লেখাটি পড়বার আগে একটি কাজ করুন। গুগলে গিয়ে রমডয়টার (raumdeuter) লিখে সার্চ দিন। কাকে পেলেন?
জি আজ্ঞে, থমাস মুলারকে। থমাস মুলার - যিনি নিজের প্রথম বিশ্বকাপে মাত্র ২০ বছর বয়সে পাঁচ গোল করে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। থমাস মুলার, মাত্র ২৯ বছর বয়সেই যার ক্যারিয়ারটা ঝলমলে। থমাস মুলার - যিনি ফুটবলে টিকে থাকা একমাত্র ছায়ামানব।
'ছায়ামানব' বলায় অবাক হচ্ছেন? হবার কিছু নেই। রমডয়টার পজিশনটির কোন আদর্শ বাংলা প্রতিশব্দ নেই, কিন্তু খেলার ধরনের সঙ্গে মিলিয়ে ছায়ামানব বলাই যেতে পারে, কারণ মুলার যে মাঠের মধ্যে ছায়ার মত ঘুরে বেড়ান, তাকে ধরতে পারাটা অসম্ভব!
মুলারের গল্পে যাওয়ার আগে রমডয়টার পজিশনটা ব্যাখ্যা করা দরকার, নয়তো অনেকেই হয়তো যে তিমিরে ছিলেন, সে তিমিরেই থেকে যাবেন।
রমডয়টার আসলে কোনো পজিশন নয়, বরং রমডয়টার হলো মাঠের এমন একজন খেলোয়াড়, যিনি কি না দলের আক্রমণভাগ বা মাঝমাঠে ম্যাচ শুরু করেন বটে, তবে সেখানে আটকে থাকেন না, তার কাজ হয় ভিন্ন। একজন রমডয়টার প্রতিপক্ষের অর্ধে স্পেস খুঁজে বেড়ান, যেখানে স্পেস পান সেখানেই নিজের জায়গা করে নেন, সেই স্পেস থেকেই দলের আক্রমণে অংশ নেন। এভাবে কোনো নির্দিষ্ট পজিশনে না খেলার সুবিধা হলো, প্রতিপক্ষ আপনাকে ম্যান মার্ক করতে পারবে না, কারণ ম্যান মার্ক করতে গেলেই তাদের নিজস্ব ডিফেন্সিভ শেপ নষ্ট হবে বারবার পজিশন বদল করার কারণে। মুলার এজন্যই দুর্দান্ত, তিনি এই কাজটা করেন নিখুঁতভাবে। মুলার সম্পর্কে তো প্রবাদপ্রতিম উক্তিই আছে,
'যেখানে স্পেস, সেখানেই মুলার!'
মিস্টার রমডয়টার! Image Source: The Raumdeuter
মুলার এভাবে মাঠজুড়ে ঘুরে বেড়ান স্পেসের খোঁজে, স্পেস পেলেই সেখানে জায়গা করে নেন। ডিফেন্ডাররা তাকে মার্ক করতে গিয়ে বিপদে পড়েন, কারণ থমাস মুলার একজন ছায়ামানব, তাকে আপনি দেখতে পারবেন বটে, কিন্তু ধরতে? সে বড় জটিল কাজ।
স্টিভেন জেরার্ড, পাওলো মালদিনি, ফ্রান্সেসকো টট্টি - এদের সাথে থমাস মুলারের কিছুটা মিল আছে। এরা সবাই নিজেরা যে শহরে জন্মেছেন, সে শহরের ক্লাবেই খেলেছেন একদম ক্যারিয়ারের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত, অন্য কোথাও যাননি। জেরার্ড অবশ্য শেষ বয়সে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমিয়েছিলেন, তবে সেটা হিসেবে না ধরাটাই বাঞ্ছনীয়। মুলারের জন্ম ১৯৮৯ সালে, মিউনিখের উইলহেইমে। টিএসভি পাহল ইউথের অ্যাকাডেমিতে শুরু করলেও ১১ বছর বয়সেই পাড়ি জমান ৫০ কিলোমিটার দূরের বায়ার্ন মিউনিখে। তখন থেকেই আছেন সেখানে, কোথাও যাবার কথা ভাবেননি কখনও।
অনূর্ধ্ব-১৯ দলে প্রতিভার ঝলক দেখানোর পর ২০০৮ সালে বায়ার্ন মিউনিখের রিজার্ভ দলের হয়ে অভিষেক হয় তার। মূল দল যে খুব বেশি দূর নয়, সেটি তখনই বোঝা যাচ্ছিল। সে বছরই প্রি-সিজন ইয়ুর্গেন ক্লিন্সম্যানের অধীনে খেলেন তিনি, প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচে অভিষেক হয় আগস্ট মাসে হামবুর্গের সাথে মিরোস্লাভ ক্লোসার বদলি হিসেবে। ব্যাপারটাকে রূপক অর্থে ভাবতে পারেন, এক জার্মান কিংবদন্তি ব্যাটন তুলে দিচ্ছেন ভবিষ্যৎ কিংবদন্তির হাতে! সে বছর বায়ার্নের হয়ে বেশ কিছু ম্যাচ খেলেন মুলার, তবে প্রথম চুক্তি স্বাক্ষর করেন পরের বছর ফেব্রুয়ারিতে।
তরুণ খেলোয়াড়দের বড় দলগুলো সুযোগ দেওয়ার চেয়ে বরং ধারে পাঠিয়েই বাজিয়ে দেখতে পছন্দ করে। কিন্তু ২০০৯ সালে যখন বায়ার্নের কোচ হয়ে লুই ফন হাল এলেন, তিনি মুলারকে দলেই রেখে দিলেন।
নিজের প্রতি এই বিশ্বাসের দারুণ প্রতিদান দিয়েছিলেন মুলার। মৌসুমের শুরু থেকেই দারুণ খেলতে থাকেন, ২০০৯-১০ মৌসুমের সেপ্টেম্বর মাসে জিতে নেন বুন্দেসলিগার সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার। দারুণ খেলার পুরস্কার দিতে ক্লাবও দ্বিধা করেনি, ২০১৩ সাল পর্যন্ত নতুন চুক্তি করে তারা। ২০০৯-১০ মৌসুম মুলার শেষ করেন ১৯ গোল ও ১৬ অ্যাসিস্ট নিয়ে, সাথে বায়ার্ন মিউনিখ জিতে নেয় বুন্দেসলিগা ও ডিএফবি-পোকাল, তিনিই ছিলেন বায়ার্নের হয়ে সর্বোচ্চ গোলদাতা। দারুণ এই মৌসুম শেষে জার্মানির হয়ে বিশ্বকাপ খেলতে যান মুলার।
তবে প্রশ্ন আসে, খেলতে? নাকি ইতিহাস গড়তে?
বিশ্বকাপ থেকে অবশ্য ছিটকে যেতে পারতেন মুলার, ট্রেনিংয়ে সাইকেল থেকে পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত বাদ পড়েননি, সুযোগ পেয়েছিলেন ১৩ নম্বর জার্সি পড়ে বিশ্বকাপ মাতানোর। যে জার্সি ছিল চোটগ্রস্ত অধিনায়ক মাইকেল বালাকের, যে জার্সি এককালে পরতেন ‘ডার বম্বার’ - জার্ড মুলার।
বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচেই অস্ট্রেলিয়ার সাথে গোল করেন তিনি, জার্মানি ম্যাচ জেতে ৪-০ ব্যবধানে। দ্বিতীয় রাউন্ডে ইংল্যান্ডের সাথে ৪-১ গোলের জয় তুলে নেয় জার্মানি, মুলার সেখানে করেন জোড়া গোল ও এক অ্যাসিস্ট। কোয়ার্টার ফাইনালে আর্জেন্টিনাকে ৪-০ গোলের ব্যবধানে রীতিমত দুমড়েমুচড়ে দেয় জার্মানরা, সেখানে প্রথম গোল করে টুর্নামেন্টে নিজের চতুর্থ গোল করেন মুলার। সেমিফাইনালে স্পেনের কাছে হেরে বাদ পড়লেও উরুগুয়ের সাথে ৩-২ গোলে জিতে তৃতীয় স্থানে শেষ করে জার্মানি, তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে গোল করে মুলার বিশ্বকাপে নিজের গোলসংখ্যাকে নিয়ে যান পাঁচে। পাঁচ গোল ও তিন অ্যাসিস্ট নিয়ে গোল্ডেন বুট জিতে নেন মুলার, সাথে জেতেন বিশ্বকাপের সেরা উদীয়মান খেলোয়াড়ের পুরষ্কারও, ২০ বছর বয়সে।
বিশ্বকাপের পর বায়ার্ন মিউনিখের হয়ে দুর্দান্ত খেলা বজায় রাখেন তিনি। ২০১০-১১ মৌসুমে করেন ১৭ গোল, করান ১৯টি, তবে সে বছর ক্লপের দুর্দান্ত বরুশিয়া ডর্টমুন্ডের কাছে লিগ হারায় বায়ার্ন, সাথে ব্যর্থ হয় ডিএফবি-পোকাল জিততে। লিগে তৃতীয় হওয়ায় চাকরি যায় লুই ফন হালের, দলের দায়িত্ব নেন ইয়ুপ হেইঙ্কেস।
পরের মৌসুমেও লিগ ও পোকাল জিততে ব্যর্থ হয় বায়ার্ন, তবে মুলার সব মিলিয়ে ৫৩ ম্যাচে ১১ গোল ও ২০ অ্যাসিস্ট করেন। সে বছর চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল হয়েছিল বায়ার্নের ঘরের মাঠ অ্যালিয়াঞ্জ অ্যারেনায়, তবে চেলসির কাছে টাইব্রেকারে হেরে সে স্বপ্নকে বিদায় জানাতে হয় বাভারিয়ানদের। মৌসুমজুড়ে দুর্দান্ত খেলে নিজের রমডয়টার হিসেবে খ্যাতি বাড়াচ্ছিলেন মুলার, আসছিল ২০১২ ইউরো। ২০০৮ সালে স্পেনের কাছে শিরোপা খোয়ানোর পর আবার ফিরে পেতে মরিয়া ছিল জার্মানরা, আর জোয়াকিম লো'র তুরুপের তাস ছিলেন থমাস মুলার।
তবে ইউরোতে ব্যর্থ সময় কাটান মুলার, জার্মানিকে ফিরতে হয় সেমিফাইনাল থেকেই। লিগ আর ডিএফবি-পোকাল ঘরে ফেরানোর লক্ষ্য তো ছিলই, সাথে ছিল চ্যাম্পিয়নস লিগ ঘরে আনার ধনুর্ভাঙা পণ।
থমাস মুলার ২০১২-১৩ মৌসুমে হয়ে ওঠেন দুর্দান্ত। ম্যাচ খেলেন ৫৭টি, করেন ২৩ গোল, সাথে গোল করান আরও ১৭টি। বায়ার্নও তাদের লক্ষ্যে অটুট থাকে, ঘরে তোলে লিগ ও ডিএফবি-পোকাল।
চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে মুখোমুখি হয় ডর্টমুন্ডের, আগের দুই মৌসুম বড্ড যন্ত্রণা দিয়েছিলো যারা। আরিয়েন রোবেন প্রায় শেষ মুহূর্তে গোল করলেন, বায়ার্ন ঘরে তুলল ঐতিহাসিক ট্রেবল, থমাস মুলারের ট্রফি ক্যাবিনেটে আরেকটি শিরোপা।
এত শিরোপা জিতেও বোধ করি মুলারের একটা আক্ষেপ থেকেই গিয়েছিলো, জার্মানির হয়ে যে জেতা হয়নি কিছুই! ২০১৪ সালের বিশ্বকাপে যেন তাই গেলেন সে আক্ষেপ দূর করতে, প্রথম ম্যাচেই পর্তুগালের সাথে করলেন হ্যাটট্রিক।
গ্রুপপর্বের শেষ ম্যাচে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে গোল করেন বটে, তবে গোল পাননি নকআউট পর্বের প্রথম দুই ম্যাচে। ব্রাজিলের সাথে সেমিফাইনালে প্রথম গোলটি করলেন তিনি, যার পরপরই শুরু হয় গোলবন্যা, যা শেষ হয় স্বাগতিকদের জন্য অপমানজনক ৭-১ হারে। ফাইনালে জার্মানি, প্রতিপক্ষ লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনা।
নির্ধারিত ৯০ মিনিটের খেলা শেষ হওয়ার পর স্কোর ০-০, খেলা গড়ালো অতিরিক্ত সময়ে। ১১৩ মিনিটে মারিও গোৎজের গোল, বিশ্বচ্যাম্পিয়ন জার্মানি, মুলারের মুকুটে আরেকটি পালক, সাথে জিতলেন সিলভার বুট।
২০১৩ সালে ইয়ুপ হেইঙ্কেস বিদায় নিলে বায়ার্নে আসেন পেপ গার্দিওলা। তার অধীনে আরও দুর্দান্ত হয়ে ওঠেন মুলার, তিন মৌসুমে গোল করেন ৮৭টি, সাথে গোল করান আরও ৬১টি। তবে তার এই দারুণ সময়টায় আক্ষেপ হয়ে থাকবে ২০১৬-১৭ মৌসুমের চ্যাম্পিয়নস লিগ সেমিফাইনালে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের সাথে তার পেনাল্টি মিস, যার খেসারত দিতে হয় ছিটকে পড়ে।
২০১৬ ইউরোতে ফ্রান্সের কাছে ২-০ তে হেরে সেমিফাইনাল থেকে বিদায় নেয় জার্মানরা, ছয় ম্যাচ খেলেও কোনো গোল বা অ্যাসিস্ট পাননি মুলার।
২০১৬ থেকেই ফর্ম নীচের দিকে নামতে থাকে মুলারের, তার অন্যতম কারণ জোনাল মার্কিং দিয়ে তাকে আটকে ফেলতে পারাটা। ২০১৭-১৮ মৌসুমে ১৫ গোল ও ১৮ অ্যাসিস্ট করলেও তার তেমন কোন গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিলো না, বায়ার্ন আবারও ব্যর্থ হয় চ্যাম্পিয়নস লিগ জিততে।
২০১৮ বিশ্বকাপটা জার্মানি এবং থমাস মুলার, দু’জনের জন্যই এক বিভীষিকার নাম। মেক্সিকো ও দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে হেরে গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নিতে হয় বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের; আগের দুই বিশ্বকাপে ১০ গোল করা মুলার থাকেন গোলশূন্য।
২০১৮-১৯ মৌসুমটা বাজে যায় মুলারের, ৪৫ ম্যাচ খেলে করেন নয় গোল ও ১৬ অ্যাসিস্ট। তেমন খারাপ না শোনালেও মুলারের জন্য এটি বেশ বাজে পরিসংখ্যান, বায়ার্ন লিগ জিতলেও বাদ পড়ে চ্যাম্পিয়নস লিগের দ্বিতীয় পর্ব থেকেই। মরার ওপর খাড়ার ঘা হিসেবে, জাতীয় দলে নিজের নিশ্চিত জায়গাটাও হারিয়েছেন।
সাম্প্রতিক সময়টা বাজে গেলেও মুলারের ক্যারিয়ার পরিসংখ্যান যে দুর্দান্ত, সেটি নিয়ে সন্দেহ নেই। বায়ার্ন মিউনিখের হয়ে ম্যাচ খেলেছেন ৪৯০টি, সব মিলিয়ে গোল ১৮৫টি, সাথে অ্যাসিস্ট ১৬৯টি। বায়ার্নের হয়ে জিতেছেন আটটি বুন্দেসলিগা, পাঁচটি ডিএফবি-পোকাল, পাঁচটি জার্মান সুপার কাপ, একটি চ্যাম্পিয়নস লিগ, একটি উয়েফা সুপার লিগ ও একটি ক্লাব বিশ্বকাপ। জাতীয় দলের হয়ে ১০০ ম্যাচে করেছেন ৩৮ গোল, জিতেছেন বিশ্বকাপ।
১৯৮৯ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর জন্মেছিলেন এই ছায়ামানব। নিজের দুর্দান্ত রূপে ফিরে আসুক বিলুপ্তপ্রায় ‘রমডয়টার’ দের শেষ বংশধর থমাস মুলার, তার ৩০তম জন্মদিনে এটিই কামনা।
This article is in Bangla language. It is an overview of Germany and Bayern Munich footballer Thomas Muller's career. He is the very last of a rare kind, raumdeuter. He was the highest scorer in his very first world cup. Afterwards, he conquered the world.
Feature Photo: FC Bayern