Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

আফসোসের নাম তাসকিন আহমেদ

আকাশি হালকা  নীল জার্সি পরা লম্বা মতোন একটা ছেলে। সমানে বল করে যাচ্ছে তৎকালীন চিটাগং কিংসের হয়ে। মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে সেদিন ছেলেটির বোলিং অ্যাকশন, গতি আর শরীরী ভাষার সঙ্গে দুরন্ত রাজশাহীর বিপক্ষে সেই ম্যাচে ৩১ রানে ৪ উইকেট নিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। তা দেখে রই রই পড়ে গিয়েছিল। কত দ্রুত তাকে জাতীয় দলে আনা যায়, তা নিয়ে সমর্থকরা মেতে উঠেছিল।

ছেলেটি ছিলেন তাসকিন আহমেদ। ছিলেন না, এখনও আছেন। আছে সবই, সঙ্গে যোগ হয়েছে আফসোস। ইনজুরির আফসোস। মাশরাফি বিন মুর্তজাকে নিজের আদর্শ মানা ছেলেটি বাংলাদেশের জার্সিতে অভিষেক করলেন ২০১৪ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ দিয়ে। টুর্নামেন্টের ৩১তম ম্যাচ। তাসকিনের প্রথম; প্রতিপক্ষ ছিল শক্তিশালী অস্ট্রেলিয়া। যে মিরপুরের ভেন্যুতে তাকে সবাই চিনেছিল, ঢাকার মোহাম্মদপুরের ছেলেটি সেই ভেন্যুতেই অভিষেক করলেন। ৪ ওভারের ২৪ বলে খরচ করলেন সমান ২৪ রান। সঙ্গে টি-টোয়েন্টি স্পেশালিষ্ট ম্যাক্সওয়েলকে বোল্ড করে দিয়ে তাক লাগিয়ে দিলেন। বলটি বুঝেই উঠতে পারেননি ম্যাক্সওয়েল!

সদ্য কৈশোর পেরোনো সেই তাসকিন; Image Source: BCB

বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) তাকে লম্বা সময়ের ঘোড়া হিসেবে দেখছিল। তার মেধা আর ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহ অবাক করছিল সবাইকে। মাশরাফি বিন মুর্তজার অভাবটা একসময় তিনিই কাঁধে তুলে নেবেন; সেভাবেই  তৈরি করা হচ্ছিল তাকে। এখনও করা হচ্ছে। কিন্তু ওই যে, ফাস্ট বোলার হয়ে একাধিকবার ইনজুরিতে পড়ে যেন খেই হারাতে বসলেন তিনি। ফলাফল, পারফরম্যান্স খারাপ হতে থাকলো। দুর্ভাগ্য সঙ্গী হয়ে বারবার ভাগ্যে ইনজুরির আশঙ্কা এসে সবকিছু ভজকট করে দিল। চুক্তি থেকে বাদ পড়লেন, ইনজুরি নিয়ে পুনর্বাসন শুরু করলেন। তারপর আবার যা, তা-ই। তাসকিন ‘ইনজুরড’।

১.

তামিম ইকবালকে একবার বলা হলো, বাংলাদেশি কোনো বোলারের বলে ক্যাচ মিস হওয়ার ঘটনা বর্ণনা করতে। তাসকিন আহমেদের কথা বলেছিলেন তিনি। তামিমের ভাষায়, “ভারতের কোনো এক ব্যাটসম্যান একবার তাসকিনের বলে ক্যাচ তুলেছিল। তাসকিন উইকেটে দাঁড়িয়ে হাতজোড় করে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছিল যেন ক্যাচটা মিস না হয়। ব্যাপারটা আমার কাছে খুব মজা লেগেছে। কিন্তু সত্যিটা হলো, তাসকিন ক্রিকেটের ব্যাপারে খুবই প্যাশনেট। সে কখনোই তার পাওয়া উইকেট হারাতে চায় না।”

তাসকিনকে কিছু একটা বোঝাচ্ছেন তামিম ইকবাল; Image Source: AP

এই হাতজোড় করার পেছনেও কারণ আছে। তাসকিন বোলার হিসেবে ভালো হলেও ভাগ্যটা দুর্গতির মতো। কেন যেন তার ওভারে ক্যাচ উঠলেই তা মিস হয়ে যায় ফিল্ডারদের। তাতে বারবার আশাহত হন তাসকিন, যা তার বোলিংয়েও প্রভাব ফেলে। সেসব কাটিয়ে তাসকিন চেষ্টা করেন আবারও নিজেকে ফিরে পেতে।

তাসকিন ক্যারিয়ারের প্রথম ধাক্কাটা খেয়েছিলেন ২০১৬ সালে। সেবার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে তার বোলিং অ্যাকশন অবৈধ বলে অভিযোগ করেন আম্পায়াররা। পরে অবশ্য প্রমাণিতও হয়। সেই থেকে বারবার দলে আসা যাওয়ার মধ্যে আছেন তাসকিন।

টেস্ট খেলার খুব ইচ্ছে ছিল তার। বারবার গণমাধ্যমে সে কথা জানাতেনও। কিন্তু সামর্থ্য থাকলেও তার ইনজুরির আশঙ্কায় সাদা পোশাকে খেলাতে চায়নি বিসিবি। পরে অবশ্য বাধ্য হয়েছে টেস্টে নামাতে। গেল বছর; অর্থাৎ ২০১৭ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়েলিংটনে এই ফরম্যাটে অভিষেক হয় তার। সাদা পোশাকে পারফরম্যান্স রঙিন করতে পারেননি তাসকিন। এখন পর্যন্ত ৫ টেস্ট খেলে নিয়েছেন ৭ উইকেট। অন্যদিকে, ওয়ানডে খেলেছেন ৩২টি। এখানে আছে ৪৫ উইকেট। ১৯ টি-টোয়েন্টি ম্যাচে ১২ উইকেট।

২৩ বছর বয়সী তাসকিনের সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন নেই স্বয়ং বোর্ডেরও। কিন্তু তাসকিনের উপর ভর করেছে দুর্ভাগ্য। সেটা কাটানোর ক্ষমতা কার?

২.

তাসকিন প্রথম ইনজুরিতে পড়েছিলেন ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে। এবার ‘এ’ দলের হয়ে ভারত সফরে যাওয়ার কথা ছিল তার। কিন্তু ইনজুরির কারণে যাওয়া হয়নি। সেবার তার জায়গায় দলে ভেড়ানো হয়েছিল কামরুল ইসলাম রাব্বিকে।

ডানহাতি ফাস্ট বোলার তাসকিন এর পরে একাধিকবার ইনজুরিতে পড়েছেন। পুনর্বাসন প্রক্রিয়া শেষে মনে রাখার মতো করে ফিরেছেনও। কিন্তু সর্বশেষ নিদাহাস ট্রফি থেকে যেন এই ইনজুরি তার পিছুই ছাড়ছে না। ওই সিরিজে পাওয়া চোট কাটিয়েছিলেন ৩ মাস ধরে। কিন্তু আবাহনী মাঠে অনুশীলন করতে গিয়ে আবারও বিপত্তি। পিঠের ব্যথায় বিছানায় পড়ে থাকতে হয়েছে তাকে। সঙ্গে হাতের কবজির চোট। এই ইনজুরিগুলোর কারণেই আফগানিস্তান সিরিজে জায়গা হয়নি তার।

বাঁধভাঙা উদযাপন; Image Source: AP

সবকিছু যখন ঠিক হয়ে গেল, বাংলাদেশ তখন উইন্ডিজ সফরে। এর মধ্যে আবার আয়ারল্যান্ড ‘এ’ দলের বিপক্ষে বাংলাদেশ ‘এ’ দলের লম্বা সিরিজ। তাই আয়ারল্যান্ড সফরে ভাগ্য খুললো তাসকিনের। তাকে দলে ভেড়ানো প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীন নান্নু বলেছিলেন, “আমাদের হাতে তাসকিনের মেডিকেল রিপোর্ট এসেছে। সে অনুযায়ী বলা যায়, আয়ারল্যান্ড সিরিজের জন্য ও প্রস্তুত, কোনো সমস্যা হবে না। পুরোপুরি ফিট আছে। তাকে দলে পেলে ফাস্ট বোলিংয়ের পুল আরও শক্তিশালী হবে, কারণ সামনে জাতীয় দলের অনেক খেলা আছে, সেখানে ফাস্ট বোলারের প্রয়োজন আছে।”

তাসকিন আয়ারল্যান্ড গেলেন। প্রথম তিনটি ওয়ানডেতে সুযোগ না পেলেও চতুর্থ ওয়ানডেতে একাদশে জায়গা হলো তার। কিন্তু ওই ম্যাচই শেষ। আবারও ইনজুরিতে  পড়লেন। ফলাফল, মাঝপথে দেশে ফিরতে হলো।

৩.

যে কব্জির ইনজুরি নিয়ে ভুগছিলেন, সেই একই জায়গায় আবারও আঘাত পান তাসকিন। দেশে ফিরে বলেছিলেন, “পিঠে আমার বড় ইনজুরি ছিল। এরই মধ্যে আবার অনুশীলনে আমার হাত ফেটে যায়। তখন সাতটা সেলাই লেগেছিল। তারপর হাত শুকানোর পর আয়ারল্যান্ডে আবার পিঠের ইনজুরি সমস্যা করছিল। ব্যথা সেরে যাওয়ার পর ফিটনেস টেস্ট দিয়ে চার নম্বর ওয়ানডেটা খেলতে পেরেছিলাম, পাঁচ ওভার বল করেছিলাম। একই ম্যাচে থার্ড ম্যানে ফিল্ডিংয়ের সময় বল থ্রো করতে গিয়ে হাতটা আবার ফেটে যায়।”

তাসকিন বলেন, “তখন হাতে সাতটা সেলাই লেগেছিল, এবার দুটি। হাতের তালুর দিকটায় বল লেগে ফেটে গিয়েছ। এটা আসলে আমার দুর্ভাগ্য বলা যায়। একই জায়গায় আগে ব্যথা পেয়েছিলাম, এখন আবার সেই জায়গাতেই ফাটলো। এটা খুবই দুঃখজনক। আমি সাড়ে পাঁচ-ছয় মাস পর খেলতে নামলাম। কিছু করার নেই আসলে। সামনে অনেক খেলা আছে, যদি হাত ঠিক হয় তাহলে সুযোগের অপেক্ষায় থাকবো।”

ইনজুরির এমন সমস্যা নিয়ে প্রচণ্ড হতাশ তাসকিন। বারবার ফিরতে চাইলেও যেন পেরে  উঠছেন না তিনি। কেবল নিজেকে নিয়ে নিজে নয়, আপনজনরাও তাকে নিয়ে আফসোস করছে। সব মিলিয়ে এই বাজে সময়ের মধ্যেও খেই হারাচ্ছেন ২১ বছর বয়সী এই ক্রিকেটার।

টেস্টে উইকেট নেওয়ার পর তাসকিনের উদযাপন; Image Source: AFP

তিনি বলেছেন, “আমার কথা না হয় বাদ দিলাম। পরিবারের সদস্য থেকে শুরু করে বন্ধুরা সবাই আফসোস করছে। আমার কেমন অনুভব হচ্ছে সেটা আমি ভালো জানি। তবে এসব জীবনের অংশ। তাছাড়া আহামরি কিছু তো হয়ে যাইনি। সামনে ভালো করার বয়স আছে। আমি চাই সবসময় খেলার মধ্যে থাকতে, ভালো করতে। কিন্তু শেষ এক বছর ধরে ইনজুরি নিয়ে খেলে যাচ্ছি, সব মিলিয়ে একটু খারাপ গেল। আমি এখন ভালো সময়ের অপেক্ষায় আছি। আমি আমার মতো কঠোর পরিশ্রম করে যেতে পারি আর বাকিটা আল্লাহর ইচ্ছা।”

মাশরাফি বরাবরই ফাস্ট বোলারদের বিশেষভাবে ফিটনেসের যত্ন নেওয়ার তাগিদ দিয়ে এসেছেন। একই কাজ করেছেন তাসকিনের সঙ্গেও। তরুণ এই ফাস্ট বোলার নিজে যতটা পারেন ফিটনেস ঠিক রাখার জন্য কাজ করে যান। কিন্তু যে ভয়টা পাওয়া হচ্ছিল, সেটাই হচ্ছে। ইনজুরিতে পড়ছেন তাসকিন।

ফিচার ইমেজ-  AFP

Related Articles