জন্মভূমি ছেড়েছিলেন নতুন ঠিকানার উদ্দেশ্যে। ভেবেছিলেন, ইউরোপের দেশ স্পেনকে বানাবেন তার নতুন বসতবাড়ি। কিন্তু সে দেশে ম্যারাডোনার মন বসেনি। দুই বছর পর এক অঘটনের জের ধরে স্পেন থেকে তাকে রীতিমতো বিতাড়িত হতে হয়েছিল। বার্সেলোনা যখন তাকে খলনায়ক বানিয়ে দূরে সরিয়ে দিতে চাচ্ছে, ইতালির দক্ষিণের শহরের এর পুঁচকে ক্লাব তাকে প্রবল মমতায় বুকে জড়িয়ে নিল। সে ক্লাবটির নাম: নাপোলি।
নেপলস। নামটি শুনলেই উত্তরের মিলান বাসিন্দাদের নাক কুঁচকে উঠতো। উত্তরের সবাই যেন রাজা-বাদশা, আর নেপলস হলো নর্দমা থেকে উঠে আসা গেঁয়ো ভূত। এই তাচ্ছিল্যের ক্লাবটিই রেকর্ড পরিমাণ অর্থ খরচ করে ম্যারাডোনাকে দলে টানল। স্তাদিও সান পাওলোতে ম্যারাডোনাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য হাজির হয়েছিল প্রায় ৮৫ হাজার দর্শক।
নিজের মাঠে নেপলসবাসী যখন তাদের নতুন নায়ককে বরণ করে নিতে ব্যস্ত, উত্তরে থাকা সকলে যেন ফুঁসছে। ম্যারাডোনা এই ইতালি সম্পর্কে তখনও কিছু জানেন না। দেশ তো পরের কথা, নতুন ক্লাবই ঠিকভাবে চেনেন না। অথচ ততক্ষণে তিনি ইতালির অনেক ক্লাবের সমর্থকদের চোখে বিষে পরিণত হয়ে গেছেন।
নাপোলি ইতালিয়ান লিগের মধ্যম সারির দল। কখনও ‘সিরি-আ’ ট্রফি হাতে ধরে দেখা হয়নি তাদের। ভিনদেশী এক খেলোয়াড়কে নায়কের আসনে বসিয়ে তারা কী ভেবেছিল, তা আমরা জানি না। হয়তো লিগ জেতার এক সুপ্ত বাসনা তাদের মনে ছিল। তবে তা বাইরে প্রকাশ করে হাসির খোঁড়াক হতে কে চায়!
কিন্তু ম্যারাডোনা বাস্তব অথবা অবাস্তব সব স্বপ্নকে ছাপিয়ে গেলেন। সম্পূর্ণ একক নৈপূন্যে নাপোলিকে এনে দিলেন ইতালিয়ান লিগ শিরোপা। তাও একবার নয়, চার বছরে দুইবার। এই দুইবার লিগ শিরোপা জেতার মাঝে নাপোলি পেল উয়েফা সুপার কাপ জেতার মতো রোমাঞ্চিত স্বাদ।
প্রথম মৌসুমেই ম্যারাডোনা বনে গিয়েছিলেন নেপলসের রাজা। শুধু মাঠের জাদুতে নয়, মুখের কথাতেও নেপলস সমর্থকদের মন জয় করে নিয়েছিলেন। বছরঘুরে ১৯৯০ সালে ফুটবলপ্রেমীদের সামনে যখন আরও একটি বিশ্বকাপ হাজির হলো, ম্যারাডোনা তখন নাপোলির ঈশ্বর। যিশু খ্রিস্টের ছবির ঠিক পাশেই তার ছবি লাগানো থাকত। পুরো শহরে যেদিকে চোখ পড়বে, সেখানেই ম্যারাডোনার প্রতিচ্ছবি। শহরের গোরস্থানে পর্যন্ত মৃতদের উদ্দেশ্যে ব্যানার ঝুলতো,
"তোমরা কী জানো, কী মিস করছো!"
মাঠে একেকটি ম্যাচ শেষের সাথে সাথে শুরু হয় ম্যারাডোনা-বন্দনা। স্কুদেত্তো জেতার পরে নাপোলি ড্রেসিংরুমে জয়ের উল্লাসের ঢেউয়ের সাথে সবাই গেয়ে ওঠে ম্যারাডোনাকে নিয়ে বানানো ভালোবাসা ও আগেব মিশ্রিত গান,
“Oh mamma, mamma, mamma!
Do you know why my heart is racing?
I've seen Maradona! I've seen Maradona!
I fell in love with him!”
নাপোলির ঠিক এই সুখের সময় বছর ঘুরে হাজির হলো আরেক বিশ্বকাপ। সে বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হবে এই ইতালির মাটিতে। নাপোলির ফুটবল সম্রাটকেও দেখা যাবে বিশ্বকাপের মঞ্চে। কিন্তু তার গায়ে থাকবে আকাশী ও সাদা মিশ্রণের এক অন্য জার্সি। সে জার্সি তাদের কাছে যেন একদম অচেনা।
ইতালিতে বিশ্বকাপ-পর্ব শুরুর আগে আর্জেন্টিনা শিবিরে এক ইনজুরির ঝড় বয়ে যায়। আগের বিশ্বকাপে ৪ গোল করা হোর্হে ভালদানো ইনজুরির কারণে একেবারেই ছিটকে গেলেন। টাটা ব্রাউন, অস্কার রুগেরি, রিকার্দো জিউস্তি থেকে হোর্হে বুরুচাগা, এমনকি খোদ ম্যারাডোনা বাদ যাননি ইনজুরির কবল থেকে। যদিও তিনি বিশ্বকাপের মঞ্চে আসার পূর্বেই পায়ের আঙ্গুলের চোটে ভুগছিলেন।
ইনজুরি-সমস্যা নিয়ে তাই আর্জেন্টিনা আবারও মধ্যমমানের সেরা টিম হিসেবে বিশ্বকাপ খেলতে ইতালি-যাত্রা করল। কিন্তু মেক্সিকো বিশ্বকাপে প্রথম থেকে ম্যারাডোনাকে নিয়ে যেমন সমালোচনা চলছিল, এবার তা ভিন্ন। বিশ্বকাপ যেখানে হবে, সেখানের মাঠে প্রতি সপ্তাহে নামেন ম্যারাডোনা। নাপোলির মাঠেও বেশ কিছু ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে। যে মাঠের প্রতিটি ঘাস ম্যারাডোনার স্পর্শ চেনে। এছাড়াও ফর্মের দিক দিয়েও তিনি দারুণ সময় পার করছেন; ইতালির হয়ে দ্বিতীয় স্কুদেত্তো জিতেছেন, ১৬ গোল করে ইতালিয়ান লিগে হয়েছেন সর্বোচ্চ গোলদাতা।
কিন্তু সান সিরোর মাঠে ক্যামেরুনের সাথে প্রথম ম্যাচে ম্যারাডোনা হতাশ করলেন। পুরো ম্যাচে ক্যামেরুনের খেলোয়াড়দের একমাত্র লক্ষ্য ছিল ম্যারাডোনা ও তার পা থেকে বল কেড়ে নেবার নামে অযথা ফাউল। আর্জেন্টিনার বাকি ৯ জনও ঐ মধ্যমমানের উপরে যেতে পারলেন না। একজন সুইপার ডিফেন্ডারকে নিয়ে ৪-৪-২ ফর্মেশনে আর্জেন্টিনার আক্রমণভাগে বুরুচাগা ও আবেল বালবো তেমন সুবিধা করতে পারেননি। তাই প্রথম ম্যাচেই ১-০ গোলের পরাজয়।
সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে গ্রুপপর্বের দ্বিতীয় ম্যাচ ফিরল নাপোলি মাঠ স্তাদিও সান পাওলোতে। পুরো গ্যালারিতে আর্জেন্টিনার সমর্থকদের থেকে বেশি নাপোলির ভক্ত। তাদের স্বপ্নের নায়ক ভিন্ন এক জার্সিতে নিজের মাঠে ফিরলেও তিনি নেপলসের রাজা। কিন্তু নিজের মাঠে, নিজের চেনা দর্শকদের সামনেও ম্যারাডোনা গোল বা অ্যাসিস্টের খাতা খুলতে পারলেন না। তবে দলে ফর্মেশনে বদল হলো, আর্জেন্টিনার তৎকালীন সবচেয়ে প্রতিভাবান তরুণ ক্লদিও ক্যানিজিয়া একাদশে ফিরলেন। তবে ২-০ গোলের ব্যবধান তৈরি করে আর্জেন্টিনাকে জয় পাইয়ে দিলেন বুরুচাগা ও ত্রোগিলো।
তৃতীয় ম্যাচ আবারও সেই স্তাদিও সান পাওলোতে। প্রতিপক্ষ রোমানিয়া, বিলার্দোর প্রথম পছন্দের গোলরক্ষক পাম্পিদো ইনজুরিতে বিশ্বকাপ শেষ। তার বদলি হিসেবে অ্যানহেল কোমিজ্জো ইতালিতে উড়ে আসলেন, আর রোমানিয়ার বিপক্ষে গোলবারের নিচে দাঁড়ালেন সার্জিও গোয়কচিয়া।
আর্জেন্টিনা রোমানিয়ার বিপক্ষে জয় নিয়ে ফিরতে পারলো না। ১-১ গোলে ড্র হওয়া সে ম্যাচে ম্যারাডোনা খুবই গড়পড়তা মানের ফুটবল খেললেন। কিন্তু সে ম্যাচে ম্যারাডোনার চাওয়া-পাওয়া বেশ পরিষ্কার হয়ে গেল। তিনি বুঝেছিলেন এবারের দল খুবই সাধারণমানের। ভালদানো নেই, বুরুচাগার ফর্মও আগের মত নেই। ক্যানিজিয়া প্রতিভাবান, তবে এখনও জ্বলে উঠতে পারেননি। আর প্রতি ম্যাচে ঈশ্বর-প্রদত্ত ফুটবল খেলা সম্ভব না। যদি ছিয়াশির বিশ্বকাপের মতো একাই নেতৃত্ব দিয়ে দলকে এগিয়ে নেবার চেষ্টা করেন, হয়তো তিনি সফল হতেও পারেন। কিন্তু এক ম্যাচে থমকে গেলে আগের মতো বুরুচাগা এগিয়ে এসে দলকে টানতে পারবেন না। তাই একা না চেষ্টা না করে পেছনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়াই হবে সবচেয়ে নিরাপদ।
ম্যারাডোনা গ্রুপপর্বের তিন ম্যাচের খেলার ধরনের সাথে বর্তমান যুগের ফুটবলে 'ওয়ার্করেট' টার্ম দারুণভাবে মানিয়ে যায়। একজন মিডফিল্ডার যিনি মধ্যমাঠে খেলা গড়ছেন, রক্ষণভাগের দায়িত্ব পালন করছেন, প্রতিপক্ষের কৌশল বা আক্রমণ ভোঁতা করে দিচ্ছেন - এ ধরনের পরিশ্রমী মিডফিল্ডার বর্তমান যুগের কোচদের অত্যন্ত পছন্দের। তিনি যদি নিয়মিত গোল বা অ্যাসিস্ট না-ও করে থাকেন, তাতেও কোচের আপত্তি থাকে না। একটি সাধারণ মানের দলকে এগিয়ে নিয়ে যেতে নব্বইয়ের বিশ্বকাপে ম্যারাডোনা ঠিক এই পরিশ্রমী মিডফিল্ডাররূপেই আবির্ভূত হয়েছিলেন।
গ্রুপ বি থেকে আর্জেন্টিনা তৃতীয় হয়ে পরের রাউন্ডে পা দিল। নকআউট স্টেজে তাদের প্রতিপক্ষ গ্রুপ সি চ্যাম্পিয়ন হওয়া লাতিন আমেরিকান পরাশক্তি ব্রাজিল। এ ম্যাচে ম্যারাডোনার সব থেকে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী জিকো ছিলেন না, তবে সেলেকাও ও আলবিসেস্তেদের এই ফুটবল-লড়াই বরাবরই আগ্রহব্যঞ্জক।
তুরিনের স্তাদিও দেল্লে আলপিতে এই ব্রাজিলের বিপক্ষে ম্যারাডোনা স্বরূপে ফিরলেন। এতদিন আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপজয়ী নায়ক নিচ থেকে নির্দেশনা দিয়ে গেছেন। এই ম্যাচে লড়াইয়ের মাঠে তিনিই এগিয়ে গেলেন। বুরুচাগা খেললেন ম্যারাডোনার বেশ নিচে; ক্যানিজিয়াও ছিলেন, বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো তিনিও স্বরূপে ফিরেছিলেন। কিন্তু ম্যাচে ব্রাজিলই সবসময় এগিয়েছিল। সেলেকাওদের দুর্দান্ত কিছু শট রুখে দিয়েছিলেন গোয়কচিয়া। কিন্তু ম্যাচ জিতে নেবার জন্য ১০ মিনিটই যথেষ্ট।
৮০ মিনিটে একদম মাঝমাঠে বল পেয়েছিলেন ম্যারাডোনা। তবে তাকে ঘিরে ছিল ব্রাজিলের চার মিডফিল্ডার। তবে সবার চোখে ধুলো দিয়ে চকিতে ম্যারাডোনা তাদের রক্ষণবুহ্য ভেদ করে গেলেন। হোর্সে বাসুলদা পেছনে থেকে ম্যারাডোনাকে ফাউল করে আটকানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলেন। ব্রাজিলের ডি-বক্সে তখন তিনজন ডিফেন্ডার, কিন্তু বাম প্রান্তে ক্যানিজিয়া একদম ফাঁকা। চোখের কোণা দিয়ে ম্যারাডোনা তা দেখেছিলেন। তিনজন ডিফেন্ডারের মাঝ থেকে রক্ষণচেরা এক পাসে বল বাড়িয়ে দিলেন ক্যানিজিয়ার দিকে। অবশ্য ম্যারাডোনার এই পাস বেশি দৃষ্টিনন্দন নাকি তাফারেলকে পরাস্ত করা ক্যানিজিয়ার সে বুদ্ধিদীপ্ত শট, তা নির্ধারণ করা বেশ কষ্টসাপেক্ষ।
ম্যারাডোনা কিছুটা হলেও স্বরূপে ফিরলেন। এক ম্যাচেই ভরসার পাত্র হয়ে উঠলেন ক্যানিজিয়া ও গোয়কচিয়া। কিন্তু তখনও কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি, ক্যানিজিয়াকে করা অ্যাসিস্টই ইতালি বিশ্বকাপে ম্যারাডোনার শেষ অবদান হতে চলছে।
কোয়ার্টার ফাইনালে আর্জেন্টিনার প্রতিপক্ষ যুগোস্লাভিয়া, ৯০ মিনিটে কোনো গোল না হওয়ার কারণে যা পেনাল্টি শ্যুটআউট পর্যন্ত পৌঁছায়। বুরুচাগার একটি গোল আশ্চর্যজনকভাবে বাতিল করে দিয়েছিলেন সেদিনের রেফারি। তবে ঐ গোল বাতিল না করলে যে সেদিনের অন্যতম নাটক অধরাই থেকে যেত!
যুগোস্লাভিয়ার প্রথম পেনাল্টি শটে গোল করতে ব্যর্থ হয়েছিল, বিপরীতে আর্জেন্টিনা পরপর দুই শটেই গোল করেছিল। কিন্তু গোলমাল বাধে তৃতীয় শট নেবার সময়। স্বয়ং ম্যারাডোনা গোল করতে ব্যর্থ! তার নেওয়া দুর্বল শট খুব সহজেই ধরে ফেলেছেন যুগোস্লাভিয়ার গোলরক্ষক ইভোকোভিচ। ম্যারাডোনাকে মিস করতে দেখে ভেতরে ভেতরে হয়তো আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিলেন ত্রোগিলো। তিনিও সবাইকে অবাক করে দিয়ে গোলবারে পেনাল্টি উড়িয়ে মারেন। আর্জেন্টিনার ভয়ঙ্কর এই দুঃসময়ে নায়ক হয়ে আর্বিভাব ঘটে গোয়কচিয়ার। প্রবল চাপ মাথায় রেখে একদম শান্ত মনে গোয়কচিয়া যুগোস্লাভিয়ার শেষ দুই পেনাল্টি শট ঠেকিয়ে আর্জেন্টিনাকে সেমিফাইনালে তোলেন।
ম্যারাডোনা নাপোলিতে ক্যারিয়ার গড়েছেন। এই দেশে জন্ম না হলেও এখন ইতালির শহরই তার বসতবাড়ি। জুভেন্টাসকে হারিয়ে নেপলসের রাস্তায় সমর্থকদের সাথে হেঁড়ে গলায় গান ধরেন এই ভিনদেশী। আবার নিজেই বলেন, আমি নেপলসের রাজা। তিনিই এবার নামবেন ইতালির বিপক্ষে। স্বয়ং বিধাতাও হয়তো নাটকীয় একটি মুহূর্ত তৈরি করতে চাচ্ছিলেন। নাহলে এতটা কাকতালীয়ভাবে এই উত্তেজক ম্যাচের ভেন্যু কি না স্তাদিও সান পাওলো ঠিক হয়!
ম্যাচের কয়েকদিন আগে ম্যারাডোনা রীতিমতো আগুনে ঘি ঢাললেন। তিনি ফুটবলকে আর খেলার ভেতরই রাখলেন না, সরাসরি নিয়ে গেলেন রাজনৈতিক বিতর্কের দোরগোড়ায়। ম্যাচ শুরু আগের প্রেস কনফারেন্সে ম্যারাডোনা বলেন,
"সবাই এখন নেপলসকে ইতালিয়ান হয়ে ইতালিকে সমর্থন করতে বলছে। আমার এ বিষয়টি একদম পছন্দ হচ্ছে না। নাপোলি সবসময় এই দেশের বাকি অঞ্চল থেকে রীতিমতো আলাদা ছিল। এই শহর সবথেকে বেশি বৈষম্য দেখেছে, বর্ণবাদের শিকার হয়েছে।"
নাপোলিকে একঘরে করে রাখার ক্ষোভ ঝাড়তে ম্যারাডোনা এক মুহূর্ত চিন্তা করলেন না। ইতালিকে সমালোচনা করে তিনি নাপোলিকে সেমিফাইনালে আর্জেন্টিনাকে সমর্থন দেবার জন্য অনুরোধ করে বলেন,
"তোমরা নিজের দেশে ৩৬৪ দিনই বিদেশি হিসেবে বিবেচিত হও। আর সেই তোমাদেরকে আবার সমর্থন দেবার জন্য বলা হচ্ছে। আমাকে দেখো, আমি বছরের ৩৬৪ দিনই নাপোলিয়ান।"
নব্বইয়ের জুলাইয়ে স্তাদিও সান পাওলোতে অদ্ভুত এক ম্যাচ। আর্জেন্টিনা বনাম ইতালি। কিন্তু ইতালির নাপোলি শহরের সমর্থকরা পুরোদমে দ্বিধাগ্রস্ত। আর্জেন্টিনার জাতীয় সংগীত চলাকালীন পুরোটা সময়ে স্বাগতিক দর্শককরা অভিবাদন জানাতে ভুললো না। নেপলসবাসীরা সাথে বিভিন্ন ব্যানার নিয়ে এসেছিল। তাতে লেখা,
" ডিয়েগো আমাদের হৃদয়ে। কিন্তু ইতালি আমাদের জন্মভূমি।"
"ম্যারাডোনা, নেপলস তোমাকে সবসময় ভালোবাসে। তবে ইতালি আমাদের মাতৃভূমি।"
বিশ্বকাপজুড়েই ম্যারাডোনা বিভিন্ন ইনজুরিতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। সেমিফাইনালের ম্যাচেও গোড়ালির ইনজুরি তাকে ভুগিয়েছিল। এছাড়াও এ বিশ্বকাপের প্রায় পুরোটা সময়ে আর্জেন্টিনার আক্রমণভাগ সহজাত খেলা খেলতে পারেনি। বিপরীতে রক্ষণ বেশ নিরেট হবার কারণে রক্ষণভাগও আর্জেন্টাইনদের সহায়তা করেছে বিশ্বকাপে লম্বা পথ পাড়ি দিতে। কিন্তু ১৭ মিনিটে শিলাচির সামনে আর্জেন্টিনার রক্ষণ শুরুতেই একটা ধাক্কা খায়, এগিয়ে যায় ইতালি।
তবে গোল হজম করেও ম্যাচে ফেরে আর্জেন্টিনা। ম্যারাডোনা বেশ ইনজুরড, সাথে ফিটনেস সমস্যাও ছিল। এরপরও তার প্লেমেকিংয়ে আর্জেন্টিনা ৬৭ মিনিটে সমতায় ফেরে। তবে এই ম্যাচের গোল বা অ্যাসিস্টের তালিকায় ম্যারাডোনার নাম খুঁজে পাবেন না। কারণ, মধ্যমাঠে তার দারুণ প্লেমেকিংয়ের দরুন বল পেয়ে যান আর্জেন্টিনার লেফট উইঙ্গার ওলার্তিকোয়েচিয়া। তারই অ্যাসিস্টে বিশ্বকাপের নিজের দ্বিতীয় গোল করেন ক্যানিজিয়া।
১২০ মিনিটেও ম্যাচের ভাগ্য পরিষ্কার হয়নি। অতএব, পেনাল্টি শ্যুটআউট।
আর্জেন্টিনা ও ইতালি নিজেদের প্রথম তিন শটে তিনটিতে গোল করতে সক্ষম হয়েছে। ঘরের মাঠে, নিজের দর্শকদের সামনে আর্জেন্টিনার চতুর্থ পেনাল্টি শট নিতে এগিয়ে আসছেন নাপোলির ফুটবল-ঈশ্বর। আগের ম্যাচে এই পেনাল্টি মিস করে আর্জেন্টিনাকে প্রায় খাদে ঠেলে দিয়েছিলেন। গোয়কচিয়া ডোনাডুনির শট ঠেকিয়ে দিয়েছেন। এবার কি গোল হবে? ভেতরে ভেতরে কী ভীষণ স্নায়ুচাপ!
যুগোস্লাভিয়ার বিপক্ষে দুর্বল শট নিয়েছিলেন। ইতালির বিপক্ষেও মাটি কামড়ানো দুর্বল শটই নিলেন তিনি। কিন্তু ইতালির গোলরক্ষক ওয়াল্টার জেঙ্গা লাফ দিলেন একদম উল্টো দিকে। তবে ম্যারাডোনার কারণে এই ম্যাচ বিশ্বকাপের অন্যতম স্মরণীয় ম্যাচ হয়ে থাকলেও ফাইনালের ওঠানোর নায়ক কিন্তু তিনি ছিলেন না। ডোনাডুনি ও সেরেনার পেনাল্টি আটকে আর্জেন্টিনা টানা দ্বিতীয়বারের মতো ফাইনালে উঠেছিল গোলরক্ষক গোয়কচিয়ার নৈপুণ্য।
ফাইনালে আর্জেন্টিনার প্রতিপক্ষ জার্মানি, ইতালি বিশ্বকাপসহ যারা টানা তিন ফাইনাল খেলছে। ছিয়াশির বিশ্বকাপে ফাইনালে তারা এই আর্জেন্টিনার কাছেই হেরেছিল বটে, তবে এবারের জার্মান দল ভিন্ন। ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ারের দল গুলিত-ক্যোমান-রাইকার্ডের হল্যান্ডকে হারিয়ে ফাইনালের মঞ্চে পৌঁছেছে। আর সেমিফাইনালে হলুদ কার্ড দেখার জন্য ক্যানিজিয়া ফাইনাল খেলতে পারবেন না। তার না থাকার কারণে আর্জেন্টিনা আরও শক্তি হারিয়েছে। তাই ফাইনালে অবশ্যই ফেভারিট জার্মানি।
তবে আর্জেন্টিনা বনাম জার্মানির এই ফাইনাল বিশ্বকাপের ইতিহাসের অন্যতম বিতর্কিত ফাইনালের একটি। আর্জেন্টিনা সেদিন একদমই আক্রমনাত্মক মনোভাব নিয়ে খেলেনি। ৬৫ মিনিটে পেদ্রো মোঞ্জনের লাল কার্ডের পর ১০ জনে পরিণত হওয়া আর্জেন্টিনা আর পেরে ওঠেনি, ৮৫ মিনিটে জার্মানির হয়ে পেনাল্টিতে গোল করেন ব্রেহমে। তবে এই পেনাল্টি দেওয়াকে কেন্দ্র করে এখনও যথেষ্ট বিতর্ক চালু রয়েছে। আবার এই পেনাল্টির ঠিক ২ মিনিট পরই লাল কার্ড দেখানো হয় আর্জেন্টিনার সেদিনের স্ট্রাইকার গুস্তাভো দেজত্তিকে।
ইতালির বিশ্বকাপ ম্যারাডোনার জন্য ঐতিহাসিক বা দু'হাত ভরা সাফল্যের ছিল না। খর্বশক্তির আর্জেন্টিনা নিয়েও ফাইনালের মঞ্চে উঠেছিলেন বটে, কিন্তু সেখানে ম্যারাডোনার থেকে ক্যানিজিয়া বা গোয়কচিয়ার একক অবদানই বরং বেশি ছিল। তবে ভাগ্যদেবী আরেকটু সহায় হলে বা রেফারির নেওয়া সিদ্ধান্তগুলো সম্পূর্ণ আর্জেন্টিনার বিপক্ষে না গেলে সেদিন স্তাদিও অলিম্পিকোতে এক ভিন্ন গল্প লেখা হলেও হতে পারতো!
আগের পর্বগুলো:
This article is in Bangla language. It is about the first world cup of Diego Maradona. This is the third installment of a series on Diego Maradona at the world cups.
Feature Image Source: Getty Images
Background Image Source: Getty Images