Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বাইশ গজের মন্দির

১.

মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে আজ রাজ্যের ভিড়। দেখে মনে হচ্ছে, মুম্বাইয়ের সকল মানুষই আজ খেলা দেখতে চলে এসেছে স্টেডিয়ামে। অথচ মাত্র পঁয়তাল্লিশ হাজার ধারণক্ষমতার এক স্টেডিয়ামে তা হওয়ার আসলে কোনো কারণই নেই।

কিন্তু তারপরেও মনে হচ্ছে।

দিনটা ১৫ নভেম্বর, ২০১৩। গ্যালারিতে উড়ছে তেরঙ্গা পতাকা, দর্শকের হাতে হাতে দেখা যাচ্ছে প্ল্যাকার্ড। ক্রিকেট মাঠে প্ল্যাকার্ড মানেই দর্শকের সৃজনশীলতার চূড়ান্ত রূপ, তবে এর মধ্যেও একটা প্ল্যাকার্ড বিশেষভাবে চোখে পড়ছে। প্ল্যাকার্ডে লেখা, ‘গড ডাজন্ট রিটায়ার’।

গড? হ্যাঁ, গডই তো। ম্যাথিউ হেইডেন যার সম্পর্কে বলেছিলেন, “আমি ঈশ্বরকে দেখেছি। তিনি ভারতের হয়ে চার নাম্বারে ব্যাট করেন।” ভারতের সেই ক্রিকেট ঈশ্বর শচীন টেন্ডুলকার হয়তো আজই শেষবারের মতো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ব্যাট করতে নামছেন।

ক্রিকেট ‘গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলা’ বলেই ‘হয়তো’ শব্দটা ব্যবহার করা হচ্ছে। তা নাহলে এই সিরিজে ওয়েস্ট ইন্ডিজের এমনই যাচ্ছেতাই অবস্থা যে, শচীন যে দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিং পাবেন, সে ব্যাপারে আশাবাদী লোক একেবারেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

সেই আশঙ্কাই সত্যি হলো শেষ পর্যন্ত। প্রথম ইনিংসের মতো দ্বিতীয় ইনিংসেও ওয়েস্ট ইন্ডিজ ব্যাটিং বিপর্যয়ে পড়ায়, ইনিংস এবং ১২১ রানের বড় জয় পেল ভারত, দুই ম্যাচের সিরিজে হোয়াইটওয়াশ করল ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। তবে শচীনের বিদায়ী ম্যাচে সেসব নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় কোথায়? ৭৪ রান করে শরীর টেনে টেনে ড্রেসিংরুমের দিকে ফিরছেন শচীন, পা সরছে না, মন সাড়া দিচ্ছে না, কিন্তু তারপরেও যেতে হচ্ছে, সেটাই হয়ে থাকল এই ম্যাচের প্রধান ছবি।

২.

ভিসিআর বা ভিসিপিতে ছবি দেখা হয়েছে নিশ্চয়ই? সিনেমার ক্যাসেট রিওয়াইন্ড করলে ছবির চরিত্রগুলোর অদ্ভুত সব কাণ্ড দেখে হেসে কুটিকুটিও হয়েছেন হয়তো। সেরকমই এক ফ্ল্যাশব্যাকে শচীনের বিদায়ী ম্যাচ থেকে ঠিক দুই যুগ আগে ফিরে যাওয়া যাক।

১৯৮৯ সালে পাকিস্তান সফরে গেল ভারতের জাতীয় ক্রিকেট দল। শচীনের বয়স তখন নেহাতই ১৬, সে হিসেবে অনূর্ধ্ব-১৭ কিংবা অনূর্ধ্ব-১৯ দলেই খেলা নিয়তি ছিল হয়তো। কিন্তু তা-ই যদি হবে, তবে তার নাম শচীন কেন?

তার গা থেকে কৈশোরের গন্ধ যায়নি তখনও। স্কুল ক্রিকেটে বিনোদ কাম্বলির সাথে গড়া ৬৬৪ রানের রেকর্ড পার্টনারশিপের কথাও পুরনো হয়ে গেছে ততদিনে। রঞ্জি ট্রফিতে অভিষেক হয়েছে গুজরাটের বিপক্ষে, প্রথম ম্যাচেই করেছেন সেঞ্চুরি, তা-ও সবচেয়ে কম বয়সে। সেঞ্চুরি করেছেন ইরানি ট্রফির প্রথম ম্যাচেও। এর সাথে যদি দিলীপ ভেংসরকার, কপিল দেব, সুনীল গাভাস্কারের প্রশংসাপত্রের ব্যাপারটি যুক্ত করা যায়, তাহলে তার সম্পর্কে যে কথাটা মাথায় আসে, তা হলো, ‘বিস্ময় বালক’।

এত কিছুর পরেও শচীনকে জাতীয় দলে নেয়াটা ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। কারণ প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট আর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের মধ্যে যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য সে-ও তো কারও অজানা নয়। তারপরেও ঝুঁকিটা নিলেন নির্বাচক কমিটি, যার প্রধান ছিলেন রাজ সিং দুঙ্গারপুর। পাকিস্তান সফরের ভারতীয় দলে শচীনের নামটি ঢুকিয়ে দিলেন। আর ১৯৮৯ সালের ১৫ নভেম্বর, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষিক্ত হলেন শচীন টেন্ডুলকার।

প্রথম টেস্ট ম্যাচটা ভালো গেল না অবশ্য। ওয়াকার ইউনুসের বলে বোল্ড হওয়ার আগে করলেন ১৫ রান। তবে দ্বিতীয় টেস্টেই পেয়ে গেলেন টেস্ট এবং আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের প্রথম হাফ সেঞ্চুরি। এসব কিছুই নয়, ওয়াকার ইউনুসের বল লাফিয়ে উঠে আঘাত করেছে শচীনের নাকে, শচীন রক্তটা মুছেই বাউন্ডারি মারছেন পরের বলে, চতুর্থ টেস্টের বীরত্বপূর্ণ এই দৃশ্যই হয়ে থাকল এই সিরিজের প্রতীকী ছবি। বিস্ময় বালক পরিণত হলেন বালক বীরে। আর সেই মুহূর্ত থেকেই গোটা বিশ্ব জেনে গেল, শচীন নামের এই বীর বালক ক্রিকেটকে শাসন করতেই এসেছেন।

সেই সফরেরই আরেকটা ঘটনা। পেশোয়ারের প্রথম ওয়ানডে পরিত্যক্ত হওয়ার পরে দর্শকদের কথা ভেবে একটা ২০ ওভারের প্রদর্শনী ম্যাচ খেলার সিদ্ধান্ত নিল দুই দল। পাকিস্তানের আব্দুল কাদির তখন সেরা লেগ স্পিনার, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে শেন ওয়ার্নের আবির্ভাবই হয়নি তখনও। সেই ম্যাচে যা হলো, তা রীতিমতো ক্রিকেট রূপকথার অংশ হয়ে গেছে।

কাদিরের প্রথম ৩ বলে ৩ ছক্কা মারলেন শচীন, তার একটা আবার ভেঙে দিল ড্রেসিংরুমের কাঁচ। চতুর্থ বলে বাউন্ডারির পরে পঞ্চম বলে ৩ রান। ৫ বলে ২৫ রান নিয়ে, ১৮ বলে হাফ সেঞ্চুরি করলেন শচীন, কিন্তু যেহেতু প্রদর্শনী ম্যাচ ছিল, তাই তার এই কীর্তিকে অফিসিয়াল হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হলো না। এই ঘটনার তিন মাসের মাথায় শ্রীলঙ্কার সাথে ১৮ বলে হাফ সেঞ্চুরি করেন অস্ট্রেলিয়ার সাইমন ও’ ডনেল। কিন্তু মাথায় রাখা প্রয়োজন, সাইমনের বয়স তখন ২৭, প্রায় ৫ বছর ধরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পথচলা তার। অপরদিকে শচীনের সেটাই ছিল প্রথম সিরিজ, সেখানেই এরকম পারফরম্যান্স।

৩.

দীর্ঘ চব্বিশ বছরের ক্যারিয়ার শচীন টেন্ডুলকারের। পুরষ্কার তো নেহাত কম পাননি। ওয়ানডেতে ম্যাচসেরাই হয়েছেন ৬২ বার। সিরিজসেরা বা অন্যান্য পুরষ্কারের কথা বাদই দেয়া যাক।

কিন্তু তারপরেও এগুলোর কোনোটাই নয়, বরং শচীনের কাছে সবচাইতে দামী পুরষ্কার ১৩টা কয়েন। এই কয়েনগুলো তিনি পুরষ্কার হিসেবে পেয়েছিলেন তার শৈশবের গুরু রমাকান্ত আচরেকারের কাছ থেকে। প্র্যাকটিস করতে করতে যেদিন টেন্ডুলকার ক্লান্ত হয়ে পড়তেন, সেদিন শিষ্যকে উদ্দীপ্ত করতে একটা কয়েন স্ট্যাম্পের উপরে রেখে দিতেন আচরেকার। যদি কেউ শচীনকে আউট করতে পারে, তবে কয়েনটি সেই বোলারের। না হলে, সেটি শচীনের। এভাবে ১৩টি কয়েনের মালিক হয়েছিলেন তিনি।

শিষ্যের গ্রিপটা ঠিক করে দিচ্ছেন আচরেকার; sourse: rediff.com

আচরেকার ছিলেন সাক্ষাৎ জহুরী। শচীন নামের কাঁচা হীরে চিনতে একেবারেই ভুল করেননি তিনি। কাঁচা হীরে আরেকজনও ছিল, বিনোদ কাম্বলি তার নাম। শচীন আর বিনোদই মুম্বাইয়ের সেরা তরুণ ক্রিকেটার, এই মর্মে সার্টিফিকেটও দিয়ে দিয়েছিলেন আচরেকার। কিন্তু ক্রিকেট নামের আকাশে শচীন যেখানে এক জ্বলজ্বলে নক্ষত্রের নাম, বিনোদ কাম্বলি তো মিটমিট করেও জ্বলছেন না?

এখানেই চলে আসে পরিবারের ভূমিকা। প্রতিভা অনেকেরই থাকে, কিন্তু সেটাকে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য গাইডের দরকার হয়। শচীন এবং বিনোদ দুজনেরই আচরেকার ছিলেন, কিন্তু শচীনের ছিল একটা শিক্ষিত পরিবার, বিনোদের যা ছিল না। শচীনের বাবা রমেশ টেন্ডুলকার ছিলেন কবি এবং মারাঠি সাহিত্যের অধ্যাপক। সন্তানকে সবসময় শিখিয়েছেন, ভালো খেলোয়াড় হওয়ার আগে একজন ভালো মানুষ হওয়ার জন্য। জাতীয় দলের হয়ে খেলা শুরু করার পরে যখন অর্থ, বিত্ত, প্রতিপত্তি স্রোতের মতো আসছে, তখনও তাকে আগলে রেখেছেন তার পরিবারের লোকেরা।

একসাথে দুই বন্ধু- বিনোদ আর শচীন; source: scoopwhoop

বিনোদকে গাইড দেয়ার ছিল না কেউ। তার বাবা গণপত কাম্বলি ছিলেন এক ফ্যাক্টরির শ্রমিক। শুরুটা ছিল ঝড়ের মতো। প্রথম টেস্টে রান নেই, দ্বিতীয় টেস্টে হাফ সেঞ্চুরি। তৃতীয় আর চতুর্থ টেস্টে ব্যাক টু ব্যাক ডাবল সেঞ্চুরি, যে কীর্তি ডন ব্র্যাডম্যান আর ওয়ালি হ্যামন্ড ছাড়া নেই আর কারও। পঞ্চম টেস্টে ব্যাটিংই পেলেন না। ষষ্ঠ আর সপ্তম টেস্টে আবার সেঞ্চুরি। বিনোদ, শচীনকেও ছাড়িয়ে যাবেন এরকমটাই যখন ভাবছে সবাই, তখনই ছন্দপতন। সুরটা এমনভাবেই কেটে গেল যে, বিনোদের টেস্ট ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গেল মাত্র ১৭ টেস্টেই।

শচীনের ক্যারিয়ারে যে ছন্দপতন হয়নি তা নয়। কিন্তু সেই ছন্দপতনকে কখনোই স্থায়ী হতে দেননি তিনি। সাধনা দিয়ে বারবার প্রতিকূলতাকে জয় করেছেন। শচীন হচ্ছেন সেই ধ্যানমগ্ন পূজারীর মতো, একমনে যিনি ক্রিকেট নামক দেবতার পূজা করে গিয়েছেন চব্বিশটা বছর ধরে। নিজের পূজারীকেও ফেরাননি দেবতা, সম্ভাব্য সকল কিছুই ঢেলে দিয়েছেন তার কোলে।

শচীন মানে তাই খ্যাতির চূড়ায় পৌঁছেও নিজেকে হারিয়ে না ফেলা। পা মাটিতে রেখে শ্রেষ্ঠত্বের দিকে ধাপে ধাপে এগিয়ে যাওয়ার নামই শচীন টেন্ডুলকার।

৪.

একশটা আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরি তার। সবগুলোর বর্ণনা দেয়া অসম্ভব, তবে সেরা কয়েকটার উল্লেখ করা তো যেতেই পারে।

১৯৯৮ সালের তিন জাতির কোকাকোলা কাপের কথাই ধরা যাক। শারজাহতে সিরিজের শেষ ম্যাচ। স্কোরবোর্ডে অস্ট্রেলিয়া জমা করল ২৮৪ রান। বালিঝড়ের কারণে সেই লক্ষ্য নেমে এলো ৫০ ওভারে ২৭৬ রানে।

ম্যাচ হারল ভারত। কিন্তু দলীয় ২৪২ রানে শচীন আউট হওয়ার আগ পর্যন্ত মনে হচ্ছিল, অস্ট্রেলিয়ার কপালে দুঃখ আছে। শচীন যখন আউট হন, তখন লাগে ১৮ বলে ৩৪, হাতে আছে পাঁচ উইকেট। সে সময়ের কথা মাথায় রাখলে কিছুটা কঠিন তো বটেই। কিন্তু অবাক ব্যাপার হলো, পরের ১৮ বলে ভারত করতে পারল মাত্র ৮ রান! অর্থাৎ, শচীনের আউটের সাথে সাথেই ম্যাচ জেতার আশা শেষ।

তার প্রতি মানুষের কতটা প্রত্যাশা ছিল তা এখান থেকেই হয়তো বোঝা যায় অনেকটা। একটা সময়, শচীন আর ভারতের ব্যাটিং লাইনআপ হয়ে গিয়েছিল সমার্থক। ‘শচীনকে আউট করো, কাজ অর্ধেক শেষ।’ এই চাপ নিয়ে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর খেলে গেছেন তিনি। ব্যর্থ যে হননি তা নয়। কিন্তু, তারপরেও ব্যর্থতা কাটিয়ে উঠেও পারফর্ম করেছেন। লোকে বলে, শচীন নাকি প্রেশারে খেলতে পারেন না। শচীনের মতো প্রত্যাশার চাপ নিয়ে ক’জন খেলোয়াড় খেলেছে?

আগের ম্যাচে সেঞ্চুরি করার পরেও দল হেরেছে, তবে তাতে ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হওয়া আটকায়নি। দুই দিন পরে, কোকাকোলা কাপের ফাইনাল। কাকতালীয়ভাবে সেদিনই শচীনের জন্মদিন। আবার ‘শচীন ঝড়’ উঠল মরুভূমির দেশে। আর সেই ঝড়ে উড়ে গেল অস্ট্রেলিয়া।

শারজাহতে শচীন ঝড়; source: sportstarlive

আগের ম্যাচে করেছিলেন ১৪৩। এই ম্যাচে করলেন ১৩৪। দলীয় ২৪৮ রানে মাইকেল ক্যাসপ্রোভিচের বলে এলবিডব্লিউ হয়ে যখন ফিরছেন তখন জয়ের জন্য ভারতের লাগে ৩৩ বলে ২৫ রান, হাতে ৭ উইকেট। এরকম এক ম্যাচ ইচ্ছে থাকলেও হারা সম্ভব না। ফলে যা হওয়ার তাই হলো। ফাইনালে জিতে কোকাকোলা কাপের চ্যাম্পিয়ন হলো আজহারউদ্দীনের দল। ম্যান অফ দ্য ম্যাচ? কে আর? শচীন টেন্ডুলকার।

পর পর দুই ম্যাচে শচীনের এই তাণ্ডব দেখে অস্ট্রেলিয়ার ক্যাপ্টেন স্টিভ ওয়াহ জানিয়ে দেন, ‘ব্র্যাডম্যানই সেরা, তবে এর পরেই শচীন। ওকে বলা যায়, আমাদের সময়ের ব্র্যাডম্যান।’ স্টিভ যে ভুল কিছু বলেননি, তা প্রমাণ হয়ে যায় যখন নিজের সেরা একাদশের চার নাম্বারে শচীনকে রাখেন স্যার ডন।

যার সাথে তুলনা, সেই ব্র্যাডম্যানেরই ৯০ তম জন্মদিনের নিমন্ত্রণে সে বছরই অস্ট্রেলিয়া যান শচীন। হাস্যোজ্জ্বল শচীনের সাথে ব্র্যাডম্যানের সেই ছবি এখনও টাঙানো আছে শচীনের মুম্বাইয়ের বাড়িতে।

ডনের ৯০তম জন্মদিনে শচীন আর ডন; source: indianexpress

অথবা ওয়ানডে ক্রিকেটের প্রথম দ্বিশতক। কে করবেন, তা নিয়ে লম্বা লম্বা প্রবন্ধ লেখা হয়েছে, সেখানে ছিল শচীনের নামও। কিন্তু যত সময় যাচ্ছিল, সুযোগ কমে আসছিল ক্রমশ। অবশেষে সাঁইত্রিশ বছর বয়সে তিনিই ভাঙলেন দ্বিশতক নামের তালা।

এখন রোহিত শর্মারই দ্বিশতক আছে তিনটে। দ্বিশতক আছে শেওয়াগ, গেইল, গাপটিলেরও। তবে একটা জায়গায় শচীন সবার থেকে এগিয়ে। ওয়ানডের প্রথম দ্বিশতক কে করেছিলেন, তা জানতে চাইলে সবাই তার নামই বলবে।

৫.

দুটো জিনিস খুব চাওয়ার ছিল শচীনের। এক, ভারতকে টেস্ট ক্রিকেটের শীর্ষে উঠতে দেখা। দুই, একটা বিশ্বকাপ।

প্রথমটা হতে দেখেছেন। ২০০৯ সালে শ্রীলঙ্কার সাথে ৩ টেস্টের সিরিজ খেলছিল ভারত, ২ টেস্ট খেলার পরেই টেস্ট র‍্য্যাংকিংয়ের শীর্ষে উঠে যায় তারা। বাকি থাকে একটা বিশ্বকাপ।

২০০৩ সাল। দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপ। সেবার অসাধারণ খেলেছিলেন শচীন। ৬৭৩ রান করে হয়েছিলেন বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। কিন্তু বিশ্বকাপটা রেখে আসতে হলো অস্ট্রেলিয়ার কাছে। আরও ভালো করে বললে, রিকি পন্টিংয়ের কাছে।

এর পরে এলো ২০০৭ সাল। সম্ভবত, এই বিশ্বকাপের কথাটা ভুলে যেতে চাইবেন শচীন। প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশের কাছে হারের পরে বারমুডার সাথে বিশাল জয়। দ্বিতীয় রাউন্ডে যেতে হলে শ্রীলঙ্কার সাথে জিততেই হতো। পারল না ভারত, পারলেন না শচীন। দিলহারা ফার্নান্দোর বলে নবিশের মতো বোল্ড হয়ে ড্রেসিংরুমে ফিরলেন, শূন্য চোখে দেশের বিশ্বকাপ স্বপ্ন ডুবতে দেখলেন ক্যারিবিয়ান সাগরে।

এর এক বছর আগে, পাকিস্তান সফরে গিয়ে প্রশ্নটা জোরেশোরে উঠে গিয়েছিল। তার নিজের দেশেরই পত্রিকা টাইমস অফ ইন্ডিয়া তাকে নিয়ে খবর ছাপিয়েছিল, যার শিরোনামটা ছিল এরকম, ‘এন্ডুলকার?’

টেন্ডুলকারের পথ শেষ তবে? source: cricketcountry.com

সেই বিশ্বকাপে শোচনীয় ব্যর্থতার পরে চাকরিচ্যুত হলেন ভারতের কোচ গ্রেগ চ্যাপেল। তবে যাওয়ার আগে তিনি ইঙ্গিতে দলের প্রতি শচীনের নিবেদন নিয়ে প্রশ্ন তুলে গেলেন।

চিরকালের মুখচোরা শচীন ফেটে পড়লেন এবার। তিনি কখনোই সমালোচনার জবাব মুখ দিয়ে দেননি, তার হয়ে কথা বলেছে তার ব্যাট। কিন্তু গ্রেগ চ্যাপেলের কথার জবাবে তিনি বললেন, “একজন মানুষ ১৮ বছর ধরে খেলে যাচ্ছে, অন্য দেশের একজন মাত্র ১৫ মাস এসেই কীভাবে তার নিবেদন নিয়ে প্রশ্ন তোলে?

অন্য কেউ হলে হয়তো নিজের ক্যারিয়ারের শেষটা দেখে ফেলতেন। কিন্তু, এ যে শচীন! তাই তো পত্রিকায় ‘এন্ডুলকার’ শিরোনাম হওয়ার পরের সাত বছরে শচীনে করেছিলেন ১০ হাজারের বেশি রান, সাথে ২৭টা সেঞ্চুরি। এর মাঝে আছে, ২০১০ সালে ৭ সেঞ্চুরিতে করা ১৫৬২ রানও। আরও আছে সেই দ্বিশতক। উইজডেন ক্রিকেটার্স অ্যালম্যানাকের ‘লিডিং ক্রিকেটার অফ দ্য ইয়ার’ এর পুরষ্কার পেলেন সেবার, পেলেন আইসিসি বর্ষসেরা ক্রিকেটারের পুরষ্কার স্যার গ্যারি সোবার্স ট্রফিও।

এন্ডুলকার বলে ঘোষিত হওয়ার পরেও এত কিছু?

একেই বুঝি বলে চ্যাম্পিয়ন!

৬.

অবশেষে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ভারত, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কায় বসেছে দশম বিশ্বকাপের আসর। শচীনের শেষ বিশ্বকাপ। হলে এবারই, নয়তো আর কখনোই নয়।

মহেন্দ্র সিং ধোনির নেতৃত্বে ২৮ বছর পরে ক্রিকেটের বিশ্বসেরা হলো ভারত। সেই ৩৮ ছুঁইছুঁই বয়সেও শচীনই ভারতের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক, টুর্নামেন্টে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। বিশ্বকাপটা হাতে নেবেন এই অপেক্ষায় যখন আছেন, তখনই চমক দিলেন বিরাট কোহলি। তাকে কাঁধে নিয়ে ল্যাপ অফ অনার দিলেন পুরো মাঠে। কারণ হিসেবে বিরাট জানালেন, “এই মানুষটা দীর্ঘ ২২ বছর ধরে পুরো ভারতবাসীর প্রত্যাশার ভার নিজের কাঁধে বয়েছেন। আজ তাকেই কাঁধে তুলে নিয়ে তার ঋণ কিছুটা শোধ করার চেষ্টা।

বিশ্বকাপ তো অনেকেই পায়, কতজনই তো পেয়েছেন। কত অখ্যাত খেলোয়াড়ও বিশ্বকাপজয়ী দলের সদস্য হয়ে আছেন। কিন্তু সতীর্থদের কাছ থেকে এই যে সম্মান, তা শচীন ছাড়া আর কেউ পেয়েছেন কি?

৭.

লেখাটা শেষ করার আগে শুরুতে ফিরে যাওয়া যাক।

ম্যাচ শেষ হয়েছে ঘণ্টাখানেক। কিন্তু অবাক ব্যাপার হচ্ছে, একটা লোকও মাঠ ছেড়ে যায়নি এখনও। সবাই অপেক্ষা করছে শচীনের বিদায়ী ভাষণের জন্য।

অবশেষে তিনি এলেন, হাতে বিশাল একটা তালিকা। খেলোয়াড় হিসেবে শচীন কতটা বড় ছিলেন, তা জানা আছে অনেকেরই, কিন্তু এই ঘটনাটা মানুষ হিসেবেও তিনি কতটা বড় বুঝিয়ে দেয় তা। তার জীবনে সামান্যতম ভূমিকা রাখা মানুষেরও নাম লিখে আনতে ভুলেননি তিনি।

একে একে সবার নাম পড়ে গেলেন শচীন। পড়তে গিয়ে কণ্ঠ আটকে গেল, বাষ্পরুদ্ধ হলো চোখ। তারপরেও শুরু যখন করেছেন, শেষ তো করতেই হবে। শেষ করতেই দুই বছর আগের স্মৃতি ফিরে এলো আবার, তাকে ঘাড়ে তুলে নিলেন বিরাট এবং ধোনি।

শচীনকে কাঁধে নিয়ে বিরাট এবং ধোনির ল্যাপ অফ অনার; source: indiatoday.in

ল্যাপ অফ অনারও শেষ হয়ে গেল। দিনের সবচেয়ে আবেগঘন মুহূর্তের সূত্রপাতও হলো তখনই। রোদের জন্য মাথায় তখনও সাদা হ্যাট। শেষবারের মতো হেঁটে গেলেন পিচের মাঝখানে। চোখ যে অশ্রুসজল হয়ে উঠেছে, না দেখেও বলে দেয়া যাচ্ছিল তা।

পূজারী হিসেবে বাইশ গজের মন্দিরে শেষবারের মতো প্রণাম করলেন শচীন রমেশ টেন্ডুলকার।

বাইশ গজে শেষবারের মতো; source: cricwizz

তথ্যসূত্রঃ উৎপল শুভ্রের লেখা বই, ‘শচীন রূপকথা’

Featured photo: Sachin Tendulkar / Facebook

 

Related Articles