Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মোহাম্মদ আলি: বক্সিংয়ের এক অকুতোভয় চ্যাম্পিয়ন

খেলাধুলার জগতে বক্সিং এক স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। এ খেলার রয়েছেও নানা ইতিহাস। তেমনই এক চ্যাম্পিয়নের গল্প শোনাবো আজ। বিশালদেহী এবং কুখ্যাত বক্সার সনি লিস্টনের পাশে ২২ বছরের ছেলেটিকে প্রায় কেউ পাত্তাই দিতে চায়নি। সবাই ধরেই নিয়েছিল যে, ২২ বছরের যুবকটি নিতান্তই শিশু। একপেশে লড়াই হবে এবং লিস্টন অল্প সময়ে ছেলেটিকে হারিয়ে দেবে বলে সবাই মেনে নিয়েছিল।

হতে পারে ১৯৬০ অলিম্পিকে লাইট হেভিওয়েটে সোনা জিতেছেন এই ক্যাসিয়াস ক্লে। কিন্তু অলিম্পিক আর হেভিওয়েট পেশাদার বক্সিং কি এক হলো? ১৯৬০ সালের ২৯ অক্টোবর পেশাদার বক্সিং-এ নামার পর ক্লে’র ১৯৬৩ পর্যন্ত ১৯টা ম্যাচের ১৯টাতেই জয়! তার মধ্যে ১৫টা নক আউট। যদিও তাক লাগানোর মতোই রেকর্ড, কিন্তু প্রতিপক্ষ তো সনি লিস্টন! ফ্লয়েড প্যাটারসনের মতো চ্যাম্পিয়নকে দু’-দু’বার প্রথম রাউন্ডে নক আউট করে দিয়েছে! তার মধ্যে এর আগে দু’টি লড়াইয়ে হারতে হারতে জিতেছিল।

কিন্তু এই ক্যাসিয়াস ক্লে অন্য ধাতুতে গড়া। যুদ্ধের আগে সে কিছুতেই হাল ছাড়তে রাজি নয়। ১৯৬৪ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি, মিয়ামির রিং-এ নামার আগে বিশ্ব আর এক ক্লে’কে দেখল। ক্যাসিয়াস সেই লড়াইয়ে জয়ী হন। ঐ বয়সেই সনি লিস্টনকে হারিয়ে হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ান হন ক্যাসিয়াস ক্লে। সপ্তম রাউন্ডে আর লড়তেই রাজি হননি লিস্টন।

পেশাদার হেভিওয়েট বক্সিংয়ে সনি লিস্টনকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ান হওয়া ক্যাসিয়াস ক্লে

অসাধারণ সেই ম্যাচে ক্যাসিয়াসের চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়া গতি দেখে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন দর্শকবৃন্দ। তা-ও মাঝে অনেকখানি সময় প্রচন্ড ব্যথায় চোখে প্রায় কিছুই দেখতে পাচ্ছিলেন না ক্লে! সেদিন সকলের মনে হয়েছিল, লুইসভিলের এই ছেলেটিই একদিন হবে ‘কিং অফ দ্য ওয়ার্ড’! সত্যিই তাই ঘটেছিল।

‘ক্যাসিয়াস ক্লে’ হলো মোহাম্মদ আলির জন্মসূত্রে পাওয়া নাম। ওই ম্যাচের কিছুদিন পরেই তিনি ঘোষণা করে দেন যে, তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন, নাম নিয়েছেন মোহাম্মদ আলি। সেই সময় এই ধর্ম পরিবর্তন ছিল আসলে বিরাট একটি বিপ্লব।

ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে ক্যাসিয়াস ক্লে মোহাম্মদ আলি নাম গ্রহণ করেন

১৯৪২ সালের ১৭ জানুয়ারি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্টাকির লুইসভিলে জন্ম ক্যাসিয়াস ক্লে-র। বাবা ক্যাসিয়াস মার্সেলাস ক্লে সিনিয়র ছিলেন একজন আফ্রিকান-আমেরিকান। তিনি সামান্য রঙের রাজ করতেন। মা ওডেসা ও’গ্র্যাডি ক্লে ছিলেন গৃহবধূ। ক্লে জুনিয়র থেকে মোহাম্মদ আলি হয়ে উঠার ইতিহাস যেন রূপকথার গল্পকেও হার মানায়। তার বক্সিংয়ে আসার গল্পটিও বেশ চমকপ্রদ।

ক্যাসিয়াস ক্লে-র মা-বাবা

ক্যাসিয়াসের তখন ১২ বছর বয়স। জন্মদিনে একটা বাইসাইকেল উপহার পেয়েছিলেন বাবার কাছ থেকে। সেই সাইকেল হঠাৎ চুরি হয়ে গেল। আর যায় কোথায়। ক্যাসিয়াস রেগে আগুন। সোজা হাজির থানায়। চুরির অভিযোগ জানিয়েই ক্ষান্ত থাকেনি সে। চোরকে পেলে কেমন উত্তম মধ্যম দেবে তা-ও জানিয়ে দিল পুলিশ অফিসারকে।

১২ বছর বয়সে বক্সিং প্রশিক্ষণরত ক্যাসিয়াস ক্লে

কিন্তু সে দিনের সেই পুলিশ অফিসারটি ছিলেন একজন বক্সিং প্রশিক্ষক, নাম জো মার্টিন। তিনি সেদিন ক্লে-র তীব্র চাহনী আর তার শরীরের গঠন দেখেই ভবিষ্যৎ প্রতিভাকে চিনতে পেরেছিলেন। তাই ক্লে-র জবাবে মার্টিন তখন বলেছিলেন, চোরকে ধরে মারতে গেলে আগে শিখতে হবে কী করে মারতে হয়। তিনিই ক্লে-কে বক্সিং শেখায় উৎসাহিত করেন। ব্যস্, শুরু হয়ে গেল ক্লে-র প্রশিক্ষণ। পরে যিনি বিশ্ব জয় করবেন, তার প্রথম মাস্টারমশাই হয়ে গেলেন জো মার্টিন। সেটা ১৯৫৪ সাল, সে বছরই অপেশাদার বক্সিং-এ নেমে পড়েন ক্লে।

ক্লে-র প্রথম বক্সিং গুরু পুলিশ অফিসার জো মার্টিন

১৯৬০ রোম অলিম্পিকে মাত্র ১৮ বছর বয়সে সোনা জেতেন ক্যাসিয়াস। ওই বছরই পেশাদার বক্সিং-এ আসেন ক্লে। তার আগে অপেশাদার রিং-এ লড়েছেন ১০৫টা ম্যাচ। জিতেছেন ১০০টায়। তিনি যে অসাধারণ প্রতিভা সম্পন্ন, তা নিয়েও কোনো বিতর্ক নেই। তিন বার লিনিয়ার ওয়ার্ল্ড হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন হন মোহাম্মদ আলি (বক্সিং এ চ্যাম্পিয়নকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করে সে লড়াই জিতে গেলে লিনিয়ার চ্যাম্পিয়ন হয়)।

রোম অলিম্পিকে লাইট হেভিওয়েটে সোনা জয়ী মোহাম্মদ আলি

পাঁচবার ‘ফাইটার অফ দ্য ইয়ার’ হয়েছেন। জীবনে ৬১টি বাউট লড়ে হেরেছেন মাত্র পাঁচবার! তবে এছাড়াও মোহাম্মদ আলির একটি বিরাট দিক ছিল শো-ম্যানশিপ। তিনি চিৎকার করে বলতে পারতেন, বক্সিং এ তিনিই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ, সেরাদেরও সেরা। বুক বাজিয়ে নানা কথা বলা আর রিং এ সেগুলোকে সত্যি প্রমাণ করে দিয়ে ভক্তদের মন জয় করে নিয়েছিলেন মোহাম্মদ আলি।

ম্যাচের আগেই তিনি ঘোষণা করে দিতেন, কত রাউন্ডে তিনি ম্যাচ শেষ করবেন। নিজের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী জো ফ্রেজিয়ারের ব্যাপারে তিনি বলেছিলেন, “চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পক্ষে ও বড্ড বোকা!

জো ফ্রেজিয়ারের সাথে এক মুষ্টিযুদ্ধে মোহাম্মদ আলি

সনি লিস্টনের সঙ্গে প্রথম ম্যাচে বলেছিলেন, “লিস্টনের গায়ে ভাল্লুকের মতন গন্ধ। ম্যাচটা শেষ হলে লিস্টনকে চিড়িয়াখানায় দান করে দেবো আমি।” এই কথায় কাজও হয়েছিল। ঐ কথা শুনে লিস্টনের প্রচন্ড রাগ চেপে যায় মাথায়। সে রাগের বশেই খেলার সময় ভুল করে বসেন লিস্টন। আলির এই দু’টো দিক ওতপ্রোতভাবেই জড়িয়ে আছে তার জীবনের বিখ্যাত সব ম্যাচগুলোর নামে।

জর্জ ফোরম্যানের বিরুদ্ধে এক লড়াইয়ে মহম্মদ আলি

জো ফ্রেজিয়ারের বিরুদ্ধে ‘ফাইট অফ দ্য সেঞ্চুরি”, বা “ থ্রিলা ইন ম্যানিলা’, জর্জ ফোরম্যানের বিরুদ্ধে  ‘রাম্বল ইন দ্য জাঙ্গল’, সনি লিস্টনের সঙ্গে দু’-দু’টি বিখ্যাত ম্যাচ…, বক্সিং ইতিহাসে এই লড়াইগুলো সব সময় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

ডাউনটাউন শহরে জর্জ ফোরম্যানের সাথে মোহাম্মদ আলির সেই ঐতিহাসিক লড়াই যা ‘রাম্বল ইন দ্য জাঙ্গল’ নামে পরিচিত

বক্সিং রিং-ই তাকে বিশ্ব জুড়ে খ্যাতি দিয়েছে। কিন্তু আত্মসম্মানের যুদ্ধে মোহাম্মদ আলি নিজের সাথে কখনো কোনো আপস করেননি। ১৯৬০ সালে অলিম্পিকে সোনা জেতার পর বন্ধুকে নিয়ে আমেরিকার এক রেস্তোরাঁয় খেতে যান। রেস্তোরাঁয় ঢুকতে গিয়ে বাধা পান তিনি। কারণ রেস্তোরাঁয় শ্বেতাঙ্গ ছাড়া অন্য কারও প্রবেশ নিষেধ। গর্জে ওঠেন তিনি। এ কেমন আইন! মনের আক্রোশে রোম থেকে জিতে আনা অলিম্পিকের সোনা তিনি নদীতে ছুঁড়ে ফেলে দেন।

তিনি যখন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন, সেই সময়টায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জোর কদমে চলছিল সিভিল রাইটস মুভমেন্ট। কৃষ্ণাঙ্গরা তাদের অধিকারের জন্য খুব লড়ছিলেন। নেতৃত্বে ছিলেন মার্টিন লুথার কিং এর মতন বড় বড় নেতারা। মূলত কৃষ্ণাঙ্গদের খেলা বক্সিং তখন শ্বেতাঙ্গদের বিনোদন ছাড়া কিছুই নয়। সাদা চামড়ার মানুষেরা কালো চামড়ার মানুষদের মানুষ বলে গণ্যই করতো না। তেমন একজন বক্সার যখন জানালেন তিনি ‘ক্রীতদাস’ নাম ত্যাগ করেছেন, তখন তা সমস্ত মানুষের কাছেই হয়ে উঠেছিল বিরাট এক অনুপ্রেরণার উৎস।

মুসলিম এক সভায় মোহাম্মদ আলির অংশগ্রহণ

বছর দু’য়েক পর আরও একটি চমকে দেওয়া কাজ করলেন মোহাম্মদ আলি। ভিয়েতনামে বোমা ফেলছে আমেরিকা। ডাক এলো মোহাম্মদ আলিরও, যেতে হবে ভিয়েতনাম যুদ্ধে। সরকারের কড়া আদেশ সত্ত্বেও তিনি বলেছিলেন, আমেরিকান সেনাবাহিনীতে নাম লিখিয়ে ভিয়েতনামে যুদ্ধ করতে তিনি যাবেন না। তিনি এই যুদ্ধ সমর্থন করেন না।

ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিপক্ষে আলিই শুধু নন, আরো অনেক আমেরিকাবাসী তার সাথে সহমত পোষণ করেন তা পত্রিকার মাধ্যমে তিনি অন্যদের বোঝাচ্ছেন

ভিয়েতনাম যুদ্ধে না যাওয়ার কারণে গ্রেফতার হয়েছিলেন মোহাম্মদ আলি। তার সমস্ত পদক কেড়ে নেয়া হয়েছিল। চার বছরের জন্য তাকে নিষিদ্ধ করা হয়। ফর্মের শীর্ষে থাকার পরও চার বছর রিংয়ে নামতে পারেননি মোহাম্মদ আলি। কিন্তু একটি বারের জন্যেও পিছু হটেননি এই যোদ্ধা। আদালতে কেস করে জয় লাভ করেছিলেন। ভয় না পেয়েই নিজের মতামত জোর গলায় এভাবে ঘোষণা করার জন্য মোহাম্মদ আলি আজও এতো বড় নাম। বাংলাদেশের এক অকৃত্রিম বন্ধু ছিলেন তিনি।

ভিয়েতনাম যুদ্ধে সেনাবাহিনীতে যোগ না দেয়ার জন্য তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয় যার বিপক্ষে আলি আদালতে রিট করেন এবং সেই রিটে তিনি জয়ী হন

যে মানুষটিকে বিপক্ষের তীব্র আক্রমণ বা জাদরেল সরকারে আক্রোশ কখনও আটকাতে পারেনি, সে মানুষটিকে হার স্বীকার করতে হয় এক দুরারোগ্য রোগের কাছে। মাত্র ৪২ বছর বয়সেই স্নায়ুর রোগ পার্কিনসন ধরা পড়ে মোহাম্মদ আলির। সাধারণত বার্ধক্যে এই রোগ হতে দেখা যায়। কিন্তু রিং এ বারবার মাথায় আঘাতের দরুণই নাকি আলিকে অল্প বয়সেই পড়তে হয়েছিল পার্কিনসনের কবলে। অমন শক্তিশালী একজন মানুষকে ঐ অসুখের কাছেই শেষমেশ নতিস্বীকার করতে হয়! ভালো করে হাত চলতো না, নড়তো না আঙ্গুল, স্পষ্টভাবে কথাও বলতে পারতেন না শেষ সময়ে। অবশেষে ২০১৬ সালে মৃত্যু তাকে চিরতরে নিয়ে গেলো না ফেরার দেশে।

পার্কিনসন রোগে আক্রান্ত মহম্মদ আলি

ক্রীড়াজগত চিরকাল তার নাম মনে রাখবে অসাধারণ প্রতিভা আর অসাধারণ ব্যক্তিত্বের জন্য। কেন তিনি বহু মানুষের অনুপ্রেরণা? ওই যে হারিয়ে যেতে যেতে আবার ফিরে আসা, বাধা সরিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চ্যালেঞ্জ, বুক ভরা সাহস, তীক্ষ্ন আত্মসম্মানবোধ আর মানুষকে ভালবাসা- এই সব দিয়েই তো তৈরি হয় একজন মোহাম্মদ আলি। আজকের এই লেখার মধ্য দিয়ে এই মহান ব্যক্তিকে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলী।

রেস্ট ইন পিস, চ্যাম্প!

তথ্যসূত্র

১) biography.com/people/muhammad-ali-9181165

২) en.wikipedia.org/wiki/Muhammad_Ali

৩) history.com/topics/black-history/muhammad-ali

৪) ducksters.com/biography/athletes/muhammad_ali.php

৫) bbc.co.uk/timelines/zy3hycw

Related Articles