Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

কেমন গেল টোকিও অলিম্পিক ২০২০?

আতশবাজির ঝলকানি, চোখ-ধাঁধানো সমাপনি অনুষ্ঠান শেষে অলিম্পিক শিখা নিভে যাওয়ার মাধ্যমে পর্দা নামলো ২০২০ গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকের। ২০৪টি দেশের ১১ হাজারেরও বেশি অ্যাথলিটের কষ্ট, ত্যাগ, হতাশা, উৎকণ্ঠা, জয়ের উল্লাস এবং অশ্রুতে রচিত হয়েছে অনেক ইতিহাস। অনেক রেকর্ড ভেঙ্গেছে, অনেক রেকর্ড গড়েছে। অনেক কিংবদন্তীর উত্থান হয়েছে, জন্ম নিয়েছে আগামী দিনের অনেক তারকা।

কিন্তু এবারের অলিম্পিক আয়োজন নিয়ে ছিল অনেক সংশয়। করোনা মহামারির কারণে এক বছর পেছানোর পরও টোকিওতে করোনার প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়া, ঘূর্ণিঝড়, প্রচণ্ড তাপদাহ এবং টোকিওতে অলিম্পিকবিরোধী আন্দোলন এই সবকিছুই চোখরাঙানি দিয়ে উঠছিল। এত কিছুর মাঝেও সফলভাবেই ইতি টানাটা প্রাপ্তির চাইতেও বেশি কিছু ছিল। তো চলুন, এক নজরে দেখে নেয়া যাক, কী কী ঘটেছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রীড়াযজ্ঞের এই আসরে।

বাইরে বিক্ষোভের মাঝে দর্শকবিহীন উদ্বোধনী অনুষ্ঠান

উদ্ভোধনী অনুষ্ঠানের আতশবাজিতে আলোকিত জাপানের জাতীয় স্টেডিয়াম; Image source: LEE JIN-MAN | AP

অনেক বিতর্ক আর বাধা পেরিয়ে ২৩ জুলাই পর্দা ওঠে এবারের অলিম্পিক আসরের। সেই অনুষ্ঠান জাঁকজমক করতে চেষ্টার কোনো কমতি রাখেনি জাপান। এবারের মাসকট ছিল মিরাইতোয়া, যার অর্থ ‘চিরস্থায়ী আশা’। নিজেদের সংস্কৃতি তুলে ধরার পাশাপাশি আতশবাজি আর রঙ বেরঙের আলোর খেলা, সুর এবং নাচে তারা আমন্ত্রণ জানায় অ্যাথলিটদের। কিন্তু সে অনুষ্ঠান উপভোগ করতে ৬৮ হাজার দর্শক ধারণক্ষমতার সেই স্টেডিয়ামে কোনো সাধারণ দর্শক ছিল না। যে ৯৫০ জনের সুযোগ হয়েছিল স্টেডিয়ামে বসে এই অনুষ্ঠান উপভোগের, তারা সবাই বিভিন্ন দেশের কর্মকর্তা, আয়োজক কমিটি ও ভিআইপি।

জমকালো অনুষ্ঠানের সময় এভাবেই ফাঁকা ছিল পুরো স্টেডিয়াম; Image source: Reuters

ঐতিহ্যবাহী মার্চপোস্টে অংশ নিয়েছিল ২০৪টি দেশ এবং রিফিউজিদের নিয়ে গড়া রিফিউজি টিম। অনেক অ্যাথলেট মার্চপোস্টে অংশ না নেয়ায় এবারের দলগুলো আগের তুলনায় বেশ ছোট ছিল। তারাও নাচ, গান, উল্লাসের মাধ্যমে এক উৎসবের আবহাওয়া সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন। মার্চপোস্টে বাংলাদেশের পতাকা বহন করছিলেন সাঁতারু আরিফুল ইসলাম।

মার্চপোস্টে বাংলাদেশ Patrick Smith/Getty Images

এর আগে দ্বিতীয় ব্যাক্তি হিসেবে সম্মানজনক অলিম্পিক লরেল অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হন নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন তিনি।

অলিম্পিক লরেল ট্রফি হাতে ড. মুহাম্মদ ইউনূস; Image source: Dr. Muhammad Yunus

আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি জাপানকে ধন্যবাদ জানায় এই মহামারির মধ্যেও অলিম্পিক আয়োজনের জন্য। সেখানে জাপানের স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রতি সম্মানও প্রদর্শন করা হয়। অলিম্পিকের উদ্ভোধন করেন জাপানের সম্রাট নারুহিতো। আর অলিম্পিক শিখা প্রজ্বলন করেন টেনিস তারকা নাওমি ওসাকা।

প্রথম টেনিস তারকা হিসেবে অলিম্পিক শিখা প্রজ্বলনের গৌরব ওসাকার; Image source: Jamie Squire/Getty Images

ওদিকে স্টেডিয়ামের বাইরে ছিল অলিম্পিক বাতিলের জন্য আন্দোলন। টোকিওতে ক্রমাগত বেড়ে চলা করোনার সংক্রমণের মাঝে এমন বৈশ্বিক ক্রীড়ার আসর আয়োজনকে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত বলেন তারা।

স্টেডিয়ামের বাইরে টোকিওবাসির আন্দোলন; Image source: Reuters

কোভিড ঠেকাতে ছিল বেশ কিছু নতুন নিয়ম

প্রতিবার অলিম্পিকে ডোপ টেস্ট নিয়ে যতটা আলোচনা হতো, এবার সেটা হয়েছে কোভিড টেস্ট নিয়ে। নিয়ম ছিল: সকল অ্যাথলিট এবং কর্মকর্তাদেরই জাপানে পৌছানোর ৯৬ ঘন্টার মধ্যে দুইবার কোভিড টেস্ট করতে হবে। জাপানে পৌছানোর পর আবার এয়ারপোর্টেই হবে অ্যান্টিজেন টেস্ট। জাপানিজ অ্যাথলিটদের ৭২ ঘন্টার মধ্যেই একবার কোভিড টেস্ট করতে হবে। অলিম্পিক শুরুর পর প্রতিদিন টেস্ট তো আছেই।

ট্রেতে রাখা পদক নিজেদেরকেই নিতে হয়েছে; Image source: Olympics

বিজয়ীদের এবার নিজের পদক পরতে হয়েছে নিজেদেরকেই। তাছাড়া খাওয়া, অনুশীলন, ঘুমানো এবং মূল প্রতিযোগিতার সময় ছাড়া সবসময় মাস্ক পড়া, হাত ধোয়া এবং  অন্য অ্যাথলিট থেকে ২ মিটার দূরত্ব বজায় রাখার নিয়মের পাশাপাশি নিষিদ্ধ ছিল করমর্দন বা একে অপরকে জড়িয়ে ধরার মত বিষয়গুলো। কিন্তু অনেক অ্যাথলিট সেগুলো মানেননি।

বিধিনিষেধের তোয়াক্কা না করে আনন্দ ভাগাভাগি; Image source: GREG BAKER/AFP

ভেন্যুতে সকল দেশি-বিদেশি দর্শক প্রবেশে ছিল নিষেধাজ্ঞা। সুতরাং দর্শকদের উল্লাস, চিৎকার, ছবি তোলা, অটোগ্রাফ এসবের কিছুই ছিল না।

যুক্ত হয়েছে চারটি নতুন খেলা

এবারের অলিম্পিকে ৩৩টি ভিন্ন খেলায় রেকর্ড ৩৩৯টি মেডেল ইভেন্ট হয়েছে। কারাতে, স্কেটবোর্ডিং, স্পোর্ট ক্লাইম্বিং এবং সার্ফিংয়ের মতো নতুন খেলার সাথে ২০০৮ সালের পর আবার এসেছে সফটবল এবং বেসবল। এছাড়া বক্সিং, ক্যানু স্প্রিন্ট, সাইক্লিং, রোয়িং এবং সাঁতারে ১০টি নতুন ইভেন্টের পাশাপাশি জুডো, সাঁতার, শ্যুটিং, আর্চারিসহ আরো বেশ কিছু খেলার ১৮টি ইভেন্টে এবার নারী-পুরুষ একসাথে প্রতিযোগিতা করেছে। মুলত নতুন প্রজন্মের দর্শকদের অলিম্পিকের প্রতি আগ্রহী করতেই এই নতুন ইভেন্টগুলোর আয়োজন করা হয়েছে।

জুডোতে প্রথমবারের মতো মিশ্র ইভেন্ট; Image source: Olympics

অলিম্পিক শেষে পদক তালিকার শীর্ষে আবারও যুক্তরাষ্ট্র

শেষের আগের দিন পর্যন্ত ৩৮টি স্বর্ণপদক নিয়ে পদকতালিকার শীর্ষে ছিল চীন। কিন্তু শেষদিনে আরো তিনটি স্বর্ণজয়ের মাধ্যমে তাদেরকে আর ২০০৮ সালের পুনরাবৃত্তি করতে দেয়নি যুক্তরাষ্ট্র। ৩৯টি স্বর্ণসহ মোট ১১৩টি পদক নিয়ে শীর্ষে থেকেই আবারও অলিম্পিক শেষ করল তারা। চীন শেষদিনে কোনো স্বর্ণ না জেতায় ৩৮ স্বর্ণসহ মোট ৮৮টি পদক নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে থেকেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে তাদের।

পদক তালিকার শীর্ষ দশ; Image source: Olympics

পদক তালিকায় নাম লেখিয়েছে মোট ৮৬টি দেশ। এদের মধ্যে ভারোত্তোলক পলিনা গুরিয়েভার রৌপ্যজয় তুর্কমেনিস্তানকে, আলেসান্দ্রা পেরেল্লির শুটিং ট্র্যাপে ব্রোঞ্জজয় সান মারিনোকে এবং হুগুয়েস ফ্যাব্রিস জাঙ্গোর ট্রিপল জাম্পে ব্রোঞ্জজয় আফ্রিকান দেশ বুরকিনা ফাসোকে প্রথমবারের মতো অলিম্পিক পদক জয়ের আনন্দ এনে দিয়েছে। সান মারিনো রেকর্ডবুকে নাম  লেখিয়েছে অলিম্পিকজয়ী সবচাইতে ছোট দেশ হিসেবে। এদিকে আবার স্বর্ণজয়ী ৬৩টি দেশের তালিকায় নতুন নাম ছিল বারমুডা, ফিলিপাইন এবং কাতার।

হুগুয়েস ফ্যাব্রিস জাঙ্গো ব্রোঞ্জ জয়ে দেশকে গর্বিত করলেন; Image source: Reuters

আরেকটি মজার তথ্য, এবারের অলিম্পিকের পদকগুলো তৈরি করা হয়েছে ৭৮,৯৮৫ টন ইলেকট্রনিক ডিভাইস রিসাইকেল করার মাধ্যমে, যার মধ্যে ছিল বাতিল আর নষ্ট স্মার্টফোন এবং ল্যাপটপ।

বাংলাদেশের রোমান-দিয়া’র ব্যর্থতা

১৯৮৪ সাল থেকে আটটি অলিম্পিকে যা ঘটেছিল, এবারেও তার ব্যাতিক্রম হয়নি। আমাদের ছয়জন অ্যাথলিটের সবাই ফিরেছেন খালি হাতে। আরিফুল-জুয়েনা সাঁতারে নিজেদের সেরাটা দিলেও সেটা পরের রাউন্ডে যাওয়ার জন্যই যথেষ্ট নয়। কমনওয়েলথ গেমসে দুইবার রৌপ্যজয়ী শুট্যার আব্দুল্লাহ হেল বাকি রিও থেকেও খারাপ স্কোর করেছেন। স্প্রিন্টার জহির রায়হান পুরুষদের ৪০০ মিটার স্প্রিন্টে হিট থেকেই বিদায় নিয়েছেন। তবে এবার সবার নজর ছিল আর্চারিতে।

এই বছরের বিশ্বকাপের মঞ্চে রোমান-দিয়া; Image source: world archery

এবছরের মার্চে তীরন্দাজ রোমান সানা আর দিয়া সিদ্দিকী প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের রিকার্ভ মিশ্র ইভেন্টের ফাইনালে উঠে রৌপ্যজয় আমাদের মনে আশা জাগিয়েছিলেন অন্তত কিছু একটা করার। অলিম্পিকের মিশ্র রিকার্ভের চূড়ান্ত পর্বে শক্ত প্রতিপক্ষ দক্ষিণ কোরিয়ার আন সান ও কিমের কাছে হারলেও তারা শেষ পর্যন্ত লড়েছেন। এরপর রোমান রিকার্ভের পুরুষ এককের প্রথম রাউন্ডে হারিয়েছিলেন গ্রেট ব্রিটেনের টম হলকে। প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে লড়েছেন দ্বিতীয় রাউন্ডে। সেখানে মাত্র এক পয়েন্টের জন্য হার এবারে আশাহত করলেও অন্তত আমাদের নতুন দিনের স্বপ্ন দেখালেন। ১৭ বছর বয়সী দিয়া সিদ্দিকাও লড়েছিলেন ভালোই, তবে শেষে হেরেছেন টাইব্রেকারে।

নিজ দেশেই মাতালো জাপান

আয়োজক জাপান ২৭টি স্বর্ণপদকসহ মোট ৫৮টি পদক নিয়ে পদক তালিকায় তৃতীয় স্থানে থেকে সবাইকে অতিভূত করে দেয়। এর আগে অ্যাথেন্স অলিম্পিকে জেতা ১৭টি স্বর্ণপদকসহ মোট ৩৭টি পদক এতদিন ছিল তাদের সর্বোচ্চ। মূলত এই অলিম্পিক আয়োজন নিয়ে জাপানীদের মাঝে যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ছিল, অ্যাথলেটদের এমন অর্জনে তা অনেকটাই এখন স্তিমিত।

নতুন চারটি খেলার মধ্যে তিনটিতেই পদক জিতেছে জাপান। এর মধ্যে স্কেটবোর্ডের চারটির মধ্যে জাপানকে তিনটি স্বর্ণপদক এনে দিয়েছে ১৩ বছর বয়সী বালিকা মোমিজি নিশিইয়া, ১৯ বছর বয়সী সাকুরা ইউসোজামি এবং ২২ বছর বয়সী ইতো হরিগোমে।

স্বর্ণজয়ে আনন্দে আপ্লুত মোমিজি নিশিইয়া; Image source: AP/PTI Photo

জুডোতেও জাপানের সাফল্য ছিল দেখার মতোই। ৯টি স্বর্ণপদক নিয়ে সবাইকেই পেছনে ফেলেছে তারা। তবে জুডোর সবচাইতে সুন্দর মুহূর্তটা ছিল একই দিনে দুই ভাইবোনের জুডোর দুইটি ইভেন্টে স্বর্ণজয়। বছরতিনেক আগেও বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে এমন কিছুই করে দেখিয়েছিলেন তারা। তবে অলিম্পিকের ইতিহাসে উতা আবে ও হিফুমি আবের এই কীর্তি এবারেই প্রথম।

স্বর্ণপদক হাতে উচ্ছাসিত ভাইবোন; image source: Nippon

কিছু অঘটন না ঘটলে পদক তালিকাটা হয়তো আরো বড় করতে পারত জাপান। যেমন ‘কিং কোহেই’ নামে খ্যাত কোহেই উচিমুরা, যাকে সর্বকালের অন্যতম সেরা পুরুষ জিমন্যাস্ট বলা হয়, তিনি নিজ দেশে হয়েছেন ব্যর্থ। টানা তিন অলিম্পিকে স্বর্ণজয়ের ইতিহাস না করার আক্ষেপ অবশ্য কিছুটা দূর করতে পেরেছেন তার যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে বিবেচিত হাশিমোতো দাইকি।

দুটো স্বর্ণপদক জিতেছেন হাশিমাতো দাইকি; Image source: espn

ভারতের সাত পদক

একটি স্বর্ণ, ২টি রৌপ্য এবং চারটি ব্রোঞ্জ জয়ের মাধ্যমে টোকিও অলিম্পিক ছিল ভারতের সফলতম অলিম্পিক। ২০০৮ সালের পর জ্যাভলিন থ্রোয়ে নীরজ চোপড়া ভারতকে ব্যাক্তিগত ইভেন্টে আবার স্বর্ণজয়ের গৌরব এনে দেন। এদিকে এটিই ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে ভারতের প্রথম পদক জয়।

এই আসরের ভারতের একমাত্র স্বর্ণজয়; Image source: Economic Times

এবারের অলিম্পিকের প্রথমদিনেই ভারোত্তলনের ৪৯ কেজি বিভাগে রৌপ্য জয়ের মাধ্যমে ভারতকে প্রথম পদক এনে দেন মীরাবাঈ চানু। এদিকে ৪১ বছর পর পুরুষ হকিতে আবার পদক জিতল ভারত। এছাড়াও পিভি সিন্ধু, লভলিনা বড়গোহাঁই, বজরং পুনিয়া জিতেছেন ব্রোঞ্জ, কুস্তিগীর রবি কুমার দাহিয়া জিতেছেন রৌপ্য।

হেরেও আলো ছড়ালেন এবারের সর্বকনিষ্ঠ অলিম্পিয়ান

যুদ্ধবিদ্ধস্ত সিরিয়ার হয়ে এবারের অলিম্পিকের পতাকা ছিল ১২ বছর বয়সী হেন্দ জাজার হাতে। ১৯৬৮ সালের পর জাজাই ছিল অলিম্পিকের সর্বকনিষ্ঠ প্রতিযোগী। টেবিল টেনিসে শক্ত প্রতিপক্ষ অস্ট্রিয়ার লিউ জিয়ার কাছে হেরে প্রথম রাউন্ডে বিদায় নিলেও জাজার গল্পটা এর চাইতেও বড়। ছোটবেলা থেকেই দেশে গোলাগুলির শব্দে বড় হওয়া, প্রশিক্ষণ নেয়া এবং নিজ যোগ্যতায় অলিম্পিকে পা রাখার এই দৃঢ় মনোবল মুগ্ধ করেছে সবাইকে। জাজাও জানিয়ে দিলেন, পরের অলিম্পিকে তিনি আবার ফিরবেন এবং ভালো কিছুই করে দেখাবেন।

প্রতিপক্ষ লিউ জিয়ার সাথে হেন্দ জাজা; image source: ANNE-CHRISTINE POUJOU

এদিকে আবার প্রথমদিনেই বিদায় নিয়েছিলেন এবারের অলিম্পিকের সবচাইতে বয়সী প্রতিযোগী অস্ট্রেলিয়ার মেরি হানা। ৬৬ বছর বয়সী এই অশ্বারোহী জানিয়ে দিয়েছেন, তার শরীর যদি ভেঙে না পড়ে, তিনি ৭০ বছর বয়সে পরবর্তী অলিম্পিকেও লড়বেন।

বিশ্বরেকর্ড ভেঙেছে মোট ২২টি

নরওয়ের কারস্টেন ওয়ারহোমের ৪০০ মিটার হার্ডলসে অবিশ্বাস্য ৪৫.৯৪ সেকেন্ডে নিজের বিশ্বরেকর্ড নিজেই ভেঙে স্বর্ণজয় এবারের অলিম্পিকের অন্যতম সেরা একটি মুহূর্ত ছিল। আবার ওদিকে ভারোত্তোলনের চারটি বিশ্বরেকর্ডের মধ্যে গ্রেগরিয়ান লাশা তালাখাদজে একাই ভেঙেছেন তিনটি। তবে এবার স্পোর্টস ক্লাইম্বিংয়ের মতো নতুন খেলা যুক্ত হলেও রিও অলিম্পিকের চেয়ে বেশি বিশ্বরেকর্ড ভাঙা হয়নি। রিওতে রেকর্ড ভেঙেছিল ২৭টি আর এবার ২২টি।

image source: Nielsen Gracenote

নারী সাঁতারের লড়াইটা জমেছিল বেশ

১৯৯৬ সালের পর প্রথমবারের মতো মাইকেল ফেলপসের অনুপস্থিতিতে অনেকের মনে হয়েছিল এবারের অলিম্পিকের সাঁতার তার দ্যুতি হারাবে। কিন্তু তেমন কিছুই হয়নি। সাঁতারে ছিল জমজমাট লড়াই, ভেঙেছে কয়েকটি বিশ্বরেকর্ড, আত্মপ্রকাশ করেছে বেশ কিছু নতুন তারকা। কিন্তু সবার নজর কেড়েছে নারী সাঁতারের দ্বৈরথ। যুক্তরাস্ট্রের কেইট লেডেকি রিও অলিম্পিকের সাঁতারে আধিপত্য বিস্তার করলেও এবার তার মুখোমুখি হয়েছিলেন তার যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী অস্ট্রেলিয়ার আরিয়ার্ন টিটমাস। ২০০ এবং ৪০০ মিটার ফ্রিস্টাইলে টিটমাস লেডেকির মুকুট ছিনিয়ে নেন। তবে ৮০০ মিটার ফ্রিস্টাইলে ‘টিটমাস টেস্ট’ পাস করে স্বর্ণজয় করেন লেডেকি।

৪০০ মিটার ফ্রিস্টাইল জেতার পর আরিয়ার্ন টিটমাস; Image source: Maddie Meyer/Getty Images

আরেক অস্ট্রেলিয়ান নারী সাঁতারু এমা ম্যাককিওন গড়েছেন ইতিহাস। প্রথম নারী সাঁতারু হিসেবে তিনি এই এক আসরে জয় করেছেন একক বিভাগে সাতটি পদক, যার মধ্যে আবার চারটিই ছিল স্বর্ণ।

১০০ এবং ২০০ মিটার ট্র‍্যাক পেল নতুন রাজা

২০০৮ সাল থেকে পুরুষদের ১০০ এবং ২০০ মিটারে ছিল উসাইন বোল্টের একচ্ছত্র আধিপত্য। কিন্তু এবার তার অনুপস্থিতিতে অন্যদের সুযোগ হয়েছিল সেই রাজত্বে ভাগ বসানোর। ফাইনালে সবার চোখ ছিল দু’জনের উপর, চীনের বিংতিয়ান সু এবং কানাডিয়ান আন্দ্রে ডি গ্রাস। কিন্তু সবাইকে অবাক করে ৯.৮০ সেকেন্ডে দৌড় শেষ করে স্বর্ণ জিতে নিলেন ইতালির মার্চেল জ্যাকবস।

১০০ মিটারের নতুন রাজা জ্যাকবস; Image source: REUTERS/Andrew Boyers

১০০ মিটারের স্বর্ণ হাতছাড়া হলেও ২০০ মিটারের পদকটি নিজের করেই নিয়েছেন আন্দ্রে ডি গ্রাস। গতবারেও এই দৌড়ে রৌপ্য জিতেছিলেন তিনি। কিন্তু এবার বোল্টের অনুপস্থিতিতে তাকে আর কেউ হারাতে পারেনি। ১৯.৬২ সেকেন্ড সময় নিয়ে জিতেছেন সোনা।

জয়ের পর ট্র্যাকের উপরই এভাবে শুয়ে পড়েন আন্দ্রে ডি গ্রাস; Image source: Fabrizio Bensch/Reuters

এদিকে নারীদের ১০০ মিটার স্প্রিন্টের রাজত্ব হাতছাড়া করেননি এলেইন থম্পসন-হেরা। অলিম্পিক ফাইনালের সেরা টাইমিং ১০.৬১ সেকেন্ড সময় নিয়ে রিও অলিম্পিকের পুনরাবৃত্তি করলেন তিনি। তার থেকে একটু বেশি সময় নেয়ায় রৌপ্য নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে বেইজিং এবং লন্ডনে স্বর্ণজয়ী আরেক জ্যামাইকান শেলি অ্যান ফ্রেজার-প্রাইস। অন্য দেশকে সুযোগ না দিয়ে রৌপ্য জিতেছেন আরেক জ্যামাইকান শেরিকা জ্যাকসন।

পদকজয়ী তিন জ্যামাইকান; Image source: Olympics

ক্যালেব ড্রেসেল জিতেছেন সর্বোচ্চ স্বর্ণপদক

সাঁতারে ক্যালেব ড্রেসেলকে অলিম্পিক শুরুর আগে থেকেই তুলনা করা হচ্ছিল তার স্বদেশী কিংবদন্তী মাইকেল ফেলপসের সাথে। যদিও সেটায় তার ঘোর আপত্তি ছিল কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের নতুন এই স্পিডস্টারই ২০১৯ সালে ভেঙে দিয়েছিলেন মাইকেল ফেলপসের ১০০ মিটার বাটারফ্লাইয়ের রেকর্ড। আর অলিম্পিকে নিজের সেই রেকর্ড আবার ভেঙে জয় করে নিলেন স্বর্ণ। টোকিও অলিম্পিকে তার গলাতেই ঝুলেছে সর্বোচ্চ পাঁচটি স্বর্ণপদক।

১০০ মিটার বাটারফ্লাইয়ে স্বর্ণজয়ী ক্যালেব ড্রেসেল; Image source:  AFP

‘রাশিয়ান’রা জয় করেছে রাশিয়ার চাইতে বেশি পদক!

ডোপিং কেলেংকারিতে ২০১৯ সালে সব ধরনের আন্তর্জাতিক আসরে রাশিয়াকে চার বছরের জন্য নিষিদ্ধ করেছিল ওয়ার্ল্ড অ্যান্টি ডোপিং এজেন্সি। তবে যেসব অ্যাথলিট নিজেদের ডোপিংয়ের সাথে সম্পর্ক নেই প্রমাণ করতে পেরেছেন, তারাই এবার ROC (Russian Olympic Committee)-এর পতাকা নিয়ে অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করতে পেরেছে। টোকিও অলিম্পিকে তারা ২০টি স্বর্ণসহ মোট ৭১টি পদক নিয়ে তালিকায় পঞ্চম স্থান দখল করে নেয়। গত দুই অলিম্পিকে এত স্বর্ণ বা পদক জিততে পারেনি রাশিয়াই।

উদ্ভোধনী অনুষ্ঠানে ROC পতাকা হাতে রাশিয়ান অ্যাথলিটরা; Image source: Patrick Smith/ Getty Images

শরণার্থীরাও লড়েছেন:

রিও অলিম্পিকে ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিক কমিটি প্রথমবারের মতো শরণার্থী অ্যাথলিটদের অলিম্পিকের স্বপ্নপূরণের জন্য গঠন করে রিফিউজি অলিম্পিক টিম। এবারেও সেই দলের হয়ে অলিম্পিকে ১২টি খেলায় লড়েছেন ১১টি ভিন্ন দেশের ২৯ জন অ্যাথলেট।

মার্চপোস্টে রিফিউজি অলিম্পিক টিমের পতাকা হাতে ইউসরা মারদিনি এবং তাকলিওনি গ্যারবিওসিস; Image source:  IOC / Greg Martin

সিমোন বাইলসের সরে আসা এবং অ্যাথলিটদের মানসিক স্বাস্থ্য

সিমোন বাইলস নিঃসন্দেহে বর্তমান সময়ের অন্যতম সেরা নারী জিমন্যাস্ট। তিনি ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের নারী জিমন্যাস্টিক দলের প্রধান মুখ। রিও অলিম্পিকের পর এবারও সবার প্রত্যাশা ছিল তেমন কিছুরই পুনরাবৃত্তি করে দেখাবেন তিনি। কিন্তু যখনই তিনি টোকিওর আরিয়াকে জিমন্যাস্ট সেন্টারে প্রবেশ করেন, তিনি তার কাঁধে ‘গোটা পৃথিবীর’ চাপ অনুভব করেন। তাই নিজেকে একের পর এক ইভেন্ট থেকে সরিয়ে নেন তিনি।

সিমোন বাইলসের মাধ্যমে উঠে অ্যাথলিটদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি; Image source: FoxSports

তার শৈশবটা ছিল নানা সমস্যায় ভরপুর। এছাড়াও অনেকেই মনে করছেন করোনা মহামারীও তার এই মানসিক স্বাস্থ্যে খুব বাজে প্রভাব ফেলেছে। সিমোন বাইলস বলেছিলেন,

“আমাদের নিজেদের উপরও মনোযোগ দিতে হয়, কারণ আমরাও মানুষ। পৃথিবী আমাদের যা করতে চায় তা করার চাইতে আমাদের নিজেদের শরীর-মনের দিকে নজর দেওয়া উচিত।”

মূলত বাইলসের মাধ্যমেই আমাদের সামনে উঠে এসেছে অ্যাথলিটদের ঠিক কী পরিমাণ চাপ সহ্য করে এই পর্যায়ে আসতে হয়। তাছাড়া এবারের প্রতিযোগিতা ছিল অন্যবারের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাই বাইলসের এভাবে সরিয়ে নেওয়াটাই বুঝিয়ে দিল অ্যাথলিটদের পারফর্মেন্সের সাথে সাথে মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে নজর দেয়াটাও কতটা গুরুত্বপূর্ণ। শেষে নিজেকে সামলিয়ে নারী ব্যালেন্স বিমে অংশ নিয়ে অর্জন করেন ব্রোঞ্জ – বাইলসের কাছে যা স্বর্ণের চাইতেও মূল্যবান ছিল।

 সবশেষে নারী ব্যালেন্স বিমে অংশ নিয়ে ব্রোঞ্জ জিতে নেন তিনি; Image source: Laurence Griffiths/Getty Images

টেনিসে ছিল অঘটনের পর অঘটন

জুলাইয়েই উইম্বলডন জেতা নারী টেনিসের নাম্বার ওয়ান অ্যাশলি বার্টিকে প্রথম রাউন্ডেই সরাসরি সেটে হারিয়ে অঘটনের জন্ম দেন সারা সরিবেস। ওদিকে টোকিওতে সবচাইতে যার উপর সবার প্রত্যাশা ছিল সেই নাওমি ওসাকাও তৃতীয় রাউন্ডে হেরে যান মারকেটা ভনদ্রউসোভার কাছে। আর স্বর্ণ জিতে নেন বেলিন্দা বেনচিচ।

পোডিয়ামে হাসিমুখে বেলিন্দা বেনচিচ; Image source: Reuters

পুরুষ এককে এবার হ্যাটট্রিক স্বর্ণজয়ের সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেল অ্যান্ডি মারের চোটের কারণে। তাই তিনি নাম প্রত্যাহার করে নেন। আর ওদিকে গ্র্যান্ডস্ল্যামে নাদালকে ছুঁয়ে ফেললেও অলিম্পিকের নাদালকে এবারও ধরতে পারলেন না জোকোভিচ। বিদায় নিলেন খালি হাতেই। পুরুষ এককের স্বর্ণ জিতেছেন আলেক্সান্দার জাভারেভ।

স্বর্ণজয় আলেক্সান্দার জাভারেভের; Image source: AFP

ফুটবলে স্বর্ণ ব্রাজিল আর কানাডার

ফুটবলের দু’টি ফাইনালের লড়াই ছিল একেবারে সমানে সমান। পুরুষদের ফাইনালের একদিকে অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল, অপরদিকে বার্সেলোনা অলিম্পিক জয়ী স্পেন। নির্ধারিত সময়ে খেলায় ১-১ এ সমতা থাকায় খেলা গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। সেখানেই ম্যালকমের গোলে ২-১ গোলে স্পেনকে হারিয়ে টানা দ্বিতীয়বারের মতো অলিম্পিক স্বর্ণ নিজের করে নেয় ব্রাজিল। আর ব্রোঞ্জের লড়াইয়ে স্বাগতিক জাপানকে ৩-১ গোলে হারিয়ে ব্রোঞ্জ জিতে নেয় মেক্সিকো।

টানা দ্বিতীয় স্বর্ণজয়ে উচ্ছাসিত ব্রাজিল ফুটবল দল; Image source: Thomas Peter/Reuters

নারী ফুটবলের ফাইনালও গড়িয়েছিল অতিরিক্ত সময় পর্যন্ত যেখানে কানাডা আর সুইডেন দুইদলই ১-১ গোলে সমতায় ছিল। শেষে সাডেন ডেথ পেনাল্টি শ্যুটআউটে সুইডেনকে ৩-২ এ হারিয়ে নারী ফুটবলে প্রথমবারের মতো স্বর্ণ জিতে নেয় কানাডা। আর ব্রোঞ্জ জিতেছে যুক্তরাষ্ট্র।

নারী ফুটবলে প্রথম স্বর্ণ কানাডার; Image source: Kiichiro Sato/AP

পুরুষ হকির ফাইনালটাও ছিল দুর্দান্ত

ফাইনালটা ছিল হকির বর্তমান বিশ্বচ্যাম্পিয়ন বেলজিয়াম আর অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে। হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে নির্ধারিত সময়ে ১-১ গোলে সমতা থাকার পর ম্যাচ গড়ায় টাইব্রেকারে। সেখানে দুর্দান্ত ছিলেন বেলজিয়ামের গোলরক্ষক ভিনসেন্ট ভানাচ। তার কারণেই অজিরা তিনবার বল জালে জড়াতে ব্যর্থ হয়। আর ম্যাচ জিতে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব আবারও প্রমাণ করল বেলজিয়াম।

হকিতে প্রথম স্বর্ণজয়ের উল্লাস বেলজিয়ামের; Image source:  Alexander Hassenstein/Getty Images

সুন্দর কিছু গল্পও আছে

পুরুষ হাই জাম্পের ফাইনালে একই উচ্চতায় লাফানোয় কাতারের মুতাজ ঈসা বারশিম ও ইতালির জিয়ানমারকো তামবেরি দুইজনই ছিলেন স্বর্ণপদকের দাবিদার। পুরো ইভেন্টে কোনোদিক থেকেই দুইজনকে আলাদা করা সম্ভব হচ্ছিল না। তাই বিজয়ী নির্ধারণ করতে অলিম্পিক কমিটির একজন সদস্য যখন জাম্প-অফের প্রস্তাব দেন, তখন মুতাজ তাকে জিজ্ঞেস করেন,

“আমাদের কি যুগ্ম স্বর্ণপদক পাওয়া সম্ভব?”

এভাবেই অলিম্পিকের ইতিহাসে ১১৩ বছর পর কোনো অ্যাথলেট তাদের স্বর্ণপদক ভাগাভগি করলেন। মূলত অলিম্পিক সম্প্রীতির যে বার্তা সবসময় দিয়ে যায়, এবার তার উদাহরণ হয়ে রইলেন মুতাজ-তামবেরি।

ইতিহাস গড়লেন দুজন; Image source: AP Photo/Francisco Seco

পুরুষদের ৮০০ মিটার দৌড়ের সেমিফাইনালের মাঝামাঝিতে বতসোয়ানার নিজেল আমোস এবং যুক্তরাষ্ট্রের ইজায়াহ জুয়েট একে অপরের সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যান এতে বাদ পড়েন দু’জনই (তবে পরবর্তীতে আমোস ফাইনালের জন্য নির্বাচিত হন)। কিন্তু সেখানে রাগারাগি করার বদলে দু’জন একে অপরকে সাহায্য করেন, জড়িয়ে ধরেন এবং ফিনিশ লাইন পর্যন্ত একসাথে হেঁটে যান।

রাগারাগির বদলে একে অপরের সাথে করছেন করমর্দন; Image source: JAE C. HONG | AP

গ্রেট ব্রিটেনের ডাইভার টম ডেলেই লন্ডন এবং রিওতে ব্রোঞ্জ পেলেও একটি স্বর্ণজয় তার এতদিন অধরাই ছিল। কিন্তু এবার সঙ্গী ম্যাটি লিকে নিয়ে পুরুষদের ১০ মিটার সিনক্রোনাইজড প্ল্যাটফর্ম ইভেন্টে সেই স্বর্ণপদক জয় করেন। হার না মানে আরেক অ্যাথলেট টেরেসা পোর্টেলা ছয় অলিম্পিক লড়ে বেশ কয়েকবার পোডিয়ামের খুব কাছে গিয়েও ফিরে এসেছিলেন। কিন্তু এবার অবশেষে জয় করে নিলেন ক্যানু স্প্রিন্টে রৌপ্য।

স্বর্ণজয়ের পর চোখের পানি আটকাতে পারেন নি টম ডেলেই; Image source: BBC Sports

২০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোক শেষ করে যখন তাতানা শোয়েনমেকার বড় পর্দায় তাকালেন তখন তিনি নিজেই নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। স্বর্ণ জেতার সাথে সাথে তিনি ভেঙে ফেলেছেন আট বছর পুরনো বিশ্বরেকর্ড! আবেগে নিজের চোখের পানি সামলাতে পারেননি। তখনই তাকে অভিনন্দন জানাতে এগিয়ে আসেন তার প্রতিদ্বন্দ্বী লিলি কিং, অ্যানি লেজর এবং কেলি করবেট।

তাতানাকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন অন্যান্য প্রতিযোগীরা; Image source: Reuters

নারীদের ট্রায়াথলনে ২৪তম হয়ে যখন লোটি মিলার ফিনিশ লাইনের পাশে বসে নিজেকে সামলিয়ে নিচ্ছিলেন, তখন তিনি দেখতে পান বেলজিয়ামের ক্লেয়ার মাইকেল গোড়ালিতে আঘাতের কারণে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে তখনও ফিনিশ লাইনের দিকে এগিয়ে আসছেন। জয়ী অ্যাথলিটের প্রায় ১৫ মিনিট পর তিনি ফিনিশ লাইন স্পর্শ করেন। সাথে সাথেই তিনি বিধ্বস্ত অবস্থায় মাটিতে বসে পড়েন, আর তাকে সান্ত্বনা দিতে ছুটে যান মিলার। সেই ট্রায়াথলনে ৪৫ জন প্রতিযোগী অংশ নিলেও ২০ জন রেস শেষ না করেই সরে পড়েন। তাই রেস শেষ করার জন্য মাইকেলের এই মনোবল মুগ্ধ করে মিলারকে।

মাইকেলকে জড়িয়ে ধরেন মিলার; image source: Eurosports

অল্প কিছু বিতর্কও যে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেনি, তা নয়

বেলারুশের স্প্রিন্টার ক্রিস্টিনা সিমানোস্কায়া সামাজিক মাধ্যমে বেলারুশের কোচ এবং অফিশিয়ালদের সমালোচনা করায় তাকে জোর করে নিজের দেশে ফিরিয়ে নেয়া হচ্ছে এবং সেখানে তাকে শাস্তি দেয়া হবে – এই দাবি করলে সেখানে জাপানের পুলিশ তাকে ফিরিয়ে আনে। পরে পোল্যান্ড তাকে মানবিক ভিসা দেয়। এরপর দুইজন কোচকে অলিম্পিক থেকে সরিয়ে দেয়া হয়।

টোকিও বিমানবন্দরে ক্রিস্টিনা সিমানোস্কায়া; Image source: BBC

নারী হয়েও চুল ছোট রাখার কারণে অনলাইনে নিজ দেশের মানুষের কাছেই হয়রানির শিকার হতে হয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার তীরন্দাজ আন সানকে। তবে এসব কিছুকেই মাথায় না নিয়ে নিজের মতো খেলেই তিনি জিতেছেন তিনটি স্বর্ণপদক।

স্বর্ণজয়ী আন সান; Image source: AP Photo/Alessandra Tarantino

করোনা ঠিকই আঘাত হেনেছিল

অলিম্পিক শুরুর আগে থেকেই টোকিওতে যেভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে করোনা সংক্রমণ বাড়ছিল, তাতে অলিম্পিকেও যে করোনা আঘাত হানতে পারে, তা অনুমেয় ছিল। কিন্তু মাঠে দর্শক না থাকা, বিদেশীদের ভ্রমণের নিষেধাজ্ঞার এবং টেস্ট আর পজেটিভ হলেই আইসোলেশনের মতো ব্যাপারগুলোর কারণে মাঝপথে অলিম্পিক থামানোর মতো কোনো ক্ষতি করতে পারেনি করোনাভাইরাস। তবে প্রচণ্ড দাবদাহ প্রচুর ভুগিয়েছে অ্যাথলিটদের।

প্রথমদিনেই গরমে অজ্ঞান হয়ে পড়েন রাশিয়ার আর্চার সভেৎলতা গমবোয়েভা; Image source: Reuters

তবে নেদারল্যান্ডের ফিন ফ্লোরিন, যুক্তরাষ্ট্রের স্যাম কেন্ড্রিক, চিলির ফারনান্দা আগুয়েরে, সাবেক ইউএস ওপেন চ্যাস্পিয়ন ব্রাইসনের মতো অনেকের অলিম্পিক স্বপ্নই ভেঙে যায় কোভিড পজিটিভ হবার কারণে। আর সবমিলিয়ে জুলাইয়ের এক তারিখ হতে অলিম্পিকের শেষ দিন পর্যন্ত ৪৩০ জনের শরীরে কোভিড ধরা পড়ে যাদের বেশিরভাগই স্থানীয় আর অলিম্পিকের সাথে নিযুক্ত কর্মী। ৪৩০ জনের মধ্যে অ্যাথলেট ছিল ২৯ জন আর ২৫ জন বিভিন্ন সংবাদকর্মী।

বিদায় টোকিও

সবশেষে করোনা, ঘূর্ণিঝড়, দাবদাহ কিংবা আন্দোলন – সবকিছুকেই পেছনে ফেলে একটি সফল কিন্তু ব্যতিক্রমী আসরের আয়োজন সম্পন্ন করল টোকিও। শুরুটা যেভাবে দর্শকশূন্য স্টেডিয়ামে হয়েছিল, শেষটাও হয়েছে একইভাবে। তবে শুরুর দিকে যে একটা নীরব আতঙ্ক ছিল, তা পাল্টে পুরোই উৎসবের রূপ নেয় সমাপনী অনুষ্ঠানে। সেখানে নিয়ম অনুযায়ী সবশেষ দুটো পদক তুলে দেয়া হয় ম্যারাথন জয়ীদের হাতে। সেখানেই ম্যারাথনে টানা দ্বিতীয়বারের স্বর্ণপদক নিজের করে নিয়ে কেনিয়ার ইলিউড কিপচোগে জায়গা করে নিলেন অলিম্পিক কিংবদন্তীদের কাতারে। 

টানা দ্বিতীয়বারের মতো অলিম্পিক ম্যারাথনজয়ী ইলিউড কিপচোগে; image source: Reuters

তারপর ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিক কমিটির প্রেসিডেন্ট থমাস বাখ, অলিম্পিক পতাকা তুলে দেন প্যারিসের মেয়র অ্যানি হিদালগোর হাতে। প্যারিসেই বসবে অলিম্পিকের পরবর্তী আসর।

থমাস বাখ তার সমাপনি বক্তৃতায় ধন্যবাদ জানান অ্যাথলিটদের। তিনি বলেন,

“আপনারা এই কঠিন সময়ে বিশ্বকে সবচাইতে মূল্যবান জিনিসটিই উপহার দিয়েছেন। আশা। মহামারী শুরুর পর এই প্রথমবারের মতো পুরো বিশ্ব একসাথে হয়েছে। এই টোকিও ২০২০ অলিম্পিক গেমসটি হলো আশা, একতা এবং শান্তির অলিম্পিক গেমস।”

নিভু নিভু অলিম্পিক শিখা; Image source: Jewel Samad/AFP/Getty Images

তারপরেই আস্তে আস্তে নিভতে শুরু করে অলিম্পিক কলড্রনের শিখা। অন্ধকার হয়ে যায় পুরো স্টেডিয়াম। অলিম্পিক শিখা পুরোপুরি নিভে যাওয়ার মাধ্যমেই শেষ হয় এবারের ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’। টোকিও পুরো বিশ্বকে জানালো ‘আরিগাতো’।

This article is in bangla language. It is about the highlights of the Tokyo Olympic Games. All necessary links have been hyperlinked.

Feature Image: Olympics

Related Articles