Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মারাকানায় যে ম্যাচে রচিত হয়েছিল ব্রাজিলের নবযুগের ভবিষ্যৎ

১৯৯৩ সাল। ব্রাজিলের ফুটবল ইতিহাসের নিকষতম সময়টা চলছে। ১৯৭০ সালের তর্কযোগ্যভাবে ইতিহাসের সেরা সেই ব্রাজিলের বিশ্বকাপ জয়ের পর আর কোনো বিশ্বকাপ আসেনি ব্রাজিলের ঘরে। চিরশত্রু আর্জেন্টিনার উত্থান হয় চোখের সামনে। ১৯৮৬-তে বিশ্বকাপ জেতা আর্জেন্টিনার কাছেই ১৯৯০ সালে ছিটকে যায় ব্রাজিল সেই কুখ্যাত ‘হলি ওয়াটার’ কেলেঙ্কারির ম্যাচে।

একে ২০ বছর শিরোপা খরা, তার উপর আবার চিরশত্রুর হাতে বিদায়- ব্রাজিলিয়ান ফুটবল জগতে চলছিল অশান্তি। খেলার ধাঁচ বদলে যায়, ঘরোয়া লিগেও শুরু হয় পেশীশক্তির খেলা। সব মিলিয়ে ব্রাজিলিয়ান ফুটবল একদম খাঁদের কিনারায় এসে দাঁড়ায় ১৯৯৩ সালে সেই মারাকানা স্টেডিয়ামে। সেপ্টেম্বর ১৯, ১৯৯৩; ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে সফলতম ফুটবল জাতি। হয়তোবা সেদিনই নির্ণয় হতো হতাশার তিমির পথ যাত্রা।

প্রেক্ষাপট ব্রাজিল

ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা ম্যাচের একটি মুহুর্ত; Image Source: bol.uol.com.br

সেই অবধি ফুটবল বিশ্বে একমাত্র ব্রাজিলই ছিল এমন দেশ, যারা প্রতিটি বিশ্বকাপেই অংশগ্রহণ করেছে। ১৯৯৪ বিশ্বকাপের বাছাইপর্বের শেষভাগে এসে ব্রাজিল খেই হারিয়ে ফেলে। ইকুয়েডরের সাথে গোলশূন্য ড্র করে একটু পিছিয়ে যায় ব্রাজিল। সমীকরণ তখনো পক্ষে, তার ওপর পরের ম্যাচ বলিভিয়ার সাথে, যাদের কাছে ব্রাজিল হারেনি শেষ ৩২ বছরেও। কিন্তু সেই অভাবনীয় ব্যাপারটিই ঘটে যায়। ব্রাজিল ২-০ ব্যবধানে হেরে বসে লাতিন টেবিলের সদা নিচু সারির দল বলিভিয়ার কাছে।

ব্রাজিলের জন্য বিশ্বকাপে যাওয়ার সমীকরণ হয়ে উঠলো প্রচন্ড জটিল। শেষ ম্যাচে উরুগুয়ের সাথে ব্রাজিলকে জিততেই হতো ২-০ গোলে। খেলার ভেন্যু সেই মারাকানা, যেখানে ব্রাজিলের ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি রচিত হয়েছিল। বলা বাহুল্য, সেবারও প্রতিপক্ষ ছিল উরুগুয়েই! উরুগুয়ে আর আর্জেন্টিনা- এই দুই দল ব্রাজিলের ঐতিহাসিক প্রতিদ্বন্দ্বী। উরুগুয়ের সাথে ব্রাজিল এর আগের চার ম্যাচ জয়শূন্য ছিল। এক বছরেরও কম সময় আগে উরুগুয়ে ব্রাজিলের মাটিতে এসে ২-১ গোলে হারিয়ে দিয়ে যায় তাদের।

২৩ বছরের শিরোপাহীন দলের সামনে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ না খেলার শঙ্কা, নিজের দেশের সমর্থকদের সামনে নিজেদের সেরা স্টেডিয়ামে ফুটবল গৌরব বিসর্জন দেয়ার দ্বারপ্রান্তে ব্রাজিল। ব্রাজিলিয়ান গণমাধ্যম এই ম্যাচটিকে বলেই দিয়েছে ‘ব্রাজিলের ভবিষ্যৎ নির্ণায়ক ম্যাচ’ হিসেবে। গণমাধ্যম আরেক দাবিতে সোচ্চার, “রোমারিওকে ফেরাও”। কিন্তু কেন?

প্রেক্ষাপট রোমারিও

ইতিহাসের অন্যতম সেরা ফরোয়ার্ড রোমারিও; Image Source: CNN International

সেই সময়ের সেরা ব্রাজিলিয়ান প্রতিভা রোমারিও। কারো পায়ে যদি ব্রাজিলের সাম্বা ঝলক ছিল বলার মতো, তাহলে তিনি রোমারিও। মাত্র ৫’৬” এর রোমারিওকে ব্রাজিলিয়ানরা ভালভাসতো প্রচন্ড। কিন্তু তার সমস্যা ছিল অন্যত্র। তিনি শৃঙ্খলার ব্যাপারে একদম উদাসীন। কথা বলায় কোনো বাঁধ নেই, আবার তুখোড় স্ট্রাইকার- সব মিলিয়ে তিনি যেকোনো কোচের জন্যই একাধারে সৌভাগ্য ও ঝামেলা!

পিএসভির হয়ে ইউরোপকে নিজের জাত চেনানোর পর তখন তিনি ক্রুয়েফের বার্সা ‘ড্রিম টিম’ এর আক্রমণভাগের প্রধান খেলোয়াড়। ট্রেনিং করায় তার চিরায়ত অনীহা। একপর্যায়ে ক্রুয়েফও হাল ছেড়ে দেন, কারণ ভোর অবধি পার্টি করে এসেও কোচকে বড় ম্যাচের আগে বলতেন, “দুশ্চিন্তা করো না, আমি আছি। গোল দেবো নিশ্চিত থাকো।” তার সাবেক কোচ হিডিঙ্কের মতে, শতকরা ৮০ ভাগ সময়েই তাই-ই করে দেখাতেন। কিন্তু ব্রাজিল কোচ পেরেইরার সাথে তার সম্পর্ক খারাপ হয়ে যায় তার মুখের কথার কারণেই। ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের হয়ে এক প্রীতি ম্যাচের জন্য দলে ডাক পান তিনি। উড়ে আসেন হল্যান্ড থেকে। কিন্তু কোচ তাকে নামাননি। রেগে গিয়ে রোমারিও বলেন, খেলতে নামবেন না জানলে তিনি আসতেনই না! ব্যস, পেরেইরাও চটে যান। বন্ধ হয়ে যায় ব্রাজিল জাতীয় দলের দরজা তার জন্য। ধুঁকতে থাকা ব্রাজিলের স্ট্রাইকার হিসেবে খেলতে থাকেন রোমারিওর অর্ধেক প্রতিভাবান সাও পাওলোর মুলার। ব্রাজিলের দুরবস্থাও পেরেইরার মত বদলাতে কাজে আসেনি।

রোমারিও তখন বার্সার হয়ে জ্বলছেন। রিয়াল মাদ্রিদ থেকে জুভেন্টাস- তার সামনে নত তাবড় রক্ষণভাগ। কিন্তু ব্রাজিলে তিনি ব্রাত্যই। প্রতিদিন সংবাদমাধ্যমে পেরেইরাকে এই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হতো। সদাশান্ত পেরেইরাও কেন জানি রোমারিও প্রসঙ্গ এলেই তার স্বভাবসুলভ গাম্ভীর্য ধরে রাখতে পারতেন না, রেগে যেতেন। ব্রাজিলের গণমাধ্যম থেকে জনতা- সবাই রোমারিওকে ফেরানোর দাবিতে এককাট্টা।

কোচ কার্লোস আলবার্তো পারেইরা; Image Source: FIFA.com

ইনজুরি যখন আশীর্বাদ

খাটো হওয়ায় রোমারিওকে ডাকতো সবাই ‘ও ব্যাক্সিনহো’ বলে, যার অর্থ ‘পুঁচকে’। তখন তো আর হ্যাশট্যাগ ছিল না। সিবিএফ সদর দপ্তরের সামনের দেয়ালে, রাস্তায় রোমারিওকে ফেরানোর স্লোগান লেখা হতো। কোচ অনড়। ‘ভবিষ্যৎ বাঁচানোর ম্যাচ’ সামনে রেখেও রোমারিওকে ফেরানোর নাম নেই।

ঠিক সেই ম্যাচের দিনকয়েক আগে চোট পান সাও পাওলোর ফরোয়ার্ড মুলার। ব্রাজিল কোচের হাতে আর কোনো বিকল্প রইলো না। ইগো ভেঙে পেরেইরা ডাকলেন ‘ও ব্যাক্সিনহো’কে। মারাকানায় যে দলের নাম ঘোষণা করা হলো, সেখানে স্ট্রাইকার হিসেবেই খেলতে নামলেন তৎকালীন সেরা, তথা ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার রোমারিও।

“ঈশ্বর রোমারিওকে মারাকানায় পাঠিয়েছেন”

কথার উপর লাগাম না থাকায় বাদ যাওয়া রোমারিও দলে যোগ দিয়েই কোচকে তার স্বভাবসুলভভাবেই বলেন, ভাবার কী আছে? গোল তিনি করবেনই। চিন্তিত পেরেইরাও সহমত জ্ঞাপন করে গেলেন। কিন্তু রোমারিও শুধু বলার জন্য বলতেন না। শক্তিশালী উরুগুয়ের সাথে শুরু থেকেই মারাকানা দেখলো দৃঢ়প্রতিজ্ঞ রোমারিওকে। অন্য খেলোয়াড়ের সাথে লিঙ্ক-আপ দেখে বোঝার উপায় ছিল না যে, বছরখানেক তিনি দলের বাইরে। পাস, ড্রিবলিং, ওয়ান-টু-ওয়ান করে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন, তিনি আজ ছাড়ার লোক না।

গোলরক্ষকের দক্ষতায় গোলবঞ্চিত হন, এরপর গোলবারে লেগে ফিরে আসে তার শট। ম্যাচ গড়িয়ে যাচ্ছে। হাতে ২০ মিনিট আছে, দর্শকরা শঙ্কিত। ঠিক এমনই এক অবস্থায় ১৯৫০ সালে উরুগুয়ের কাছেই হেরে গিয়েছিল ব্রাজিল। এবার তা হতে দিলেন না। ৭৮ মিনিটে পুরোদস্তুর স্ট্রাইকারের মতো হেডে দলকে এগিয়ে দেন। এর ৮ মিনিট পর মাউরো জুনিয়রের বাড়ানো বলে গোলরক্ষককে কাটিয়ে দুরূহ কোন থেকে যে গোলটি দেন, তা তার ক্যারিয়ারেরই অন্যতম সেরা এক গোল। হতবাক উরুগুয়ের গোলরক্ষক ভাবতেও পারেননি একা পেয়ে শ্যুট না মেরে এভাবে তাকে পাশ কাটিয়ে গোল দেবেন তিনি! ব্রাজিল নিশ্চিত করে ১৯৯৪ সালের টিকিট। উদ্বেলিত কোচ ম্যাচ শেষে করে দেন সেই অমর উক্তি, “ঈশ্বরই রোমারিওকে মারাকানায় পাঠিয়েছেন।”

ক্রুয়েফের বার্সা-সাফল্যের অন্যতম কান্ডারী ছিলেন রোমারিও; Image Source:Gazeta do Povo

নবযুগে ব্রাজিল

সেই ম্যাচ শুধু ব্রাজিলকে ১৯৯৪ বিশ্বকাপেই পৌঁছে দেয়নি, দলে এনে দিয়েছিল অন্য মাত্রা। রোমারিও পেলেন নবজীবন। তিনি পরে বলেছিলেন, “আমি নিশ্চিত, আমি যদি ডাক না পেতাম আর ব্রাজিল জিতে যেত, তবে বিশ্বকাপ তো দূরে থাক, আমি আর ব্রাজিলের হয়ে খেলতেই পারতাম না।” নবজীবন পাওয়া রোমারিও নবজীবন দেন ব্রাজিলকেও। ১৯৯৪ এর বিশ্বকাপটি ছিল কেবলই তার। গ্রুপপর্বের সব ম্যাচে গোল করেন, প্রি-কোয়ার্টারে দলের জয়সূচক গোলটি বেবেতোকে বানিয়ে দেন, কোয়ার্টারে হল্যান্ডের সাথে গোলের সূচনা করেন আর সেমি ফাইনালের জয়সূচক গোলটি করেন সুইডেনের সাথে। ফাইনালে গোল পাননি ফ্রাঙ্কো বারেসির সর্বকালের অন্যতম সেরা একক রক্ষণাত্মক প্রদর্শনীর জন্য, কিন্তু ঠাণ্ডা মাথায় টাইব্রেকে সফলভাবে বল জালে জড়ান। ব্রাজিল ২৪ বছর পরে বিশ্বকাপের স্বাদ পায়। ব্রাজিলের জন্য শুরু হয় এক নবযুগ।

আস্তে আস্তে উঠে আসে এক প্রজন্ম, যারা এনে দেয় স্বর্ণযুগ; Image Source:Sport.net

১৯৯৫, ৯৭, ৯৯, ২০০৩, ২০০৭- পাঁচবার ফাইনালে ওঠে ব্রাজিল, যার মধ্যে চারবারই চ্যাম্পিয়ন। ১৯৯৭, ৯৯, ২০০৫,২০০৯ ও ২০১৩- এ পাঁচবার কনফেডারেশন কাপের ফাইনাল খেলে চারবার জিতে নেয় ব্রাজিল। ১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠেও হেরে যায় ফ্রান্সের কাছে, তবে ২০০২ সালে আর ভুল করেনি ব্রাজিল।

১৯৯৪-২০০৫ অবধি ব্রাজিলের সাফল্যের কয়েকজন কান্ডারী কার্লোস, কাফু, রোনালদো নবীন সদস্য হিসেবে ছিলেন সেই ১৯৯৪ বিশ্বকাপ দলে। যদি ব্রাজিল সেই ম্যাচে ব্যর্থ হতো এবং ২৪ বছরের শিরোপাখরা আরো দীর্ঘায়িত হতো, একটা তরুণ প্রজন্ম ধ্বংস হয়ে যেত কেবল নেতিবাচকতা আর হতাশায়। ১৯৯৩ সালের সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় মারাকানায় ব্রাজিল কেবল একটি ম্যাচই জেতেনি, বাঁচিয়েছিল একটি প্রজন্মকেও, যে প্রজন্ম পরের একযুগ সদর্পে শাসন করে ফুটবল বিশ্ব।

ভাগ্যিস, ঈশ্বর রোমারিওকে মারাকানায় পাঠিয়েছিলেন!

ফিচার ইমেজ: Sporting News

Related Articles