"ঘর খুলিয়া বাহির হইয়া জোছনা ধরতে যাই;
হাত ভর্তি চান্দের আলো ধরতে গেলে নাই।"
বেলজিয়ামের সোনালি প্রজন্মের গল্প কি নিদারুণভাবেই না মিলে যায় হুমায়ুন আহমেদের লেখা লাইনটার সাথে! শূন্য থেকে এক রাজকীয় উত্থান, আবার সেই শূন্য হাতেই প্রস্থান। অবশ্য কাতার বিশ্বকাপ রয়ে গেছে, সেটা মনে করিয়ে দিতেই পারেন অনেকেই। তবে বুড়িয়ে যাওয়া আজার, ডি ব্রুইনা, লুকাকুরা সেখানে সফল হবেন, তা নিয়ে বাজি লাগার মানুষ নেহায়েতই অল্প। সুদূরপ্রসারী এক চিন্তার ফসল এই সোনালী প্রজন্মের উত্থান, আশার জয়গান ও বড় মঞ্চে মুখ থুবড়ে পড়ার গল্প নিয়েই এই আয়োজন।
বেলজিটিউড। খটমটে এই শব্দটা গুগল করলে অর্থটা যা আসে, সেটা হলো বেলজিয়ান আত্মা এবং পরিচয়। মোটে সাড়ে এগার মিলিয়নের মতো জনসংখ্যার এই দেশে গত বছরকয়েক ধরে রীতিমতো যেই ফুটবলবিপ্লব চলছে, তাতে একটা বড় ভূমিকা রয়েছে এই শব্দটার। আর বেলজিয়ান ফুটবলে এই 'বেলজিটিউড' শব্দটার পুনঃপরিচয় করিয়ে দেওয়া মানুষটার নাম মিশেল স্যাবলন।
'আমি হাতের লিস্টটা ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলাম।'
১৯৯০ বিশ্বকাপের স্মৃতি এইভাবেই স্মরণ করেছিলেন মিশেল। সেবার বিশ্বকাপের দ্বিতীয় রাউন্ডে মুখোমুখি হয়েছিল বেলজিয়াম এবং ইংল্যান্ড। অতিরিক্ত সময়ের অন্তিম মুহূর্তে ডেভিড প্লাটের গোলে ম্যাচটি জিতেছিল ইংলিশরা। মাঠে বসে ছিলেন বটে, তবে গোলটা স্বচক্ষে দেখার সৌভাগ্য হয়নি স্যাবলনের। তিনি যে ততক্ষণে টাইব্রেকারে কারা কারা পেনাল্টি নেবে, তার একটা লিস্ট করছিলেন একটি সাদা খাতায়! কী হবে সে লিস্ট দিয়ে, যদি শেষ মুহূর্তে গোল খেয়েই ছিটকে পড়তে হয়? মিশেলও তাই রাখেননি আর তালিকাটা। ঝঞ্ঝাট বিদেয় করাই ভালো।
একবিংশ শতাব্দির শুরুর দিকের কথা। বেলজিয়ান ফুটবলের চিরাচরিত আলসেমি আর জড়তাপূর্ণ ফুটবলের ইতি টানতে চাইলেন একজন স্বপ্নদ্রষ্টা, তৎকালীন টেকনিক্যাল ডিরেক্টর মিশেল স্যাবলন। উদ্দেশ্য, খেলোয়াড়দের উন্নতির পাশাপাশি গোটা ফুটবল সিস্টেমেই একটা বিপ্লব নিয়ে আসা।
সেই বেলজিয়াম-ইংল্যান্ড ম্যাচের এক দশকেরও একটু বেশি সময় পর আরেকটা সাদা খাতা হাতে বসে আছেন স্যাবলন। এইবার অবশ্য অন্য কাজে, বেলজিয়াম ফুটবল ফেডারেশনের নব্যনিযুক্ত টেকনিক্যাল ডিরেক্টর হিসেবে তখন তিনি কাজ সবেমাত্র শুরু করেছেন। ব্রাসেলসের হেডকোয়ার্টারে বসে সেই সাদা খাতায় তিনি এঁকেছিলেন বেলজিয়ান ফুটবলের এক নীল-নকশা, যার ফলাফল এই সোনালী প্রজন্ম।
ফিরে যাওয়া যাক সেই '৯০ বিশ্বকাপে। সেই ম্যাচের পর বেলজিয়াম ফুটবল এক প্রকার অন্ধকারেই ছিল। এর ১০ বছর পর তারাই হয় ইউরো আয়োজক। সেই ইউরোতেও যথারীতি ভরাডুবি; তবে আয়োজক হওয়ার সুবাদে বেশ কিছু টাকাকড়ি আসে ফেডারেশনের হাতে। সেই লগ্নি দিয়েই সফল করা হয় স্যাবলনের নীলনকশা। তো কী ছিল সেখানে?
মূলত তিনটি জিনিসের উপর জোর দিয়েছিলেন স্যাবলন। প্রথমত, কোচিং। লেভেল-ওয়ান কোচিং কোর্স সবার জন্য ফ্রি করে দিয়েছিলেন স্যাবলন, যার ফলে প্রচুর মানসম্পন্ন কোচ তৈরি হয় বেলজিয়ামে। দ্বিতীয়ত, তরুণ ফুটবলারদের ডেভেলপমেন্টে কাজ করেছেন। সেই সময় বেলজিয়ামের একজন স্কুলবালক দিনে বড়জোড় সর্বোচ্চ ২-৩ ঘন্টা প্র্যাকটিস করতে পারত। বেলজিয়ান ফেডারেশন সরকারের সাথে কাজ করে সেটি নিয়ে আসে ৫-৬ ঘন্টায়। শুধু তা-ই নয়, বয়সভিত্তিক দলগুলোতে ১১ জন করে খেলোয়াড় না খেলিয়ে ৫-৬ জন করে খেলাত, যার ফলে অল্প বয়স থেকেই বলের উপর নিয়ন্ত্রণ আসত খেলোয়াড়দের। কারণ, মাঠে যত কম খেলোয়াড়, একজন খেলোয়াড়ের বল টাচ হবে তত বেশি। তৃতীয়ত, প্রতিভা আবিষ্কার। ফেডারেশন পুরো দেশকে আটটি ভাগে ভাগ করে প্রতিটি ভাগে একটি করে আন্তর্জাতিক মানের স্টেডিয়াম নির্মাণ করে, যার ফলে সহজেই ট্রায়ালের মাধ্যমে দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে থাকা প্রতিভাবান ফুটবলার উঠে আসে।
মূলত আরো অন্যান্য ইউরোপিয়ান জায়ান্ট জার্মানি, ইংল্যান্ড কিংবা ফ্রান্সের অনুকরণে বেলজিয়াম ফেডারেশনও নেয় এক বিশাল পদক্ষেপ। আর তারই ফসল আজকের এই বেলজিয়ান সোনালী প্রজন্ম।
জন কিন্ডারম্যান ছিলেন প্রতিভা অন্বেষণের কাজে। প্রতিটি স্কুলে গিয়ে গিয়ে তিনি প্রতিভা খোঁজ করতেন, যার এক গালভরা নাম দিয়েছিলেন 'পার্পল ট্যালেন্টস'। দুই সেশনের সেইসব ট্রায়ালগুলো থেকে প্রচুর খেলোয়াড় আসতে শুরু করে। রোমেলু লুকাকু তাদেরই একজন। ১৩ বছর বয়সী লুকাকুকে নিয়ে কিন্ডারম্যান বলেছিলেন,
'ওই সময়ই যথেষ্ট শক্তিশালী আর ভালো ফুটবলার ছিল সে। কিন্তু টেকনিকের দিক থেকে ছিল খুবই কাঁচা। তাকে তুলে এনে ঘষামাজা করার ফলাফলই আজকের এই লুকাকু।'
শুধু লুকাকুই নন, আজকের এডেন আজার-ডি ব্রুইনা থেকে শুরু করে থরগান আজার, মুনিয়ের, কোর্তোয়া, মার্টেন্স কিংবা কারাসকো সবাই মাতিয়ে বেড়াচ্ছেন ইউরো। মাত্র ১২-১৪ বছরের ব্যবধানেই মাত্র ১১ মিলিয়ন মানুষের মধ্য থেকে এত এত ফুল ফুটিয়েছে বেলজিয়াম ফেডারেশন।
তবে খেলোয়াড় তুলেই ক্ষান্ত থাকেননি স্যাবলন। পাল্টে দিয়েছিলেন গোটা বেলজিয়ামের ফুটবল খেলার ধরনও। সেই সময় জাতীয় দলসহ বেশিরভাগ বেলজিয়ান ক্লাবই দলকে খেলাত ৪-৪-২ ফর্মেশনে খেলাত। কিন্তু স্যাবলন সমন জারি করলেন ৪-৩-৩ ফর্মেশনে খেলানোর জন্য। লক্ষ্য ছিল সুস্পষ্ট, দলগুলোকে আরো আক্রমণাত্মক খেলানো।
'আমার মনে আছে, প্রথম আমরা এই ফর্মেশন ব্যবহার করেছিলান অনুর্ধ্ব-১৭ পর্যায়ের একটি ম্যাচে, যেখানে ফ্রান্সের বিপক্ষে আমরা হেরেছিলাম ৭-১ গোলে। তবুও হাল ছেড়ে দেইনি।'
নিজের অবস্থানের পক্ষে অটুট ছিলেন স্যাবলন, ভরসা রেখেছিলেন প্রোসেসে। ফল? সেই একই ফ্রান্স দলকে এক বছরের মধ্যেই হারাতে সক্ষম হয় বেলজিয়াম।
স্যাবলন যখন সংস্কারকার্যে ব্যস্ত, সেই সময়টাতে আক্ষরিক অর্থেই অন্ধকার সময় পার করছে বেলজিয়াম। ২০১২ সালে তাদের ফিফা র্যাংকিং গিয়ে ঠেকে ৭১-এ। মাঝের দুইটি মেজর টুর্নামেন্টের বাছাইপর্বও উতরাতে পারেনি দেশটি। সেখান থেকে মাত্র ২ বছরের ব্যবধানে রেড ডেভিলরা ব্রাজিল বিশ্বকাপে পা রাখে র্যাংকিংয়ে ৫ নাম্বার স্থানে থেকে। তবে কোয়ার্টার ফাইনালে মেসির আর্জেন্টিনার কাছে হেরে বিদায় নিতে হয় তাদের। সেবার শেষ আট থেকে বিদায় নিলেও নিজেদের আগমনী বার্তা দারুণভাবেই জানান দেয় বেলজিয়াম।
সাফল্য ধরা দেয় এক বছর পর। নিজেদের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ফিফা র্যাংকিংয়ের শীর্ষে উঠে আসে বেলজিয়াম। আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে প্রত্যাশার পারদও। প্রথমবারের মতো শিরোপা জয়ের স্বপ্নে বিভোর হয় বেলজিয়ামবাসী। দেখতে দেখতে দুয়ারে চলে আসে ২০১৬ ইউরো।
শুরুটা দুর্দান্তই করে বেলজিয়াম। স্বাগতিক ফ্রান্সের সাথে শিরোপার ইঁদুরদৌড়ে উচ্চারিত হতে থাকে বেলজিয়ামের নামটাও। অথচ সেই বেলজিয়াম কোয়ার্টার ফাইনালে হার মানে নবাগত ওয়েলসের কাছে। শুরুতে রাদজা নাইঙ্গোলানের গোলে এগিয়ে যাওয়ার পরও হাল রবসন কানুর জোড়া গোলে বিশ্ববাসীকে চমকে দেয় ওয়েলস। ট্যাকটিকস নিয়ে চরম সমালোচিত হন তৎকালীন কোচ মার্ক উইলমটস। দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় তাকে। ডাগআউটে আসেন স্প্যানিশ কোচ রবার্তো মার্টিনেজ।
মার্টিনেজ দায়িত্ব নেওয়ার পর আরো ক্ষুরধার হয়ে ওঠে বেলজিয়াম। তার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে ইউরোপে সবচেয়ে বেশি ৪৭ ম্যাচ জয়ী দল বেলজিয়াম। তদুপরি, এই সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৭৬টি গোলও করে তারা। অথচ পরপর দুইটি মেজর টুর্নামেন্ট থেকে খালি হাতেই বিদায় নিতে হয় তাদের।
মূলত প্রতিআক্রমণে খেলাই বেলজিয়ামের মূলমন্ত্র, যেখানে লুকাকুর শক্তি আর আজারের ড্রিবলিং-সামর্থ্য কাজে লাগিয়ে দ্রুতলয়ে আক্রমণে উঠতে পারে বেলজিয়াম। আর একটু পিছনে থেকে খেলার কলকাঠি নাড়েন ডি ব্রুইনা। রাশিয়া বিশ্বকাপে ব্রাজিলের সাথে করা দ্বিতীয় গোলটি কিংবা জাপানের বিপক্ষে অন্তিম মুহূর্তে চ্যাডলির গোলটিই আপনাকে ধারণা দেবে বেলজিয়ামের খেলার ধরণ সম্পর্কে।
কিন্তু... তারপরও কেন বড় মঞ্চে ভেঙ্গে পড়া?
সুনির্দিষ্ট কিছু কারণের পাশাপাশি ভাগ্যকেও যদি বেলজিয়ানরা দোষারোপ করে, তাতে সায় না দিয়ে উপায় থাকবে না বোধহয়। এই সোনালি প্রজন্মের চারটি টুর্নামেন্টের মধ্যে এক ওয়েলস বাদে বেলজিয়াম বাদ পড়েছিল ওই সময়ে টুর্নামেন্টে দুর্দান্ত খেলা তিন দলের সাথে - আর্জেন্টিনা, ফ্রান্স এবং ইতালি। প্রশ্ন আসতে পারে, শিরোপা জিততে হলে তো বড় দলগুলোকে টপকাতে হবেই।
এইখানটাতেই বেলজিয়ামকে সবচেয়ে বেশি পিছিয়ে দিয়েছে অনভিজ্ঞতা। এর আগে ইউরো আর বিশ্বকাপে বেলজিয়ামের সেরা সাফল্য ছিল সেমিফাইনাল পর্যন্ত যাওয়া। বড় মঞ্চে বড় দলগুলোর সাথে খেলার আবহ, চাপ কিংবা ঐতিহ্যের পাল্লায় বেলজিয়াম অনেকটাই নিচে। এমনকি টেকনিক্যাল স্টাফদেরও বড় শিরোপা জেতার অভিজ্ঞতা নেই। বড় দলের মন-মানসিকতা না হয়ে ওঠাও একটি প্রতিবন্ধকতা।
রাশিয়া বিশ্বকাপের দিকে তাকালে দেখবেন, তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে নিজেদের ইতিহাসের সর্বোচ্চ সাফল্য অর্জনের পর বেলজিয়াম দলের আনন্দ আর উল্লাস। অথচ দুর্দান্ত ব্রাজিলকে বাড়ির টিকেট ধরিয়ে দেওয়া বেলজিয়ামের শতভাগ সামর্থ্য ছিল বিশ্বকাপ নিজের করে নেওয়ার। সেখানে তৃতীয় হয়েই সন্তুষ্ট?
দ্বিতীয়ত, কঠিন ও আঁটসাঁট রক্ষণের সামনে পড়লে প্রায়ই খেই হারিয়ে ফেলে তারা। আর এইজন্য প্রতিবার ভালো কোনো রক্ষণের সামনে পড়লেই আটকে যাচ্ছে বেলজিয়াম। ২০১৪ বিশ্বকাপের নকআউট রাউন্ডে আর্জেন্টিনার রক্ষণদূর্গ ছিল দুর্দান্ত, আর সামনে ছিলেন একজন মাশ্চেরানোও; যার ফলে গোলের মুখই খুঁজে পাননি লুকাকুরা। একই কথা প্রযোজ্য রাশিয়া বিশ্বকাপের ফ্রান্স কিংবা এবারের ইতালির ক্ষেত্রেও। অথচ এক্ষেত্রে কোনো 'প্ল্যান বি' বাস্তবায়নও করতে দেখা যায়নি বেলজিয়ামকে। ফলাফল, শিরোপাপ্রত্যাশী হওয়া সত্ত্বেও শেষ আট থেকেই বিদায়।
বেলজিয়ামের সোনালী প্রজন্ম শেষের শুরু দেখতে শুরু করেছে ইতোমধ্যেই। আজার, ডি ব্রুইনা, কোর্তোয়া, ভার্তোঙ্ঘেনরা পা দিয়েছেন ত্রিশে। তবে আশার আলো জাগিয়ে রেখেছেন থরগান আজার, জেরেমি ডৌকু, ইউরি টিয়েলেমান্সের মতো তরুণরা।
এই সোনালি প্রজন্ম না পারুক, আরেক সোনালি প্রজন্মে এসে সে না পাওয়ার অতৃপ্তি পূরণ করবে। সেই স্বপ্ন স্যাবলন দেখতেই পারেন, দেখাতেই পারেন বেলজিয়ানবাসীকে। স্বপ্ন দেখতে তো আর মানা নেই! আর হাল ছেড়ে দেওয়া? বেলজিটিউডে উদ্বুদ্ধ এই দলটার যে লক্ষ্য কেবলই সামনে এগিয়ে যাওয়া!
This Bangla article is about the rise of the belgian football and waste of their golden generation. Necessary information are hyperlinked in the article.
Feature Image : TheIndian express