Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ফিরে দেখা: ইউরো ২০০৮ (প্রথম পর্ব)

২০০৮, ২০১০, ২০১২। ইউরো-বিশ্বকাপ-ইউরো।

তিনটা টুর্নামেন্টের শেষ হাসি হেসেছে একটা দল – স্পেন। বল পায়ে রেখে দ্রুতগতির উদ্যমী ফুটবল খেলার মাধ্যমে স্পেন যে আধিপত্যের শুরু করেছিল ২০০৮ এর ইউরোতে, অমন আধিপত্যের দৃষ্টান্ত ফুটবল ইতিহাসে বিরল। ২০০৪-এর বিজয়ী গ্রিসের মতো দলীয় সমন্বয় তো ছিলই, এর সাথে স্পেন যুক্ত করেছিল নিখুঁত টেকনিক, দারুণ সৃষ্টিশীলতা আর দুর্ধর্ষ আক্রমণ। ফলাফল হিসেবে ২০০৮ এর ‘লা রোহা’রা ছিল উড়ন্ত, অপ্রতিরোধ্য।

২০০৮ ইউরোর কথা উঠলেই ট্রফি হাতে স্পেনের উল্লাসের ছবিটা সবার মনে ভেসে ওঠাটাই স্বাভাবিক, কিন্তু ঐ ইউরোতে বলার মতো একমাত্র গল্প হিসেবে যদি কেউ স্পেনের বিজয়ের গল্পকেই ভেবে নেন, ভুল করবেন। ঐ ইউরোর পরতে পরতে মিশে ছিল দারুণ আক্রমণাত্মক ফুটবলের রোমাঞ্চকর গল্প, যেটা ঐ টুর্নামেন্টকে আলাদা জায়গা দিয়েছে ইউরোর সব সংস্করণের মাঝে। এই লেখার প্রথম পর্বে আমরা বলব ঐ ইউরোর গ্রুপপর্বের গল্পগুলো, দ্বিতীয় পর্বে থাকবে নকআউট পর্ব আর বিশেষত স্পেনের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পিছনের গল্প। 

ড্রতে উঠল জার্মানির নাম; Image Source: Getty Images

২০০৮ এর জুনে অনুষ্ঠিত ঐ ইউরোর স্বাগতিক ছিল অস্ট্রিয়া এবং সুইজারল্যান্ড। আটটি ভেন্যুতে অনুষ্ঠিত এই টুর্নামেন্টে ষোলটি দলকে বিভক্ত করা হয় চারটি গ্রুপে। গ্রুপ এ-তে স্বাগতিক সুইজারল্যান্ডের সাথে ছিল পর্তুগাল, তুরস্ক ও চেক প্রজাতন্ত্র। অপর স্বাগতিক অস্ট্রিয়ার সাথে জার্মানি, ক্রোয়েশিয়া আর পোল্যান্ড ছিল গ্রুপ বিতে। নেদারল্যান্ড, ইতালি, ফ্রান্স আর রোমানিয়াকে নিয়ে গ্রুপ-সি ছিল এক সাক্ষাৎ ‘মৃত্যুকূপ’, অপরদিকে বাকি চার দল, অর্থাৎ স্পেন, রাশিয়া, গ্রিস আর সুইডেন জায়গা পেয়েছিল গ্রুপ ডি-তে।

গ্রুপ এ

বাসেলের সেন্ট জ্যাকব পার্কে স্বাগতিক সুইজারল্যান্ডের প্রথম ম্যাচ ছিল চেক প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে। স্বাভাবিকভাবেই স্বাগতিক দর্শক-সমর্থকদের প্রত্যাশার পারদ ছিল আকাশচুম্বী। কিন্তু প্রত্যাশার বেলুন ফুটো হয়ে যেতে বেশি সময় লাগেনি। প্রত্যাশার বেশিরভাগটাই যাকে ঘিরে, সেই অধিনায়ক আলেকজান্ডার ফ্রেই প্রথম ম্যাচেই হাঁটুর লিগামেন্টের ইনজুরি নিয়ে ছিটকে গেলেন পুরো টুর্নামেন্ট থেকে। অধিনায়ককে হারিয়ে সুইজারল্যান্ডও মনোবল হারিয়ে ফেলল, ফলাফলে ০-১ ব্যবধানে হারল প্রথম ম্যাচটা।

ইনজুরিতে পড়ে ইউরো থেকে ছিটকে গেলেন আলেকজান্ডার ফ্রেই; Image Source: Getty Images

ফ্রেইয়ের অনুপস্থিতিটা শুধু প্রথম ম্যাচেই নয়, বরং সুইসদের নকআউট পর্বে ওঠার স্বপ্নেই বড় আঘাত হয়ে এসেছিল। এর মধ্যে তুরস্কের বিপক্ষে নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচটা পড়েছিল প্রবল বৃষ্টি আর ক্ষণে ক্ষণে বজ্রপাতের মুখে। বৃষ্টির তীব্রতায় মাঠ হয়ে উঠেছিল একটা সুইমিং পুলের মতো। খেলার প্রায় অনুপযোগী এই মাঠের সহায়তা থেকেই অবশ্য ম্যাচের প্রথম গোলটা পেয়ে গিয়েছিল সুইজারল্যান্ড, ৩২তম মিনিটে হাকান ইয়াকিনের গোলে এগিয়ে যায় স্বাগতিকরা। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি, ৫৭তম মিনিটে সেমিনের গোলে সমতায় ফেরে তুরস্ক। আর ৯২তম মিনিটে আর্দা তুরানের গোলে প্রত্যাবর্তনের অসাধারণ গল্প লিখে জয় পায় তুরস্ক, অবশ্যই টুর্নামেন্টে শেষবারের মতো নয়। অপরদিকে পরপর দুই ম্যাচে সুইজারল্যান্ডের পরাজয়ের অর্থ একটাই, এক ম্যাচ হাতে রেখেই টুর্নামেন্ট থেকে বিদায়।

শেষ ম্যাচে পর্তুগালের বিপক্ষে ‘সান্ত্বনার’ জয় পেলেও সেটা নিদেনপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালের স্বপ্ন দেখা সুইজারল্যান্ডের যন্ত্রণা কতটুকু কমাতে পেরেছে, সেটা অবশ্য প্রশ্নসাপেক্ষ। প্রথম ম্যাচেই অধিনায়ক ফ্রেইয়ের ছিটকে পড়ার আঘাতটা স্কোয়াড ডেপথের অভাবে ভুগতে থাকা দলটার জন্য এসেছে খুব বাজেভাবে। ঝড়ের মাঝে পথহারা নাবিকহীন জাহাজের মতোই দলটা হয়েছে লক্ষ্যচ্যুত, বিদায় নিয়েছে দৃশ্যপট থেকে।

পেপে আর রাউল মিরালেসের গোলে তুরস্কের বিপক্ষে জয় দিয়ে টুর্নামেন্টের শুভসূচনা করে পর্তুগাল। পরের ম্যাচে চেক প্রজাতন্ত্রের ডেকো, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো আর রিকার্ডো কারেজমার গোলে ৩-১ ব্যবধানে জিতে কোয়ার্টার ফাইনাল নিশ্চিত করে তারা। এরপর ‘নিয়ম রক্ষার’ তৃতীয় ম্যাচে সুইজারল্যান্ডের বিরুদ্ধে বেঞ্চের শক্তি পরীক্ষা করতে চেয়েছিল পর্তুগিজরা। সেই পরীক্ষা অবশ্য সফল হয়নি, হাকান ইয়াকিনের জোড়া গোলে পর্তুগালকে ২-০ ব্যবধানে পরাজিত করে টুর্নামেন্টে নিজেদের যাত্রার সমাপ্তি টানে স্বাগতিক সুইজারল্যান্ড।

তবে স্বাগতিক সুইজারল্যান্ডের বিদায়টা এই গ্রুপের জৌলুশ কমাতে পারেনি। ধারে-ভারে ছোট দল সুইসদের ওপর থেকে সরে যাওয়া আলোটা নিজেদের ওপর টেনে নিয়েছিলে তুরস্ক। তুরস্কের কোচ ফাতিহ তেরিম একজন অনুপ্রেরণাদায়ী নেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন আগেই, গ্যালাতাসারাইয়ের হয়ে ঘরোয়া সাফল্যও ছিল; কিন্তু তবুও তিনি মোটাদাগে একজন বিতর্কিত ব্যক্তিই ছিলেন। ‘৯৬ ইউরোতে ভরাডুবির সময়ে তুরস্কের কোচ তিনিই ছিলেন, দল গঠনের ক্ষেত্রে প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের পরিবর্তে ’জ্বী-হুজুর’ ধরনের খেলোয়াড় বাছাইয়ের অভিযোগও ছিল তার বিরুদ্ধে। ২০০২ বিশ্বকাপের নায়ক হাকান সুকুরকে বাদ দেওয়ার ব্যাপারটা ঐ বিতর্কের আগুনে আরো বেশি ঘি ঢেলেছিল।

তবে টুর্নামেন্টে তুরস্কের শুরুটা তেমন ভালো হয়নি, নিজেদের প্রথম ম্যাচেই পর্তুগালের কাছে ২-০ ব্যবধানে হেরে যায় তারা। তবে এরপরই নিজেদের ফিরে পায় তারা। দ্বিতীয় ম্যাচে সুইজারল্যান্ডকে ২-১ ব্যবধানে পরাজিত করে তুরস্ক, তবে ম্যাচের ফলাফল বা ব্যবধানের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল তুরস্কের জয়ের ধরনটা। নিশ্চিত ড্রয়ের দিকে এগোতে থাকা ম্যাচের বিরানব্বইতম মিনিটে গোল করে নায়ক হয়ে যান আর্দা তুরান, তুরস্কও পেয়ে যায় নিজেদের ‘ট্রেডমার্ক’ ব্যাপারটা, শেষ পর্যন্ত লড়াই করে ম্যাচ জিতে নেওয়া। তবে আসল নাটক তখনও বাকি, আসলে সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষের ম্যাচটাকে বড়জোর ‘ট্রেলার’ বলা চলে।

চেক প্রজাতন্ত্রের বিপক্ষে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় অনুষ্ঠিত গ্রুপপর্বের শেষ ম্যাচটা ছিল তুরস্কের জন্য বাঁচামরার ম্যাচ। ওদিকে পর্তুগাল আগেই গ্রুপের শীর্ষস্থান নিশ্চিত করায়, এবং তুরস্ক ও চেক প্রজাতন্ত্র দুই দলেরই সমান পয়েন্ট এবং গোল ব্যবধান থাকার ফলে এই ম্যাচটা ছিল পরের রাউন্ডে ওঠার সুবর্ণ সুযোগ। জয়-পরাজয়ের বদলে এই ম্যাচটা অমীমাংসিতভাবে শেষ হলে কোয়ার্টার ফাইনালের জন্য যোগ্যতর দল বেছে নেওয়া হতো টাইব্রেকারে। 

বাঁচামরার এই ম্যাচের ঘণ্টা পেরোতে না পেরোতেই তুরস্ক পিছিয়ে পড়ে ২-০ ব্যবধানে। চেক প্রজাতন্ত্রের জেরোস্লাভ প্লাসিল মাত্রই দলের দ্বিতীয় গোলটা করেছেন, ম্যাচের মাত্র ত্রিশ মিনিট বাকি, তুরস্কের ফুটবলাররা হয়তো নিজেদের বিদায়ঘণ্টাটা শুনতে পাচ্ছিলেন। সেই ঘণ্টাধ্বনিই যেন তাঁদের ‘ঘুম’ ভাঙালো, ৭৫তম মিনিটে আর্দা তুরানের গোলে কমলো ব্যবধান। তবে নাটকের শেষ অঙ্ক তখনও বাকি।

ম্যাচের নির্ধারিত সময়ের পাঁচ মিনিট বাকি, ২-১ ব্যবধানে এগিয়ে থাকা চেক প্রজাতন্ত্র ততক্ষণে পরের রাউন্ডে এক পা দিয়ে রেখেছে। এমনই এক সময়ে ডান প্রান্ত থেকে উড়ে আসা ক্রসটা ঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণে নিতে ব্যর্থ হলেন চেক প্রজাতন্ত্রের গোলরক্ষক পিটার চেক, তার হাত ফসকে বল পড়লো তুরস্কের ফরোয়ার্ড নিহাত কাহভেচির ঠিক সামনে। রুপোর থালায় পরিবেশিত সুস্বাদু খাবারটা হাতছাড়া করেননি নিহাত, সহজেই বল পাঠালেন জালে। সমতায় ফেরা ম্যাচটা তখন এগোচ্ছে টাইব্রেকারের দিকে, কিন্তু নিহাতের কারিশমা তখনও শেষ হয়নি। দুই মিনিটের মধ্যে আবার তাঁর পায়ের জাদু, আর তাতেই সমতায় ফেরার ‘দুঃখ’টা তখনও সামলে না ওঠা চেক প্রজাতন্ত্রের সমর্থকেরা অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করলেন, বল আবারও জড়াচ্ছে জালে।

নিহাত কাহভেচির গোলে প্রত্যাবর্তনের অবিশ্বাস্য গল্প লিখলো তুরস্ক; Image Source: Getty Images

ম্যাচে প্রথমবারের মতো পিছিয়ে পড়া চেক প্রজাতন্ত্রের হাতে হয়তো সমতায় ফেরার মতো সময় ছিল, অহেতুক মারামারিতে জড়িয়ে তুরস্কের নিয়মিত গোলরক্ষক ভলকান দেমিরাল লাল কার্ডও দেখেছিলেন, কিন্তু এই রাতটা চেকদের ছিল না। জেনেভার ঐ তারাভরা রাতটা ছিল শুধুই তুর্কিদের, তাই ইউরোর ইতিহাসের অন্যতম সেরা প্রত্যাবর্তনের গল্প লিখে ৫০ বছরের মধ্যে প্রথমবার তাঁরা পরাজিত করলো চেক প্রজাতন্ত্রকে, আর তাতে কোয়ার্টার ফাইনালে ক্রোয়েশিয়ার প্রতিপক্ষ হিসেবে নাম লেখা হয়ে গেলো তুরস্কের।

গ্রুপ বি

সুইজারল্যান্ডের মতো টুর্নামেন্টের আরেক স্বাগতিক দল অস্ট্রিয়াও শুরু করেছিল দর্শকদের প্রবল উদ্দীপনা আর সমর্থনের মধ্য দিয়ে। কিন্তু দুই দলের খেলোয়াড়দের সামর্থ্যের ব্যবধান যদি থাকে অনেক বেশি, দর্শকদের উৎসাহে ঐ ব্যবধান কতটা-ই বা কমতে পারে! অস্ট্রিয়ার ক্ষেত্রেও সেটা হয়নি স্বাভাবিকভাবেই, ভিয়েনায় টুর্নামেন্টে নিজেদের প্রথম ম্যাচের দ্বিতীয় মিনিটেই প্রতিপক্ষ ক্রোয়েশিয়াকে পেনাল্টি উপহার দেন অস্ট্রিয়ার রেনে আউফহসার। পেনাল্টি থেকে গোল করে ১৮ বছর পরে কোনো বড় টুর্নামেন্ট খেলতে নামা অস্ট্রিয়ার সমর্থকদের উৎসাহে শুরুতেই জল ঢেলে দেন মিডফিল্ডার লুকা মদরিচ।

মদরিচের গোলে ক্রোয়েশিয়ার শুভসূচনা; Image Source: Getty Images

এমনিতেই দল হিসেবে সামর্থ্যের ঘাটতি আছে, তার ওপর টুর্নামেন্টের শুরুতেই পিছিয়ে পড়া – এই দুইয়ের ধাক্কা আর কাটিয়ে উঠতে পারেনি অস্ট্রিয়া। পোল্যান্ডের সাথে অতিরিক্ত সময়ে পেনাল্টি থেকে গোল করে একটা পয়েন্ট অর্জন করেছিল বটে, শেষ ম্যাচে জার্মানিকে হারাতে পারলে কাগজে-কলমে পরের রাউন্ডে যাওয়ার একটা সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছিল, কিন্তু ফ্রি-কিক থেকে মাইকেল বালাকের অসাধারণ গোলে উবে যায় সেই সম্ভাবনা।

অস্ট্রিয়া-জার্মানির ঐ ম্যাচটা আরো এক কারণে বিখ্যাত। ঐ ম্যাচের দুই দলের দুই ম্যানেজার একসাথে লাল কার্ড দেখেছিলেন, এবং ডাগআউট থেকে গ্যালারির দিকে পা বাড়ানোর পথে দুই ম্যানেজার, জোসেফ হিকারসবার্গার আর জোয়াকিম লো, করেছিলেন ‘হাই ফাইভ’।

লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়ছেন দুই ম্যানেজার; Image Source: Xinhua/Reuters Photo

অন্য দিকে, প্রথম ম্যাচে অস্ট্রিয়াকে হারালেও দ্বিতীয় ম্যাচে জার্মানিকে হারানোর মাধ্যমেই মূলত সবার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে ক্রোয়েশিয়া। ডাগআউট থেকে কোচ স্লাভেন বিলিচের দারুণ দিকনির্দেশনা আর মাঠে ক্রোয়াট খেলোয়াড়দের অসাধারণ নৈপুণ্যে পাত্তাই পায়নি জার্মানরা। শেষ পর্যন্ত ফলাফলটা ক্রোয়েশিয়ার অনুকূলে ২-১ হলেও এই ব্যবধানটা আরো বড় হতেই পারতো। এরপর অস্ট্রিয়া আর জার্মানির পরে তৃতীয় ম্যাচে পোল্যান্ডকে পরাজিত করে শতভাগ জয়ের রেকর্ড নিয়েই কোয়ার্টার ফাইনালে নিজেদের নাম লেখায় ক্রোয়েশিয়া।

গ্রুপ সি

ইতঃমধ্যেই বলা হয়েছে, দুই স্বাগতিক দল সুইজারল্যান্ড ও অস্ট্রিয়া বিদায় নিয়েছে এই টুর্নামেন্ট থেকে। তবে শুধু দুই স্বাগতিক দল নয়, ঐ ইউরোর প্রথম রাউন্ড থেকে বাদ পড়া দলগুলোর মধ্যে আরো ছিল দারুণ প্রতিভাধর দল ফ্রান্স। দুর্দান্ত আর প্রাণবন্ত খেলার উৎসবের মধ্যে কোচ রেমন্ড ডমেনেখের ফ্রান্স দলের খেলাতে প্রথম থেকেই একটা সুর-তালের অভাব বোধ হচ্ছিল, যার ফলাফল গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায়।

জিনেদিন জিদানের অবসরের সাথে সাথে ফ্রান্সও যেন তাদের সেরা ফর্মটাকে অবসরে পাঠিয়ে দিয়েছিল, দল হিসেবে তাদের মোটেই অনুপ্রাণিত মনে হচ্ছিল না। থিয়েরি অঁরির মতো প্রতিভাবান খেলোয়াড়কেও এই দলে মনে হচ্ছিল শুধুই ‘অপচয়’।

প্রথম ম্যাচে রোমানিয়ার সাথে গোলশূন্য ড্রয়ের পর ফ্রান্স হেরে যায় নেদারল্যান্ড আর ইতালির বিপক্ষে, তিন ম্যাচে সবেধন নীলমণি হয়ে ছিল নেদারল্যান্ডের বিপক্ষে অঁরির ঐ সান্ত্বনাসূচক গোলটাই। আর শুধু গ্রুপপর্ব থেকে বাদ যাওয়ার কারণেই নয়, ফ্রান্সের জন্য পুরো ব্যাপারটাই আরো বেশি বাজে দেখাচ্ছিল কোচ ডমেনেখ প্রেমিকাকে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার জন্য ফ্রান্সের বিদায়ের পরে ম্যাচ-পরবর্তী সাক্ষাৎকারের সময়টাকে বেছে নেওয়ায়।

থিয়েরি অঁরির এই হতাশা যেন পুরো টুর্নামেন্টে ফ্রান্সেরই প্রতিচ্ছবি; Image Source: Allsport

তবে ফ্রান্স বিদায় নিলেও গ্রুপপর্বে শতভাগ জয় নিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেছিল নেদারল্যান্ড। ফ্রান্স, ইতালি আর রোমানিয়ার সাথে ‘গ্রুপ অব ডেথ’-এ অবস্থান করলেও ডাচদের তারকাবহুল দলটা পাত্তা দেয়নি কাউকেই। প্রথম ম্যাচে ‘অলস’ ইতালির বিপক্ষে রুড ফন নিস্তলরয়, ওয়েসলি স্নেইডার আর ফন ব্রঙ্কহর্স্টের গোলে ৩-০ ব্যবধানে জয় পায় নেদারল্যান্ড, সাথে নিজেদের যেন ঘোষণা করে শিরোপার অন্যতম দাবিদার হিসেবে।

পরের ম্যাচে ডাচরা আরো ভয়ঙ্কর, তর্কসাপেক্ষে টুর্নামেন্টের সেরা পারফরম্যান্স দিয়ে ফ্রান্সকে উড়িয়ে দিলো ৪-১ ব্যবধানে। এর মধ্যে রবিন ফন পার্সির গোলের বিল্ড-আপটা নিয়মিত ফুটবল-দর্শকদের চোখে লেগে থাকার কথা, বিশেষ করে মাঝমাঠে পায়ের কারুকাজ দেখিয়ে রুড ফন নিস্তরলয় যেভাবে প্রতিপক্ষের তিনজন খেলোয়াড়ের মধ্যে থেকে বল বের করে পাস দিয়েছিলেন আরিয়েন রোবেনকে। এরপর বাঁ প্রান্ত ধরে রোবেনের অসাধারণ দৌড়, আর ফন পার্সির ফিনিশিং।

নেদারল্যান্ডসের এই অসাধারণ পারফরম্যান্সের ধারা বজায় ছিল গ্রুপের শেষ ম্যাচেও, যেখানে রোমানিয়াকে তারা পরাজিত করে ২-০ ব্যবধানে। তিন ম্যাচে তিন জয় নিয়ে নেদারল্যান্ডস পৌঁছে যায় কোয়ার্টার ফাইনালে, যেখানে তাদের প্রতিপক্ষ ছিল রাশিয়া।

ফ্রান্সের বিপক্ষে গোল করেছিলেন নেদারল্যান্ডের রবিন ফন পার্সি; Image Source: Getty Images

অপরদিকে, প্রথম দুই ম্যাচে যথাক্রমে নেদারল্যান্ডস ও ইতালির বিপক্ষে জয়বঞ্চিত ইতালি ঠিকই ফ্রান্সের বিপক্ষে তুলে নেয় ২-০ ব্যবধানের জয়। আন্দ্রে পিরলো আর ড্যানিয়েল ডি রসির গোলে এক জয় আর এক ড্র নিয়েই পরের রাউন্ডে উঠে যায় আজ্জুরিরা।

গ্রুপ ডি

রাশিয়া টুর্নামেন্টটা শুরু করেছিল তাদের সবচেয়ে বড় তারকা আন্দ্রেই আরশাভিনকে ছাড়াই। ইউরোর বাছাইপর্বের শেষ ম্যাচে, যে রাতে ওয়েম্বলিতে ক্রোয়েশিয়ার কাছে হেরে ইউরোতে খেলার স্বপ্ন ধূলিস্মাৎ হয়ে গিয়েছিল, অ্যান্ডোরার বিপক্ষে ১-০ ব্যবধানে জয়ের ম্যাচে লাল কার্ড দেখে মাঠ ছেড়েছিলেন আরশাভিন। এর ফলাফল হিসেবে পরের দুই ম্যাচ, অর্থাৎ ইউরোর প্রথম দুই ম্যাচে নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ার দলে ছিলেন না আরশাভিন।

ইউরোতে আরশাভিন-বিহীন রাশিয়ার শুরুটা হয়েছিল সম্ভাব্য সবচেয়ে বাজে উপায়ে। প্রথম ম্যাচে ডেভিড ভিয়া হ্যাটট্রিক করেছিলেন, এর সাথে সেস ফ্যাব্রিগাসের গোলে স্পেনের কাছে রাশিয়া উড়ে গিয়েছিল ৪-১ ব্যবধানে। দ্বিতীয় ম্যাচে কন্সটান্টিন জিরিয়ানোভের গোলে গ্রিসকে পরাজিত করলে শেষ ম্যাচের আগে রাশিয়ার সামনে দাঁড়ায় একটি পরিষ্কার সমীকরণ – হয় সুইডেনকে পরাজিত করো, নয়তো বিদায় নাও টুর্নামেন্ট থেকে। আগের দুই ম্যাচে সমান সংখ্যক জয়-পরাজয় নিয়েও প্রতিপক্ষ সুইডেনের জন্য অবশ্য সমীকরণটা একটু সহজ ছিল, এই ম্যাচের ফলাফল ‘ড্র’ হলে গোল ব্যবধানের কারণে সেটা তো আদতে সুইডেনের জয়ই!

জয়টা অবশ্য সুইডেনের পাওয়া হয়নি। আরশাভিনের প্রত্যাবর্তনে উজ্জীবিত রাশিয়া ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল প্রথম মিনিট থেকেই, এরপর ঐ আরশাভিনের গোলটাই সুইডেনের জন্য এসেছে কফিনের শেষ পেরেক হিসেবে। ২-০ ব্যবধানের জয়ে গ্রুপ রানার্স-আপ হিসেবে রাশিয়া উঠে যায় কোয়ার্টার ফাইনালে। ওদিকে সুইডেনের মতো হতাশা নিয়ে ফিরতে হয়েছিল ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন গ্রিসকেও, তিনটা ম্যাচ থেকে কোনো পয়েন্টের দেখা পায়নি অটো রেহাগেলের দলটি।

ডেভিড ভিয়ার হ্যাটট্রিকে রাশিয়াকে উড়িয়ে দেয় স্পেন; Image Source: Getty Images

ঐ একই গ্রুপের সেরা দলটার নাম স্পেন, অনুমিতভাবেই। প্রথম ম্যাচে ভিয়ার হ্যাটট্রিকে রাশিয়াকে ৪-১ ব্যবধানে উড়িয়ে দেওয়া, এরপর সুইডেন আর গ্রিসকে ২-১ ব্যবধানে পরাজিত করা, স্পেনের কোয়ার্টারে ওঠার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি কেউই। দ্বিতীয় ম্যাচে সুইডেনের স্লাতান ইব্রাহিমোভিচের দুর্দান্ত গোলটা হয়তো ড্রয়ের সম্ভাবনা জাগিয়েছিল, কিন্তু অতিরিক্ত সময়ে ভিয়ার গোলে মুছে যায় সেই সম্ভাবনা। তৃতীয় ম্যাচেও ক্যারিস্টেসের গোলে গ্রিস এগিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু ৬১ মিনিটে রুবেন গুতিয়েরেজ আর শেষ মুহূর্তে ড্যানিয়েল গুইজার গোলে ম্যাচটা জিতে নেয় স্পেন, সাথে সাথে কোয়ার্টার ফাইনালে ইতালির প্রতিপক্ষ হিসেবেও নিজেদের নামটা নিশ্চিত করে ফেলে। আর সাথে সাথে সবার অলক্ষ্যেই যেন একটা ঘোষণাও ছুঁড়ে দেয় ফুটবলবিশ্বের উদ্দেশ্যে, “আগামী পাঁচ বছরে, মহাদেশীয় ও বৈশ্বিক শিরোপাগুলো উঠবে শুধু আমাদের গলাতেই!”

This article is in Bangla Language. It is about the group stage of the European Championship 2008. Necessary pictures are attached inside the article.

Featured Image: Lars Baron/Bongarts

Necessary Source: These Football Times

Related Articles