তাসকিন আহমেদের শুরুটা দারুণ হয়েছিল। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল) সেই সময়ে চিটাগং কিংসের হয়ে কিশোর ছেলেটির গতির ঝড় দেখে গ্যালারির উল্লাস কানে পৌঁছেছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডেরও (বিসিবি)। স্টাইল, গতি, সুইং, বোলিং আর অ্যাকশন; সবকিছু মিলিয়ে যেন ভবিষ্যতের মাশরাফি বিন মুর্তজার নতুন 'ভার্সন' খুঁজে পেয়েছিল নির্বাচকরা। সুখের তরীতে বৈঠা বেঁয়ে সেই তাসকিন জাতীয় দলের জার্সি গায়ে চড়ালেন ২০১৪ সালে।
তাসকিনের গল্প সেই থেকে শুরু। গেল পাঁচ বছরে খেলেছেন ৫ টেস্ট (৭ উইকেট), ৩২ ওয়ানডে (৪৫ উইকেট) আর ১৯ টি-টোয়েন্টি (১২ উইকেট)। কিন্তু সেই গল্পের সাথেও জমে গিয়েছিল অনেক দুঃস্বপ্ন, অনেক চড়াই-উৎরাই আর সুতোয় গাঁথা ভাগ্য।
গেল পাঁচ বছরে তাসকিন দলের পেস আক্রমণের 'অটোমেটিক চয়েস' হওয়ার পথে ছিলেন। পুনরায় বলা হোক, 'পথে' ছিলেন। আদতে তা হয়নি। তাকেই ভাবা হচ্ছিল বাংলাদেশ দলের আগামীর পেস আক্রমণের নেতৃত্ব। খুব দ্রুতই নিজেকে সাইডলাইনে আবিস্কার করলেন তাসকিন। অবৈধ বোলিং অ্যাকশনের কারণে বাদ পড়লেন। পরীক্ষায় পাস করে যখন ফিরলেন, তখন আবার ফর্মটা ঠিক 'আপ টু দ্য মার্ক' ছিল না। তাই দল থেকে বাদ পড়তে সময় লাগেনি। অথচ, এসবের মধ্যেই তাসকিন দেখেছেন কীভাবে তার পরে দলে জায়গা পাওয়া পেসাররা তাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। কীভাবে তারা পারফর্ম করছে।
শেষ এক-দেড় বছরে ক্যারিয়ারে ইনজুরিই ছিল তাসকিনের সবচেয়ে বড় শত্রু। যে কারণে তার ফর্মে উত্থান-পতন, আসা-যাওয়া প্রায় লেগেই ছিল। তারপরও চেষ্টার কমতি করেননি ঢাকার এই ক্রিকেটার। সর্বশেষ বিপিএলের আসরে সিলেট সিক্সার্সের হয়ে ২২ উইকেট নিয়ে ছিলেন সর্বোচ্চ উইকেটশিকারির দিক থেকে দুই নম্বরে। পেসারদের মধ্যে সবার উপরে। ফেরার বার্তা দিয়ে তাসকিনের জন্য টুর্নামেন্টটি ভালোই ছিল। নির্বাচকরাও তাকে ভেবে রেখেছিলেন বিশ্বকাপের জন্য। এমন ফেরার পর এটুকু তো আশা করতেই পারেন ২৪ বছর বয়সী এই ক্রিকেটার! কিন্তু না, বিধাতা তাসকিনের ভাগ্যে লিখে রেখেছিলেন অন্যকিছু। যে কারণে নিজেদের শেষ ম্যাচে বাউন্ডারি লাইনে ফিল্ডিং করতে গিয়ে আবারও ইনজুরড তাসকিন! ব্যস, বিশ্বকাপ স্বপ্নটা ক্রমশ মিইয়ে যেতে বসলো।
মাঝের সময়টুকুতেও শেষ চেষ্টা করেছিলেন তাসকিন। পুনর্বাসন প্রক্রিয়া শেষ করে ফিরতে চেয়েছিলেন ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগ দিয়ে। কিন্তু সর্বোচ্চ পরিশ্রমের পরেও নিজেকে শতভাগ ফিট প্রমাণ করতে পারেননি। বিশ্বকাপের স্কোয়াড থেকেও তাই নামটি কাটা গেল। দল ঘোষণার দিন তাসকিন নিজের নামটি খুঁজে না পেয়ে আবেগাপ্লুত হলেন, ফিরিয়ে আনলেন ২০১১ সালের বিশ্বকাপ স্মৃতি। যেবার ঠিক একইভাবে কেঁদেছিলেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। তবে ঈশ্বর মাশরাফিকে না ফেরালেও তাসকিনের কথা শুনেছেন। বিশ্বকাপের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে আয়ারল্যান্ডে উইন্ডিজ ও আইরিশদের বিপক্ষে ত্রিদেশীয় সিরিজে তার নাম উঠেছে। যদিও সেটা শেষ মুহূর্তে, পেস বোলিং কোচ কোর্টনি ওয়ালশ ও হেডকোচ স্টিভ রোডসের অনুরোধে।
তাসকিন এখন আয়ারল্যান্ডে। বাংলাদেশ দলের হয়ে ত্রিদেশীয় সিরিজে খেলছেন। খেলার চেয়ে বড় কথা নিজের বিশ্বকাপ স্বপ্নটাকে বাঁচিয়ে রাখতে লড়ছেন। কারণ, কোচরা তাকে ফিরিয়েছেন; তার একটাই কারণ, 'যদি' বিশ্বকাপ স্কোয়াডে কোনোভাবে তাকে নেওয়া হয়। যদিও বিসিবির অপারেশন্স কমিটির চেয়ারম্যান আকরাম খান জানিয়ে দিয়েছেন, বিশ্বকাপ স্কোয়াডে পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা কম। তারা সেটা চানও না। তবে কেউ যদি ইনজুরিতে পড়ে তখন হয়তো সুযোগ আসতে পারে।
সবকিছু মিলিয়েই নিভু নিভু আশার প্রদীপেই ভরসা রাখছেন তাসকিন।
অবশ্য সেই ভরসার শুরুটাও একেবারে খারাপ হয়নি। আয়ারল্যান্ড 'এ' দলের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচে দল হারলেও, তাসকিন একাই বল হাতে তুলে নিয়েছেন তিনটি উইকেট, যা দলের পক্ষে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত উইকেট। মূল ম্যাচেও পারফরম্যান্সটা ধরে রাখতে চান এই ক্রিকেটার। লক্ষ্য কিন্তু একটাই, বিশ্বকাপ।
তাসকিন যাওয়ার আগেই বলে গিয়েছিলেন,
আয়ারল্যান্ডে আমার উপর অনেক চাপ থাকবে। আমাকে ভালো করতেই হবে। আমি চেষ্টা করবো নিজের উপর থেকে সেই চাপটা কমিয়ে ফেলতে। আমি যদি আমার সেরাটা দিয়ে প্রমাণ করতে পারি, তাহলে অবশ্যই জায়গা পাবো।
তাসকিনের এই বাড়তি আশা করাটা নিজের কাছে প্রহসন মনে হলেও আসলে তা তাসকিনের জন্যই এক অদৃশ্য শক্তি। যেকোনো মূল্যেই তাসকিন নিজেকে ফিরে পেতে চান, বল হাতে ঘুরে দাঁড়াতে চান। প্রিমিয়ার ডিভিশন লিগে ৩ ম্যাচে ৬ উইকেট নিয়ে তার ফিরতে চাওয়ার শুরুটাও চোখে পড়ার মতোই ছিল। তাসকিন তাই ফিরতে চাওয়ার লড়াই করতেই পারেন।
তাসকিনকে সর্বশেষ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দেখা গিয়েছিল ২০১৭ সালে ঘরের মাঠে নিদাহাস ট্রফিতে। সেবার ঘন্টায় ১২০-১২৫ কিলোমিটার বেগে বল করেছিলেন। যদিও শুরুর দিকে তাসকিন ঘন্টায় ১৩৫ কিলোমিটারের বেশি গতিতে স্বাচ্ছন্দ্যে বল করতেন। অর্থাৎ, তার ফিটনেসের ব্যাপারটিও তার প্রতিকূলে চলে যায়। ফর্ম আর ইনজুরি; সবকিছু মিলিয়েই বারবার 'লাইফলাইন' খুঁজেছেন তাসকিন। তার সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন নেই নির্বাচকদেরও। নিজেও তা প্রমাণ করেছেন। ২০১৪ সালে অভিষেক ম্যাচেই ভারতের বিপক্ষে ওয়ানডে ম্যাচে ৫ উইকেট নিয়ে শুরু করা তাসকিন ২০১৫ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি ছিলেন।
তবে তাসকিন নিজের প্রতি পুরোটা সময় কতটা সচেতন থেকেছেন তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। ওয়ানডে ক্রিকেটে অভিষেক করার পর দলের হয়ে নিজের সেরাটা ঢেলে দিতে চাইলেও সমস্যা কিছু হলেও ছিল। আড়ালে দলের সদস্যদের অভিযোগ, তাসকিন মাঠে চটপটে নন। এমনকি অভিযোগ ছিল কোচদের ও জ্যেষ্ঠ ক্রিকেটারদের পক্ষ থেকেও। তাসকিন নাকি নিজের সেরাটা দিতে কৃপণতা করেন।
মোদ্দা কথা, তাসকিন ফিরতে চান পুরনো রুপে। এ প্রসঙ্গে বলেছেন,
আমি আগে যেভাবে বল করতাম, সেভাবে বল করতে চাই। আমার জন্য এটা অনেক বড় চ্যালেঞ্জ হবে কারণ আমি অনেকদিন ম্যাচ খেলিনি। ক্রিকেটে আপনি যখন নিজের জায়গা হারাবেন, অন্য কেউ জায়গাটা নিয়ে নেবে; তখন সেই জায়গা ফিরে পাওয়া অনেক কঠিন ব্যাপার।
আয়ারল্যান্ডে সিরিজের প্রথম ম্যাচে উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামার সুযোগ পাননি তাসকিন। অপেক্ষা, 'অপেক্ষাকৃত' কম শক্তির স্বাগতিক দল আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে সুযোগ পাওয়ার। সেটার জন্য আপাতত অপেক্ষায় তার শক্তি হতে পারে।
যতকিছুই হোক, বাংলাদেশ দলে নিজের জায়গা ফিরে পেতে মরিয়া তাসকিন আহমেদ। পাখা মেলে উড়ে যাওয়ার মতো গতি, সহজাত পেসারের মতো শরীরী ভাষা মিলিয়ে তাসকিন ক্যারিয়ারের প্রথম ১২ মাস স্রেফ উড়েছেন। কিন্তু ডানা ভেঙে পড়ে যেতেও সময় লাগেনি তার। শেষ বিশ্বকাপে যে ক্রিকেটার ছিলেন দলের 'লাইফলাইন', সেই ক্রিকেটারই নতুন আসরে নিজের জায়গা নিয়ে সংশয়ে আছেন। তবে শেষমুহূর্তে তাকে ত্রিদেশীয় সিরিজে জায়গা করে দেওয়াটা একরকম 'আশীর্বাদ' হিসেবে নিচ্ছেন এই ক্রিকেটার। অপেক্ষা কেবল সময়ের। নিজেকে প্রমাণ করার, নিজেকে এগিয়ে নেওয়ার, আরও একবার দেশকে গর্বিত করার।
This is an article based on Taskin Ahmed, who is a pacer in Bangladesh national cricket team. He got chance in Ireland tour for tri nation series. He is not under the WC Bangladesh team due to his fitness, but he is dreaming his inclusion after getting chance in Ireland. Necessary link has been hyperlinked.
Feature Photo: AFP