Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

অকল্যান্ডের ক্ষত

২৪ মার্চ, ২০১৫ সাল। রাত পেরিয়ে গেছে অনেকটা। বৃষ্টির জন্য ঠান্ডা বাতাসেও স্নায়ুচাপে ঘামছেন রাসেল ডমিঙ্গো। ইডেন পার্কের মাঠে যে দিকটায় বসেছিলেন ডমিঙ্গো, তার ঠিক সামনেই ফাইন লেগ বাউন্ডারিতে দাঁড়িয়ে মাত্রই দুর্দান্ত ফিল্ডিং করে একটি চার বাঁচিয়ে দিলেন ডেল স্টেইন। তখনও নিউ জিল্যান্ডের প্রয়োজন ৮ বলে ১৮ রান। ডেল স্টেইন চেচিয়ে ডমিঙ্গোকে বাউন্ডারি থেকে বলছিলেন

‘কোচ, দুশ্চিন্তা করো না। আমরা এই ম্যাচ জিততে চলেছি।’

রাসেল ডমিঙ্গো পরবর্তীতে বলেছেন যে, শেষ ওভার করার আগেও পুরোপুরি শান্ত ছিলেন স্টেইন। সে জানতো, কী করতে হবে তাকে। কিন্তু যখন ভেট্টোরি আর এলিয়ট মিলে সমীকরণ নিয়ে এলেন ২ বলে ৫ রান, তখনই স্টেইন নিজের স্নায়ুচাপ সামলাতে পারেননি। মুভির শেষ দৃশ্যের মতো তুলির শেষ আঁচড় দিয়েছেন গ্র‍্যান্ট এলিয়ট, স্টেইনের অফ স্ট্যাম্পের করা বাইরের বলকে লং অফ দিয়ে ছয় হাঁকিয়ে। যে ছয়ের পর রীতিমত ছোটোখাটো ভূমিকম্প হয়ে গিয়েছিলো ইডেন পার্কে, যার শব্দে চাপা পড়ে গেছে প্রোটিয়াদের কান্না।

প্রতিবারই ভজকট পাকিয়ে ফেলে দক্ষিন আফ্রিকা; Image Source : Hindustan Time

অকল্যান্ডের সেই ক্ষত এখনও তাড়িয়ে বেড়ায় প্রোটিয়াদের, তা অস্বীকার করেননি ডমিঙ্গো৷ একের পর এক ট্র‍্যাজেডিতে বিশ্বকাপে বাদ পড়া দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য বিশ্বকাপ জেতার সবচেয়ে মোক্ষম সুযোগ ছিল ২০১৫ বিশ্বকাপই। সব দিক থেকেই দক্ষিণ আফ্রিকার অনূকুলে ছিলো সবকিছু। দীর্ঘদিন ধরেই ওয়ানডে ক্রিকেটে ১ নাম্বার র‍্যাংকিং থেকেই বিশ্বকাপ যাত্রা শুরু করে প্রোটিয়ারা। বলতে গেলে সবাই ছিল ক্যারিয়ারের তুঙ্গে। ডি ভিলিয়ার্স হতে শুরু করে ডু প্লেসি, আমলা, ডি কক, মিলার, স্টেইন, মরকেল সবাই ছিলেন ইন ফর্ম। যে দলকে বহুমুখিতার দিক দিয়ে ১৯৯৯ সালের হ্যানসি ক্রনিয়ের দলের সাথে তুলনা করেছিলেন ডমিঙ্গো। শুধুমাত্র একজন ল্যান্স ক্লুজনারের মতো ৭ নাম্বারে একজন অলরাউন্ডারের অভাব ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার। যদিও ভারনন ফিল্যান্ডার অতটা খারাপ অলরাউন্ডারও ছিলেন না।

ডমিঙ্গোর মতে, দক্ষিণ আফ্রিকাই ছিল হট ফেভারিট। তাদের সাথে পাল্লা দেয়ার মত দল বলতে ছিল অস্ট্রেলিয়া। সেই অস্ট্রেলিয়াকেও বিশ্বকাপ শুরুর আগে জিম্বাবুয়েতে অনুষ্ঠিত ত্রিদেশীয় ফাইনালে হারিয়েছিল ভিলিয়ার্সের দল৷ নিউ জিল্যান্ডে গিয়ে জিতে এসেছিল ওয়ানডে সিরিজও।

Image Credit: AP

যদিও গ্রুপপর্বে ভারত ও পাকিস্তানের সাথে হোঁচট খায় প্রোটিয়ারা। তবে নকআউট পর্বে দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়ায় তারা। নিজেদের ক্রিকেট ইতিহাসে প্রথমবারের মতো নকআউট ম্যাচ জিতে নকআউট গেরো খোলে ডি ভিলিয়ার্সরা। শ্রীলঙ্কাকে নয় উইকেটে উড়িয়ে দিয়ে সেমিফাইনালে পৌছে দক্ষিণ আফ্রিকা। সে ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার ডমিনেশন দেখে প্রোটিয়াদের আগাম চ্যাম্পিয়ন ও ঘোষনা করে দেয় অনেকে। সবচেয়ে বড় কথা, নকআউট পর্বের ভূত তাড়াতে পারায় ডমিঙ্গোর দলও ছিল আত্মবিশ্বাসের তুঙ্গে।

ম্যাচের আগের দিন পর্যন্ত কোয়ার্টার ফাইনালের একাদশ খেলানোর কথা থাকলেও ওই দিন শেষ বিকালে ৫:৩০ টার দিকে ডি ভিলিয়ার্সকে জানানো হয় যে, ভারনন ফিল্যান্ডার ফিটনেস টেস্ট উতরে গেছেন। কাইল অ্যাবটের জায়গায় তাই তিনিই খেলছেন নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে। তবে দুর্দান্ত পারফর্ম করা কাইল অ্যাবটের বাদ পড়ার পিছনে বর্ণবৈষম্যের নীতিও অনুসরণ করেছিল দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেট বোর্ড, এমন অভিযোগও উঠেছিল। এতে সন্তুষ্ট ছিলেন না অধিনায়ক ডি ভিলিয়ার্সও। তবে ভারনন ফিল্যান্ডারের উপর ভরসা ছিল দলের৷

ভারনন ফিল্যান্ডার; Image Credit: Backpagepix 2014

খেলার দিন শুরুতেই ট্রেন্ট বোল্টের দুর্দান্ত সুইংয়ের সামনে পড়ে দ্রুতই প্যাভিলিয়নে ফিরেছিলেন দুই ইনফর্ম প্রোটিয়া ওপেনার আমলা ও ডি কক। সবাই যখন ধরেই নিয়েছিল আরেকটি দক্ষিন আফ্রিকান চোকিং গল্প রচিত হচ্ছে, ঠিক তখনই দলের হাল ধরেন ডু প্লেসি। আর শেষ দিকে ডি ভিলিয়ার্স আর মিলারের ঝড়ো ব্যাটিংয়ে স্কোরবোর্ডে যথেষ্ট রান জমা করে প্রোটিয়ারা।

শেষ দিকে বৃষ্টি হানা দিলে পুরনো স্মৃতির ভয় ঝেঁকে বসলেও এইবার বৃষ্টি তেমন ক্ষতি করতে পারেনি। তবে ডমিঙ্গোর মতে, একটি দিক দিয়ে বিরাট ক্ষতিই করেছিল বৃষ্টি। এই বিশ্বকাপে উদ্বোধনী ম্যাচে জনি বেয়ারস্টোর বিপক্ষে ইমরান তাহিরকে দিয়ে বোলিং শুরু করিয়েছিলেন ডু প্লেসি। ফলও পেয়েছিলেন হাতে নাতে। চার বছর আগেও একইভাবে শুরু করতে চেয়েছিলেন ভিলিয়ার্স। ম্যাককালামের বিপক্ষে তাহির। কিন্তু বৃষ্টির জন্য পরিকল্পনা বদলে পেসার দিয়েই শুরু করেছিলেন ভিলিয়ার্স। তাতে চওড়া হয়ে উঠেছিলেন ম্যাককালাম। তার ঝড়ো ইনিংসে শুরুতেই শক্ত ভিত পেয়ে যায় ব্ল্যাক ক্যাপসরা। শেষে যখন ডেল স্টেইনেরও বিশ্বাস ছিলো ম্যাচটি জিততে পারবেন, সেই স্টেইনের বলেই দক্ষিণ আফ্রিকার স্বপ্ন ধূলিস্মাৎ করেন আরেক দক্ষিণ আফ্রিকান, গ্র‍্যান্ট ইলিয়ট। স্কয়ার লেগের বাউন্ডারিতে হাঁকানো সেই ছয়ের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা স্টেইনের ছবি আজও কাঁদায় ভক্তকূলদের।

সেই শূন্য দৃষ্টি; Image Credit: Reuters

সময় সব ক্ষতই দূর করে। তবে ডমিঙ্গোর মতে, ইডেন পার্কের এই দুঃসহ স্মৃতি প্রোটিয়াদের তাড়িয়ে বেড়িয়েছে অনেকদিন। মানসিকভাবে অনেকদিন পর্যন্ত বিপর্যস্ত ছিল পুরো দল৷ সেই ধাক্কার পরে চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতেও হতাশাজনক পারফরমেন্সের পর তো অবসরেই চলে গেলেন ডি ভিলিয়ার্স। শুধু ডি ভিলিয়ার্সই নন, সেই সেমিফাইনাল আমলা ও স্টেইনের ক্যারিয়ারেও যতি চিহ্ন হয়ে ছিল। অকল্যান্ডের ওইদিন থেকে দুইজনের ফর্মই পড়তির দিকে। ইনজুরির সাথে লড়াই করা স্টেইন তো একটি ম্যাচেও খেলতে পারেননি চলতি বিশ্বকাপে৷ আমলাও নিজেকে হারিয়ে খুঁজছেন।

পরবর্তীতে ডমিঙ্গো বলেছিলেন, অকল্যান্ডের সেই ম্যাচটি দুইরকমভাবে প্রভাব ফেলেছিল দলের উপর৷ কেউ কেউ বিশ্বাস করা শুরু করেছিল, এত কাছে যখন আসতে পেরেছি, তাহলে জেতার সম্ভাবনাও ফেলে দেওয়ার নয়। অন্যদিকে, কিছু খেলোয়াড় আন্তর্জাতিক শিরোপার জয়ের আশাই ছেড়ে দিয়েছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন রাইলি রশো ও কাইল অ্যাবট। বিশ্বকাপে এই দুইজন ভালো খেলার পরও ২০১৭ সালে কোলপাক চুক্তিতে ইংল্যান্ড পাড়ি জমান দুইজনই। যেখানে রশোকে ডি ভিলিয়ার্সের উত্তরসূরী, আর অ্যাবটকে মরনে মরকেলের যোগ্য প্রতিস্থাপন হিসেবে ভাবা হচ্ছিল, তারাও দক্ষিণ আফ্রিকা’কে বিপদে ফেলে চলে যান।

রশো কিংবা অ্যাবট, কেউই এখন আর দৃশ্যপটে নেই; Image Credit: Sky Sports

সেই থেকে আজও ঠিকঠাকমতো দলই গুছিয়ে উঠতে পারেনি প্রোটিয়ারা। ডু প্লেসি দলের ভারসাম্য রক্ষার পাশাপাশি বিশ্বকাপ জেতার চেষ্টাও চালিয়েছেন। কিন্তু উল্টো এইবার আরো লজ্জাজনকভাবেই বিশ্বকাপকে বিদায় জানাতে বাধ্য হয় তার দল। রাসেল ডমিঙ্গোকেও ২০১৭ সালে সরে যেতে হয়। তার জায়গায় কোচ হিসেবে আসেন ওটিস গিবসন। যাওয়ার আগে ডমিঙ্গো পুরনো সেই ম্যাচের কথাই স্মরণ করেছিলেন। বলেছিলেন তার কোচিং ক্যারিয়ারে সবচেয়ে ইমোশনাল ও সেরা ম্যাচটি ছিল অকল্যান্ডের সেই সেমিফাইনালটি। তিনি আরো বলেন, এটি এমন একটি স্মৃতি, যেটি নিয়ে আমরা কথা বলতে চাই না, কিন্তু সবসময় সেটি মনের ভেতর তাড়িয়ে বেড়াবে।

এই বিশ্বকাপশেষে প্রোটিয়ারা তাদের হারানো শক্তি ফিরে পাক, সেটিই ক্রিকেটভক্তদের কাম্য। ‘চোকার্স’ তকমাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে যেদিন দক্ষিণ আফ্রিকা কোনো শিরোপা জিতবে, সেদিন হয়তো এই ডি ভিলিয়ার্স, ডু প্লেসি, স্টেইনরাই সবচেয়ে বেশি খুশি হবেন। কারণ, ‘আমরা জিততে পারি’ সেই স্বপ্ন তো এদের হাত ধরেই দেখা শুরু প্রোটিয়াদের!

This Bangla article is about the semifinal of 2015 cricket world cup. References are hyperlinked below. 

Feauture Image : India.com

 

Related Articles