Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ক্রিকেট-কর্তৃত্বের হাতবদল: বিশ্বক্রিকেটের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পথে ভারতের প্রথম পদক্ষেপ

প্রথম পর্বে আমরা জেনেছিলাম ইংলিশ ক্রিকেটের আধিপত্যে ভারতের চ্যালেঞ্জের কারণ, এবং সেই ফলশ্রুতিতে পাক-ভারত যৌথ অংশীদারিত্বে বিশ্বকাপ আয়োজনের উদ্যোগ। এবারে আমরা জানার চেষ্টা করব, বিশ্বকাপ আয়োজনের উদ্যোগ কীভাবে সফলতার মুখ দেখেছিল।  

উপমহাদেশে বিশ্বকাপ আয়োজনের বাধা কেবল ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া ছিল না, চ্যালেঞ্জ ছিল বহুমুখী। আজকের বিসিসিআই বিশ্বক্রিকেটের মোড়ল, সবচেয়ে পয়সাওয়ালা ও ক্ষমতাবান ক্রিকেট বোর্ড। কিন্তু আশির দশকে ভারতীয় ক্রিকেটের অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল সঙ্গীন। বিশ্বকাপজয়ী কাপ্তান কপিল দেবের কিশোর বেলার একটি ঘটনা উল্লেখ করা যায়।

কপিলের বয়স তখন তেরো কি চৌদ্দ। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের তত্ত্বাবধানে প্রতিভাবান কিশোরদের নিয়ে মুম্বাইতে চালু করা হয়েছে একটি অস্থায়ী ট্রেনিং ক্যাম্প। ছেলেবেলা থেকেই কপিল দুর্দান্ত প্রতিভাবান, তাই তিনিও ছিলেন সেই অনুশীলন ক্যাম্পে। প্রখর রৌদ্রের মধ্যে ছেলেদের প্রচুর খাটানো হয়, অথচ সেই অনুযায়ী যে পরিমাণ খাবার দেয়া হয় তা পর্যাপ্ত নয়; দুটো রুটি আর সামান্য ডাল-তরকারি। সারাটাদিন খেটেখুঁটে এই সামান্য খাবার খেয়ে কী দিনাতিপাত করা যায়? ছেলেদের মধ্যে একটা চাপা ক্ষোভ কাজ করে। সবাই চেপে গেলেও বা ভয়ে মুখ না খুললেও প্রতিবাদ করলেন একজন। অসন্তোষ ও রাগ চেপে না রেখে প্রকাশ্যে ঘোষণা করলেন — খাবারের নামে এই তামাশা তার পছন্দ নয়। ক্যাম্পের খাবার বয়কট করলেন কপিল।

বয়কটের কথা শুনে ক্যাম্পের ইনচার্জ কেকি তারাপোরে এসে কপিলকে জিজ্ঞেস করেন,

‘ব্যাপার কী হে ছোকরা? আমাদের দেয়া খাবার নাকি তোমার পছন্দ না?’

কপিলের তাৎক্ষণিক জবাব,

‘জ্বি স্যার, পছন্দ না। আমি একজন ফাস্ট বোলার। আর ফাস্ট বোলারদের আরো ভাল খাদ্যের প্রয়োজন রয়েছে।’

তারাপোরে তখন বিদ্রুপের হাসি হেসে বলেন,

‘ও মা! তুমি ফাস্ট বোলার! ভারতে আবার কোনো ফাস্ট বোলার আছে নাকি?’

খাবার বা কপিলের প্রতিবাদ মূখ্য নয়, এই ঘটনা উল্লেখ করার কারণ হচ্ছে, ভারতীয় ক্রিকেটের হতদরিদ্র অবস্থা বোঝানো। যে ভারতীয় ক্রিকেট আজকাল ক্ষুধে ক্রিকেটারদের পর্যন্ত যেই মানের সুযোগ সুবিধা দিচ্ছে, যা কি না বহু টেস্ট খেলুড়ে দেশের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটারও পায় না, সেই ভারতীয় ক্রিকেটেরই তখন ছিল ভীষণ অর্থাভাব।

কিশোর কপিলের সাহস – ফাস্ট বোলারদের দরকার পুষ্টিকর খাবার; Image Source: BCCI

অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ড বা এমসিসির কাছ থেকে অনুমোদন আদায়ের পাশাপাশি তাই ভারতীয় ক্রিকেটকে ভাবতে হচ্ছিল অর্থ সংগ্রহনের উপায় নিয়েও। ত্রিশ কোটি টাকার বাজেট ব্যবস্থাপনা রীতিমতো অসম্ভব। তবুও মাথার উপর আশীর্বাদ হয়ে ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন। তার এক কথায় ধীরুভাই আম্বানি সমস্ত খরচ বহন করতে দু’বার ভাবতেন না। প্রধানমন্ত্রীকে ব্ল্যাঙ্কচেক পর্যন্ত দিতে রাজি ছিলেন তিনি। সব ঠিকঠাকই এগোচ্ছিল। 

হা হতোস্মি! মিসেস গান্ধী খুন হলেন, বিসিসিআই হারিয়ে ফেলল সুবিশাল বটবৃক্ষের ছায়া। ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক অবস্থাও তেমন শক্তপোক্ত নয়। সালভে কি করবেন, বুঝে উঠতে পারেন না। তিনি ইন্দিরা-পুত্র রাজিব গান্ধীর দ্বারস্থ হন। বুঝিয়ে বলেন আগাগোড়া। রাজিব গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন সত্যি, স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন মা ইন্দিরার; কিন্তু মায়ে-পোয়ে দু’জনের ব্যক্তিত্বে তফাৎ আসমান-জমিন। শৈশব-কৈশোর থেকেই ব্রিটিশ ভারতের ঝানু রাজনীতিবিদদের সঙ্গ পেয়ে বেড়ে উঠেছেন ইন্দিরা, রাজনীতি তার কাছে নেশা ও মায়ের আঁচলের মতো আপন মনে হয়। অন্যদিকে রাজিব অনেকটা পাকেচক্রে বনে গেছেন রাজনীতিবিদ। ক্ষমতা নিয়ে ভিপি সিংকে দিয়েছেন অর্থ মন্ত্রণালয়। আর তিনি দায়িত্ব পেয়ে প্রথম যে কাজটি করেছেন, তা হচ্ছে ধীরুভাই আম্বানির ইনকাম ট্যাক্স ও আয়ের উৎস সংক্রান্ত তথ্য অনুসন্ধান। সরকারের সঙ্গে আম্বানির স্বাভাবিকভাবেই সম্পর্ক বিনষ্ট হয় এতে। তাছাড়া ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে ধীরুভাই আম্বানির যে আন্তরিক সুসম্পর্ক ছিল, তার তনয়ের সঙ্গে তেমনটা গড়ে উঠার সময় ও সুযোগ হয়নি। ফলে বিশ্বকাপ আয়োজন ও ব্যয়ভার বহনের মৌখিক সম্মতি থেকে সরে যেতে তেমন দুর্ভাবনার প্রয়োজন পড়েনি ধীরুভাই আম্বানির। কিন্তু সালভের মাথায় পড়ে বজ্রপাত। এতগুলি টাকা এখন পাবেন কোথায়? 

নতুন স্পন্সর খুঁজতে গিয়ে বহু কোম্পানির দ্বারে ঘুরেও ফল হয় না। মরার উপর খাড়ার ঘা — সিকিউরিটি মানি হিসেবে চার কোটি রুপি অগ্রিম পরিশোধ করতে হবে। ডেডলাইন হচ্ছে ১৯৮৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। মরুভূমির পথ হারানো পথিক পানির জন্য যেমন হন্য হয়ে এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করে, টাকার জন্য সালভের অবস্থাও অনেকটা তেমনি। অত টাকা দেবে তেমন দিলদরিয়া নেই কেউ। সিকিউরিটি মানি পরিশোধ করতে হবে পাউণ্ডে, রুপি হলে হবে না। চার কোটি রুপি মানে তখনকার হিসেবে ১৮ লক্ষ পাউন্ড সমমূল্যের প্রায়। বিদেশী স্পন্সর চাইল বিসিসিআই, কিন্তু সেখানেও মিলল শুধুই হতাশা। বৈদেশিক পণ্যের বাজার তখনো গড়ে ওঠেনি ভারতে। রক্ষণশীল সমাজে নানা নিয়মকানুন, বহু পণ্যের বিজ্ঞাপন তাই সম্ভব নয় ভারতবর্ষে। বিস্তর ছোটাছুটি ও ক্লান্তিহীন খাটুনির ফল মিলল মোটে ৩৮ লাখ রুপি। 

জমজমাট ক্রিকেট মাঠে গড়ানোর পূর্বে কত সংশয়, শঙ্কা ও উত্তেজনা; Image Source: Getty Images

কোকাকোলা, জিলেট, রথম্যানস, মিৎসুবিশি মোটরস, কোডাক ইত্যাদি স্পন্সর পেলেও কাজের কাজ হচ্ছিল না। টিভি ও গ্রাউন্ডস বা মাঠের বিলবোর্ডের বিজ্ঞাপন থেকে যদিও বেশ ভালো একটা অঙ্ক মিলবে, কিন্তু সেটা পাওয়া যাবে বিশ্বকাপের পর। এদিকে ‘৮৪-র ডিসেম্বরেই ১.৮ মিলিয়ন পাউন্ড বা আঠারো লক্ষ পাউন্ড বুঝিয়ে দিতে হবে সিকিউরিটি মানি বাবদ।

উপায়ান্তর না পেয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছেই সমাধান খুঁজলেন সালভে। অন্যকথায়, হাত পাতলেন। রাজীব গান্ধী ছিলেন উদার ও দিলওয়ালা মানুষ, মায়ের মতো কঠিন নন। ফলে সব শুনে তিনি ঘোষণা দিলেন, সরকার ধার হিসেবে টাকাটা দেবে ক্রিকেট বোর্ডকে। সরকারের রিজার্ভ ফান্ড থেকে টাকা তুলে সিকিউরিটি মানি দেয়া হলো — যেটা কি না ভয়ঙ্কর ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত ছিল। বিশ্বকাপ আয়োজনের জন্য সরকারের রিজার্ভ ব্যাঙ্কে হাত দেয়ার দুঃসাহস অন্য কোনো প্রধানমন্ত্রী করতেন কি না, কে জানে! সেই টাকাটা ফেরত আসবে, সেই নিশ্চয়তা তখন কোথায়? রাজীব গান্ধীর অত কথা ভাবার ফুরসৎ ছিল না। দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভারতের সুনাম রক্ষার দায়িত্ব তো তার উপরই বর্তায়। তাছাড়া ‘৮৩ বিশ্বকাপ জয়ের পর ক্রিকেট পুরো ভারতের জন্য মর্যাদা ও আত্মগৌরবের ব্যাপার হয়ে ওঠে। কিছুতেই সেই মর্যাদার ক্ষতি করতে চাইলেন না রাজীব। রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের গোড়ার দিকেই চরমতম ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতেও তাই দু’বার ভাবেননি তিনি। কোনোভাবেই দেশকে ছোট হতে দেয়া যাবে না। সেজন্য যেকোনো ঝুঁকি নিতে পারেন তিনি। নিঃসংকোচে বাজি ধরতে পারেন নিজের প্রধানমন্ত্রীত্ব বা সদ্য জেগে উঠা রাজনৈতিক ক্যারিয়ার নিয়েও! 

ক্রিকেট বোর্ডের আর্থিক দৈন্যতা, সরকারের ভান্ডারেও একরাশ শূন্যতা, এবং অর্থ লাভের সকল উৎস হাতড়িয়েও ব্যর্থ হওয়া… সবকিছু চমৎকার দক্ষতা ও চাতুর্যের সঙ্গে গোপন রাখলেন সালভে ও তার টিম। কোনোভাবে দুর্বলতা ফাঁস হয়ে গেলে মুখ আর দেখাতে হবে না। লজ্জা ও অপমানের চেয়েও বড় ব্যাপার হচ্ছে, বিশ্বকাপ আয়োজন ফস্কে বেরিয়ে যাবে ভারতের হাত থেকে। এমসিসি ও ইংল্যান্ড তো যেকোনো মোক্ষম সুযোগের অপেক্ষাতেই প্রহর গুনছে।

প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীই শেষ ভরসা; Image Source: Getty Images

দুরদর্শন বিশ্বকাপের ব্রডকাস্টিং পার্টনার। তারা জানিয়ে দিল, কোনো প্রকার লভ্যাংশ বিসিসিআইকে দিতে পারবে না তারা। ক্রিকেট বোর্ডের মাথায় হাত। নিশ্চিত অর্থলাভের যে সম্ভাবনা বা খাত, সেটাকে যেন হামানদিস্তা দিয়ে পিষে দেয়া হল। দুরদর্শনের যুক্তিও ফেলনা নয়। ব্রডকাস্টিং ফ্যাসিলিটির মানোন্নয়ন ও সম্প্রচারের আধুনিকায়নের শর্ত পূরণ করতে গিয়ে অনেক টাকা বেরিয়ে গেছে তাদের; এখন যদি বোর্ডকেও দিতে হয়, তাহলে তারা টিকে থাকে কী করে? তাদের টিকে থাকার স্বার্থে বিসিসিআইকে জলাঞ্জলি দিতে হলো রয়্যালিটির ছয় কোটি রুপি। এবার বুঝি লোকের দ্বারে দ্বারে যেতে হবে; কোনো কূলকিনারা খুঁজে পায় না আয়োজক কমিটি।

ত্রিশ কোটির এক-তৃতীয়াংশ খরচ মেটাবে পাকিস্তান, বাকি দুই-তৃতীয়াংশ ভারতের যোগাড় করতে হবে। স্পন্সর নেই, সম্প্রচার স্বত্ব নেই, বিদেশী বিনিয়োগ নেই, সরকার থেকে সহযোগিতা পাওয়ার সম্ভাবনাও নেই আর. এখন তাহলে যাবে কোথায় বিসিসিআই?

এমসিসি ও ইংল্যান্ডের পায়ে ধরে বলবে — ছেড়ে দে বাপ, তোরাই আয়োজন কর বিশ্বকাপ। এই ঝামেলা, এই প্রেশার আমরা আর সামলাতে পারছি না!

ভিপি সিংকে নিয়ে ওদিকে কংগ্রেসে চলছে তুলকালাম। তার অতি-মাতব্বরি সহ্য করতে পারছেন না অনেকে। শেষ পর্যন্ত তাকে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হল। অনেকে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল এবার, ছাড়ল স্বস্তির নিঃশ্বাস। সবার আগে সালভে নেচে উঠলেন একচোট। দুরু দুরু বুকে ডায়াল করলেন ধীরুভাই আম্বানির নাম্বার,

‘আপনি কি এখনো বিশ্বকাপ স্পন্সর করতে আগ্রহী আছেন?’

‘হ্যাঁ, আছি। কিন্তু এবারে একটা শর্ত আছে।’

সালভের কপালে শঙ্কার ছায়া,

‘কী শর্ত?’

‘বিশ্বকাপের পূর্বে পাকিস্তান-ভারত যে প্রদর্শনী ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে, সেখানে প্রধানমন্ত্রীর পাশের চেয়ারটা আমার জন্য রাখতে হবে।’

কিছুটা স্বস্তি পান সালভে। 

‘ও আচ্ছা, এই ব্যাপার… প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে হবে যে!’

‘ঠিক আছে, বলুন তবে!’ 

রাজীব গান্ধী মোটেও আপত্তি করলেন না। তার পাশের চেয়ার বরাদ্দ হয়ে গেল। এবারে ধীরুভাই আম্বানি যেন ব্ল্যাঙ্কচেক নিয়েই হাজির হলেন। প্রথমেই সরকারের ফান্ডে চার কোটি টাকা জমা দিয়ে দিলেন, যেটা ক্রিকেট বোর্ড ধার নিয়েছিল। আরো দেড় কোটি দিয়ে ‘টাইটেল স্পন্সরশিপ’ কিনে নিলেন। বিশ্বকাপের নামকরণ করা হলো রিলায়েন্স বিশ্বকাপ।

ধীরুভাই আম্বানির জ্যেষ্ঠ পুত্র অনিল আম্বানি রিলায়েন্সের পক্ষে চুক্তি স্বাক্ষর করলেন। সাংবাদিক সম্মেলনে গিয়ে ফাটালেন রিলায়েন্স গ্রুপের ‘ব্র্যান্ডিং’ বোমা। এক সাংবাদিক তাকে জিজ্ঞাসা করলেন,

“তো… বিশ্বকাপ নিয়ে পরিকল্পনা কী আপনাদের?”

‘কীহ! বুঝলাম না ঠিক।’

‘বিশ্বকাপ নিয়ে বলছিলাম…’

‘বিশ্বকাপ? সেটা আবার কী? ধুর ছাই, আমি জানি না ওসব।’

‘মানে? বলছেন কী আপনি? যে টুর্নামেন্টের স্পন্সর হলেন তা-ই জানেন না? আশ্চর্য!’

ধীরুভাই আম্বানির ছেলে গ্রুপ অব কোম্পানির পক্ষে চুক্তি স্বাক্ষর করতে এসে জানেনই না কীসের আয়োজন, কী আশয়-বিষয়! সাংবাদিকের দল যখন ভেতরে ভেতরে বিশাল উত্তেজনা নিয়ে ভাবছে জব্বর একটা খবর পাওয়া গেল, ঠিক তখনই ঝেড়ে কাশলেন আম্বানির উত্তরাধিকার।

‘ওহ আচ্ছা… ওটার কথা বলছেন… সেটাকে বিশ্বকাপ নয়, ‘রিলায়েন্স কাপ’ বলবেন, জাস্ট রিলায়েন্স কাপ। আর কিচ্ছু নয়।’

প্রশ্নকর্তা ও উপস্থিত সবাই বুঝে গেলেন, ধীরুভাই আম্বানি তার যোগ্য উত্তরাধিকারীকেই পাঠিয়েছেন। তারা শুধু বিশ্বকাপকে স্পন্সর করবে না, বুঝি বিশ্বকাপটাকে কিছু সময়ের জন্য দত্তক নিয়ে নেবে।

অনিল আম্বানির ‘ব্র্যান্ডিং’ বোমা; Image Source: PTI

বিসিসিআইয়ের অর্থ সংকট কেটে গেল মুহূর্তেই, যেন আলাদিনের চেরাগ জুটে গেছে। ভোজবাজির মতো পাল্টে গেল সব। মুশকিল আসান — রিলায়েন্স গ্রুপ। আম্বানির পয়সাকড়ির সমস্যা নেই, ভারতের অন্যতম শীর্ষ ধনী তিনি। কিন্তু তার চাই ব্র্যান্ডিং। শুধু ভারতবর্ষে নয়, গোটা বিশ্বব্যাপী। বিশ্বকাপটাই হয়ে গেল তার লক্ষ্য অর্জনের প্রথম সোপান। আম্বানি বিশ্বকাপটাকে ব্যবহার করেছেন, নাকি বিশ্বকাপই আম্বানির দ্বারা উপকৃত হয়েছে, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। তবে দুই পক্ষই এই লেনদেন থেকে লাভবান হয়েছে, তা নিশ্চিত।

ব্র্যান্ডিংয়ের অংশ হিসেবে প্রথমেই বদলে ফেলা হলো আয়োজক কমিটির নাম। ‘ভারত-পাকিস্তান যৌথ বিশ্বকাপ আয়োজক কমিটি’ থেকে তা হয়ে গেল ‘রিলায়েন্স কাপ আয়োজক কমিটি’। আড়াই কোটিরও বেশি অর্থমূল্যে সকল মাঠের সমস্ত মাঠ-বিজ্ঞাপন বিক্রি হয়ে গেল আম্বানির কাছে। অনেকেই প্রশ্ন তুলল, ব্যবসা শুধু আম্বানি করলেই হবে? আমরা করব না?

তাদের জন্য ক্রিকেট বোর্ডের জবাব ছিল একটিই; আমার যখন পয়সার দরকার ছিল, স্পন্সর খুঁজে মরেছি, তখন কই ছিলে তোমরা?

সব সমস্যার সমাধান তখনো হয়নি। বিসিসিআই আবাসন বা বিদেশী ক্রিকেটারদের জন্য পাঁচতারা হোটেল নিশ্চিত করতে পারেনি। কুছ পরোয়া নেহি। আম্বানি আছেন। বিশ্বকাপের অর্থ সংক্রান্ত যাবতীয় সংকট যেন, ক্রিকেট বা ভারতীয় বোর্ডের নয়, সবই রিলায়েন্স গ্রুপের, ধীরুভাই আম্বানির। হোটেল ঠিক করা, ক্রিকেটারদের সাক্ষাৎকারসহ নানান রকমের যত আয়োজন, সব রিলায়েন্স গ্রুপের মাধ্যমে সম্ভব হয়ে গেল। ‘রিলায়েন্স বিশ্বকাপ ১৯৮৭’ নামে টিভি সিরিজ তৈরি হলো দুরদর্শনের জন্য। যেখানে যেভাবে দরকার, সেখানে সেভাবে হাজির থাকল রিলায়েন্স ও আম্বানি। এখন প্রশ্ন হতে পারে, ব্র্যান্ডিং ঠিক আছে, তাই বলে পানির মতো এমন পয়সা খরচ কীভাবে সম্ভব?

আম্বানি বা রিলায়েন্স গ্রুপ ক্রিকেটপ্রেমী নন, আদতে ব্যবসায়ী। তিনি তার ব্যবসা ঠিক রাখবেনই। তার লস হয়, এমন কোনো বিনিয়োগে তিনি যাবেন না। এবং হয়েছেও তাই; বিশ্বকাপ ঘিরে সম্পূর্ণ আয়োজনের ব্যয়ভার বহনের মাধ্যমে ধীরুভাই আম্বানির দুরদর্শিতার প্রমাণও পাওয়া যায়। একটি টুর্নামেন্ট দিয়ে তার যত ‘সিস্টার কনসার্ন’ আছে, সবগুলোর বিজ্ঞাপন করেছেন তিনি। এবং যে ‘ব্র্যান্ডিং’ তিনি চাইছিলেন, তা তো পেয়েছেনই, সকাল-সন্ধ্যা মানুষের চোখে ভেসেছে তার পণ্য, স্বভাবতই বেড়েছে বিক্রিবাট্টা। ব্যবসায়ীরা আসলে কোনো লস প্রজেক্টে হাত দেন না, তাদের সব প্রজেক্ট বুঝি লাভ-ই লাভ।

রিলায়েন্স বিশ্বকাপ ১৯৮৭; Image Source: Getty Images

সকল শঙ্কা-সংশয়-দ্বন্ধ পেরিয়ে পাকিস্তান ও ভারত যৌথভাবে বনে গেল বিশ্ব আয়োজনের গৌরবপূর্ণ অংশীদার। সালভে বাস্তবায়ন করলেন তার জেদ — বিশ্বকাপ উঠোন ছাড়া হলো ইংল্যান্ডের। বাছাধন, তোমাদের কাছে টিকেট চাইব না এবার, বরং দরকার পড়লে তোমরাই চাইবে।

মানুষকে অকারণ তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে নেই। অপ্রয়োজনে প্রত্যাখান করতে নেই। আপাতদৃষ্টিতে ছোট ব্যাপারও হয়ে উঠতে পারে বিশাল। প্রত্যাখ্যাত কেউ জেদের বশে এমন কাণ্ড করে দেখাবে, যা পৃথিবীর মানুষ দূরতম দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করার দুঃসাহস রাখেনি। ভারত বা পাকিস্তান কেউই বিশ্বকাপ জিততে পারেনি সেবার। কিন্তু তারা জিতে নিয়েছিল স্বাধিকার, আত্মমর্যাদা ও আত্মগৌরব; জিতে নিয়েছিল কথা বলার অধিকার। জবাব দিয়েছিল বঞ্চনা ও অপমানের। পরের প্রজন্মের জন্য রেখে গেছে সুন্দরতম দীক্ষা — যদি লক্ষ্য থাকে অটুট, যদি সদিচ্ছা থাকে, ন্যায়ের পক্ষে থাকো, তাহলে পাহাড়ের উচ্চতা যত উঁচুতে হোক, সমুদ্রের ঢেউ যত বড় হোক, তা তোমাকে দাবিয়ে রাখতে পারবে না। সমস্ত মুশকিল ও চ্যালেঞ্জ সামলে সফল তুমি হবেই। যেমনটা ১৯৮৭ বিশ্বকাপ আয়োজন করতে গিয়ে ভারত ও পাকিস্তান হয়েছিল।    

তারপরের গল্পটা আরো ব্যাপক, আরো বিস্তৃত। কেবল বিশ্বকাপ নয়, ক্রিকেট খেলাটাই বিলেত ছেড়ে বুঝি চলে গেল ভারতবর্ষে। ১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপ জয় যদি ক্রিকেট উন্মাদনার চারাগাছ হয়, ১৯৮৭ বিশ্বকাপ আয়োজন যেন সেই চারায় সার দিয়ে, যত্নআত্তির মাধ্যমে হৃষ্টপুষ্ট করে তোলা। শতকোটিরও বেশি মানুষ খেলাটাকে প্রাণের উঠোনে স্থান দেয় সেখানে। ক্রিকেট কর্তৃত্বের ব্যাটনও তাই স্বাভাবিকতার সূত্র মেনে ইংল্যান্ড ছেড়ে পাড়ি দেয় ভারতে।  

This article in Bengali language, on about how cricket power transfer from England to India. And how India and Pakistan jointly organized world cup 1983 after facing numerous problems. 

Featured Image: PA Photos

Related Articles