'অ্যান্ড লিটন দাস ইজ পেইন্টিং আ মোনালিসা হিয়ার!'
কমেন্ট্রি বক্স থেকে ইয়ান বিশপের বিখ্যাত লাইনের কথা মনে করতে বসলে ২০১৬ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ফাইনালের কথাই আগে মনে আসে। “কার্লোস ব্র্যাথওয়েইট, রিমেম্বার দ্য নেম!” - বেন স্টোকসকে টানা চার ছয় মেরে উইন্ডিজকে দ্বিতীয়বারের মত বিশ্বকাপ জেতানোর পর ইয়ান বিশপ বলেছিলেন ব্র্যাথওয়েইটকে মনে রাখবার কথা।
লিটনকে নিয়ে কথাটা অবশ্য তেমন বিখ্যাত কিছু না। বাংলাদেশ ভক্তদের সবার মনেও সে কথা গেঁথে নেই, এমনকি আইসিসির অফিসিয়াল হাইলাইটস রিলেও নেই। বিশপ এ কথা বলেছিলেন ২০১৯ বিশ্বকাপে উইন্ডিজের সাথে বাংলাদেশের ম্যাচে, সেদিন বিশ্বকাপে নিজের প্রথম ম্যাচ খেলতে নেমেই করেছিলেন অপরাজিত ৯৪। সাকিবের শতকের সাথে লিটনের এই ইনিংসে বাংলাদেশ ৩২২ রানের লক্ষ্য টপকে গিয়েছিলো ৫১ বল থাকতে। আচ্ছা, লিটন কি সেই ম্যাচ শেষে আফসোস করেছিলেন, উইন্ডিজ আর রান দশেক বেশি করলো না কেন?
ম্যাচ জিতবার পর লিটনের আক্ষেপ থাকবার অবশ্য কথা নয়। নাহলে নিজেকে চাইলেই দুর্ভাগা ভাবেতে পারতেন, মাত্র ছয় রানের জন্য যে দ্বিতীয় ওয়ানডে শতকটা হলো না। অবশ্য লিটনের ক্যারিয়ারজুড়েই ভাগ্যদেবীর কাটাছেঁড়া। মাঝেমধ্যে নিজের দোষে যে দাগ পড়েনি সেটা নয়, তবে ভাগ্যদেবীর সঙ্গে বিরোধের কথা বলাই যায়।
তবে ভাগ্যদেবী মুখ তুলে তাকান অবশ্যই, কোনো না কোনোদিন। লিটনের দিকে তাকালেন ৬ই মার্চ, ঠিক মাশরাফির অধিনায়ক হিসেবে শেষ ম্যাচে, সেই মাশরাফির দিনে, যিনি লিটনকে আগলে রেখেছেন এত বছর। ভাগ্যদেবী ঠিক সেদিনই লিটনকে বর দিলেন, যেন লিটন মাশরাফির দিনকে নিজের মতো রাঙাতে পারেন।
ঠিক আগের ম্যাচেই ভাগ্যের পরিহাসে আউট হয়েছিলেন। তামিমের অফ ড্রাইভটা বোলারের হাতে লেগে স্ট্যাম্পের দিকে গেল, ক্রিজ থেকে বেরিয়ে যাওয়া লিটন ফিরতে পারলেন না। নির্বিষ জিম্বাবুইয়ান বোলিংয়ের বিপক্ষে দারুণ ফর্মে থেকেও আরেকটু রান করবার সুযোগ হলো না। হলে? আরও কয়েকটা রেকর্ড নিশ্চিত নিজের ঝুলিতে পুড়তেন লিটন।
যেমন পুড়েছেন শেষ ওয়ানডেতে। বৃষ্টি নামবার আগেই সিরিজের দ্বিতীয় আর ক্যারিয়ারের তৃতীয় সেঞ্চুরি, ৮০ পেরোবার পর থেকে কেমন যেন ছটফট করছিলেন। তামিম অন্য পাশ থেকে বললেন ধীরস্থির থাকতে। লিটন থাকলেন। জিম্বাবুইয়ান বোলাররা হয়তো ভেবেছিলেন, থাকবেন না। ম্যাচের পর হয়তো বলেছেন, না থাকলে কী হতে পারতো!
অবশ্য জিম্বাবুয়ে অধিনায়ক শন উইলিয়ামসের আক্ষেপটা হবার কথা যে কারও চেয়ে বেশি। লিটন তখন ৫৪ রানে, একটা আর্ম বল মিস করলেন, পেছনের পায়ে লাগলো বল। আম্পায়ার আউট দিলেন না, কী যেন ভেবে উইলিয়ামসও রিভিউ নিলেন না। হক-আই দেখালো, বলটা লেগ স্ট্যাম্পে লাগছিলো। উইলিয়ামস কি ম্যাচ শেষে ভেবেছেন, রিভিউটা নিলে কী হতো?
বৃষ্টির পর খেলা সাত ওভার কমে নেমে এলো ৪৩ ওভারে। আকাশ থেকে ঈশ্বর বৃষ্টি থামালেও ২২ গজে লিটন শুরু করলেন ছক্কা-বৃষ্টি! যে তিনি এতক্ষণ একটা ছয়ও মারেননি, পরের ২৭ বলে মারলেন গুনে গুনে আট ছয়! সেই ২৭ বলে রান নিলেন ৭৪, সবেমাত্র আগের ম্যাচেই তামিম নিজেরই রেকর্ড ভেঙ্গে খেলেছিলেন বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ওডিয়াই ইনিংস, ১৫৮। লিটন সেই রেকর্ড টিকতে দিলেন মাত্র দু’রাত। যখন আউট হয়ে ফিরছেন, তার নামের পাশে জ্বলজ্বল করছে ১৭৬। ক্যারিয়ারের ওয়ানডে রান ১০০০ ছাড়িয়েছে, প্রথমবারের মতো ওয়ানডে গড় পৌঁছেছে ৩০-এর ঘরে।
লিটনের এই দুর্দান্ত ইনিংসে অবশ্য দাগ সামান্য একটু, জিম্বাবুইয়ান ফিল্ডারদের পিছলে হাত। সহজ ক্যাচ পড়েছে দু’বার, কঠিন ক্যাচ দু’বার এবং একবার ক্যাচ ধরবার পরও সেটা নো-বলের ফাঁদে পড়ে কাটা পড়েছে। কিন্তু ওরকম জীবন পেয়ে সেটা কাজে লাগাতেও জানতে হয়, এবং সামান্য নাহয় পেয়েছেন ভাগ্যদেবীর আশীর্বাদ, কিন্তু লিটন পেরেছেন তো।
তবে লিটন এমন খেলবেন, সে আশা নতুন নয়। সেই যখন থেকে ঘরোয়ায় রানের বন্যা বইয়ে দিয়েছেন, তখন থেকেই এদেশের ক্রিকেট অনুরাগীরা এই স্বপ্নে বিভোর যে, লিটন ক্রিকেট বিশ্বে ছড়ি ঘোরাবেন। লিটনের অভিষেক হয়েছে সেই ২০১৫তে, কিন্তু লিটন পারেননি। ঝলক দেখিয়েছেন, কিন্তু ধারাবাহিকতা আসেনি। এখানে-ওখানে ফিফটি কিংবা ছোট্ট কোনো ইনিংস, লিটনের ক্ষমতার সামান্য প্রমাণ দেখা যেতো সেগুলোতেই। কিন্তু নিয়মিত বড় রান করবেন, সেটি হয়ে ওঠেনি।
লাক্কাতুরা চা-বাগানের মধ্যে সিলেটে ঝড় তুলবার আগে লিটন এর আগে একবার মরু-ঝড় তুলেছিলেন, দুবাইয়ে। সেবার প্রতিপক্ষ ছিল ভারত, বোলিং আক্রমণ ছিল বিশ্বের সেরা আক্রমণগুলোর একটি। লাভ হয়নি, লিটন নিজের ক্ষমতা দেখিয়েছিলেন। দেখিয়েছিলেন, কেন মাশরাফি-সাকিব তাকে এতটা বিশ্বাস করেন। কেন তাকে বারবার সুযোগ দেওয়া হয়।
সেদিন ফিফটি ছোঁয়ার পর মাশরাফি লিটনকে বলেছিলেন ইনিংস বড় করতে। লিটন করেছিলেন। সবকিছু চুরমার করে দিয়ে বুমরাহ-ভুবনেশ্বর-চাহাল-কুলদীপদের মাঠের চারদিকে উড়িয়ে দিয়ে করেছিলেন ১২১। বাকি দশ ব্যাটসম্যান মিলে করতে পেরেছিলেন মাত্র ১০১, বিরাট কোহলিবিহীন ভারতের সেই লক্ষ্য পার করতে ঘাম ছুটেছিলো, কিন্তু তারা অতিক্রম করেছিল ঠিকই। লিটনের নিজেকে দেখানোর দিন বাংলাদেশের জন্য হয়ে দাঁড়িয়েছিলো আরেকটি আক্ষেপের রাতে।
এরপর খুচরো ইনিংস কিছু। ভারতের বিপক্ষে সর্বশেষ টেস্ট সিরিজেও ঝলক দেখিয়েছিলেন, কিন্তু স্রেফ ওই পর্যন্তই। হার্শা ভোগলে অবাক বিস্ময়ে বলেছিলেন, এরকম একজন ব্যাটসম্যানের গড় কোনো ফরম্যাটেই ২৫-এর বেশি না! ভোগলে সাহেব একা নন, এরকম মানুষ দিয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেট কমিউনিটি ভর্তি। ইডেনে পিংক বল টেস্টে যেখানে বাংলাদেশের বাকি ব্যাটসম্যানদের নাকের পানি চোখের পানি এক হয়ে গিয়েছিলো, সেখানে লিটন ছিলেন সাবলীল, নিজের দ্যুতি ছড়াচ্ছিলেন। কিন্তু ভাগ্যদেবীর নির্মম পরিহাস, কনকাশনের কারণে ফিরে গেলেন মাত্র ২৪ রানের মাথায়।
তবে লিটনের সময় এসেছে। বাংলাদেশের ভক্ত-সমর্থক গোষ্ঠী আশা করবে, জিম্বাবুয়ের সাথে ম্যান অফ দ্য সিরিজ হবার পথে ৩১১ রান করেছেন, সেটি তার ওপরে ওঠার শুরু হোক।
লিটনের ব্যাটিংয়ের অলস সৌন্দর্য্য কিংবা কমনীয়তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। কোনো প্রশ্ন নেই তার সামর্থ্য নিয়েও। প্রশ্ন ছিল এতদিন একটাই, লিটন কি ধারাবাহিক হতে পারবেন? ঘরোয়ায় যে অবিশ্বাস্য ধারাবাহিকতা দেখান, সেটি কি তিনি আন্তর্জাতিক মঞ্চে নিয়ে আসতে পারবেন?
প্রশ্ন এখনও আছে, আছে আশাও। আশার কারণ, লিটন নিজে বলেছেন, তিনি আগের চেয়ে অনেক বেশি পরিণত। আশার কারণ, সেই বিপিএল থেকেই রানের মাঝে আছেন, পাকিস্তানে টি-টোয়েন্টিতে নিজের পজিশনে না খেলতে পেরে রান পাননি, টেস্টে দুর্ভাগ্যক্রমে ভুল সিদ্ধান্তে আউট হয়েছেন। তবে জিম্বাবুয়ের সাথে টেস্টে পঞ্চাশ পেড়িয়েছেন, ওয়ানডেতে জোড়া সেঞ্চুরি।
প্রশ্ন বা ভয়ের কারণ, তিনি লিটন দাস। লিটনের হাতে এত শট, মাঝেমধ্যে মনে হয়, তিনি যেন এদের মধ্যে থেকে বাছতে গিয়ে গুলিয়ে ফেলেন। তবে আশার প্রদীপ জ্বলে ওঠে এখানেও, লিটন বলেছেন তিনি চেষ্টা করছেন শট খেলার প্রবণতা কমিয়ে আনতে।
জিম্বাবুয়ের সাথেও ভুল শট খেলেননি, এমন নয়। খেলেছেন, তবে জিম্বাবুইয়ান বোলাররা সেটার ফায়দা লুটতে পারেননি। কিন্তু তাদের চেয়ে ভালো বোলাররা পারবেন না, বিষয়টা তো এমনও না, তাই না?
ঠিক এই জায়গাটা বদলে ফেললেই লিটন হয়ে উঠতে পারেন ক্রিকেট ইতিহাসের রত্ন। তিনি পারবেন কি না, সেটা সময় বলে দেবে।
মাশরাফি বোধকরি বলেছিলেন, নেটে লিটনকে বল করাটাই সবচেয়ে কঠিন। ২২ গজে পৃথিবীর সব বোলারের এই উপলব্ধি হোক, বাংলাদেশের ক্রিকেট ভক্তরা এই কামনাই করেন নিশ্চয়ই!
The article is about Bangladesh's classy opening batsman Litton Kumar Das, who has always shown promise, but at last, now he has started to show his aptitude.
Feature Photo: Ratan Gomes/BCB