Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ফুটবল-ঈশ্বরের দ্বিতীয় বিশ্বকাপ

১৯৮৬ বিশ্বকাপের শুরুটা বেশ নড়বড়ে হলো।

এই বিশ্বকাপটা ঠিক মেক্সিকোতে অনুষ্ঠিত হবার কথা ছিল না। ‘৮২ বিশ্বকাপের আগেই অবশ্য নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল, এই বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হবে লাতিন আমেরিকার দেশ কলম্বিয়াতে। তবে কলম্বিয়াতে হুট করে গৃহযুদ্ধ, অভ্যন্তরীণ সমস্যা ও মাদক আদান-প্রদানের মাত্রা ভয়াবহ আকারে বেড়ে যাওয়াতে ফিফা সে বিশ্বকাপ সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়। আর এতেই মেক্সিকোর ভাগ্য খুলে যায়। হা হতোস্মি, ১৯৮৫ সালে মেক্সিকো সিটিতে রিখটার স্কেলে ৮ মাত্রার ভয়াবহ এক ভুমিকম্পে ৫ হাজার মানুষের মৃত্যুর পাশাপাশি আহত হয় প্রায় ১০ হাজার মানুষ। ক্ষয়ক্ষতি হয় প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলারের মতো। বিশ্বকাপ শুরু হবার আগেই এমন বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি দেশটির জন্য বড় ধরনের ধাক্কা ছিল।

১৯৮৩ সাল। স্পেনের বিশ্বকাপ পর্ব শেষ করে ফিফা যখন চার বছর পরের বিশ্বকাপ নিয়ে ভাবছে, ডিয়েগো ম্যারাডোনা তখন ইউরোপের দেশ স্পেনে গিয়ে ক্যারিয়ার ও নিজের সাথে লড়ছেন। একে তো প্রথমবারের মতো ইউরোপের মঞ্চ, তার উপর প্রথম মৌসুমেই হেপাটাইটিস বি’তে আক্রান্ত হয়ে অনেকগুলো ম্যাচে তার খেলা হলো না। দলের সাথে খাপ খাইয়ে নেবার পর্যাপ্ত সুযোগ পাবার আগেই শুরু হয়ে গেল পরের মৌসুম। অ্যাটলেটিকো ক্লাবের ডিফেন্ডার আন্দোনি গয়কোচিয়ার সাথে সংঘর্ষে গোড়ালি ভেঙে আবার লম্বা সময়ের জন্য মাঠের বাইরে ম্যারাডোনা। দ্বিতীয় মৌসুমের শেষের দিকে অ্যাটলেটিকো ক্লাবের সাথে কোপা দেল রে ফাইনালে মারামারিতে জড়িয়ে পড়ার পর তাকে আর বার্সার জার্সিতেই দেখা যায়নি। তাই ১৯৮৬ বিশ্বকাপ যখন দ্বারপ্রান্তে, ম্যারাডোনা তখন বার্সেলোনা ঘুরে ইতালির নাপোলিতে মাত্র থিতু হতে শুরু করেছেন।

বার্সার জার্সি ম্যারাডোনা; Image Source: FC Barcelona

‘৮২ বিশ্বকাপে ব্রাজিলের বিপক্ষে হার ও সেই লাল কার্ডের পর ম্যারাডোনা প্রবল সমালোচিত হয়েছিলেন। সেবার নিজের নামের প্রতি সুবিচার তিনি করতে পারেননি। এতে পেলে মন্তব্য করেছিলেন,

“ম্যারাডোনা তো টাকার জন্য খেলে।” 

তবে বিশ্বকাপ হারের পর ম্যারাডোনা যে কতটা পরিণত হয়ে উঠেছেন, তখনও তা বাইরে থেকে সেভাবে দৃশ্যমান হয়ে ওঠেনি। তার খেলায় আমূল পরিবর্তন এসেছে। মাঠের লড়াই বা মুখের লড়াই উভয়ে কীভাবে ঠাণ্ডা মাথায় জবাব দেয়া যায়, ততদিনে ম্যারাডোনা তা আয়ত্ত্বে নিয়ে ফেলেছেন। চার বছর আগে রেগেমেগে হাল ছেড়ে দেবার উদাহরণ এরপর বার্সেলোনায় এক হতাশাকাব্যের পর ফুটবলবোদ্ধারা মূলত দুই ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। একদল মনে করতেন, মাঠের উগ্র স্বভাব ও মেজাজ হারানোর জন্য ম্যারাডোনা আর্জেন্টিনার জার্সিতে সুবিধা করতে পারবেন না। অপর দলের ভাবনা ছিল তার ঠিক বিপরীত।

‘৮২ বিশ্বকাপের ব্যর্থতার পর আর্জেন্টিনার কোচের দায়িত্ব ছেড়ে দেন মেনোত্তি। তার উত্তরসূরী হিসেবে আসা কার্লোস বিলার্দোর বিশ্বাস ও ভরসার পাত্র ছিলেন ম্যারাডোনা। বিশ্বকাপের আগে দল ঘোষণার পর তাই দলনেতা হিসেবে তিনি নির্বাচিত করলেন ২৫ বছর বয়সী ম্যারাডোনাকেই। মেক্সিকোর বিশ্বকাপের মূলমঞ্চের টিকেট পেতে আর্জেন্টিনার তেমন বেগ পেতে হয়নি। কিন্তু আর্জেন্টিনা দলকে ত্রাস ছড়ানো দল আর বলা যায় না। স্পেন বিশ্বকাপেই অনেক তারকা বুড়িয়ে গিয়েছিলেন। সেবারের বিশ্বকাপ থেকে ৩৩ বছর বয়সী প্যাসারেলা ও ৩০ বছর বয়সী স্ট্রাইকার হোর্হে ভালদানো ছাড়া তারকা খেলোয়াড় আর কেউ থাকল না।

কার্লোস বিলার্দো ও ম্যারাডোনা; Image Source: Getty Images

তবে বিলার্দোর দলে কয়েকজন আস্থাবান খেলোয়াড়ও ডাক পেয়েছিল। ফরোয়ার্ড হোর্হে বুরুচাগা ও পেদ্রো পাসকুলি এবং মিডফিল্ডার হেক্টর এনরিকে ও কার্লোস তাপিয়া ছিল ২৫ বছর বয়সী ডিয়েগো ম্যারাডোনাকে নিয়ে তৈরি করা একাদশের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিলার্দো চেয়েছিলেন আলবিসেলেস্তে একাদশকে তার দর্শনে নতুন করে সাজাতে। সেই মোতাবেক একটি দল নিয়েই মেক্সিকোর উদ্দেশ্যে উড়াল দিল ম্যারাডোনারা। সবাই জানল, গত দুই বিশ্বকাপের মতো এবারের আর্জেন্টিনা দল তেমন শক্তিশালী নয়। কেবল তাদের ভরসার স্থান রেগেমেগে হাল ছেড়ে দেওয়া ডিয়েগো ম্যারাডোনা, যিনি আবার ইউরোপে গিয়ে রীতিমতো সমালোচনার শীর্ষে আছেন।

স্তাদিও অ্যাজতেকে আর্জেন্টিনার মেক্সিকো বিশ্বকাপের যাত্রা শুরু হলো দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষের ম্যাচ দিয়ে। প্রথম ম্যাচে দক্ষিণ কোরিয়া সেই পুরনো কৌশল বেছে নিল। ম্যারাডোনাকে অসম্ভব কড়া মার্কিয়ে একের পর এক ফাউল করে গেল তারা। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে ম্যারাডোনা নির্বাক; ফাউলের স্বীকার হয়ে তেড়েফুঁড়ে লড়াই করতে যাচ্ছেন না, হতাশ হবার কোনো নিশানা নেই তার মুখে, নীরবে মেনে নিয়ে আবার লড়ে যাচ্ছেন। আবার মাঝে মাঝে দক্ষিণ কোরিয়ার ডিফেন্ডারদের কড়া মার্ক ও ট্যাকলকে এড়িয়েও যাচ্ছেন। এর কারণ, প্রতিপক্ষের অতি রক্ষণাত্মক ভঙ্গিতে খেলার সাথে ম্যারাডোনা ততদিনে বেশ পরিচিত। তিনি খেলেন নাপোলিতে, ইতালির প্রত্যেক ক্লাবই রক্ষণে বেশি জোর দেয়। দক্ষিণ কোরিয়া তাকে কড়া মার্কিং কিংবা টানা ফাউল করেও রুখতে পারল না। ৩-১ গোলে জেতা ম্যাচে ম্যারাডোনা করলেন তিন অ্যাসিস্ট, তার বাড়ানো পাসে বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচেই জোড়া গোল করলেন ভালদানো।

দক্ষিণ কোরিয়া তাকে কড়া মার্কিং করে, টানা ফাউল করেও রুখতে পারল না; Image Credit: Goal

দ্বিতীয় ম্যাচে ইতালির বিপক্ষে। স্পেন বিশ্বকাপে ম্যারাডোনাকে রুখে দেবার ম্যাচে সে স্মৃতি এখনও জলজ্যান্ত। সেবার ম্যারাডোনাকে আটকে দিয়ে নায়ক বনে যাওয়া ক্লাদিও জেন্টাইল এবার ইতালি দলে নেই। তবে জেন্টাইল ধাঁচের খেলোয়াড় হিসেবে আজ্জুরিদের একাদশে ছিলেন পিয়েত্রো ও সিরেয়া। ইতালিও ফিরে গেল তাদের পুরনো কৌশলে। বরাবরই তারা কৌশলগত দিক থেকে রক্ষণাত্মক, এ ম্যাচে ম্যারাডোনাকে কড়া মার্কিংয়ে রেখে তারা আরও রক্ষণাত্মক ভঙ্গিতে খেলা শুরু করল। ইতালির ডি-বক্স ম্যারাডোনার জন্য যেন সিংহের গুহা। তিনি সেদিকে গেলেই আজ্জুরি রক্ষণভাগ তার উপর হামলে পড়ছে।

কিন্তু ম্যারাডোনা ততদিনে নিজেকে পাল্টে ফেলেছেন। কড়া মার্কিংয়ের কবলে পড়ে থমকে যাবার পাত্র তিনি আর নন। ইতালিয়ান ডিফেন্ডারদের তিনি ছিটকে ফেলছেন গতি ও চতুরতায়। ছয় মিনিটে পেনাল্টি থেকে আর্জেন্টিনা গোল হজম করলেও তার প্রভাব ম্যারাডোনার খেলায় পড়ল না। ইতালির ডি-বক্সের সামনে সেন্ট্রাল পজিশনে তিনি ক্রমাগত ওঠানামা করছেন। ইতালির রক্ষণ পুরো ম্যাচে ঠিক করতে পারেনি, তারা ম্যারাডোনাকে মার্ক করে উপরে উঠে যাবে, নাকি নিজেদের পজিশন ধরে রাখবে।

ম্যাচ শেষ হলো ১-১ গোলে ড্রয়ের মধ্য দিয়ে। আর্জেন্টিনাকে এক পয়েন্ট পাইয়ে দেওয়া গোলটি করেছিলেন ম্যারাডোনাই।

ইতালি আবিষ্কার করেছিল এক নতুন ম্যারাডোনাকে; Image Source: FIFA

পরবর্তী ম্যাচে বুলগেরিয়ার বিপক্ষে ২-০ গোলের জয়। সে ম্যাচে ম্যারাডোনা একটি মাত্র অ্যাসিস্ট করলেও তার পায়ের জাদু মুগ্ধ করল পুরো গ্যালারিকে। ২ জয় ও ১টি ড্রয়ের ৫ পয়েন্ট নিয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে পরবর্তী রাউন্ড নিশ্চিত করল আর্জেন্টিনা। গ্রুপপর্বের তিন ম্যাচে ম্যারাডোনার পারফরম্যান্সের বদৌলতে ততদিনে পুরো বিশ্ব জেনে গেছে, ‘৮২ বিশ্বকাপের জুজু তিনি কাটিয়ে উঠেছেন। ফুটবলের সাথে মানসিক দিক থেকেও তিনি এখন দারুণ পরিণত খেলোয়াড়।

শেষ ১৬-তে আর্জেন্টিনার প্রতিপক্ষ উরুগুয়ে। পাসকুলির একমাত্র গোলে আর্জেন্টিনা লাতিন আমেরিকার দেশটির বিপক্ষে সহজ জয় তুলে নিল। এ ম্যাচে ম্যারাডোনা কোনো গোল বা অ্যাসিস্ট করতে পারেননি বটে, কিন্তু গোল করা ছাড়াও কোনো দলের হয়ে একজন খেলোয়াড় কেমন প্রভাব রাখতে পারেন, তার উদাহরণ এই ম্যাচ। ম্যারাডোনা একদম নাম্বার টেন হিসেবে এই ম্যাচ খেললেন। ওয়ান-টু-ওয়ান পাস, চকিতে ইউটার্ন নিয়ে ড্রিবল… কোনো গোল বা অ্যাসিস্ট ছাড়াই ম্যারাডোনা বিশ্বকাপের স্মরণীয় এক ম্যাচ পার করলেন।

আর্জেন্টিনা উরুগুয়েকে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে পৌঁছে গেল। বিপরীতে ইংল্যান্ডও ৩-০ গোলে হারাল আরেক লাতিন আমেরিকার দেশ প্যারাগুয়েকে। ফকল্যান্ড আইল্যান্ডকে ঘিরে এই দুই দেশের টালমাতাল সম্পর্ক ততদিনে পুরনো হলেও তাদের অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ তখনও জীবিত। তাদের দুই দেশের মানুষের ক্ষোভ বিভিন্নভাবে বিভিন্ন জায়গায় প্রকাশ পেলে ফুটবল মঞ্চে এই দুই দেশের মুখোমুখি লড়াই এই প্রথম। ইংল্যান্ডের জাতীয় সঙ্গীত “গড সেভ দ্য কুইন” বেজে উঠতেই ক্যামেরা খুঁজে নিল ম্যারাডোনার মুখ। অভিব্যক্তিহীন পাথুরে মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি, চোখদুটো যেন আগুনের চুল্লীর মত জ্বলছে। কিক-অফের বাঁশি বাজতেই শুরু হল দুই দেশের ফুটবল যুদ্ধের দামামা।

প্রথমার্ধে বলার মতো কোনো ঘটনা ঘটল না। তাদের প্রথাগত ধরণের ফুটবলের বাইরে গিয়ে ইংল্যান্ড বেশ রক্ষণাত্মক ভঙ্গিতে খেলা শুরু করল। মূলত তাদের রক্ষণজুটি ম্যারাডোনাকে আটকাতেই বেশি মনোযোগী ছিল। তবে ইংলিশদের হতভম্ব করে ম্যাচের ভাগ্য বদলে যায় দ্বিতীয়ার্ধে। দ্বিতীয়ার্ধ শুরুর পর অবশ্য আর্জেন্টিনা আহামরি কোনো ফুটবল খেলা শুরু করেনি, তবে ৫১ মিনিটে ম্যারাডোনার এনে দেওয়া যুগান্তকারী ব্রেক-থ্রু ম্যাচের গতিপথ বদলে দেয়। অবশ্য নিজের অমর ইতিহাস গড়ার সূচনাটা ম্যারাডোনা নিজের বাঁ পায়ের জাদুতেই শুরু করেছিলেন।

মধ্যমাঠ থেকে বল কাটিয়ে এনে তিনি পাস দিয়েছিলেন বিশ্বকাপে চার গোল করা ভালদানোকে। ভালদানো চেয়েছিলেন ভলি করতে, কিন্তু তিনি ব্যর্থ হবার পর সে বল পিটার শিল্টনের দিকে ঘুরিয়ে মারেন ইংলিশ ডিফেন্ডার স্টিভ হজ। তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি, ম্যারাডোনা দৌঁড়ে সেখানে পৌঁছে যাবেন। বল ম্যারাডোনার সামনে ভাসছে, বিপরীতে গোলবার থেকে এগিয়ে আসছেন পিটার শিল্টন। হাই-ভোল্টেজ ম্যাচে সময়কে থমকে দেয়ার মত এক মুহূর্ত।

বলের কাছাকাছি এসেই ম্যারাডোনা শূন্যে লাফ দিলেন, সাথে তার বাম হাতও কিছুটা উপরে উঠে গেল। ইংলিশদের ইতিহাসের অন্যতম সেরা গোলরক্ষক শিল্টনকে হতভম্ব করে, হেড দেবার বদলে ঐ হাত দিয়েই ম্যারাডোনা বল জালে জড়িয়ে দিলেন।

কিন্তু স্টেডিয়ামের দর্শকরা তা বুঝতে পারেনি, পারেননি রেফারি বা লাইসেন্সম্যানরাও। রেফারি গোল হবার বাঁশি বাজিয়ে দিলেন, গ্যালারিতে পুরো আলবিসেলেস্তে সমর্থকের কান-ফাটানো চিৎকারের সামনে সতীর্থদের সাথে হাত-পা ছুঁড়ে উন্মত্ত উল্লাসে মত্ত ম্যারাডোনা। ওদিকে শিল্টন-হজরা হতভম্ব ঘটনার আকস্মিকতায়; উত্তর খুঁজে ফিরছেন, হলোটা কী এইমাত্র! 

হ্যান্ড অফ গড; Image Source: Getty Images

শিল্টনসহ ইংলিশ ডিফেন্ডাররা তেঁড়েফুড়ে নালিশ জানাতে এসেও লাভ হলো না। তিউনিসিয়ান রেফারি আলি বিন নাসেরের চোখে হাত দিয়ে গোল করার বিষয়টি ধরা পড়েনি, আর টিভি ক্যামেরায় গোলের এই কাণ্ড ধরতে ধরতে পার হয়ে গেছে প্রায় চার মিনিট। ধারাভাষ্যকাররা যখন বিষয়টি বুঝতে পেরে সে সম্পর্কে কিছু বলতে যাবেন, ম্যারাডোনা ততক্ষণে সে বিশ্বকাপের অন্যতম সেরা গোল করে ফেলেছেন। শুধু কি সেই বিশ্বকাপের? তর্কসাপেক্ষে সেই শতাব্দিরই অন্যতম সেরা গোল বলতেও অনেকেই কুণ্ঠাবোধ করবেন না।

৭ জনকে ড্রিবল করে কাটিয়ে ৪০ গজ দৌঁড়ে শিল্টনকে ফাঁকি দিয়ে অবিশ্বাস্য করা ঐ গোলের প্রশংসা করবেন, নাকি চতুর ম্যারাডোনার সমালোচনা করবেন, সেটাই ধারাভাষ্যকাররা যেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। ম্যারাডোনার অবশ্য সেসবে কান দেওয়ার সময় নেই, তিনি স্রেফ সময়টা উপভোগ করছেন। সময়টা যে তার, সেটা যেন ভাগ্যদেবীও হাতে-কলমে বুঝিয়ে দিচ্ছেন। 

৮৫ মিনিটের দিকে ইংলিশ স্ট্রাইকার গ্যারি লিনেকার একটি গোল ফিরিয়ে দিলেও আর্জেন্টিনা ম্যাচ জেতে ২-১ গোলের ব্যবধানে। এই ম্যাচের জয়ের পর আর্জেন্টিনা ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায়। আর ম্যারাডোনা? তিনি ভাসছেন প্রশংসার সাগরে। বিশ্বকাপের প্রথমদিকে তার সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলে করা সমালোচনাগুলো ততক্ষণে ভোজবাজির মতো উবে গেছে।

পুরো ম্যাচে ঠিকভাবে তাকে মার্কই করতে পারেনি বেলজিয়ান ডিফেন্ডাররা ;Image Source; Getty Images

‘৮৬ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডকে হারানো ও ম্যারাডোনার অভাবনীয় পারফরম্যান্সের কথা সবসময় সবার আগে বলা হয়ে থাকে। কিন্তু বেলজিয়ামের বিপক্ষে তিনি যে একাই অবিশ্বাস্য জাদুকরী ফুটবল উপহার দেবার সাথে দুই গোল করে আর্জেন্টিনাকে ফাইনালে তুলেছিলেন, সে প্রশংসা সেভাবে মুখে মুখে ঘোরে না।

স্পেন বিশ্বকাপে ইতালি ছাড়া ম্যারাডোনা নাস্তানাবুদ হয়েছিলেন এই বেলজিয়ামের বিপক্ষে। স্তাদিও অ্যাজটেকে সেমিফাইনালের ম্যাচ শুরুর বাঁশি বাজার সাথে সেই পুরনো স্মৃতি যেন ফেরত আসল। বিরাশির বিশ্বকাপে ম্যারাডোনাকে আটকে দেওয়ার অর্থ গোটা আর্জেন্টিনাকে আটকে দেবার কৌশল প্রথম বের করেছিল এই বেলজিয়ামই। মেক্সিকোতেও তারা সেই পুরনো কৌশলে ফিরে গেল। কিন্তু হতভম্ব বেলজিয়াম আবিষ্কার করল এক ভিন্ন ম্যারাডোনাকে। পুরো ম্যাচে ঠিকভাবে তাকে মার্কই করতে পারেনি বেলজিয়ান ডিফেন্ডাররা। আর ম্যারাডোনা বাম পায়ের জাদুতে শুধু আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপের ফাইনাল মঞ্চেই তোলেননি, বেলজিয়ানদের সাথে নিয়েছেন এক মধুর প্রতিশোধ।

হোর্হে বুরুচাগার পাসে ৫১ মিনিটে আর্জেন্টিনাকে প্রথম গোল এনে দেন ম্যারাডোনা। এই প্রথম গোলই বলে দেয় বেলজিয়ামের কৌশল কতটা ব্যর্থ হয়েছিলেন ম্যারাডোনাকে আটকাতে। বুরুচাগার থ্রু পাস দেবেন, তা বুঝে ম্যারাডোনা যখন প্রতিপক্ষের ডি-বক্সে ঢুকে পড়েন, বেলজিয়ামের দুই সেন্টারব্যাক তখনও তার পিছু পিছুই ছুটছিলেন। ৬৩ মিনিটে দ্বিতীয় গোলটা সম্পূর্ণই ম্যারাডোনার একক কৃতিত্ব। মাঝমাঠের কিছুটা উপরে বল পেয়ে তিনি তিনজন খেলোয়াড়ের মাঝ থেকে ছিটকে বের হয়ে যান বেলজিয়ামের ডি-বক্সে। সেখানে থাকা আরেক ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে করা সেই গোল ইংল্যান্ডে বিপক্ষে তার করা নিজের গোলের কথাই মনে করিয়ে দেয়।

বিশ্বকাপ হাতে ম্যারাডোনা; Image Source; Getty Images

পুরো বিশ্বকাপে অদম্য ম্যারাডোনাকে আসলেই কেউ যদি হতাশ করে থাকেন, তিনি হ্যারাল্ড শ্যুমাখার। অ্যাজটেকে ফাইনালের মঞ্চে ম্যারাডোনার নামের পাশে কোনো গোল না থাকার কারণ এই জার্মান গোলরক্ষক। পুরো ম্যাচে ম্যারাডোনার দারুণ সব গোলসুযোগ অবলীলায় ঠেকিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। তবে জার্মানির বিপক্ষে আর্জেন্টিনা খেলেছে একদম নির্ভেজাল দলগত ফুটবল। সেখানে ইংল্যান্ড বা বেলজিয়ামের মতো ম্যারাডোনার একক কৃতিত্বের প্রয়োজন ছিল না।

তবে আর্জেন্টিনার দ্বিতীয় বিশ্বকাপ জয়ের চিত্রপটে শেষ তুলির আঁচড় ম্যারাডোনাই দিয়েছিলেন। ব্রাউন ও ভালদানোর দুই গোলের পর ৮১ মিনিটে ভোলার ২-২ গোলে সমতা আনেন। তবে ভোলারের গোলের তিন মিনিটের মাথায় ম্যারাডোনার দেয়া এক পাসে গোল করে আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ নিশ্চিত করেন বুরুচাগা।

পাঁচ গোল ও পাঁচ অ্যাসিস্ট – কোনো দ্বিমত ছাড়াই বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন ডিয়েগো ম্যারাডোনা। তবে ম্যারাডোনার অতিমানবীয় পারফরম্যান্সের নিচে ঢাকা পড়ে গেলেও অ্যালবিসেলেস্তেরা ভোলেনি ২৩ বছর বয়সী ফরোয়ার্ড হোর্হে বুরুচাগা ও ভালদানোর নামও। ফাইনালের মঞ্চে গোল করে বিশ্বকাপ জেতানো বুরুচাগা এবং পুরো আসরে চারটি গোল করা ভালদানো ছিলেন আর্জেন্টিনার দলনেতা ম্যারাডোনার যোগ্য সহচর।

বুরুচাগা ছিলেন আর্জেন্টিনার দলনেতা ম্যারাডোনার যোগ্য সহচর; Image Source: Getty Images

শেষ লড়াইয়ের সমাপ্তির পর একে একে বিশ্বকাপের সকল পুরস্কারের বিজেতার নাম ঘোষণা করা হলো। গোল্ডেন বুট পেলেন গ্যারি লিনেকার, গোল্ডেন বল ম্যারাডোনার ঝুলিতে। সর্বশেষে বিশ্বকাপজয়ী দলের হাতে সেই মোহনীয় ট্রফি তুলে দেবার সময় ঘনিয়ে এলো। ম্যারাডোনার মুখে স্বস্তির এক স্মিত হাসি। সে হাসি যেন একজন যুদ্ধ জেতা দলনায়কের মুখেই মানায়। বিশ্বকাপের সোনালী শিরোপা হাতে তুলে দিতেই প্রথমে তাতে চুমু একে দিলেন তিনি। এরপর মেক্সিকোর নীলাকাশে তা মেলে ধরলেন। ম্যারাডোনা তখন সাধারণ রক্তমাংসের কোনো মানুষ নন, অ্যালবিসেলেস্তে ফুটবল দলের দলনেতাও নন, পুরো আর্জেন্টিনার জন্য ততক্ষণে তিনি পরিণত হয়েছেন একজন ফুটবল-ঈশ্বরে।

(চলবে)

প্রথম পর্ব পড়ুন এখানে: ফুটবল-ঈশ্বরের প্রথম বিশ্বকাপ

Related Articles