Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

টিকি-টাকা : কখন কীভাবে এখানে

২০০৮ থেকে ২০১২ সময়টা স্বপ্নের মতোই কেটেছিলো বার্সেলোনার। এই ৪ মৌসুমে সম্ভাব্য ১৯টির ১৪টি শিরোপাই যে ঘরে তুলেছিলো কাতালানরা! পেপ গার্দিওলার অধীনে বার্সেলোনা যেন হয়ে উঠেছিলো ভিনগ্রহের এক দল, যাদের ফুটবল স্টাইল টিকি-টাকার সামনে অসহায় ছিল বাকি দলগুলো। পেপ গার্দিওলার বার্সেলোনা টিকি-টাকা খেলতো প্রায় নিখুঁতভাবে, এজন্য অনেকেই ভেবে নেন এই স্টাইলের জনক হয়তো এই টেকো ভদ্রলোকই। কিন্তু আসলেই কি তাই?

না, আসলে ব্যাপারটা সেরকম কিছু না। পেপ গার্দিওলা কেবলমাত্র তার নিজের খেলোয়াড়ি জীবনে পাওয়া শিক্ষাকেই নিখুঁত করেছেন, যে শিক্ষা তিনি পেয়েছিলেন এক ডাচ কিংবদন্তির থেকে। টিকি-টাকার আবিষ্কারক এই ডাচ শিক্ষকই, তার নাম ইয়োহান ক্রুইফ।

ক্রুইফ কবে এবং কীভাবে টিকি-টাকা তৈরি করেছিলেন সেই গল্প শোনার আগে আরও দুটো গল্প শুনতে হবে। একটা টোটাল ফুটবলের, অন্যটা ট্যাঙ্গোর।

টোটাল ফুটবল : যা বদলে দিয়েছিলো অনেক কিছুই

রাইনাস মিশেলস ও ক্রুইফ ; Image Source : Mundbol

টোটাল ফুটবল স্টাইলটা যদিও বিখ্যাত হয়েছে আয়াক্স ও নেদারল্যান্ডস জাতীয় দলের বদৌলতে, এই স্টাইলের অনুরূপ স্টাইল দেখা গিয়েছিলো বিখ্যাত দু’টি দলে। প্রথমটি ত্রিশের দশকের অস্ট্রিয়ান ওয়ান্ডার টিমে, যে দলে প্রথমবারের মতো ‘ফলস নাইন’ হিসেবে দেখা যায় ম্যাথিয়াস স্টিন্ডেলারকে। অন্য দলটি হলো পুসকাস, ককসিস, হিদেকুটিদের বিখ্যাত হাঙ্গেরি দল, ‘ম্যাজিকাল ম্যাগিয়ার্স’। উল্লেখ্য, এই দু’টি দলই মূলত ট্র‍্যাডিশনাল নাম্বার নাইনের বদলে ব্যবহার করতো ‘ফলস নাইন’।

কিন্তু টোটাল ফুটবলকে পারফেকশন প্রদান করেন আয়াক্সের কালজয়ী জুটি – রাইনাস মিশেলস এবং ইয়োহান ক্রুইফ। মিশেলস মাঠের বাইরে থেকে খেলার উপায় বাতলাতেন, ক্রুইফ সেটা মাঠে করে দেখাতেন। ক্রুইফকে নিয়ে অন্যান্য দলের কোচরা বেশ বিরক্ত ছিলেন, জিনিয়াসদের নিয়ে অবশ্য সবাই তাই থাকে। কিন্তু ক্রুইফের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ছিলো আলাদা, ক্রুইফ নাকি মাঠে দাঁড়িয়েই প্রতিপক্ষের কৌশলের সমাধান বের করে ফেলতেন!

‘টোটাল ফুটবল’ ট্যাকটিক্সে দল শুরু করতো ৪-৩-৩ ফর্মেশনে। ম্যাচ শুরুর পর তারা কিছুটা বদলে রূপ নিতো ৩-৪-৩ ডায়মন্ড ফর্মেশনে, এর ফলে তারা মাঝমাঠে একজন বেশি খেলোয়াড় পেতো। তখনকার দিনে অধিকাংশ দলই শুরু করতো ৪-৪-২ ফর্মেশনে, যার ফলে ৩-৪-৩ এ শিফট করার পর মাঝমাঠ দখল করতে সুবিধা হতো। কিন্তু টোটাল ফুটবল খেলা আয়াক্স বা নেদারল্যান্ডসের মূল শক্তির জায়গা মোটেও এটি ছিলো না।

পজিশন পরিবর্তনের সাথে যেকোনো ফুটবল দর্শকই পরিচিত, প্রায়ই আমরা দেখি একজন আরেকজনের পজিশন খালি দেখলে সেখানে গিয়ে সেই ফাঁকা জায়গা পূরণ করে। কিন্তু অধিকাংশ সময়ই দেখা যায় এই মুভমেন্টগুলো উল্লম্ব বা আনুভূমিক। যেমন লেফট ব্যাকের পজিশনে আসছেন লেফট উইঙ্গার, কিংবা সেন্টার ব্যাক সরে যাচ্ছেন রাইটব্যাকের পজিশনে। এখানেই ছিলো টোটাল ফুটবলের আসল কারিশমা।

আয়াক্স এবং নেদারল্যান্ডস দল দুটোর প্রতিটি আউটফিল্ড খেলোয়াড় ছিলেন যেকোনো পজিশনে খেলতে সক্ষম। এর ফলে উল্লম্ব বা আনুভূমিক পজিশন সোয়াপের পরিবর্তে তারা এমন সব পজিশন সোয়াপ করতেন, যেগুলো মার্ক করা ছিল অসম্ভব। যেমন লেফটব্যাক চলে যাচ্ছেন রাইট উইংয়ে, ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার লেফট উইংয়ে, স্ট্রাইকার রাইটব্যাকে! সাথে ক্রুইফ ছিলেন ‘ফলস নাইন’ হিসেবে, যিনি নাম্বার নাইন হিসেবে ম্যাচ শুরু করলেও নিচে নেমে আসতেন। কিন্তু তাকে মার্ক করা ডিফেন্ডাররা তাদের নিজেদের জায়গা ছাড়তে রাজি ছিল না, ফলে প্রতিপক্ষ অর্ধের খুবই বিপজ্জনক এলাকায় অনেকখানি জায়গা পেয়ে যেতেন ক্রুইফের মতো জিনিয়াস। বাকিটা বলার দরকার আছে কি?

টোটাল ফুটবলের আরেকটি ভয়ংকর বিষয় ছিলো এটির প্রেসিং। বর্তমান ফুটবলে প্রেসিং হয় ‘ম্যান-ওরিয়েন্টেড’, অথবা ‘জোন ওরিয়েন্টেড’। কিন্তু মিশেলসের দল যা করতো, তা হলো বল-ওরিয়েন্টেড প্রেসিং।

পাড়ার ফুটবল দেখেছেন কখনও? যে জায়গায় বল, সেই জায়গায় দুই দলের সবাই জড়ো হচ্ছে বল দখল করতে, গোল কোনদিকে করতে হবে থোড়াই কেয়ার! আয়াক্স এবং নেদারল্যান্ডস দলের প্রেসিংও ছিল অনেকটা এরকম, প্রতিপক্ষের যেই খেলোয়াড়ের পায়ে বল, তার দিকে ৪-৫ জন একই সাথে ধেয়ে যেতেন। এর ফলে লাভ হতো দু’টি। প্রথমত, সেই খেলোয়াড়ের প্রায় সব পাসিং লেন ব্লকড হয়ে যেত। দ্বিতীয়ত, প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়ের উপর মানসিক চাপ পড়তো প্রচন্ড, যার ফলে বল হারাতে বাধ্য হতেন তিনি।

এভাবেই রাইনাস মিশেলস ও ইয়োহান ক্রুইফ মিলে তৈরি করেছিলেন ভয়ংকর এক স্টাইল; যার জোরে আয়াক্স জিতেছিলো টানা তিনটি ইউরোপিয়ান কাপ, আর নেদারল্যান্ডস পৌঁছে গিয়েছিলো টানা দু’টি বিশ্বকাপ ফাইনালে। ১৯৭৪ এর পিপলস চ্যাম্পিয়নও ছিলো ডাচরাই, কিন্তু জার্মানদের কড়া ম্যান মার্কিংয়ে আটকে ফাইনালে হার মানতে বাধ্য হয় তারা।

ট্যাঙ্গো : ফুটবল নাকি নাচ?

ট্যাঙ্গো নাচের নাম শুনেছেন? ধীরস্থির ছোট ছোট মুদ্রায় শুরু হয়, ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে গতি। একসময় এতটাই দ্রুত হয়ে যায় যে দর্শকেরা সৌন্দর্যে সম্মোহিত হয়ে পড়েন, চোখে ফেরাতে পারেন না। এই নাচের জন্ম আর্জেন্টিনা ও উরুগুয়ের সীমান্ত এলাকা রিভারপ্লেটে, যেখানকার মানুষের রক্তে ফুটবল। তাই এই নাচ মঞ্চ থেকে ছড়িয়ে গেলো মাঠের সবুজ ঘাসে, আর্জেন্টিনা এবং উরুগুয়ের ফুটবলে।

ট্যাঙ্গো ফুটবল স্টাইলে বিল্ডআপ শুরু হয় খুব ধীর ছোট ছোট পাস দিয়ে, যেগুলো একদমই নিরীহদর্শন। সময়ের সাথে সাথে বাড়তে থাকে পাসিংয়ের গতি, ঠিক যেমন বাড়তে থাকে নাচের মুদ্রার গতি। এই দ্রুত লয়ের পাসের মধ্যে হঠাৎ একটি পাস খেলা হয় প্রতিপক্ষের বক্সের সামনে অপারেট করতে থাকা অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার বা নাম্বার টেনকে। ব্যস, কেল্লাফতে!

এই দ্রুতলয়ের ফুটবলে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন দুই ফুলব্যাক, কারণ ট্যাঙ্গোর এই যে ছোট ছোট পাস, এগুলো শুরু হতো দুই উইং ধরে, অন্যান্য পাসিং স্টাইলের মত সেন্টার অফ দ্য পিচ দিয়ে না। দুই ফুলব্যাক পাস খেলতে খেলতে বারবার নিজেরা মাঝখানে এসে উইঙ্গারদের ওয়াইডে চেপে মার্কারদের সেন্টার অফ দ্য পিচ থেকে সরিয়ে দিতেন, যার ফলে প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ফাঁকা জায়গা পেয়ে যেতেন দলের সবচেয়ে দক্ষ ও বিপদজনক খেলোয়াড়। যতক্ষণে প্রতিপক্ষ এই দ্রুত ওয়ান টাচ পাসিং এর মর্মোদ্ধার করতো, ততক্ষণে যা সর্বনাশ হবার তা হয়ে গেছে।

এই ট্যাঙ্গোর জোরেই প্রথম ফুটবল বিশ্বকাপে ফাইনাল খেলে উরুগুয়ে ও আর্জেন্টিনা, যেখানে ৪-২ গোলে প্রথম বিশ্বকাপটা নিজেদের করে নেয় উরুগুয়ে। সময়ের সাথে উরুগুইয়ানরা এই স্টাইল ত্যাগ করলেও আর্জেন্টাইন ফুটবলের ডিএনএ তে মিশে গেছে এই ট্যাঙ্গো, মেনত্তি বলুন কিংবা বিয়েলসা, সবার খেলানোর স্টাইলেই ট্যাঙ্গো প্রচ্ছন্ন।

টিকি-টাকার জন্ম

বার্সেলোনার ম্যানেজার হিসেবে ; Image Source : L’Equipe

বার্সেলোনার সাথে ক্রুইফের সম্পর্কের শুরু ১৯৭৩ সালে, যখন ট্রান্সফার ফি এর বিশ্বরেকর্ড গড়ে আয়াক্স থেকে বার্সেলোনায় যোগ দেন এই ডাচ তারকা। বার্সেলোনায় এসে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রিয়াল মাদ্রিদকে তাদেরই মাঠে উড়িয়ে দেন ৫-০ গোলে, বহু বছর পর ১৯৭৪ সালে কাতালোনিয়ায় নিয়ে আসেন লিগ শিরোপা। ১৯৭৮ সালে ক্লাব ছাড়েন। এরপর ১৯৮৮ তে যখন কোচ হিসেবে ফিরে আসেন, বার্সেলোনার তখন ঘোর দুর্দশা।

ক্রুইফ ১৯৭৪ সালে লীগ জিতিয়ে যাবার পরে লিগ শিরোপা ধরা দিয়েছে মোটে একবার, অন্যদিকে রিয়াল মাদ্রিদ এর মধ্যে জিতেছে ৮টি লিগ শিরোপা। মাদ্রিদের এই প্রবল প্রতাপের জবাব হিসেবে বার্সেলোনা বোর্ড নিয়ে আসে ক্রুইফকে।

খেলোয়াড় থাকতেই ক্রুইফ বার্সেলোনা বোর্ডকে বলেছিলেন আয়াক্সের মত একাডেমি তৈরি করতে। কেননা ক্রুইফের মতে, যখন আপনি ছোটবেলা থেকেই কাউকে একটি নির্দিষ্ট স্টাইলে খেলাবেন, সে সেটায় আরও বেশি দক্ষ হয়ে উঠবে। ক্রুইফের এই পরামর্শ মোতাবেক ১৯৭৯ সালে চালু হয় বার্সেলোনার বিখ্যাত ফুটবল একাডেমি লা মাসিয়া, যেখান থেকে পরবর্তী সময়ে উঠে এসেছেন পেপ গার্দিওলা, আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা, জাভি হার্নান্দেজ, সার্জিও বুস্কেটস, জেরার্ড পিকে, কার্লোস পুয়োল, লিওনেল মেসির মতো খেলোয়াড়েরা।

কোচ হয়ে ক্রুইফ সময় নিলেন দুই বছর, এরপর জিতলেন টানা ৪ লিগ শিরোপা, সাথে বার্সেলোনাকে জেতালেন তাদের সর্বপ্রথম ইউরোপিয়ান কাপ (হালের চ্যাম্পিয়নস লিগ)। কীভাবে? নড়েচড়ে বসুন, টিকি-টাকার জন্ম ইতিহাস বলছি।

ক্রুইফ প্রথমত টোটাল ফুটবল ব্যবহার করতে চাইলেও দেখলেন যে, সেটা এই যুগে এসে সম্ভব না। অন্য কোন উপায় খুঁজে বের করা লাগতো, সেজন্য ক্রুইফ এক অবিশ্বাস্য কাজ করলেন। দুটো স্টাইলের ফিউশন ঘটালেন – টোটাল ফুটবল আর ট্যাঙ্গো।

টিকি-টাকার মূল ছিলো সেই টোটাল ফুটবলই, সাথে যোগ করা হয়েছিলো ট্যাঙ্গোর কিছু বৈশিষ্ট্য। টোটাল ফুটবলের মতই পজিশন সোয়াপিং চলতো, তবে এত বেশিও না। ট্যাঙ্গো থেকে মূলত এসেছিলো দুটি বিষয় – দ্রুত শর্ট পাসিং এবং ফুলব্যাকদের ব্যবহার করে সেন্টারে স্পেস ক্রিয়েশন। প্রেসিং করার ক্ষেত্রেও এসেছিলো বেশ কিছু পরিবর্তন, বলে চার্জ করার বদলে ক্রুইফের দল জোনাল মার্কিং করতো।

প্রথমত, ক্রুইফ ব্যবহার করলেন ৩-৪-৩ ডায়মন্ড ফর্মেশন। অদ্ভুতভাবে, ব্যাকলাইনের ৩ জনের দুই পাশের দুই জন প্রায়ই আক্রমণ উঠে যেতেন। টোটাল ফুটবলের গন্ধ পাচ্ছেন? এই সিস্টেমে মিডফিল্ডের চতুর্ভুজের নিচের অংশে খেলতেন পেপ গার্দিওলা, উপরে বাকেরো। ডায়মন্ড ফর্মেশনে পেপ গার্দিওলার জন্য বরাদ্দ সেন্টার সার্কেল ও তার আশেপাশের এলাকা, কেননা এখান থেকে মাঠের সব জায়গায় পাস দেওয়া তুলনামূলক সহজ ছিলো, পেপ গার্দিওলার সামনে খোলা থাকতো অসংখ্য পাসিং লেন। তাছাড়া টোটাল ফুটবল বা টিকি-টাকা, দুই ক্ষেত্রেই মাঠে একজন পরিচালক বা কন্ডাক্টর লাগে। রাইনাস মিশেলস এর আয়াক্স এবং নেদারল্যান্ডস দলে সেটা ছিলেন ক্রুইফ, ক্রুইফের এই দলে ছিলেন গার্দিওলা। এজন্যই গার্দিওলার সেন্টার অফ দ্য পার্কে অপারেট করা খুবই জরুরী ছিলো, কেননা তিনিই যে ছিলেন রিং মাস্টার! আর বাকেরো ঠিক স্ট্রাইকারের নীচে অপারেট করতেন, যার ফলে তাকে মার্ক করাটা ছিলো দুঃসাধ্য। এতেই বাকেরো লাইসেন্স পেয়ে যান, প্রায়ই বক্সে ঢুকে গোল করে বসেন।  সাথে ছিলো রোনাল্ড কোম্যানের মত সেট পিস স্পেশালিস্ট সেন্টার ব্যাক এবং লাউড্রপ স্টইচকভের মত ফরোয়ার্ড। ওয়েল, ড্রিম টিম বানাতে আর কি লাগে?

লাগে না বোধহয়, তাই এই দল নিয়েই ক্রুইফ তৈরি করে ফেলেছিলেন তার ড্রিম টিম, যেই দল জিতেছিলো টানা চার লিগ শিরোপা। সাথে তৈরি করে গিয়েছিলেন একজন উত্তরসূরী – যে তার সৃষ্টিকে নিয়ে গিয়েছিলো অন্য উচ্চতায়।

জুয়েগো ডি পজেসিয়ন : টিকি-টাকার পারফেকশন?

অভিষেক মৌসুমেই ট্রেবল জয়ের পর ; Image Source : Goal

২০০৮ সালে যখন ফ্রাঙ্ক রাইকার্ডের স্থলাভিষিক্ত হলেন পেপ গার্দিওলা, কাতালোনিয়ার অনেকেরই ভ্রু কুঁচকে গিয়েছিলো। গার্দিওলার যে বড় কোন ক্লাব সামলানোর অভিজ্ঞতা নেই! অন্যদিকে চাকরির দৌড়ে গার্দিওলার প্রতিদ্বন্দ্বী হোসে মরিনহো ছিলেন ইতোমধ্যেই চ্যাম্পিয়নস লিগ বিজয়ী, সাথে চেলসিকে লিগ জিতিয়েছেন দুইবার। স্রেফ ক্রুইফের উপর ভরসা করে বার্সেলোনা প্রেসিডেন্ট লাপোর্তা গার্দিওলাকে দায়িত্ব দেন। কিন্তু প্রথম দুই ম্যাচে বার্সেলোনা সংগ্রহ করে মাত্র ১ পয়েন্ট, আর তাতেই সমালোচনার তীর ছুটে আসতে থাকে সব দিক থেকে।

কিন্তু এরপরই যেন রূপকথার শুরু, বার্সেলোনা হয়ে পড়লো অপ্রতিরোধ্য। একে একে জিতে নেয় লীগ শিরোপা, এর মধ্যে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রিয়াল মাদ্রিদকে সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে ৬-২ গোলের অপমান দিয়ে আসে পেপ শিষ্যরা। সাথে এলো কোপা দেল রে, আর কফিনে শেষ পেরেকটা ঠুকলেন লিওনেল মেসি। চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে তার করা গোলেই লেখা হয়ে গেলো, ট্রেবল জিতেছে বার্সেলোনা। পরের মৌসুমে সেই রেকর্ডটা আরেকটু বেড়ে দাড়ালো হেক্সাতে, সম্ভাব্য ছয়টি ট্রফির সবগুলো জেতা একমাত্র দল হয়ে গেলো পেপ গার্দিওলার বার্সেলোনা। আরেকবার প্রমাণিত হলো, ইয়োহান ক্রুইফ ঠিক ছিলেন।

তো ঠিক কী করেছিলেন পেপ? ক্রুইফের টিকি-টাকাকে বেশ খানিকটা পরিবর্ধিত করেছিলেন এই সাবেক ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার। কিন্তু কীভাবে?

কিংবদন্তি ম্যানেজার আরিগো সাচ্চি একবার বলেছিলেন, ফুটবলের পরের পরিবর্তনটা হবে পুরো মাঠটাকে মাঝমাঠ বানিয়ে ফেলে। পেপ প্রাথমিকভাবে ইয়াইয়া তোরেকে সেন্টার ব্যাক খেলিয়ে সেটা কিছুটা পূরণ করেন। পরে ২০১০ এ মাশ্চেরানো ও ফ্যাব্রেগাস দলে আসলে ইনিয়েস্তাকে লেফট উইং ও মাশ্চেরানোকে সেন্টার ব্যাকে খেলিয়ে সম্পুর্ণভাবে পুরো মাঠটাকে মাঝমাঠ বানাতে সফল হন পেপ। সাথে প্রেসিং এ যোগ করেন ফাইভ সেকেন্ড রুল, অর্থাৎ বল হারানোর পাঁচ সেকেন্ডের ভেতর বল উদ্ধার করতে হবে। এছাড়াও তার দলের দুই ফুলব্যাক (আবিদাল ও আল্ভেস/পুয়োল) ছিলেন ফলস ফুলব্যাক, তারা ভিতরে ড্রিফট করে অনেকখানি জায়গা তৈরি করতেন। তবে পেপ গার্দিওলার আসল মাস্টারক্লাস ছিলো হাফ স্পেস এর ব্যবহার।

গার্দিওলা মাঠকে ভাগ করতেন এভাবে! ; Image Source : spielverlagerung

সাধারণত কোচেরা ফুটবল মাঠকে উল্লম্বভাবে ৬টি ও আনুভূমিকভাবে ৩টি অর্থাৎ মোট ১৮টি ভাগে ভাগ করেন। আক্রমণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধরা হয় জোন ১৪ কে, ঠিক প্রতিপক্ষের পেনাল্টি বক্সের বাইরের জোনকে। কিন্তু পেপ গার্দিওলা প্রথাগত জোন ব্যবহার না করে ব্যবহার করলেন হাফ স্পেস, তার হাফ স্পেসগুলো ছিলো জোন ১৩ ও ১৪ এর মধ্যে থাকা হাফ স্পেস, জোন ১৪ ও ১৫ এর মধ্যে থাকা হাফ স্পেস। এই হাফ স্পেস জিনিসটা কী? প্রতিটি জোন কভার করার জন্য একজন ডিফেন্ডার থাকেন, কিন্তু তাদের দুজনের মধ্যে খানিকটা খালি জায়গা থাকে, যেগুলো দুটো জোনের মধ্যেই পড়ে। এই খালি জায়গাগুলোকে বলে হাফ স্পেস। পেপ গার্দিওলা এই হাফ স্পেস ব্যবহার করে ধ্বস নামান প্রতিপক্ষের ডিফেন্সে। এই কাজে তার কন্ডাক্টর ছিলেন জাভি হার্নান্দেজ, সাথে তার হাতে ছিলো লিওনেল মেসি নামের এক মারাত্মক ফলস নাইন।

তবে এসব বাদ দিলে, গার্দিওলা তার সবচেয়ে বড় সাহায্যটা পেয়েছিলেন গুরু ক্রুইফের কাছেই। কারণ, পেপের সেই দলটা যে ছিল ‘লা মাসিয়া’নির্ভর! ভিক্টর ভালদেস, কার্লোস পুয়োল, জেরার্ড পিকে, সার্জিও বুস্কেটস, জাভি হার্নান্দেজ, আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা, সেস ফ্যাব্রেগাস, পেদ্রো রদ্রিগেজ এবং লিওনেল মেসি – এরা সবাই ছিলেন লা মাসিয়ার দীক্ষায় দীক্ষিত। ছোটবেলা থেকেই তারা ছিলেন পাসিং ফুটবলে অভ্যস্ত, যা তাদের সাহায্য করেছে প্রতিটি ক্ষেত্রেই। আর এভাবেই পারফেকশনিস্ট পেপ গার্দিওলা টিকি-টাকাকে দিয়েছিলেন তার দুর্দান্ত ফিনিশিং টাচ।

শেষ করবার আগে একটা গল্প বলি পেপ গার্দিওলার পারফেকশনের। ২০১১ চ্যাম্পিয়নস লীগের ফাইনাল চলছে ওয়েম্বলিতে, স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সাথে ৩-১ গোলে এগিয়ে বার্সেলোনা। এই সময় পেপ তার এক সহকারীকে ডাক দিয়ে জিজ্ঞাসা করেন,

‘আচ্ছা, তোমার কি মনে হয়, আমরা সবকিছু ঠিকভাবে করছি তো?’

গুরু শিষ্য ; Image Source : AS

পেপ গার্দিওলা মানুষটা এমনই, পারফেকশন খুঁজে বেড়ান সবখানে। তাই তো ক্রুইফের তৈরি করে যাওয়া প্লেয়িং স্টাইল টিকি-টাকাকে তিনি পূর্ণতা দেন। অনেকে অবশ্য সেই পারফেকশনের কদর করেন না, হয়তো বা তারা বোঝেন না, হয়তো পেপ আর ক্রুইফ চান না বোঝাতে। হয়তো পেপও তার গুরু ক্রুইফের মতো করেই বলেন,

‘যদি আমি চাইতাম তুমি বোঝো, তাহলে আমি আরও ভালোভাবে বোঝাতাম!’

This article is in Bangla language. It is an in-depth article on the invention and perfection of tiki-taka. 

Tiki-taka is one of the most famous styles of playing football. This was originally invented by Dutch legend Johan Cruyff and later perfected by Pep Guardiola. 

Feature Image: El Periodico

Related Articles