১.
"আমি ভুল সময়ে জন্মেছিলাম। আমার সময় তখনো আসে নি।
আমি ভুল বৃক্ষে ফুটেছিলাম। আমার বৃক্ষ কখনো অঙ্কুরিত হয় নি।
আমি ভুল নদীতে স্রোত হয়ে বয়েছিলাম। আমার নদী তখনো উৎপন্ন হয় নি।
আমি ভুল মেঘে ভেসে বেরিয়েছিলাম। আমার মেঘ তখনো আকাশে জমে নি।
হুমায়ূন আজাদ কাকে উদ্দেশ্য করে কবিতাখানা লিখে গিয়েছিলেন জানা যায়নি, তবে মুশফিকুর রহিম কিংবা মাহমুদউল্লাহ রিয়াদরা যে তার উৎসর্গকারীর তালিকায় ছিলেন না সে বেশ নিশ্চিত। তবুও, হুমায়ূন আজাদের মৃত্যুর বছর পনেরো পরে এ লেখা লিখতে গিয়ে মনে হলো, কবিতাটা যেন বাংলাদেশ দলকে উৎসর্গ করেই লিখে গিয়েছিলেন ওই কালজয়ী সাহিত্যিক।
খোলাসা করে বলাই শ্রেয়। বিশ্ব ক্রিকেটে যখন চলছে লেগ স্পিনারদের রমরমা কারবার, সে সময়ে বাংলাদেশ দল কি না হন্যে হয়ে হাতড়ে বেড়াচ্ছে একজন লেগ স্পিনার, লেগ স্পিনারদের সামলাতে গিয়ে পড়ছে মহা মুশকিলে, বাংলাদেশ যেন ক্রিকেট খেলছে ভুল সময়ে। তার চেয়ে বরং আব্দুল কাদির পূর্ব যুগটায় ক্রিকেট খেলাই ভালো হতো! ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, রিচি বেনোর অবসরের পরে আর আব্দুল কাদিরের আগমনের পূর্বে বেশ কিছুদিন লেগস্পিনারদের আকালই চলেছিল ক্রিকেটে। 'টাইম ট্রাভেল' করতে পারলে মন্দ হতো না!
কথাটা স্রেফ রসিকতা করেই বলা, বুদ্ধিমান পাঠককে তা নিশ্চয়ই আর বুঝিয়ে বলতে হবে না। তবে রসিকতার আড়ালে বাস্তব সত্যিটাও কিন্তু উন্মুক্ত এ কথাতেই। বাংলাদেশে লেগস্পিনার নেই, বাংলাদেশ লেগ স্পিন খেলতে পারে না!
২.
সর্বশেষ উদাহরণ তো একদম টাটকাই। দু'বার এলবিডব্লিউ বঞ্চিত হয়ে, একবার ফিল্ডার লোপ্পা ক্যাচ হাতছাড়া করে চার বানিয়ে দেয়ার পরেও বাংলাদেশের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম টি-২০ ম্যাচে যুজবেন্দ্র চাহাল রান দিয়েছেন মাত্র ২৪। উইকেটের ঘরে সংখ্যাটা '১' দেখালেও চুপিচুপি জিজ্ঞাসা করলে বাংলাদেশ দলের সব ক্রিকেটারই একমত হবেন, সংখ্যাটা তিন কিংবা চার হলেও অবাক হবার কিছু ছিল না!
শুধু যুজবেন্দ্র চাহালের পরিসংখ্যানেই থেমে যাওয়া কেন! তবে যে বাকিদের প্রতি অবিচারই হবে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশকে ভুগিয়েছেন তো কম-বেশি সব লেগ স্পিনারই। আফগানিস্তানের কাছে বিশাল হারের লজ্জা জুটেছিল রশিদ খানের ম্যাচে পাওয়া ১১ উইকেটের কারণেই, ক্ষয়িষ্ণু জিম্বাবুয়েও যে বাংলাদেশকে হারিয়ে অনেক বছরের মাঝে প্রথম টেস্ট জয়ের স্বাদ পেয়েছিল, সে তো অভিষিক্ত লেগ স্পিনার ব্রেন্ডন মাভুটার চার উইকেটেই। এরও আগে ভুগতে হয়েছিল আদিল রশিদের ঘূর্ণিতে, ইয়াসির শাহ কিংবা দেবেন্দ্র বিশুতে। এক রাশিদ খানই বাংলাদেশের বিপক্ষে তুলে নিয়েছেন ৩৩ উইকেট। উইকেট সংখ্যার চেয়ে গড়টাই বরং বিস্ময়কর, মাত্র ১২.৮৭!
৩.
এমন নয় যে, এ দুর্বিপাকে বাংলাদেশের পড়ে যাওয়াটা হুট করেই। টেস্ট ক্রিকেটের আঙিনায় ১৯ বছর কাটিয়ে দেবার পরেও একজন লেগ স্পিনার বাংলাদেশের জন্যে হয়ে রয়েছে সোনার হরিণই। এদেশের ক্রিকেট সিস্টেমটাই গড়ে উঠেছে এমনভাবে, লেগ স্পিনারদের উঠে আসবার ক্ষেত্রে যা কাজ করছে প্রধান অন্তরায় হয়ে। সাফল্য-বুভুক্ষু এ দেশ সবসময়ই ছুটেছে নগদ সাফল্যের খোঁজে। নইলে বাংলাদেশও তো লেগস্পিনার পেয়েছিল।
জুবায়ের হোসেন এদেশের ক্রিকেটে এসেছিলেন অসীম সম্ভাবনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে। চন্ডিকা হাথুরুসিংহে যাকে কেবলমাত্র নেটে বোলিং করতে দেখেই ডেকে নিয়েছিলেন জাতীয় দলে, এমনকি তাকে ২০১৫ বিশ্বকাপের বিমানে চড়াতে তৎকালীন প্রধান নির্বাচক ফারুক আহমেদের সঙ্গে হাথুরুসিংহের বিরোধের খবরও ক্রিকেট-পাড়ায় শোনা যায়। বিরাট কোহলির উইকেট নিয়ে সাড়া ফেলে যখন সময় কেবলই এগিয়ে যাবার, তখন ঘর থেকেই মুখোমুখি হয়েছিলেন সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতার। জাতীয় ক্রিকেট লিগ, ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ কিংবা বিপিএল, কোনোখানেই জায়গা না পেয়ে লিখন চলে যান অফ-ট্র্যাকে।
শুধু জুবায়েরই নন, লেগ স্পিনাররা রান বেশি দেয়, এ যুক্তিতে বেশিরভাগ প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচেই সুযোগ মেলে না লেগ স্পিনারদের। জুবায়ের হোসেন লিখন সর্বশেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছিলেন সেই ২০১৫ সালে, এরপরে ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলে যে নিজেকে তৈরি করবেন, পাননি সে সুযোগও। ২০১৯ সালে লিখন খেলেছেন মোটে এক ম্যাচ, তা-ও বিসিবির দাক্ষিণ্যে আফগানিস্তানের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচে। সময়কালটা যদি বিস্তৃত করে দেয়া যায় গত তিন বছরে, সংখ্যাটা বেড়ে দাঁড়ায় মাত্র সাতে। এমনকি যে আমিনুল ইসলাম বিপ্লবকে নিয়ে যুজবেন্দ্র চাহাল উচ্ছ্বাস ঝরিয়েছেন সংবাদ সম্মেলনে, ধারণা করেছিলেন অন্তত চল্লিশ-পঞ্চাশেক ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচ খেলে এসেছেন ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের মুখোমুখি হতে, সেই বিপ্লব প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে বল হাতে তুলে নিয়েছিলেন মাত্র এক ম্যাচে।
আর ঘরোয়া ক্রিকেটে লেগস্পিনারদের মুখোমুখি না হবার কারণে ব্যাটসম্যানরাও মুখ থুবড়ে পড়ছেন যেকোনো লেগ স্পিনারের সামনেই। তার ওপর বাংলাদেশের সাফল্যের অনেকটাই যাদের ব্যাটে লুকিয়ে, সেই মুশফিকু রহিম, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ কিংবা তামিম ইকবাল, লেগস্পিনের বিপক্ষে প্রত্যেকের দুর্বলতাই খুব স্পষ্ট। মুশফিক লেগ স্পিনারদের বলে উইকেট বিলিয়ে এসেছেন ১৮ বার, গড়টাও তার নামের পাশে বড্ড বেমানান, মাত্র ২২.৪৪। মাহমুদুল্লাহ আর তামিম ইকবালও লেগস্পিনারের বলে কাটা পড়েছেন যথাক্রমে ১৩ আর ১১ বার। আক্ষেপ আরও বাড়বে, যখন জানবেন, লেগ স্পিনের বিপক্ষে সবচেয়ে কমসংখ্যক বার আউট হয়েছেন সাকিব আল হাসান, ব্যাটিং গড়টাও চল্লিশ ছাড়িয়েছিলো তার ব্যাটেই।
৪
ক্রিকেট খেলাটা এ দেশে জলের চেয়েও সহজ। ক্রিকেট খেলে টাকা উপার্জন সহজ তার চেয়েও। ক্রিকেট খেলে দুবেলা দুমুঠো খেয়ে-পড়ে বাঁচতে চাইলে সব ভুলে বলটা বাঁহাতে তুলে নাও, টাকা এমনিতেই আসবে। বাংলাদেশে নাকি বাঁহাত ঘোরালেই টাকা আসে!
উপাত্তও তো এর স্বপক্ষেই যুক্তি দেয়। জাতীয় ক্রিকেট লিগের ২০১৯-২০ মৌসুমে এখন পর্যন্ত বল হাতে তুলে নিয়েছেন ২১ জন বাঁহাতি অর্থোডক্স স্পিনার। আট দলের লিগে সংখ্যাটা যথেষ্ট বেশি শোনালেও, বিগত আসরগুলোতে এ সংখ্যা ছিল আরও বেশি।
বিপরীতে, একমাত্র বিশেষজ্ঞ লেগ স্পিনার হিসেবে গতবছর জুবায়ের লিখন সুযোগ পেয়েছিলেন মাত্র দুই ম্যাচে। চট্টগ্রামের বিপক্ষে প্রথম ইনিংসে ৫ উইকেট পেলেও দ্বিতীয় ইনিংসে হাতে বল তুলতে অপেক্ষা করতে হয়েছিল ৬৬ ওভার অব্দি। জাতীয় দলের প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীন নান্নুর জোরাজুরিতে প্রস্তুতি ম্যাচের দলে জায়গা হয়েছিল একজন লেগস্পিনারের। বিসিবিকেও তাই বাধ্য হয়ে নিয়ম করতে হয়েছে, জাতীয় ক্রিকেট লিগের প্রতি দলে একজন লেগ স্পিনার খেলাতেই হবে! রিশাদ হোসেন, মিনহাজুল আবেদীন আফ্রিদি, জুবায়ের হোসেন লিখনের মতো লেগস্পিনাররা শেষ কয়েক বছরের মাঝে সবচেয়ে বেশি বোলিং করার সুযোগ পেয়েছেন এবারই।
বিসিবি লেগস্পিনের সমাধান খুঁজতে এতটাই মরিয়া হয়ে উঠেছে যে, বিপিএলের মতো টি-২০ টুর্নামেন্টের প্রতি দলে একজন লেগস্পিনার রাখা বাধ্যতামূলক করে দিয়েছে। এমন অদ্ভুতুড়ে সিদ্ধান্ত ইতোমধ্যেই সাকিব আল হাসানের অসন্তোষের কারণ হয়েছে।
সাকিব তার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। ঘরোয়া প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে তাদের তৈরি না করে ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট লিগে তাদের নামিয়ে দেয়ার তো কোনো মানে হয় না। বিসিবির এমন তড়িঘড়ি পদ্ধতিতে সাফল্য খোঁজার চিন্তা তাই প্রশ্নের মুখে পড়াটাই স্বাভাবিক।
৫
আমিনুল ইসলাম বিপ্লবের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক ঘটলো হুট করেই। বয়সভিত্তিক ক্রিকেটের মিডল-অর্ডার ব্যাটসম্যান মাত্র বছর খানেকের ব্যবধানে বনে গেলেন জাতীয় দলের বিশেষজ্ঞ লেগ স্পিনার, এমন উদাহরণ বিশ্ব ক্রিকেটেই বিরল। বিশেষ করে, বোলিংয়ের যে ধরনটা চিরকালই পেয়ে আসছে শিল্পের মর্যাদা, শেন ওয়ার্নের মতো স্পিনারকেও যে শিল্প ভালোভাবে রপ্ত করতে জাতীয় দলের বাইরে কাটাতে হয় বছর দুয়েক, সেখানে হুট করেই লেগস্পিনার বনে যাওয়া আমিনুল ইসলাম বিপ্লব লেগস্পিনারের সংকট থেকে বাংলাদেশকে কতটা মুক্ত করতে পারবেন, সে সংশয় থেকেই যায়।
সামনে টি-২০ বিশ্বকাপ, একজন লেগ স্পিনারকে দলে রাখলে বোলিং বৈচিত্র্য বাড়বে, এমন স্বল্পকালীন চিন্তায় বিপ্লবকে সুযোগ দেয়ার ক্ষেত্রে বিসিবিকে কিছুটা 'বেনিফিট অব ডাউট' দেয়াই যায়, কিন্তু লেগ স্পিনারদের থেকে দীর্ঘদিন সার্ভিস পেতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে এখনই।
সংকট থেকে উত্তরণের উপায়টা বিসিবিরও নিশ্চয়ই জানা। কিন্তু, ইচ্ছেটা আছে কি?
প্রিয় পাঠক, রোর বাংলার ‘খেলাধুলা’ বিভাগে এখন থেকে নিয়মিত লিখতে পারবেন আপনিও। সমৃদ্ধ করে তুলতে পারবেন রোর বাংলাকে আপনার সৃজনশীল ও বুদ্ধিদীপ্ত লেখনীর মাধ্যমে। আমাদের সাথে লিখতে চাইলে আপনার পূর্বে অপ্রকাশিত লেখাটি সাবমিট করুন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/
This article is in Bangla language. Bangladesh is in a hurry to find a leg spinner and is also in a need to combat foreign leg-spinners. This article is on that. Necessary hyperlinks are attached inside.
Feature image © Getty Images.