Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

একজন টমাস টুখেলের গল্প

২০২১ সালের জানুয়ারিতে ফ্রাংক ল্যাম্পার্ড যখন চেলসির কোচের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পেলেন, চেলসির অবস্থা তখন শোচনীয়। এরপর টমাস টুখেলকে চেলসির কোচ হিসেবে ঘোষণা করা হলো, সেই টুখেল দায়িত্ব নিয়েই অল্প কয় মাসের মধ্যে চেলসির চেহারাই বদলে দিলেন। যেই চেলসিকে উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগে কেউ গোনায়ই ধরছিলেন না, সেই চেলসিকে নিয়ে ইউসিএল জেতেন ৪৭ বছর বয়সী এই জার্মান কোচ। জার্মানির লোয়ার-লিগ ফুটবলার থেকে ইউসিএল-জয়ী কোচ হয়ে ওঠা… রাস্তাটা কিন্তু সহজ ছিল না মোটেই। 

বাভারিয়ায় ছোট শহর ক্রুমবাখে বেড়ে ওঠেন টুখেল। ক্লাসের সেরা ফুটবলার ছিলেন। ১৯৮৭ সালে তিনি জার্মান স্কুল চ্যাম্পিয়নশিপে নিজের স্কুল টিমকে জেতাতে সাহায্য করেছিলেন। টিএসভি ক্রুমবাখের হয়ে তিনি কিছুদিন খেলেন। এরপর অগসবুর্গে যোগ দেন। একটু ধীরগতির ডিফেন্ডার হওয়ায় শুরুর একাদশে সহজে জায়গা পেতেন না। অগসবুর্গ ছেড়ে স্টুটগার্ট কিকার্সে যোগ দেন। সেখানেও ফর্ম নিয়ে ভুগতে থাকেন। এসএসভি উমে যোগ দিলে তার ভাগ্যের চাকা ঘুরতে থাকে, কারণ রালফ র‍্যাগনিক তখন দলটির কোচ হয়ে আসেন। রালফ র‍্যাগনিককে আধুনিক জার্মান ফুটবলের পিতা বলা হয়। পজিশনাল প্লেইং-এর সাথে তিনিই টুখেলের পরিচয় ঘটান। স্টুটগার্ট কিকার্স দ্বিতীয় ডিভিশনে প্রোমোটেড হয়। কিন্তু ততদিনে হাঁটুর ইনজুরির জন্য তিনি খেলা থেকে দূরে সরে গিয়েছেন।

স্টুটগার্টের হয়ে ১৯ বছর বয়সী টুখেল; imago sportfotodienst

টুখেল এরপর জার্মানির একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন নিয়ে পড়াশোনা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার সময় তিনি একটি বারেও কাজ করতেন। বারে কাজ করলেও টুখেল কখনো মদ্যপান করতেন না। টুখেল ফুটবলকে ছাড়ার কথা কখনো ভাবতে পারেননি। তাই নয় মাস পরেই তিনি রালফ র‍্যাগনিকের সাথে তিনি যোগাযোগ করেন। তাকে অনুরোধ করেন, অন্তত রিজার্ভ টিমে হলেও যিনি তাকে জায়গা দেন। র‍্যাগনিক তার অনুরোধ ফেলেননি। কিন্তু হাঁটুর ইনজুরি গুরুতর অবস্থা ধারণ করলে ২৫ বছর বয়সে অবসর নিতে বাধ্য হন এই ডিফেন্ডার, তার আর খেলা হয়নি। 

এরপর র‍্যাগনিক টুখেলকে জিজ্ঞেস করেন, তিনি ফুটবল কোচিং করাতে চান কি না। টুখেল রাজি হয়ে যান। এরপর র‍্যাগনিকের সুপারিশে তিনি স্টুটগার্ট কিকার্সের অনূর্ধ্ব-১৪ দলের কোচ হন ২০০০ সালে। ২০০৪ সালে তিনি অনূর্ধ্ব-১৯ দলের কোচও হন। সেই বছর তার দল অনূর্ধ্ব-১৯ বুন্দেসলিগার শিরোপা জেতে। দ্রুতই তার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। অনেকটা রালফ র‍্যাগনিকের প্রভাবেই তিনি ফুটবল কোচিংকে ক্যারিয়ার হিসেবে বেছে নেন। ৩২ বছর বয়সে উয়েফা প্রো লাইসেন্স নিতে তিনি জার্মানির কোলন শহরে পৌঁছান টুখেল। 

সেখানে তিনি এরিখ রোটেমুলারের অধীনে কোচিং প্র‍্যাকটিস করতে থাকেন। এরিখ রোটেমুলার ১৯৯৪-২০০৪ সাল পর্যন্ত জার্মানির অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার ছিলেন। তিনিই তখন কোলন শহরে উয়েফার এই কোর্সটির লিডার। তার কথায়, টুখেল ছিলেন একজন ‘প্রডিজিয়াস স্টুডেন্ট’। টুখেলকে তিনি অল্প সময়েই খুব পছন্দ করেন। টুখেলের একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ডও শক্ত ছিল। স্পোর্টস সায়েন্সের ওপর তিনি এরই মধ্যে একটি ডিগ্রিও নিয়েছেন। ফলে রোটেমুলারের অন্যান্য ছাত্রদের থেকে টুখেল অনেক এগিয়ে ছিলেন। যেহেতু তার খেলুড়ে জীবনের খুব তাড়াতাড়ি ইতি টানতে হয়, সেটাই অল্প বয়সে কোচ হিসেবে তার সফল হওয়ার পেছনে উদ্দীপনা হিসেবে কাজ করেছে কি না, কে জানে!  

টুখেল উয়েফা-প্রো লাইসেন্স পাওয়ার পর চাকরির অফার পেতে দেরি হয়নি। তার ট্যাকটিক্যাল আন্ডারস্ট্যান্ডিং এবং ম্যাচের আগে একেবারে খাদবিহীন প্রস্ততি – এই দুই গুণের জন্য সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। ২০০৭-০৮ মৌসুমে তিনি অগসবুর্গের রিজার্ভ দলের কোচ হন। ২০০৯ সালের গ্রীষ্মে জার্মানি ফুটবল ফেডারেশন তাদের অনূর্ধ্ব-১৯ দলের জন্য অ্যাসিস্ট্যা‌ন্ট কোচ হিসেবে এবং হফেনহাইম তাদের হেড কোচ হিসেবে টুখেলকে নিয়োগ দিতে ইচ্ছুক ছিল। কিন্তু ঠিক এক বছর পরে মেইঞ্জ তাকে কোচ হওয়ার প্রস্তাব দিলে বুন্দেসলিগার আবেদন তিনি উপেক্ষা করতে পারেননি। আর এভাবেই অল্পসময়ের মধ্যেই সিনিয়র দলের কোচ বনে যান, মেইনস্ট্রিম ফুটবল দুনিয়ার দরজা খুলে যায় তার সামনে। 

Image Credit: Getty Images

ম্যানেজিং মেইঞ্জ

আগস্ট ২০০৯-১০ মৌসুমে মেইঞ্জ বুন্দেসলিগায় প্রোমোটেড হয়। জর্ন এন্ডারসন ডি নালফানফারদের জার্মান ফুটবলের টপ ফ্লাইটে নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু ডিএফবি পোকাল কাপের ম্যাচে ফোর্থ টায়ার ক্লাব লুবেকের কাছে ২-১ গোলে হারের পর তার খেলার ধরন নিয়ে বোর্ড অভিযোগ জানালে কোচ ও বোর্ডের মধ্যে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। শেষপর্যন্ত নরওয়েজিয়ান কোচকে ছাঁটাই-ই করে দেয় মেইঞ্জ, লিগ শুরু হওয়ার ঠিক আগের দিনে। 

খবরটা শুনে প্রচণ্ড ধাক্কা খান মেইঞ্জের খেলোয়াড়রা। আর একদিন পর লিগ শুরু হবে, আর আজ কি না কোচ ছাঁটাই! তারা কি তবে কোচ ছাড়াই নিজেদের প্রথম ম্যাচ খেলবেন? আর জর্ন এন্ডারসনের অধীনে মেইঞ্জ নিয়মিত সাফল্য পাচ্ছিল, তার হাত ধরেই তো লিগে প্রোমোশন পায় মেইঞ্জ। বোর্ডের এমন সিদ্ধান্তে খুবই হতাশ হয়েছিলেন খেলোয়াড়রা, বলাই বাহুল্য। 

লিগ শুরুর একদিন আগে মেইঞ্জের কোচ হন টুখেল; bundesliga.com

যেকোনো প্রকারে হোক লিগে টিকে থাকা চাই, রেলিগেটেড হওয়া যাবে না — এই ছিল মেইঞ্জের মূল লক্ষ্য সেই মৌসুমে। মেইঞ্জ টমাস টুখেলকে গুরুভার দেয়, এর আগে কোনো সিনিয়র টিমকে কোচিং করানোর কোনো অভিজ্ঞতা যার ছিল না। তিনি তখন অগসবুর্গের জুনিয়র টিমকে কোচিং করাচ্ছিলেন। তাই ড্রেসিংরুমে দাঙ্গা-হাঙ্গামা বেঁধে যাওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছিল না। কিন্তু টুখেলের ধীরস্থির চালচলন ও কথাবার্তা দেখে ড্রেসিংরুমের পরিবেশ স্বাভাবিক হয়ে আসে।

“টুখেলকে প্রথম দেখেই আমাদের মনে হচ্ছিল যে ভদ্রলোক নিজের কাজটা ভালোই বোঝেন। এসেই তিনি পুরো মৌসুমে কীভাবে আমরা খেলব, কীভাবে আমাদের খেলতে দেখতে চান, কার কাছ থেকে কী ধরনের খেলা প্রত্যাশা করছেন ইত্যাদি সম্পর্কে শুরুতেই একটি পরিষ্কার ধারণা দেন। আর সবচেয়ে বেশি জোর দেন যে কথাটির ওপর, তা হলো ‘টিম স্পিরিট’।”

মেইঞ্জের সাবেক ডিফেন্ডার নিকোলাই নভেস্কি বলেছিলেন। 

প্রাথমিক পরিচয়ের পর যদি টিম স্পিরিট বেড়ে গিয়ে থাকে, তবে শুরুর দিকের সাফল্য সেই টিম স্পিরিটটাকে আরো শক্তিশালী করে তোলে। লিগে প্রথম তিন ম্যাচ অপরাজিত থাকে মেইঞ্জ, দুই ড্র ও এক জয় নিয়ে। সেই জয় আসে আবার বুন্দেসলিগার জায়ান্ট লুই ভ্যান হালের বায়ার্ন মিউনিখের বিপক্ষে। 

নভেস্কির ভাষ্যমতে,

“আমার এখনও মনে আছে, ম্যাচের খুঁটিনাটি বিষয়গুলো নিয়েও টুখেল আলোচনা করছিলেন আমাদের সাথে। বায়ার্ন মিউনিখের সাথে ম্যাচের আগে মোটিভেশনাল ভিডিও দেখিয়েছিলেন আমাদের। পূর্ণ উদ্যম ও আত্মবিশ্বাস নিয়ে খেলতে নেমেছিলাম আমরা।”

সেই ম্যাচে মেইঞ্জ নিজেদের ঘরের মাঠে ২-১ গোলে বায়ার্নকে হারায়। টুখেলের প্ল্যান খেলোয়াড়রা মাঠে এত সুন্দরভাবে এক্সিকিউট করেছিলেন যে জার্মান ম্যাগাজিন কিকার পরদিন বায়ার্ন-মেইঞ্জ ম্যাচের ট্যাকটিকাল রিভিউ ছাপায়। সেখানে টুখেলের বুদ্ধিমত্তার প্রশংসা করা হয়। এরপর মেইঞ্জের খেলোয়াড়দের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জন্মে যায়, নতুন কোচের অধীনে তারা চাইলেই যেকোনো দলকে হারাতে সক্ষম। আর এই মানসিকতার জোরেই শুধু বায়ার্নই নয়, ইয়ুর্গেন ক্লপের বরুশিয়া ডর্টমুন্ড, হ্যামবুর্গ এবং গ্লাডবাখকেও হারায় মেইঞ্জ। ক্লাব ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সেরা দশে থেকে মৌসুম শেষ করে মেইঞ্জ, লিগ টেবিলে নয় নম্বর অবস্থান দখল করে। শুধুমাত্র লিগে টিকে থাকার যে লক্ষ্যমাত্রা মেইঞ্জ নির্ধারণ করেছিল নিজেদের জন্য, টুখেলের অধীনে সেই লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও ভালো অবস্থানে থেকে লিগ শেষ করে তারা। 

জর্ন এন্ডারসনের আগে ইয়ুর্গেন ক্লপও মেইঞ্জের কোচ ছিলেন। ২০০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত তিনিই মেইঞ্জের ডাগ-আউটে দাঁড়ান। ২০০৩-০৪ মৌসুমে মেইঞ্জ তাদের ক্লাব ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বুন্দেসলিগায় প্রোমোশন পায় ক্লপের অধীনেই। তিন মৌসুম ক্লপের অধীনে বুন্দেসলিগায় খেলেছে মেইঞ্জ, কিন্তু ১১-এর বেশি আর উঠতে পারেনি পয়েন্ট টেবিলে। আর টুখেল নিজের প্রথম মৌসুমেই দলকে সেরা দশে তোলেন। 

এরপর তিন মৌসুম টুখেল মেইঞ্জের দায়িত্বে ছিলেন। ২০১০-১১ মৌসুমে সীমিত বাজেটের ভেতর যথাসাধ্য ভালো খেলোয়াড় খুঁজে বের করা, লোন সাইনিং, একাডেমির খেলোয়াড়দের যাচাইবাছাই — এসব নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাতে থাকেন। বায়ার্নকে এই মৌসুমেও একটি ম্যাচে মেইঞ্জ ২-১ গোলে হারায়। এবারে মেইঞ্জ আগের থেকেও ভালো খেলে, পঞ্চম স্থানে থেকে লিগ শেষ করে এবং ইউরোপা লিগের কোয়ালিফাইং রাউন্ডে পৌঁছায়। 

টুখেল ও ক্লপের মধ্যে প্রায়ই তুলনা করা হয়; bundesliga.com

যদিও খেলোয়াড় এবং সমর্থকরা টুখেলের সাথে ছিলেন, কিন্তু একই কথা মেইঞ্জের বোর্ড বা ম্যানেজমেন্টের জন্য প্রযোজ্য ছিল না। একেবারেই সীমিত পরিসরের বাজেটের কারণে ভালো খেলোয়াড় কিনতে ব্যর্থ হচ্ছিলেন টুখেল। ইউরোপা লিগের কোয়ালিফাইং রাউন্ড, ডিএফবি পোকাল কাপ, বুন্দেসলিগার ম্যাচ — সব মিলিয়ে চাপ এত বেড়ে যায় যে মেইঞ্জ তালগোল পাকিয়ে ফেলে যে ম্যাচ হারতে শুরু করে নিয়মিত। ফলে ২০১১-১২ মৌসুমে অবনমন হয় মেইঞ্জের, ১৩-তে নেমে আসে ক্লাবটি। এমনকি দলের সেরা খেলোয়াড় আন্দ্রে শুর্লেকেও বিক্রি করে দিতে হয় গ্রীষ্মে। ২০১২-১৩ মৌসুমেও ১৩-এর গেরোতে আটকা পড়ে থাকে মেইঞ্জ। 

দলের সেরা খেলোয়াড়দের বিক্রি করে দেওয়া, ভালো রিপ্লেসমেন্ট কেনার জন্য ফান্ড না দেওয়া, ম্যাচ হারলে উলটে তাকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করানো — তিতিবিরক্ত হয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। কোচটি টুখেল ছিলেন বলেই এরকম মানসিকতার এবং তারকা খেলোয়াড়বিহীন তরুণ একটি ক্লাব লিগে বাঘা বাঘা দলগুলোকে সেয়ানে সেয়ানে লড়াই দিচ্ছিল। ২০১৩-১৪ মৌসুমে যে মেইঞ্জ সপ্তম হয়, সেটির পুরো কৃতিত্ব টুখেলের প্রাপ্য। তা সত্ত্বেও বোর্ডের কাছ থেকে খেলোয়াড় কেনার জন্য যখন ফান্ড আদায় করতে পারলেন না, টুখেল সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন; চুক্তিতে যদিও আরো কিছু বছর বাকি ছিল। মৌসুমের শেষ ম্যাচে হ্যামবুর্গকে ৩-২ গোলে হারায় মেইঞ্জ। এরপর আনুষ্ঠানিকভাবে তার ক্লাব ছাড়ার ঘোষণা আসে। জয় দিয়েই তিনি তার মেইঞ্জের ক্যারিয়ার শুরু করেন, জয় দিয়েই শেষ করেন। 

আন্দ্রে শুর্লে টুখেলের সেরা আবিষ্কারদের একজন; bundesliga.com

মেইঞ্জের খেলোয়াড়রা এই খবরে ভীষণ চমকে গিয়েছিলেন। নভেস্কি বলেন,

“আমরা ভেবেছিলাম আরো লম্বা সময় ধরে টুখেল মেইঞ্জের কোচ থাকবেন। টুখেল চলে যাওয়ার পর বিশাল বড় এক শূন্যতার সৃষ্টি হয় ক্লাবে। অবশ্য তার মতো একজন কোচ যে সারাজীবন মেইঞ্জে কাটাবেন না, সেটাও আমরা বুঝতে পারছিলাম।” 

টুখেলের অধীনে মেইঞ্জ ১৮২ ম্যাচ খেলে ৭২ টি ম্যাচে জয় পায়, ৪৬টি ম্যাচ ড্র করে ও ৬৪টি ম্যাচ হারে। 

বরুশিয়ায় বোম্বব্লাস্ট

একরাশ রহস্য আর ধোঁয়াশা তৈরি করে ক্লাব থেকে চাকরি ছেড়ে দেওয়াটা টমাস টুখেলের জন্য ট্রেডমার্ক বলা যায়। অন্ততপক্ষে বরুশিয়ার ঘটনা তারই সাক্ষ্য দিবে। ইয়ুর্গেন ক্লপ বরুশিয়া ডর্টমুন্ড থেকে লিভারপুলে পাড়ি জমান, আর বরুশিয়া ডেকে নেয় টুখেলকে। 

মেইঞ্জেও ঘটনাটা ঠিক এরকমই ছিল। ক্লপের পরপরই (মাঝে জর্ন এন্ডারসন কোচ ছিলেন কেবল) মেইঞ্জের কোচ হন টুখেল। মেইঞ্জের হয়ে টুখেল সাফল্যে ক্লপকে ছাড়িয়ে গেছেন বললেও ভুল বলা হয় না। কিন্তু ইয়ুর্গেন ক্লপ ওয়েস্টফালেন স্তাদিওনে (যেটি স্পন্সরশিপজনিত কারণে সিগনাল ইদুনা পার্ক নামেও পরিচিত) সাত বছর কাটিয়েছেন, দুটো বুন্দেসলিগা, ডিএফবি পোকাল জিতেছেন এমনকি ২০১৩ সালে চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে খেলিয়েছেন ডর্টমুন্ডকে। ডর্টমুন্ডে এসে টুখেল কি পারবেন ক্লপের কীর্তিকে ছাড়িয়ে যেতে? এই প্রশ্ন তাই স্বাভাবিকভাবেই তখন ঘুরপাক খাচ্ছিল চারদিকে। 

ইয়ুর্গেন ক্লপ যখন লিভারপুলকে বেছে নেন ক্যারিয়ারের পরবর্তী ধাপ হিসেবে, ডর্টমুন্ড সমর্থকরা অনেকটাই মুষড়ে পড়েছিলেন। ইয়ুর্গেন ক্লপকে রিপ্লেস করা তো চাট্টিখানি কথা নয়! তবে টুখেলের নাম যখন আলোচনায় আসতে থাকে, তখন স্বস্তি ফিরে আসে ব্ল্যাক-ইয়েলোদের সমর্থকদের ভেতর। ক্লপের উত্তরসূরি হিসেবে সবাই টুখেলকেই ডর্টমুন্ডে দেখতে চাইছিলেন আসলে। স্বল্প বাজেটে, স্বল্প পরিচিত খেলোয়াড়দের নিয়ে এবং তরুণ ভালো খেলোয়াড় বাছাইয়ে তার দক্ষতা এবং ট্যাক্টিক্সে বিশেষ পারদর্শিতার জন্য তিনি তখন ‘ট্যাকটিক্যাল জিনিয়াস’ নামে পরিচিতি পেয়েছেন। 

টুখেল আসার পর প্রভাবটা টের পাওয়া গেল সাথে সাথেই, টানা পাঁচ ম্যাচ জিতে উড়ন্ত সূচনা করে লিগে ডর্টমুন্ড। তবে বায়ার্নের কাছে ৫-১ গোলে হারার পর উড়তে থাকা ডর্টমুন্ড মাটিতে নেমে আসে। 

ডর্টমুন্ড ট্যাকটিক্যালি পরিবর্তিত হতে থাকে। এমনকই থ্রি-মেন ডিফেন্স নিয়েও খেলতে দেখা যায়, যেটা ক্লপের সময় দেখা যায়নি। বায়ার্নকে চ্যালেঞ্জ করার মতো ভালো দল ছিল না হাতে, আর বায়ার্নের সেই দলটা আসলে বেশিই ভালো খেলছিল পেপ গার্দিওলার অধীনে। চ্যাম্পিয়ন বায়ার্নের থেকে ১০ পয়েন্ট কম নিয়ে দ্বিতীয় হয়ে টুখেলের প্রথম মৌসুম শেষ হয়। ইউরোপায় কোয়ার্টার ফাইনালে ক্লপের লিভারপুলের কাছে হেরে বিদায় নেয় ডর্টমুন্ড। অভিষেক মৌসুম হিসেবে সন্তোষজনক পারফরম্যান্সই বলা যায় একজন অল্পবয়সী কোচের জন্য। 

স্ফেন মিসলিন্ট্যাটের সাথে টুখেলের মনোমালিন্য হয়; Credit: espn

টুখেলের প্রথম মৌসুমে চিফ স্কাউট ছিলেন স্ফেন মিসলিনট্যাট। তিনি স্প্যানিশ মিডফিল্ডার অলিভার তোরেসকে ডর্টমুন্ডে আনার তোড়জোড় করছিলেন। বোর্ড কীভাবে কোন খেলোয়াড়কে ট্রান্সফার করবে, এ ব্যাপারে সরাসরি প্রভাব ছিল না টুখেলের। ট্রান্সফার যখন প্রায় হয়ে যাচ্ছে, তখন টুখেল একদিন বলে বসেন যে অলিভার তোরেসকে তিনি দলে চাননি। এই নিয়ে বোর্ড এবং টুখেলের ভেতর মন কষাকষি চলতে থাকে। টুখেল মিসলিনট্যাটের ওপর প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হন; ট্রেইনিং গ্রাউন্ডে তাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। এর কিছুদিন পরই মিসলিনট্যাট আর্সেনালের স্কাউটিং দলে যোগ দেন। তার ডর্টমুন্ড ছাড়ার পেছনে এই ঘটনাটির প্রত্যক্ষ প্রভাব ছিল। এত বছর ক্লাবে কাজ করার পরেও টুখেলের করা এমন অপমানকর ব্যবহারে নিজেকে ডর্টমুন্ডে খুব অনাকাঙ্ক্ষিত মনে হচ্ছিল তার। তাকে দোষ দেওয়া যায় না অবশ্য। ফুটবল বিশ্বে যে কারণে বরুশিয়া ডর্টমুন্ড প্রায় সকলের কাছে পরিচিত, তৃণমূল থেকে প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের তুলে আনা ও তাদের পরিচর্যা করা — তার অনেকটাই সফল হয়েছিল মিসলিনট্যান্ট ও তার স্কাউটিং টিমের দক্ষতার কারণেই। মিসলিনট্যাটকে হারানো নিঃসন্দেহে ডর্টমুন্ডের জন্য বড় ক্ষতি ছিল।

২০১৬-১৭ মৌসুমের গ্রীষ্মে বেশ খরচা করে ডর্টমুন্ড। ম্যাটস হামেলস, ইলকায়ে গুন্দোয়ান, হেনরিখ মিখিতারিয়ানের জায়গা পূরন করতে আনা হয় উসমান দেম্বেলে, মার্ক বার্ত্রা, আন্দ্রে শুর্লে, মারিও গোৎজে, রাফায়েল গেরেইরা, সেবাস্তিন রোডকে। ক্রিশ্চিয়ান পুলিসিচ ও পিয়েরে এনরিকে অবামেয়াং এবং নতুন সাইনিং — সবাই মিলে ডর্টমুন্ডের খেলার চেহারাই বদলে দিয়েছিল। অ্যাটাকে দুর্ধর্ষ হয়ে উঠতে লাগল ডর্টমুন্ড। বায়ার্ন মিউনিখের বিপক্ষে ২০১৬-১৭ সালের ডিএফবি পোকাল সেমিফাইনালে এর প্রমাণ প্রত্যক্ষ করে বিশ্ববাসী। ৩-২ গোলে ডর্টমুন্ডের কাছে হারে বায়ার্ন।

ডর্টমুন্ডের বাসকে লক্ষ্য করে বোম্বব্লাস্ট করা হয়; Credit: AP

সেই সেমিফাইনালের দুই সপ্তাহ আগের কথা। ১১ এপ্রিল,২০১৭। তারিখটা ডর্টমুন্ড ভক্তদের ভালো করেই মনে থাকার কথা। সিগনাল ইদুনা পার্কে মোনাকোর বিপক্ষে চ্যাম্পিয়নস লিগের কোয়ার্টার ফাইনালের প্রথম লেগের ম্যাচ সেদিন। ডর্টমুন্ডের টিম বাস স্টেডিয়ামে যাওয়ার পথে তিনটি পাইপ বোমা ব্লাস্ট হয়। বোম্ব ব্লাস্টের ফলে বাস প্রায় দুমড়েমুচড়ে যায়। জানালার শক্ত কাচের গ্লাসও ভেঙে পড়ে সেই ব্লাস্টে। ভাঙা কাচের আঘাতে ডর্টমুন্ডের স্প্যানিশ ফুটবলার মার্ক বার্ত্রা গুরুতর আহত হন। পরবর্তী সময়ে সার্গেজ ওয়েনারগোল্ড নামের সেই বোমা হামলাকারীকে পুলিশ খুঁজে বের করে এবং তার বিরুদ্ধে ২৮ জন মানুষকে অ্যাটেম্পট টু মার্ডারের অভিযোগ আনে। জার্মান আদালতের রায়ে তার ১৪ বছরের জেল দেওয়া হয়। ডর্টমুন্ডের টিম বাসটি যদি খুব শক্তপোক্ত না হতো, তাহলে হয়ত পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হতে পারত। 

বরুশিয়া ডর্টমুন্ডের সিইও হান্স জোয়াকিম ওয়াটজকে বোমা হামলার পর ড্রেসিংরুমে খেলোয়াড়দের সাথে দেখা করতে আসেন। এরপর তিনি প্রেস কনফারেন্সে জানান, সেদিন ম্যাচ বাতিল করা হলেও পরেরদিনই মোনাকোর বিপক্ষে ম্যাচের ফিক্সচার ঠিক করা হয়েছে। এদিকে খেলোয়াড়রা তখনও ভয় কাটিয়ে উঠয়ে পারেননি। এইরকম মানসিক চাপের মধ্যে খেলতে নামাটা তাদের জন্য খুবই হতাশার ছিল। ফল যা হওয়ার তাই হয়, সেই ম্যাচটি ডর্টমুন্ড ৩-২ গোলে হারে। ফিরতি লেগের ম্যাচটিও ৩-১ গোলে হারে ডর্টমুন্ড। ফলে ইউসিএল থেকে বাদ পড়ে ক্লাবটি। এর কিছুদিন পর টুখেল প্রকাশ্যে বলেন, তিনি বা খেলোয়াড়রা নাকি বোম্বব্লাস্টের পরেরদিনেই ম্যাচ খেলতে চাননি। কিন্তু উয়েফা নাকি পরেরদিনই খেলার জন্য জবরদস্তি করেছিল। আর ওয়াটজকে খেলোয়াড়দের শুধু সেই সিদ্ধান্ত জানাতেই ড্রেসিংরুমে এসেছিলেন। খেলোয়াড়রা আদৌ পরেরদিন মাঠে নামার মতো মানসিক অবস্থায় আছে কি না, তা তিনি জানতেও চাননি। ওয়াটজকে চাইলেই উয়েফাকে অনুরোধ করে ম্যাচটিকে পেছাতে পারতেন। সেখানে তিনি নিজের ক্লাবের খেলোয়াড়দের প্রতি অবিবেচকের মতো ব্যবহার করেন। ডর্টমুন্ডের ডিফেন্ডার সক্রেটিস ম্যাচশেষে ক্ষোভ উগড়ে দেন,

“উয়েফাকে মনে করিয়ে দিতে চাই, আমরাও মানুষ, আমাদের পরিবার ও সন্তানাদি রয়েছে। আমরা পশু নই। আমাদেরকে সাথে পশুর মতো আচরণ করা হয়েছে।”

এর কিছুদিন পর ডিএফবি পোকাল কাপের ফাইনাল ম্যাচে ফ্রাংকফুর্টকে ২-১ গোলে হারিয়ে শিরোপা জেতে ডর্টমুন্ড। সেটিই টুখেলের শেষ ম্যাচ ছিল। বুন্দেসলিগায় তৃতীয় হয়ে শেষ করলেও ট্রফিলেস থাকেনি টুখেলের ডর্টমুন্ড। ডর্টমুন্ডে এই একটিই ট্রফি তিনি জিতেছেন। 

টুখেল ডর্টমুন্ডের হয়ে পোকাল কাপ জেতেন; Credit: Bundesliga

মৌসুম শেষ হওয়া মাত্রই ডর্টমুন্ড ছাড়তে বাধ্য হন টুখেল। বোম্বব্লাস্টের পরেও খেলা চালিয়ে যাওয়ার ঘটনায় হোয়াকিম ওয়াটজকে দোষারোপ করার পর থেকেই তার ডর্টমুন্ডের দিন ফুরিয়ে আসছিল। যদিও ডর্টমুন্ড দাবি করেছিল, টুখেলের চাকরি ছাড়ার ব্যাপারে ব্যক্তিগত সম্পর্কের তিক্ততা কাজ করেনি। কিন্তু জোয়াকিম ওয়াটজকে পরে স্বীকার করেছিলেন, দু’পক্ষের মধ্যে বনিবনা হচ্ছিল না। তিনি এ-ও বলেন, টমাস টুখেল খুবই ভালো কোচ, কিন্তু খুবই জটিল মননের লোক। 

জোয়াকিম ওয়াটজকের সাথে তার সম্পর্ক তিক্ত হয়ে যায়; Credit: Imago/Martin Hoffmann

বরুশিয়া ডর্টমুন্ডে তার অধীনে অবামেয়াং বুন্দেসলিগায় নিজের সেরা মৌসুম কাটান, ২০১৬-১৭ মৌসুমে তিনি ৩১ গোল করে লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা হন। উসমান দেম্বেলে ও ক্রিশ্চিয়ান পুলিসিচকে ঘষেমেজে ‘আনকাট ডায়মন্ড’ থেকে ‘পোলিশড ডায়মন্ডে’ তিনিই রূপান্তর করেন। জুলিয়ান ওয়েইগেল ডর্টমুন্ডের কী-প্লেয়ারদের একজন ছিলেন, টুখেল চলে যাওয়ার পর এই হোল্ডিং মিডফিল্ডার আজ নিজের পথ ভুলে বসেছেন। 

টুখেলের অধীনে বরুশিয়া ডর্টমুন্ড ১০৭টি ম্যাচ খেলে ৬৭টি ম্যাচে জয় পায়, ২৩টি ম্যাচ ড্র করে ও মাত্র ১৭টি ম্যাচ হারে। তিনি ইয়ুর্গেন ক্লপের মতো লম্বা সময় ধরে থাকতে পারেননি ক্লাবে, তাই পূর্বসূরির কীর্তিকে ছাপিয়েও যেতে পারেননি — যেমনটা মেইঞ্জের হয়ে পেরেছিলেন। 

প্যারিসের পথে…  

টুখেল এবং নাসের আল খেলাইফি; Credit: Getty Images

সমস্যা যেন টুখেলের পিছু ছাড়তে চায় না সহজে। প্রায় বছরখানেক বেকার থাকার পর ২০১৮ সালের মে মাসে প্যারিস সেইন্ট জার্মেইর কোচ হন টুখেল।

প্রথম দিনের প্রেস কনফারেন্সে নাসের আল খেলাইফি টুখেলের ‘কঠোর নীতিবোধ’ ও কোচিং করানোর দক্ষতা নিয়ে কথা বলেন। টানা ছয় বছর ধরে পিএসজি চ্যাম্পিয়নস লিগে ভুগছিল। কোয়ার্টার ফাইনালের বেশি যেতে পারছিল না কিছুতেই। টুখেল কঠোর নিয়মানুবর্তী বলেই খেলাইফির ভরসা ছিল তার দলের নানারকম মানসিকতার এবং ‘বিগ ইগো’ প্লেয়ারদের একসুতোয় বাঁধতে পারবেন তিনি।

খেলাইফির এমন ভাবাটা অমূলক নয়। যেমন মেইঞ্জের কোচ যখন ছিলেন তিনি, তখনকার একটি ঘটনার কথাই বলা যাক। ক্যান্টিন টেবিলে সব খেলোয়াড়দের একসাথে বসে খেতে হতো। কারো আগে খাওয়া শেষ হয়ে গেলেও অন্য খেলোয়াড়রা খাওয়া শেষ করা না পর্যন্ত সে টেবিল ছেড়ে উঠতে পারত না। কারণ টুখেল এ ধরনের আচরণকে অভদ্রতা মনে করতেন।

তবে প্যারিসে গিয়ে টুখেল বুঝতে পারছিলেন, বিগ ইগো সামলানো একটা চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার। বস্তা বস্তা টাকা ঢেলে নেইমার-এমবাপেদের দলে ভিড়িয়েছেন খেলাইফি। খেলোয়াড়দের সাথে তার ভালো সম্পর্ক তৈরি করতে হবে — বিশেষ করে এমবাপে-নেইমারদের সঙ্গে। ক্লাবের সত্যিকারের বস কিন্তু এরাই। খেলোয়াড়দের না ক্ষেপিয়ে ভালো সম্পর্ক তৈরি করা এবং নিজে যা চাচ্ছেন তা খেলোয়াড়দের কাছ থেকে আদায় করা — এই দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য ধরে রাখাটাই টুখেলের জন্য বড় এক চ্যালেঞ্জ ছিল। 

টুখেল আসার আগে তার আগের ছয়বারের পাঁচবারই লিগ ওয়ান জিতেছে পিএসজি। কিন্তু রাজধানী শহরের ক্লাবটির জন্য ইউসিএলে সাফল্য ধরা দিচ্ছিল না কিছুতেই। মূলত ইউসিএল জেতানোই ছিল তার কাছে পিএসজি’র আবদার। 

প্রথম মৌসুমটা তেমন সফল বলা যায় না। ২০১৮-১৯ এ লিগ ওয়ান জেতে দ্বিতীয় স্থানের ক্লাবের সাথে ১৬ পয়েন্ট ব্যবধান রেখে। কিন্তু কোপা ডি ফ্রান্সের ফাইনাল হারে রেনের কাছে। কোপা ডি লা লিগা বা ফ্রেঞ্চ লিগ কাপসে গুইগ্যাম্পের কাছে কোয়ার্টার ফাইনালে হারে এবং প্রথম লেগে ৩-১ গোলে এগিয়ে থাকার পরও ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের কাছে হেরে বাদ পড়ে ইউসিএল থেকে। 

প্যারিসের হয়ে লিগ ওয়ান শিরোপা জেতার পর; Credit: Getty Images

২০১৯-২০ মৌসুমের ট্রান্সফার উইন্ডোতে ৯৫ মিলিয়ন ইউরো খরচ করে পিএসজি, ইদ্রিসা গুইয়ে এবং আন্দ্রে হেরেরা ছিল অন্যতম সাইনিং। এই সাইনিংগুলো ফলপ্রসূ ছিল। নেইমার-এমবাপ্পে-মাউরো ইকার্দি গোলস্কোরিংয়ে মন দিতে থাকেন। গ্রুপস্টেজে রিয়াল মাদ্রিদ থাকা সত্ত্বেও গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয় পিএসজি। পরের রাউন্ডে সাবেক ক্লাব ডর্টমুন্ডকে বিদায় করে তার দল। 

২০২০-এর মার্চ মাসে যখন মহামারীর কারণে খেলাধুলো বন্ধ হয়ে যায়, তখন পিএসজিকে লিগ ওয়ানের চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করে মৌসুমের সমাপ্তি টানে ফ্রান্স। আগস্টে খেলা মাঠে ফেরার পর সব ক্লাব যখন লিগের বাকি ম্যাচগুলোর ফিক্সার নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে, পিএসজি তখন অলস সময় কাটাচ্ছে। তাই তাদের পুরো ধ্যানজ্ঞান তখন চ্যাম্পিয়নস লিগের প্রস্তুতির ওপর। 

তারকা খেলোয়াড় নেইমার-এমবাপের পারফরম্যান্সে আটলান্টা ও লাইপজিগকে বিদায় করে প্রথমবারের মতো ফাইনালে ওঠে পিএসজি। তবে হান্সি ফ্লিকের বায়ার্ন তখন দুরন্ত ফর্মে, সদ্যই বার্সেলোনাকে ৮-২ গোলে বিধ্বস্ত করেছে তারা। সেই ফর্ম ধরে রাখে বায়ার্ন ফাইনালেও, কিংসলে ক্যোমানের একমাত্র গোলে স্বপ্নভঙ্গ হয় পিএসজি’র। আর নিজেদের ক্লাব ইতিহাসে দ্বিতীয়বারের মতো ট্রেবল জেতে বায়ার্ন। 

সেই ফাইনালের পর সবকিছু বদলাতে থাকে। ইকার্দির লোন ডিল পার্মানেন্ট করা হয় ৫০ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে। এডিনসন কাভানি ও থিয়াগো সিলভা ক্লাব ছাড়েন। অক্টোবর মাসে টুখেল বলেন,

“অনেক প্লেয়ার হারিয়েছি আমরা। এই স্কোয়াড নিয়ে গতবারের পুনরাবৃত্তি ঘটানো সম্ভব না।”

এই মন্তব্যে মারাত্মক খেপে যান স্পোর্টিং ডিরেক্টর লিওনার্দো আরাউহো। তিনি টুখেলকে সতর্ক করে দেন, তিনি যেন ‘পদমর্যাদায় বড়’ ব্যক্তিদের সম্মান করে কথা বলেন। এরপর থেকে পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে শুরু করে। 

লিওনার্দোর সাথেও তুমুল বিবাদ হয় তার; Credit: Getty Images

টুখেল প্রেসের সামনে লিওনার্দো আরাউহো এবং বোর্ডকে নিয়ে তীর্যক মন্তব্য করতে থাকেন। কিছু কিছু ক্লাবে হয়তো কোচদের বলার জায়গা থাকে, কিন্তু পিএসজি’তে বোর্ডের কথাই শেষ কথা। টুখেল যখন বোর্ডের কাছে জবাবদিহিতা দাবি করতে শুরু করেন, তখন তার চাকরি ধরে রাখার শেষ সলতেটুকুও নিভে যায়। ডিসেম্বর মাসের ২৯ তারিখ টুখেলকে চাকরিচ্যুত করে পিএসজি। তবে ড্রেসিংরুমের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছেন তিনি তারও আগেই। তার ট্যাকটিক্স অনুযায়ী নেইমার এমবাপ্পেরা খেলতে চাইছিলেন না। ২০২০-২১ মৌসুমের লিগে চারটি ম্যাচ হারে পিএসজি। শীতকালীন বিরতির আগে লিগে তৃতীয় স্থানে চলে যায় দলটি। 

আড়াই বছরে পিএসজি টুখেলের অধীনে ১২৭টি ক্যাচ খেলে। ৯৫টি ম্যাচে জয় পায়, ১৩টি ম্যাচ ড্র হয়, ১৯টি ম্যাচে হারের মুখ দেখে। দু’টি লিগ ওয়ান শিরোপাও জেতে। দ্বিতীয় মৌসুমে ঘরোয়া ট্রেবলও জিতেছিলেন। দুইবার ফ্রেঞ্চ সুপার কাপ জেতেন। মোট ছয়টি শিরোপা  জিতেছিলেন টুখেল প্যারিসে। 

পিএসজি’র ক্লাব ইতিহাসের প্রথম কোচ হিসেবে তিনি তাদের ইউসিএল ফাইনালে খেলিয়েছেন। শুধু এই একটি কারণের জন্য হলেও তাকে পিএসজি’র হয়ে সফল বলে বিবেচনা করা যায় বোধহয়। 

চেলসি চ্যালেঞ্জ

টুখেলের চোখ সর্বগামী; Credit: Getty Images 

বাভারিয়ান কোচ যখন চেলসির ফ্যান-ফেভারিট কোচ ফ্রাংক ল্যাম্পার্ডের স্থলাভিষিক্ত হয়ে আসেন ২০২০-২১ মৌসুমের মাঝামাঝি সময়ে। ইপিএলে চেলসি তখন নয় নম্বরে অবস্থান করছে। 

মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানেই এই দলটি খোলনলচে বদলে গেল। চেলসি ইপিএলের সেরা চারে থেকে শেষ করে, এফএ কাপের ফাইনাল খেলে এবং সবাইকে চমকে দিয়ে ইউসিএল জিতে নেয়। মৌসুমের মাঝে এসে ক্লাবের হাল ধরা এবং এরকম পারফরম্যান্স করা দেখে পুরো ফুটবলবিশ্ব চমকে যায়। সে মৌসুমে তার অধীনে খেলা লিগের ১৯ ম্যাচে চেলসি ১১টি ক্লিনশিট রাখে এবং মাত্র ১৩টি গোল হজম করে। ইপিএলের মতো লিগে এরকম পরিসংখ্যান বিস্মিত করার মতোই বটে। এছাড়া ইউসিএলে নয় ম্যাচের নয়টিতেই জয় পায় চেলসি, গোল হজম করে মাত্র দু’টি। জিদান, সিমিওনে, গার্দিওলা, মরিনহো, ক্লপ, আনচেলত্তি — এক মৌসুমেই বাঘা বাঘা সব কোচদের সাথে খেলা পড়েছে, সবাইকে হারিয়েছেন। 

টুখেল এবং চেলসি ধারাবাহিকভাবে পারফর্ম করে যাচ্ছে। আগের বছর পিএসজিকে ইউসিএলের ফাইনালে উঠিয়েছেন, তারপরও তাকে চাকরিচ্যুত হতে হয়। পরের মৌসুমেই তিনি চেলসিকে ফাইনালে ওঠান। দুটো ভিন্ন ক্লাব নিয়ে পরপর দুই মৌসুম ইউসিএল ফাইনাল খেলা অবিশ্বাস্য অর্জনই বটে। গেল মৌসুমে তৃতীয়বারের মতো ইউসিএল ফাইনালে ওঠে চেলসি। ২০০৮ সালে ইউসিএলের প্রথম অল-ইংলিশ ফাইনালে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের কাছে পেনাল্টি শ্যুটআউটে হারে, এরপর ২০১৩ সালে বায়ার্ন মিউনিখকে সেই পেনাল্টি শ্যুটআউটেই হারায় তারা এবং প্রথমবারের মতো জিতে নেয় ইউসিএল শিরোপা। ২০২০-২১ মৌসুমে কাই হাভের্টজের একমাত্র গোলে চেলসি নিজেদের দ্বিতীয় শিরোপা উঁচিয়ে ধরে। 

অবশেষে ইউসিএল শিরোপার দেখা; Credit: Getty Images

প্রায়ই তাকে ইয়ুর্গেন ক্লপের সাথে তুলনা করা হয়, যদিও তাদের ফিলোসফি এবং ব্যক্তিত্ব পুরোপুরি আলাদা। টুখেল কিছুটা গেগেনপ্রেসিং এপ্রোচে খেলিয়েছেন। কিন্তু ক্লপের হেভিমেটাল ফুটবলের থেকে তার ধরন আলাদা। 

৪-৩-৩ ফর্মেশনে ডর্টমুন্ড ও পিএসজিতে খেলতে দেখা গেছে। ৩-৫-২ ফর্মেশনও ব্যবহার করেছেন, মাঝেমধ্যে ব্যবহার করেছেন ৫-৩-২ ফরমেশনও। ম্যানমার্কিং তার দলের বৈশিষ্ট্য। এনার্জেটিক মিডফিল্ডাররা বিপক্ষের খেলোয়াড়দের মার্ক করেন, স্পেস তৈরি করেন, যাতে ফরোয়ার্ডরা ফাইনাল থার্ডে আরেকটু বেশি জায়গা পায়,গোল করার সুযোগ পায়।  

“টুখেল ছিলেন পারফেকশনিস্ট, যখন তার মনমতো কিছু হয় না, তখন তিনি কাউকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে ভয় করেন না। ঘুরিয়েপেঁচিয়ে না বলে একেবারে সরাসরি কথাবার্তা বলেন। সবসময় ডিরেক্টলি অ্যাপ্রোচ করার অভ্যাস থাকলে, মানুষের সাথে আপনার বিবাদে জড়িয়ে পড়ার আশংকা থাকে।”

মেইঞ্জের সাবেক ডিফেন্ডার নিকোলাই নভেস্কি এক সাক্ষাৎকারে বলেন। নভেস্কির এই কথার সত্যতা বারবার পাওয়া গেছে। টুখেল পারফেকশনিস্ট এবং কিছুটা ক্ষ্যাপাটে স্বভাবেরও। খেলোয়াড়দের ডায়েট থেকে মাঠের ঘাসের উচ্চতা — সবকিছু নিয়েই থাকে তার খুঁতখুঁতানি। মেইঞ্জের ম্যানেজমেন্ট, ডর্টমুন্ডের সিইও হান্স জোয়াকিম ওয়াটজকে কিংবা পিএসজি’র স্পোর্টিং ডিরেক্টর লিওনার্দো — যখন প্রয়োজন পড়েছে, কাউকেই তিনি কথা শোনাতে ছাড়েননি। তার ট্যাকটিক্সে ফিট করবে এমন খেলোয়াড় চেয়েও না পেলে বা ক্লাবের কাছে ফান্ডিং না পেলে দু’কথা শুনিয়ে দিতে ছাড়েননি কাউকেই।

Image Credit: Getty Images

ম্যানেজমেন্টের সাথে বারবারই বিবাদে জড়িয়েছেন। অবশ্য তাতে টুখেল থোড়াই কেয়ার করেন। টুখেলের মতো মেধাবী কোচদের মন যুগিয়ে চলার অভ্যাস কখনোই থাকে না, যা থাকে তা হলো মেধাশক্তির জোর। আর জহুরীরা নিজেরাই খুঁজে নেন টুখেলদের। টুখেলের সাবেক মেন্টর এরিখ রোটেমুলারের মতে,

“টুখেল ফুটবল খেলার পেছনে যে বিজ্ঞান রয়েছে, তা খুব ভালোভাবে বোঝে। শুধু ট্রেইনিং সায়েন্স নয়, স্পোর্টস মেডিসিন, ফিজিওলজি, স্পোর্টস সাইকোলজিতেও টুখেল সমানভাবে দক্ষ।” 

টুখেলকে অনেকে বলেন পলিটিক্যালি পাওয়ারড কোচ বা কন্ট্রোল ফ্রিক — ফুটবল বিশ্বের সবচেয়ে কমপ্লেক্স বা জটিল ব্যক্তিত্বদের একজন। রোমান আব্রাহামোভিচ ও চেলসির স্পোর্টিং ডিরেক্ট মারিনা গ্রাভোন্সকিয়া তার কতটা ভক্ত হয়ে উঠবেন, বা চেলসির সাথে তার সম্পর্ক কোনদিকে মোড় নেয়, তা অবশ্য সময়ই বলে দেবে। 

উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা জয় তাকে বর্তমান সময়ের সেরা কোচদের কাতারে তুলে এনেছে নিঃসন্দেহে। তবে ফুটবল বিশ্বকে তার ট্যাকটিক্যাল জিনিয়াসনেসের অনেকখানিই দেখানো বাকি, খেলা তো সবে শুরু।

Related Articles