অ্যান্টিগার রোদ চকচকে সকালটা হয়তো এখনও বিভীষিকা ছড়ায় স্টিভ রোডসের মনে। কোনো আন্তর্জাতিক ক্রিকেট দলের হেড কোচ হিসেবে প্রথম অ্যাসাইনমেন্টের প্রথম দিনে এর চেয়ে বাজে অভিজ্ঞতা আর হতে পারে না। টিভি স্ক্রিনে বারবার দেখাচ্ছিল রোডসকে। বোর্ড হাতে কলমসহ, যেন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছেন। নিজের চোখকেই বিশ্বাস হচ্ছিল না তার।
জুনে নিয়োগ, জুলাইয়ে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের অ্যান্টিগায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে প্রথম টেস্ট দিয়ে বাংলাদেশের কোচ হিসেবে রোডসের অভিষেক। ম্যাচের প্রথম ঘন্টায় যেন ধ্বংসস্তুপে রূপ নিল বাংলাদেশের ব্যাটিং লাইনআপ। লাঞ্চের আগেই ৪৩ রানে অলআউট বাংলাদেশ!
রোডসের দুঃস্বপ্নের অভিষেক। সেখানেই যদি এই ইংলিশ কোচ ইস্তফা দিতেন, তাতে অবাকও কিছু থাকত না হয়তো। কিন্তু ৫৪ বছর বয়সী রোডস সে পথে হাঁটেননি। কারণ ইংল্যান্ডে অনেক বছর কোচিং করালেও কোনো জাতীয় দলের হেড কোচ হওয়ার রোমাঞ্চ, স্বপ্ন সবই ছিল তার মনে। সেই সুযোগ তাকে দিয়েছিল বিসিবি। তাই দুঃস্বপ্ন দিয়ে শুরু হলেও টাইগারদের পাশে থেকে নিজের ক্যারিয়ারকে সমৃদ্ধ করা, নিজের সামর্থ্যকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের মঞ্চে তুলে ধরার ব্রত প্রত্যয়ী করেছে তাকে।
হেড কোচের ভূমিকায় সেই রোডসকে নিয়েই এবার বিশ্বকাপ খেলতে যাচ্ছে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দল। ইংল্যান্ডে জন্ম, বেড়ে ওঠা, পেশাদার ক্রিকেটার হিসেবে ক্যারিয়ার, কোচ হিসেবে লম্বা ক্যারিয়ার তার। তার জন্মভূমিতেই বিশ্বকাপ মিশন নিয়ে যাচ্ছে মাশরাফি বিন মুর্তজার দল।
সম্প্রতি বিশ্বকাপ নিয়ে নিজের ভাবনার কথা, বাংলাদেশের সম্ভাবনা, বাংলাদেশের সামনে থাকা চ্যালেঞ্জসহ সার্বিক বিষয়ে কথা বলেছেন রোডস। তার মতে, বিশ্বকাপে সেমিফাইনাল খেলা কঠিন বাংলাদেশের জন্য, তবে অসম্ভব নয়। ইংল্যান্ডের কন্ডিশনে বোলারদের চ্যালেঞ্জটাই বেশি দেখছেন তিনি। বাংলাদেশের অভিজ্ঞতাপূর্ণ দলের পাঁচ সিনিয়র ক্রিকেটারের জন্য নিজের সেরাটা পারফর্ম করার এটাই সেরা সময় মনে করেন রোডস। দেশের মাটিতে বিশ্বকাপের প্রস্তুতির ঘাটতি, ইমরুল কায়েসের বাদ পড়া, ইংল্যান্ডের কন্ডিশনে তার অভিজ্ঞতা, ওপেনিংয়ে তামিমের সঙ্গীসহ নানা বিষয়ে মতামত জানিয়েছেন রোডস।
বিশ্বকাপ ক্যাম্পে কি আত্মবিশ্বাস পাওয়া সম্ভব?
প্রথমত, ক্যাম্পের প্রথমভাগে খেলোয়াড়ের সংখ্যাটা আমরা কমিয়ে এনেছি। অনেক ক্রিকেটার প্রিমিয়ার লিগে খেলছিল, সেখানে কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। তাদের কিছুটা বিরতি প্রয়োজন। যদিও তাদের সঙ্গে অনেক স্কিলের কাজ করতে পারলে ভালো হতো। আমরা মনোযোগী দিয়েছি, যারা সতেজ অবস্থায় আছে। এটা ভালোই কেটেছে। যখন লোক কম থাকবে, তখন আপনি অনেক কাজ করতে পারবেন। আমরা দুদিন সবাইকে নিয়ে কাজ করবো। এর মধ্যে আমরা আয়ারল্যান্ডে ৭ মে ম্যাচ খেলবো। আশা করি আমরা তৈরি হয়ে যাবো।
নিউ জিল্যান্ড সফরটা খুবই হতাশার ছিল। আমরা আসলেই ভালো করিনি। মিঠুন, সাব্বিরের মাধ্যমে কিছু ভালো পারফরম্যান্স এসেছে। হয়তো আমরা পরের সময়ের জন্য ভালো কিছু ধরে রেখেছি। বিপিএলে খেলার পর ছেলেরাও ক্লান্ত ছিল। প্রতিদিন ম্যাচ খেলা খুব কঠিন। আমরা কাজ ওদেরকে যতটা সম্ভব নির্ভার রাখা।
আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজটাকে বিশ্বকাপের প্রস্তুতি হিসেবেই দেখছি। আমরা আয়ারল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে খেলবো। কিন্তু এটা সুযোগ দলটাকে দেখার। তামিম এই কথাগুলো বলেছে, খেলোয়াড়দের বিশ্রাম দেয়ার কথা। কাউকে সুযোগ দেয়া, তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়ানো। আশা করি ম্যাচ জিতবো, ত্রিদেশীয় সিরিজ জেতা ব্ড় কিছু হবে। আমরা আয়ারল্যান্ডে জেতার জন্যই যাবো কিন্তু এগুলো সবই প্রস্তুতির অংশ। যখন আমরা বিশ্বকাপে যাবো, তখন আমরা দশ দলের একটি হবো যারা জিততে চায়।
সেরা চারে যাওয়ার সামর্থ্য আছে বাংলাদেশের
নিষ্ঠুর হলেও সত্যি বলতে, বিশ্বকাপে বেশ কিছু খুবই ভালো দল খেলবে। বাংলাদেশের ভালো করা কঠিন হবে। তবে আমি জানি, অনেক দল বাংলাদেশকে সম্মান করে। এবং ওরা জানে, যদি তাদের খারাপ দিন যায়, এমনকি যদি ওরা ভালোও খেলে, বাংলাদেশের সামর্থ্য আছে ওদের হারানোর। আমরা আগেও সেটা প্রমাণ করেছি। আমি এখানে আসার আগে চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে খেলেছি আমরা, ভালো দলকে হারিয়েছি আমরা। উইন্ডিজকে কয়েকবার হারিয়েছি আমরা সম্প্রতি। আমরা বড় দলকে হারাতে পারি, কিন্তু আমাদেরকে নিজেদের সেরাটা খেলতে হবে। বিশেষ করে যদি আমরা নকআউট পর্বে খেলতে চাই। আমাদের কি সেই সামর্থ্য আছে? হ্যাঁ, আছে।
পঞ্চপান্ডবের সেরা এটাই সেরা সময়
আমাদের দলে এমন খেলোয়াড় আছে, যারা আগেও বিশ্বকাপে খেলেছিল। অনেক ওয়ানডে খেলার অভিজ্ঞতা আছে তাদের। এটা খুব ভালো দিক। আমার মনে হয়, কিছু খেলোয়াড়ের জন্য এটাই সময়।
সাকিবের ম্যাচ অনুশীলনের অভাব
এটাই একটা কারণ, যার জন্য সাকিব ভারতে রয়েছে। দু-একটা ম্যাচ যেন পায়। এটা ঝুঁকি, কিন্তু আমি আশা করছি, সানরাইজার্সের হয়ে সে ২-৩টা ম্যাচ পাবে। সে অনুশীলন করছে। আমি মনে করি, সে মাঠে তীক্ষ্ম, ফিট ও গতিময় থাকবে। এটা সবসময়ই সাকিবের জন্য ভালো লক্ষণ। আমি আশা করছি সে কয়েকটা ম্যাচ খেলবে। বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারেরও কিছু ম্যাচের দরকার আছে।
এখানে দু'টি বিষয় হতে পারে। একটা হলো, সে ক্রিকেটের জন্য ক্ষুধার্ত থাকবে। যখন আপনি অনেক খেলেন, তখন আপনি খেলার জন্য ক্ষুধার্ত থাকবেন। আরেকটা বিষয়, সে সানরাইজার্সের একাদশ থেকে বাইরে থাকছে। বড় মঞ্চে তাকে অনেক কিছু প্রমাণ করতে হবে। আমার মনে হয়, বাংলাদেশ দুই দিক থেকেই সুবিধা পেতে পারে।
ব্যাটসম্যানদের চ্যালেঞ্জ বেশি, নাকি বোলারদের?
ব্যাটসম্যানদের চেয়ে ইংল্যান্ডে বোলারদের জন্যই বেশি কঠিন। উইকেটগুলো ফ্ল্যাট হবে। যদি কোনো দলকে অলআউট করা যায়, সেটা দারুণ হবে। আমাদের ধরন হবে রান আটকানো এবং উইকেট নেয়া। আমাদের বড় স্কোর গড়া দরকার হবে। কিন্তু ইংল্যান্ডে এটা করা অনেক সহজ। আউটফিল্ড অনেক দ্রুতগতির। উইকেট সাধারণত ফ্লাট হবে, এবং শট খেলার জন্য বল ব্যাটে আসে। তাই ইংল্যান্ডে বড় স্কোর দেখা যায়।
হেড কোচের ইংলিশ কন্ডিশনের অভিজ্ঞতা কতটা কাজে লাগবে?
আমি মনে করি, হয়তো কিছু সুবিধা আমি পাবো কিছু মাঠের কিউরেটর-কোচদের সঙ্গে আমার সম্পর্কের কারণে। আমার কোচিং ও এসব মাঠে খেলার অভিজ্ঞতা আছে। নির্দিষ্ট দিনে ভিন্ন ভিন্ন আচরণ করে। আমি এসব অনেকটাই জানি, কিন্তু খেলোয়াড়দেরই ব্যাটে-বলে ভালো কিছু করতে হবে।
ইমরুল কায়েসের বাদ পড়া
আমরা টপ-অর্ডারে মানসম্পন্ন ক্রিকেটারের গভীরতা বাড়াতে চাচ্ছি, চার-পাঁচ জনেরও বেশি। ইমরুল কিন্তু মানের দিক থেকে শীর্ষস্থানীয় ক্রিকেটার, সে ভালো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার। সে যদি স্কোয়াডে না থাকে, তাহলে বুঝতে হবে দলে ভালো ক্রিকেটার আছে। তার মানে, আমরা দল নির্বাচনের ক্ষেত্রে গভীরতা দেখতে পাচ্ছি। এটা আরও প্রমাণ করে, যদি আমাদের ইমরুলকে দরকার হয়, আমরা জানি সে কী করতে পারে। সে স্কোয়াডে নেই, কিন্তু খুব সহজেই কিন্তু জায়গা পেতে পারতো। আমরা যদি ভালো ক্রিকেটার রেখে যাই, তাহলে অবশ্যই আমরা ভালো ক্রিকেটার নিয়ে যাচ্ছি।
লিটন-সৌম্য, ওপেনিংয়ে তামিমের সঙ্গী কে?
আমরা তামিম-লিটনকে দিয়ে বাঁহাতি-ডানহাতি কম্বিনেশনে গিয়েছি। আমি ব্যক্তিগতভাবে এই কম্বিনেশনই পছন্দ করি। সৌম্য প্রিমিয়ার লিগে শেষ দুই ম্যাচ যা করেছে, তা ভালো লেগেছে। মজার বিষয়, সে সেঞ্চুরি করার পর তাকে বলেছিলাম, তুমি ২০০ করার সুযোগ সবসময় পাবে না। তুমি যদি সুযোগ পাও, সেটা ছুঁড়ে ফেলো না। সে অনেক সময় পেয়েছিল। এবং বিস্ময়করভাবে, পরের ম্যাচে সে ডাবল সেঞ্চুরি করে ফেলেছে।
আমি এখনই ফাঁস করতে চাই না, বিশ্বকাপে ওপেনিং কম্বিনেশন কী হবে। যেটা বলতে পাারি, সৌম্য ও লিটনের উপর আমার বিশ্বাস আছে।
বিশ্বকাপে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের চাপ
তারা সবাই পরিণত মানুষ। তাদের বুঝতে হবে, তাদের কাজ পারফর্ম করা। সিনিয়রদের সাহায্য, নির্দেশনা দরকার তরুণদের। আমি আত্মবিশ্বাসী, তারা ঠিক অবস্থানে থাকবে। ইংল্যান্ডে থাকা বাংলাদেশিদের অনেক আগ্রহ থাকবে দলের প্রতি। কিন্তু সবাই জানে, কী করা লাগবে। তারা কি অনেক দূরে যাবে? আমি প্রত্যাশা করি না। এটা দলে প্রভাব ফেলবে। আশা করি, তারা (খেলোয়াড়রা) অভিজ্ঞ। তাই এসব ঠিক হবে না।
গ্রীষ্মে ইংল্যান্ডের আবহাওয়া
ইংল্যান্ড বাংলাদেশের মতো নয়। এখানে আপনি আবহাওয়া মৌসুম জুড়ে কেমন হবে, ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারবেন। গ্রীষ্মকালে ইংল্যান্ডে আপনি কিছুই অনুমান করতে পারবেন না। খুব গরম ছিল একটা সপ্তাহ, কিন্তু তার আগের দুই সপ্তাহ খারাপ ছিল। অনেক সময় গ্রীষ্মেও খুব বাতাস হয়। ভবিষ্যদ্বাণী করা সত্যিই কঠিন। গত গ্রীষ্মকাল ছিল খুবই গরম। কিন্তু আমি ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারি না।
পাদটীকা
২০১৪ সালে বাংলাদেশের কোচ হওয়ার আগে বিশ্ব ক্রিকেটে খুব পরিচিত মুখ ছিলেন না চন্ডিকা হাতুরুসিংহে। এই লঙ্কান কোচের অধীনে ২০১৫ বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে খেলেছিল বাংলাদেশ। এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপে এটাই বাংলাদেশের সেরা সাফল্য। যার মাধ্যমে কোচিং প্রোফাইল ভারী হয়েছিল হাথুরুসিংহের।
বাংলাদেশে আসার আগে এই স্টিভ রোডসও কোচিং জগতে বড় নাম ছিলেন না। এবার তার ঘরেরই মাঠে কেমন করে বাংলাদেশ, সেটাই দেখার বিষয়। তার চেয়ে বড় প্রশ্ন, রোডস কি হাতুরু হতে পারবেন? উত্তরটা বিশ্বকাপের জন্যই তোলা থাক!
This article is in Bangla language. In this interview, Steve Rhodes, the coach of the Bangladesh cricket team, talked about the possibilities of Bangladesh in the world cup.
Featured Image: Getty Images