসন – সেল্টিক থেকে বার্সেলোনা
সেল্টিকের ইতিহাসের অন্যতম সেরা এই সুইডিশ খেলোয়াড় ফ্রিতেই নাম লিখিয়েছেন স্পেনের অন্যতম সফল দল বার্সেলোনাতে। সেল্টিকের হয়ে ৭ সিজন খেলে ২৪২ গোল করা এই খেলোয়াড় ২০০৪ সালে ফ্রি এজেন্ট হয়ে যান। ২০০৪ ইউরোতে দারুন খেলার পর সেল্টিক থেকে নতুন চুক্তি অফার করলেও তা ফিরিয়ে দেন লারসন। ইচ্ছা ছিলো বড় ক্লাবে খেলার। তাই ক্লাবের নতুন চুক্তি উপেক্ষা করে ফ্রিতে নাম লেখান কাতালানদের দলে।
বার্সেলোনা অধ্যায় সেল্টিকের মতো এতটা সুখকর না হলেও সময়মতো ঠিকই জ্বলে উঠতেন লারসন। ২০০৬ সালের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে আর্সেনালের বিপক্ষে বার্সেলোনা যখন ১-০ গোলে পিছিয়ে ছিলো, তখন ৩০ মিনিট আগে বদলী হিসেবে নেমে দারুন দুটি অ্যাসিস্ট করেন এই সুইডিশ। লারসনের অতিমানবীয় পারফরম্যান্সেই দ্বিতীয় চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা ঘরে তোলে বার্সেলোনা।
মাইকেল বালাক – বায়ার্ন মিউনিখ থেকে চেলসি
ফ্রি ট্রান্সফারের ইতিহাসে আরেক বিস্ময় জাগানিয়া খেলোয়াড় সাবেক জার্মান অধিনায়ক মাইকেল বালাক। বাভারিয়ানদের সাথে চুক্তি শেষ হওয়ার পরে তাকে ফ্রিতে দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করেছিলো রিয়াল মাদ্রিদ, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মতো ক্লাবগুলো। কিন্তু বালাক বেছে নেন চেলসিকে।
তার সিদ্ধান্ত যে ভুল ছিলো না তা প্রমাণ করেন পরবর্তী চার সিজনে। একটি লিগ শিরোপা ছাড়াও ৩টি এফএ কাপ এবং একটি লিগ কাপ জিতেন এই জার্মান কিংবদন্তী। পাশাপাশি ২০০৮ সালে চেলসিকে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে তুলতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন বালাক। যদিও ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের কাছে দুর্ভাগ্যবশত হেরে যায় তার দল। তবু বীরের বেশেই স্ট্যামফোর্ড ব্রিজ ত্যাগ করেন ফ্রিতে চেলসিতে আসা মাইকেল বালাক।
এস্তেবান ক্যাম্বিয়াসো – রিয়াল মাদ্রিদ থেকে ইন্টার মিলান
রিয়াল মাদ্রিদের সাথে নতুন চুক্তি না করে ২০০৪ সালে ইন্টার মিলানের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান এস্তেবান ক্যাম্বিয়াসো। টানা চারটি স্কুদেত্তো জিতলেও এই আর্জেন্টাইন মিডফিল্ডারের ক্যারিয়ার সেরা মূহুর্তটি আসে মরিনহোর অধীনে, ২০১০ সালে।
২০১০ সালে ইন্টারকে ট্রেবল জেতানো মরিনহোর দলের অপরিহার্য এক অংশ ছিলেন তিনি। টানা ১০ বছর ধরে সান সিরোতে থেকে ৩০০ এর উপর ম্যাচ খেলেন ক্যাম্বিয়াসো। ২০১৪ সালে এসে আরেকটি বসম্যান সুইচের মাধ্যমে নাম লেখান ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের দল লেস্টার সিটিতে। এক সিজন লেস্টারে খেলা ক্যাম্বিয়াসো একমাত্র সিজনেই ক্লাবের সেরা খেলোয়াড় মনোনীত হন। যদিও লেস্টারের ইতিহাস লেখা প্রিমিয়ার লিগ জয়ের সাক্ষী হতে পারেননি তিনি। তার আগেই ক্লাব ত্যাগ করেন ক্যাম্বিয়াসো।
জ্লাতান ইব্রাহিমোভিচ - প্যারিস সেইন্ট জার্মেই থেকে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড
প্যারিস সেইন্ট জার্মেইয়ের সাথে চুক্তি শেষে অনেক ক্লাবই বুড়ো জ্লাতানকে দলে ভেড়ানোর জন্য মুখিয়ে ছিলো। কিন্তু সবাইকে অবাক করে ইব্রাহিমোভিচ যোগ দেন ওল্ড ট্রাফোর্ডে। নিজের ক্যারিয়ারে শুধুমাত্র চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপাই ছিলো না জলাতানের। তাই কেউ ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি সেবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগে উর্ত্তীর্ণ হতে না পারা ইউনাইটেডেই গিয়ে তাবু গাড়বেন এই সুইডিশ কিংবদন্তী।
ম্যানচেস্টারের হয়ে প্রথম তিন ম্যাচে গোল করেই উড়ন্ত সূচনা করেন জ্লাতান। কিন্তু ধীরে ধীরে খেই হারিয়ে ফেলেন তিনি। পাশাপাশি বড় ধরনের ইনজুরি সমস্যায়ও ভুগতে হয় তাকে। তাই দুই সিজন পরেই ইব্রাহিমোভিচ পাড়ি জমান এলএ গ্যালাক্সির উদ্দেশ্যে। তার আগে দুই সিজন ওল্ড ট্রাফোর্ডে থেকে ৩৩ ম্যাচ খেলে করেন ১৭ গোল।
পল পগবা – ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড থেকে জুভেন্টাস
বসম্যান সুইচের মধ্যে বলতে গেলে সবচেয়ে হাস্যকর ট্রান্সফারটি ছিলো পল পগবার। ২০১১ মৌসুমে তরুণ পগবাকে দলে ভেড়ায় ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। কিন্তু পগবার ক্ষেত্রে পাকা জহুরির মতো সোনা চিনতে পারেননি স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন। প্রায় এক বছর সাইড বেঞ্চে কাটানোর পর পগবাকে ফ্রি-তে জুভেন্টাসের হাতে তুলে দেয় রেড ডেভিলরা।
ডিফেন্সিভ ও অফেন্সিভেও সমান তালে খেটে খেলা পগবা কয়েকদিনের মধ্যেই নিজের জাত চেনান। ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন জুভেন্টাসের মতো ক্লাবের মধ্যমণি। ২৩ বছর বয়সেই তুরিনের বুড়িদের হয়ে জেতেন টানা চারটি লিগ শিরোপা। পাশাপাশি ২টি কোপা ইতালিয়া, ২টি সুপারকোপা ছাড়াও ২০১৫ সালের চ্যাম্পিয়ন্স লিগে জুভেন্টাসকে ফাইনালে তুলতে সাহায্য করেন।
২০১৪ বিশ্বকাপে সেরা তরুণ খেলোয়াড়ের পুরস্কারসহ ব্যালন ডি অরের ২৩ জনের সংক্ষিপ্ত তালিকায়ও জায়গা করে নেন। ততদিনে ভুল ভাঙে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের। ঘরের ছেলেকে ঘরে ফিরিয়ে আনতে তোড়জোড় শুরু করে তারা। তবে এবার আর ফ্রি-তে নয়, বরং ৮৯ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে তবেই পগবাকে ছাড়ে জুভেন্টাস। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে ফিরে যাওয়ার আগে জুভেন্টাসের হয়ে পগবা খেলেন ১২৪টি ম্যাচ। গোল করেন ২৮টি।
আন্দ্রে পিরলো – এসি মিলান থেকে জুভেন্টাস
এসি মিলানকে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতানো পিরলোর বয়স ২০১১ সালে দাঁড়ায় ৩২ বছরে। সম্ভাব্য অবসর আর বয়সের কথা ভেবে এসি মিলানও চুক্তি নবায়ন করেনি সময়ের অন্যতম সেরা এই মিডফিল্ডারের সাথে। আর সেই সুযোগটাই লুফে নেয় জুভেন্টাস। পিরলোও পড়ন্ত ক্যারিয়ারকে জাগিয়ে তোলেন ফিনিক্স পাখির মতো।
৩৭ বছর পর্যন্ত জুভেন্টাসের হয়ে খেলে একে একে জিতে নেন চারটি লিগ শিরোপা, দুটি কোপা ইতালিয়া ও দুটি সুপার কোপা। পল পগবার সাথে মাঝমাঠে এক ভয়ঙ্কর জুটি গড়ে তোলেন এই মিডফিল্ড মায়েস্ত্রো। জুভেন্টাসে কাটানো পাঁচ মৌসুমে পিরলো ছিলেন অনেকটা ওয়াইনের মতো। বয়সের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে খেলার ধারও। আর অন্যদিকে এসি মিলান গত পাঁচ বছরে হারিয়েছে নিজেদের আগের জৌলুস। জুভেন্টাসের হয়ে ১০০ এর বেশি ম্যাচে অংশগ্রহণ করা আন্দ্রে পিরলো ২০১৫ সালে আমেরিকান সকার লিগে পাড়ি জমান।
রবার্ট লেওয়ানডস্কি – বরুশিয়া ডর্টমুন্ড থেকে বায়ার্ন মিউনিখ
বসম্যান সুইচের ইতিহাসে এক নাম্বারে থাকার যোগ্য দাবিদার রবার্ট লেওয়ানডস্কির ফ্রিতে বাভারিয়ানদের দলে যোগ দেওয়াটাই। ২০১৪ সালে ডর্টমুন্ড সমর্থকদের বিরক্তির উদ্রেক তুলে বায়ার্ন মিউনিখে নাম লেখান এই পোলিশ স্ট্রাইকার। ডর্টমুন্ডের সুযোগ ছিলো আগের বছরেই চড়া দামে লেওয়ানডস্কিকে বিক্রি করে দেওয়ার। কিন্তু ক্লাব কর্তৃপক্ষ চাইছিলো লেওয়ানডস্কি থেকে আরো এক বছর সার্ভিস নেওয়ার। আর তাতে করেই ২০১৪ সালে ফ্রি এজেন্ট হয়ে যান তিনি। রিয়াল মাদ্রিদের মতো ক্লাব লেওয়ানডস্কিকে চাইলেও তিনি নাম লেখান ডর্টমুন্ডেরই প্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাব বায়ার্ন মিউনিখে।
ডর্টমুন্ড থেকে বায়ার্নে যোগ দেওয়ার পর গোলস্পৃহা আরো বেড়েছে এই স্ট্রাইকারের। এরই মধ্যে বায়ার্নের হয়ে ১২৬ ম্যাচে করেছেন ১০৬ গোল। চারটি লিগ শিরোপা ছাড়াও জিতেছেন একটি ডিএফবি লোকাল এবং তিনটি জার্মান সুপারকাপ। ২০১৬-১৭ মৌসুমে ঘরে তুলেছেন বুন্দেস লিগা সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার। নিঃসন্দেহে ফ্রি ট্রান্সফারে সবচেয়ে বিস্ময়কর সাইনিংটি রবার্ট লেওয়ানডস্কির বায়ার্নে যোগদান।
This Bangla article is about the free transfer in football history which are astonishing. Necessary sources are hyperlinked in the article.
Feature Image: Daily Mail