পৃথিবীতে মানুষ বড় হতে পারে দুই ভাবে। একটা ফিজিক্যালি, আরেকটা মেন্টালি। ফিজিক্যালি আপনি আপনার উচ্চতা, ওজন, দৈহিক আকৃতির পরিবর্তন এনে নিজেকে জায়ান্ট বানাতে পারবেন, আবার নিজের পার্সোনালিটি, আচার ব্যাবহারে পরিবর্তন এনে নিজেকে এদিকেও বড় করতে পারবেন। ইংরেজ সাবেক ফুটবলার ও কিছু সময়ের জন্য পার্ট টাইম ক্রিকেটার উইলিয়াম ফউলকে ছিলেন দুই দিক থেকেই একজন জায়ান্ট।
১৮৯৪ সাল থেকে ১৯০৮ সাল পর্যন্ত গোলরক্ষক হিসেবে খেলা ফউলকে তার ক্যারিয়ারে খেলেছিলেন শেফিল্ড ইউনাইটেড , চেলসি এবং শেষে ব্র্যাডফোর্ডে। ফউলকের উচ্চতা কত ছিল এটি নিয়ে অবশ্য এখনও মতানৈক্য আছে। কেউ কেউ বলে ৬ ফুট ২ ইঞ্চি, আবার কেউ বলে ৬ ফুট ৪ ইঞ্চি, আবার কেউ বলে ৬ ফুট ৯ ইঞ্চি। ওই সময়ে একজন ব্রিটিশ পুরুষের গড় উচ্চতা ছিল ৫ ফুট ৮ ইঞ্চি। উচ্চতা যতই হোক, তার ওজনের ব্যাপারে কারোর কোন মতানৈক্য ছিল না। সবাই একটা সলিড নাম্বার দিয়ে দিয়েছে, “দেড়শ কেজি”। স্বাভাবিক আকৃতির দুইজন লোক অনায়াসে চাইলেই তার শর্টসের দুই পাশে ঢুকে যেতে পারতেন।
তাকে প্রথম স্কাউট করেছিল তার এলাকার একটি দল। বর্তমানে ক্লাবটির নাম ব্ল্যাকওয়েল মাইনার্স ওয়েলফেয়ার এফসি। ঠিক ওই সময়েই ইংল্যান্ডে অংকুরিত হচ্ছিল একটি ক্লাব। প্রতিষ্ঠার ৫ বছরের মাথায় তারা চিন্তা করল তাদের দলে মোটামুটি লেভেলের একজন স্টার দরকার দলের বুস্ট আপের জন্য। সেটি খুজতে গিয়ে তারা পেয়ে গিয়েছিল ফউলকেকে। সেই ক্লাবটির নাম শেফিল্ড ইউনাইটেড।
ব্লেডদের সাথে ১১ টি বছর কাটান ফউলকে। এই ১১ বছরে তাদের হয়ে জেতেন ১ টি ফার্স্ট ডিভিশন ট্রফি ও ২ টি এফএ কাপ। মাঠে ফউলকের উপস্থিতি খেলোয়াড়দের মানসিকভাবে পুরোপুরি পালটে দিত। দর্শকের খুব প্রিয় খেলোয়াড় ছিলেন তিনি সেখানে। তাকে মাঠে চাঙ্গা রাখার জন্য দর্শকরা মাঠে তার পিছনে স্লোগান দিত, “Who ate all the pies?” শারীরিক স্থুলকায় আকৃতির জন্য দর্শকদের এমন স্লোগান কিভাবে তিনি হজম করেন জানতে চাইলে বলেন,
“I don’t mind what they call me as long as they don’t call me late for my lunch.”
তবে বেশি রেগে গেলে আবার তাদের কোন নিস্তার ছিল না। সোজা গিয়ে তাদের উপরে বসে পড়তেন। যতক্ষণ না তারা মাফ চায় ততক্ষণ এই দানবীয় শরীর নিয়ে এভাবেই থাকতেন । খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে তার কোণ লিমিটেশন ছিল না। এমন ঘটনা ছিল অহরহ যে হোটেলে অর্ধেক দলের খাবার তিনি একাই সাবার করে দিয়েছেন। তার 'ফ্যাটি' নিকনেইমটাও দর্শকদের থেকেই পাওয়া।
প্যাশনেট প্লেয়ারে এক অনবদ্য উদাহরণ ছিলেন তিনি। ১৯০২ সালের এফএ কাপের ফাইনালে মুখোমুখি হয় শেফিল্ড আর সাউদাম্পটন। সেই ম্যাচের সেকেন্ড হাফে আলফ কমনের গোলে এগিয়ে যায় শেফিল্ড। কিন্তু এর দু মিনিট পরেই হ্যারি উডের গোলে সমতায় ফেরে সাউথাম্পটন। বিতর্ক উঠে ছিল এই গোলটা নিয়ে। বল যখন উডের কাছে আসে, তখন উড অফসাইড পজিশনে দাঁড়িয়ে নিচু হয়ে জুতা ফিতা বাঁধছিলেন। তো বল যখন পান, সেটি তিনি সুন্দরভাবে জালে জড়িয়ে দেন। তাকে অফসাইডে দেখায় ফউলকেও সেই বল আটকানোর কোন চেস্টা করেন নি। রেফারি মাঠে তার সহকারির সাথে কথা বলে সিদ্ধান্ত দেন যে ডিফেন্ডারের কাছে ডিফ্লেক্ট হয়ে আসায় উড অনসাইড এবং গোলটি বৈধ। তো মাঠে এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে দর্শকরা ফেটে পড়বে স্বাভাবিক, কিন্তু এর সাথে একজন খেলোয়াড়ও যোগ দিবেন তা স্বাভাবিক ছিল না। খেলোয়াড়টি ছিলেন ফউলকে।এফএ কাপের জেতা ম্যাচ হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় ফউলকে সিদ্ধান্ত নেন রেফারির সাথে এই নিয়ে সমাধান ছাড়া মাঠ ছাড়বেন না। ম্যাচ শেষে গোসল করে সেই দিগম্বর অবস্থাতেই রেফারিকে ধাওয়া করেন রেফারিদের ড্রেসিং রুমে। ফউলকের সেই অগ্নিমূর্তি দেখে রেফারি কার্কহ্যাম ঝাড়ু রাখার কাবার্ডে আশ্রয় নেন। ফউলকে সেটির দরজা ভাঙ্গার চেস্টা করলে এফএর কিছু অফিসিয়াল তাকে সরিয়ে নিয়ে যান।
তবে সমতায় শেষ হওয়া সেই ফাইনালের রিম্যাচে শেফিল্ড ২-০ গোলে জেতে। সেই রিম্যাচেও রেফারি ছিলেন কার্কহ্যাম। তার কপালটা এযাত্রা ভালই ছিল বলা যায়। না হয় ফউলকের হাত থেকে রেহাই পেয়ে এরপরের কোন ম্যাচে রেফারিং করার সুযোগ আর নাও পেতে পারতেন।
ওইসময়ে ট্রান্সফার মার্কেটে ফউলকের ডিমান্ড ছিল অনেক। এতবছর না ছাড়লেও শেষ পর্যন্ত শেফিল্ড চেলসির কাছে ফউলকেকে বিক্রি করে দেয় ৫০ পাউন্ডে। ১৯০৫ সালে তখন সবে মাত্র চেলসি ফুটবল ক্লাবটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ৩১ বছর বয়সী ফউলকে সেখানে গিয়েই হয়ে যান দলের ১ম চয়েজ গোলরক্ষক। সাথে তাকে দেওয়া হয়েছিল দলের ক্যাপ্টেন্সিও। চেলসির তৎকালীন মালিক ফউলকের এই জনপ্রিয়তাটাকে কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন মাঠে দর্শক আনতে।
চেলসি প্রতিপক্ষকে দ্বিধায় ফেলার জন্য গোলপোস্টের পেছনে দুইজন ছোট ছেলেকে রাখত। তারা ফউলকের দুই পাশে দাঁড়াতো সচরাচর। এতে ফউলকের সাইজ আরো বড় মনে হত আর আর বিপক্ষ দল দূর থেকে গ্যাপ খুজে পেত না। এইভাবে ফউলকের পেছনে বসে থাকা ছিল একটি বোরিং কাজ। তো যখন বল মাঠের বাইরে চলে যেত, তখন তারা বল কুড়িয়ে এনে ফউলকেকে দিত গোল কিক নেওয়ার জন্য। ফুটবলে বল বয়ের ধারণাটা জন্মে এখান থেকেই।
মাঠে প্রচুর মজার মজার কান্ড করেছিলেন ফউলকে। একবার দল যখন কাউন্টার এটাকে যায়, তখন সময় পার করার উদ্দেশ্যে গোল পোস্টের ক্রসবার ধরে একটু ঝুলতে যান। এতে ওই ক্রসবারটি বেঁকে ভেঙ্গে পরে। আবার একবার বিপক্ষ দলের এক ফরোয়ার্ডের সাথে বাদানুবাদ হওয়ায় তাকে চ্যাংদোলা করে তুলে নেটে ছুড়ে মারেন। কোন কোন রিপোর্টে বলা আছে তিনি নেটে নয়, ছুড়ে ফেলেছিলেন কাদায়। আবার এক ম্যাচে তার বিরুদ্ধে দুটি পেনাল্টি মিস করে বিপক্ষ দল। রাগে সেই দলের ফরোয়ার্ড বলে ফেলেন, "কোথায় মারব? আর তো জায়গাই নেই বল যাওয়ার।” যখন দেখতেন তার দলের প্লেয়াররা মাঠে অলসতা করছে, নিজেদের সামর্থ অনুযায়ী খেলছে না, ডিফেন্ডাররা বল আটকানোর কোন চেস্টাই করছে না, তখন সে সুন্দরভাবে মাঠ থেকে হেঁটে বেড়িয়ে যেতেন। এছাড়া একবার একটি ম্যাচে বিপক্ষ দলের সাথে তার জার্সির রং মিলে যাওয়ায় সেটি বদলানোর প্রয়োজন পরে। কিন্তু তার সাইজের অন্য কোন জার্সি পাওয়া না যাওয়ায় পাশের এক বাড়ি থেকে একটি বড় চাদর নিয়ে আসা হয় এবং সেটি গায়ে জড়িয়েই পুরো ম্যাচ খেলেন। এর চাইতে মজার ব্যাপার পুরো ম্যাচে তিনি একবারও ডাইভ দেন নি, বা দেওয়ার প্রয়োজনও হয় নি। ফলাফল পুরোপুপি পরিস্কার চাদরই মালিককে ফিরিয়ে দিতে পেরেছিলেন। চেলসির এই প্রথম লিজেন্ড কিন্তু খেলেছিলেন ইংল্যান্ডের হয়েও ১ টি ম্যাচ। কিন্তু সেই দলে উপেক্ষিতই হন সবসময়।
চেলসিতে মাত্র ১ সিজন কাটিয়ে যোগ দেন ব্রেন্ডফোর্ডে। সেখানে ইঞ্জুরির জন্য পরে আর খেলা বেশিদূর নিতে পারেন নি, অন্যান্য ইঞ্জুরির চাইতে পায়ের ইঞ্জুরিটা ছিল বেশি মারাত্মক। তার ওজনও বেড়ে গিয়েছিল অনেক। আস্তে আস্তে যখন তার শরীর তাকে সাপোর্ট দেওয়া ছেড়ে দিতে থাকে তখন ১৯০৭ সালে চলে যান অবসরে। অবসরের পরে পায়ের ইঞ্জুরির জন্য তার ইন্যাক্টিভিটি শরীরের অবস্থা আরো খারাপ করে দেয়। বছর খানেক পরে ধরা পরে তার লিভার সিরোসিস। এটিই ১৯১৬ সালে তার মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। জীবনের শেষের দিকে ব্ল্যাকপুল বিচে “বিট দ্যা গোলি” চ্যালেঞ্জে পেনির বিনিময়ে বেড়াতে আসা মানুষদের পেনাল্টি সেভ করতেন। এছাড়া শেফিল্ডে একটি দোকান ছিল তার। সেসময়ও ঘুরে বেড়াতেন তার জেতা এফএ কাপের মেডেল গলায় ঝুলিয়ে।
তাকে শুধু ফুটবলার বলাটা বড় ধরণের একটি ভুল। ১৯০০ সালের দিকে তিনি ডার্বিশায়ার কাউন্টি ক্লাবের হয়ে তিনি ৪ টা প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট ম্যাচ খেলেন । তখনও তিনি ছিলেন শেফিল্ডের গোলরক্ষক। সেই শীতের মৌসুমে তিনি হয়ে গিয়েছিলেন পুরোদস্থ একজন ক্রিকেটার। সচরাচর সিনিয়র লেভেলে এসে কারোর পক্ষে দুইধরণের খেলাতে যাওয়া সম্ভব হয় না। কিন্তু ফউলকে এটা করেছিলেন। স্লিপে দারুণ ফিল্ডিং দিতেন। ব্যাটসম্যান হিসেবে ফউলকের গড় ছিল ১০.৮৩। এর মধ্যে ফিফটিও করেছিলেন একটি এসেক্সের বিরুদ্ধে। কিন্তু পরবর্তীতে যখন দেখেন এইভাবে ক্রিকেট খেলা তার ফুটবল ক্যারিয়ারের বিরূপ প্রভাব ফেলবে তখন তা ছেড়ে দেন। কিন্তু ওই ৪ ম্যাচ খেলেই সবচেয়ে ভারী ফার্স্ট ক্লাস খেলোয়াড়ের রেকর্ড তিনি নিজের করে নেন।
ফউলকেকে একসময় বলা হত বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত ফুটবলার। শুধু চেলসিই না, তাকে বলা যায় ফুটবল ইতিহাসেরই প্রথম সুপারস্টার, প্রথম দিকের একজন এন্টারটেইনার। তার গোলকীপিং এবিলিটি নিয়ে কখনো কোন প্রশ্ন উঠে নি। তার যে কাজ ছিল মাঠে, পুরো ক্যারিয়ার জূড়েই তা করেছেন সফলভাবে। তার এগ্রেসিভ খেলার ধরণে কী পয়েন্ট ছিল ক্লিয়ারেন্স আর পাঞ্চ। সচরাচর ফুটবলাররা এগুলোর সামনে এসে দাঁড়াতো না। আমরা ফালকের খেলা কখনো দেখি নি, নেই তার তেমন কোন ভিডিও ক্লিপও। কিন্তু তার গ্রেটনেস, এখনো রয়ে গেছে ফুটবল বিশ্বে।
This article is in Bangla language. It is about William Foulke, the biggest footballer there ever was.
References:
2. https://www.bbc.com/sport/football/49392889
3. http://www.dawleyheritage.co.uk/unpublished-articles/346/biography
4. Phythian, Graham (2005) Colossus, The true story of William Foulke, Tempus