Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

টনি ক্রুস: এক জার্মান সাইবর্গ

গ্যারেথ বেলকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল,

‘আপনি কি জানেন রিয়াল মাদ্রিদের একমাত্র খেলোয়াড় হচ্ছেন টনি ক্রুস যিনি নিজের বুট নিজেই পরিষ্কার করেন?’

বেলের অভিব্যক্তিই বলে দিয়েছিল, ব্যাপারটা কতটা বিস্ময়কর। রিয়াল মাদ্রিদের মতো ক্লাবের একজন মিডফিল্ড-মায়েস্ত্রো নিজেই পরিষ্কার করছেন নিজের বুট! অবশ্য টনি ক্রুস মানুষটাই এমনই। চুপচাপ নিজের কাজটা করে যান, নিভৃতে-আবডালে।

আপনি কেন তাকে মনে রেখেছেন? কোন ক্রুসকে মনে রেখেছেন? বেলো হরাইজন্তে ব্রাজিলকে ছিঁড়েখুড়ে ফেলা ক্রুস হিসেবে, নাকি লস ব্ল্যাঙ্কোসদের ট্রিনিটি চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের নেপথ্যের নায়ক হিসেবে? নাকি মনে রেখেছেন রাশিয়া বিশ্বকাপে সুইডেনের বিপক্ষে অন্তিম মুহূর্তের ফ্রি-কিকে? হলফ করেই বলা যায়, আর যে কারো থেকেই অনেকটাই আড়ালে থাকেন ক্রুস, সম্ভবত নিজের স্বভাবজাত অন্তর্মুখিতার জন্যই। তবে আপনি মনে রাখুন আর না-ই রাখুন, প্রজন্মের সেরা মিডফিল্ডার হিসেবে ক্রুসের নাম উচ্চারিত হবে বেশ জোরেশোরেই। আর কেন উচ্চারিত হবে, সেটা যদি জানতে চান, তাহলে ক্রুসের ভুবনে আপনাকে স্বাগতম।

বায়ার্নে অভিষেকে ক্লোসার সাথে ক্রুস; Image Credit: Getty Images

“আপনি কি জানেন এই বিশ্বকাপজয়ী দলে একমাত্র আপনিই পূর্ব জার্মানি থেকে এসেছেন?”

২০১৪ বিশ্বকাপ শেষে ক্রুসকে এই তথ্য দিয়ে অবাক করে দিয়েছিলেন এক সাংবাদিক। অবশ্য বার্লিন দেয়াল উঠে যাওয়ার আগ পর্যন্ত বিশ্বকাপ শাসন করে এসেছে পশ্চিম জার্মানিই। যুগ যুগ ধরেই জার্মানির পূর্ব অংশ পিছিয়ে ছিল ফুটবলে। কে জানত, জার্মানির বর্তমান প্রজন্মের সেরা খেলোয়াড়টি উঠে আসবেন পূর্ব জার্মানি থেকেই!

১৯৯০ সাল। যে বছরে বার্লিন দেয়ালের পতন, সেই বছরেই ৪ জানুয়ারি গ্রিফসওয়াল্ডে জন্ম টনি ক্রুসের। বাবা রোলান ক্রুস ছিলেন প্রফেশনাল রেসলার। মা ব্রিজিট কেমার আবার ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড়। অ্যাথলেটিক পরিবারে জন্ম তার, তাই পারিবারিকভাবেই ফুটবলে হাতেখড়ি। স্থানীয় ক্লাভ গ্রিফসওয়াল্ডার এফসি’তে খেলার সময় বায়ার্ন স্কাউট দলের চোখে পড়েন ক্রুস। ফলাফল, মাত্র ১৭ বছর বয়সেই অ্যালিয়াঞ্জ এরেনায় আগমন ক্রুসের। তবে গ্রিফসওয়াল্ডার নয়, ক্রুস নিজেকে প্রমাণ করে দেখিয়েছিলেন বিশ্বমঞ্চেই। অনুর্ধ্ব-১৭ ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ ও বিশ্বকাপ দুটোতেই বগলদাবা করেছিলেন গোল্ডেন বলের পুরষ্কার, যদিও দলগত সাফল্য আসেনি। সেজন্যই কি না সিনিয়র ক্যারিয়ারে ঈশ্বর দু’হাত ভরে দলগত সাফল্য দিয়েছেন ক্রুসকে

ব্রাজিলের বিপক্ষে সেমিফাইনালে;  Image Credit: Getty Images

২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাস। ওটমার হিৎজফেল্ড তখন বায়ার্নের ডাগআউটে। সদ্যসমাপ্ত অনুর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপে ক্রুসের পারফরম্যান্সে যারপরনাই মুগ্ধ এই সুইস কোচ। মূল স্কোয়াডে অন্তর্ভুক্ত করেই তিনি ক্ষান্ত হননি, মাত্র ১৭ বছর ২৬৫ দিনবয়সী টনি ক্রুসকে নামিয়ে দেন মাঠে। সাথে সাথে ছোট্ট একটি পরিসংখ্যানভিত্তিক রেকর্ড নিজের করে নেন ক্রুস, বায়ার্নের ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় বনে যান তিনি। তবে ক্রুসের ভুবনে পরিসংখ্যানের খেলা সেটা সবে শুরু। সেই ম্যাচে হয়তো দুই-একটি ঝলকই যথেষ্ট হতো, তবে ক্রুস নিজের অভিষেক রাঙালেন শিল্পীর ক্যানভাসে আঁকা তুলির আচড়ের মতো করে। ১৮ মিনিট মাঠে থেকেই ক্লোসাকে দিয়ে করালেন দুইটি গোল। জি রবার্তো, শোয়াইনস্টাইগার, ভ্যান বোমেলদের নিয়ে গড়া মাঝমাঠেও সেবার ক্রুস জায়গা করে নিয়েছিলেন ১২ ম্যাচে।

তবে সেই মৌসুমশেষেই দেড় বছরের জন্য ধারে বায়ার লেভারকুসেনে আগমন ক্রুসের। ব্রুনো লাবাডিয়ার অধীনে লিগে খাবি খাওয়া লেভারকুসেন সেবার খেলেছিল ডিএফবি পোকাল কাপ ফাইনাল, যদিও ওজিলের গোলে ব্রেমেনের কাছে হেরে যায় ক্রুসের দল। এইদিক দিয়ে হাওয়া বদল হয় ডাগআউটে, অবসর ভেঙে কোচ হিসেবে ফিরেন হেইঙ্কেস। সেই হাওয়ায় ভাগ্য বদল হয় ক্রুসেরও। হেইঙ্কেসের অধীনে ১৯ বছর বয়সী ক্রুস হয়ে ওঠেন অপ্রতিরোধ্য। দূরপাল্লার গোল কিংবা ফ্রি-কিকে পারদর্শী হয়েও ক্রুসের মূল অস্ত্র হয়ে ওঠে সুযোগসন্ধানী সব বিধ্বংসী পাস। পরবর্তীতে ৩ বছর পর সেই হেইঙ্কেসের অধীনেই বায়ার্নে ট্রেবল জয় ক্রুসের।

বায়ার্ন মিউনিখে টনি ক্রুস; Image Credit: Getty Images

“ক্রুস অসাধারণ একজন খেলোয়াড়। তার সবকিছুই নিখুঁত। সে এমনভাবে পাস দেয় যেন সে পুরো মাঠ উপর থেকে দেখছে।”

এই প্রশংসা এসেছিল স্বয়ং কিংবদন্তি ইয়োহান ক্রুইফ থেকে। ২০১৪ ব্রাজিল বিশ্বকাপে ক্রুসের পারফরম্যান্সে এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন ক্রুইফ।

গ্রুপপর্বে পর্তুগালের বিপক্ষে ক্রুস ৭৯টি পাসের মধ্যে ৭৬টিতেই খুঁজে পেয়েছিলেন সতীর্থকে। সে ম্যাচে ব্রাজিলিয়ান দর্শকেরা ক্রুসের ডাকনাম দেন ‘গারকন’, যার মানে হচ্ছে ‘দ্য ওয়েটার’ বা ‘খাবার পরিবেশক’। কে জানত, দিনকয়েক পরই এই ব্রাজিলিয়ানদের সাথেই শুধু ‘ওয়েটার’ হয়েই থাকবেন না ক্রুস, নিজের রেট্রো অ্যাডিডাস বুট দিয়ে করবেন দুইটি গোলও! কে জানত, তিনিই হয়ে থাকবেন মিনেইরাজোর সবচেয়ে বড় ভিলেন!

আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ফাইনালেও অনবদ্য ক্রুস সফল পাস দিয়েছেন ৯৪টি। বিশ্বকাপের সেরা দশজনের তালিকাতেও জায়গা করে নিয়েছিলেন। মাঝমাঠে শোয়াইনস্টাইগার-ওজিলকে নিয়ে জার্মানির জয়ের ভিত গড়ে দিয়েছিলেন। পুরো টুর্নামেন্টে ক্রুসের ৫৩৭ পাস ছিল দ্বিতীয় সর্বোচ্চ (সর্বোচ্চ ফিলিপ লাম, ৫৬২ পাস)। অথচ ব্রাজিল বিশ্বকাপশেষে সেভাবে লাইম লাইটে আসতে পারলেন কই!

বিশ্বকাপ হাতে; Image Source: Fifa.com

বিশ্বকাপে ভালো করবেন কিন্তু ফ্লোরেন্তিনো পেরেজের রাডারে পড়বেন না, তা কীভাবে হয়! মাত্র ২৫ মিলিয়নে বায়ার্ন থেকে পানির দামে হীরে কিনে আনলেন পেরেজ। সদ্যই ‘লা ডেসিমা’ জেতা রিয়াল মাদ্রিদের প্রেজেন্টেশনে এসে ক্রুস প্রথমেই বললেন,

“আমি এটা আবারও জিততে চাই (চ্যাম্পিয়নস লিগ)।”

হাস্যোজ্জল পেরেজ পাল্টা বললেন,

“আমরা সঠিক মানুষটিকেই বার্নাব্যুতে নিয়ে এসেছি।”

সেই বার্নাব্যুতেই টানা তিনটি চ্যাম্পিয়নস লিগ নিয়ে আসার সাক্ষী এই টনি ক্রুস।

রিয়াল মাদ্রিদে চুক্তির সময় নিজের জার্সি হাতে ক্রুস; Image Credit: Getty Images

পরিসংখ্যান যাচাই বাছাইয়ে টনি ক্রুস সর্বেসর্বা, সেটি দ্বিমত করার সাহস নেই কারোরই। কিন্তু পরিসংখ্যান বাদ দিলেও ক্রুস একইভাবে ভয়ঙ্কর। আপনি শেষ কবে দেখেছেন ক্রুসকে নিজের পা থেকে বল হারাতে? কিংবা মনে পড়ে এমন কোনো দিন, যেদিন ক্রুস ছিলেন না নিজের চেনা ছন্দে?

আচ্ছা, এইবার পরিসংখ্যানের পাতায় চোখ বুলানো যাক। প্রথম মৌসুমে রিয়াল মাদ্রিদের ৬৪ ম্যাচের মধ্যে ক্রুস ৯০ মিনিট খেলেছিলেন ৫৪টি ম্যাচেই। শুধু লা লিগায় ৩৮ ম্যাচের মধ্যে শুরু থেকে খেলেছেন ৩৬টি ম্যাচ, সাবস্টিটিউট হয়েছেন মাত্র ৮ ম্যাচে। এইবার বড় পরিসরে তাকানো যাক। সর্বশেষ তিন মৌসুমে ১১৪ লা লিগা ম্যাচের মধ্যে ক্রুস পুরো ৯০ মিনিট খেলেছেন ৯৬ ম্যাচ, অর্থাৎ ৮০% ম্যাচেই পুরো মাঠে ছিল ক্রুসের বিচরণ। ‘সাইবর্গ’ বললে কি বেশি হয়ে যায়?

প্রথম মৌসুমে টানা ৩৬ লা লিগা ম্যাচ এমনি এমনিই খেলেননি, ক্রুস ছিলেন মাঝমাঠের ইঞ্জিন – যার পায়ের জাদুতে সাত মৌসুমের লা লিগা খরা কাটায় ‘অল হোয়াইট’রা। অবাক করা ব্যাপার, এখন পর্যন্ত কোনো লা লিগা মৌসুমেই ৯২% সঠিক পাসের নিচে নামেননি ক্রুস। তাও আবার নিজের সতীর্থদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি তৈরি সুযোগও এসেছে এই জার্মান স্নাইপারের বুট থেকেই।

বড়মঞ্চের কথা যদি বলতে চান, সেখানে আরো বেশি সফল ক্রুস। ৯৩% পাস অ্যাক্যুরেসি বজায় রেখেছেন চ্যাম্পিয়নস লিগেও। জিদানের অধীনে রিয়াল মাদ্রিদের মাঝমাঠ সাম্রাজ্যে মদরিচ কিংবা ক্যাসেমিরো কারো থেকেই কম যাননি ক্রুস, বরং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের ছাড়িয়েছেন নীরবে।

হেইঙ্কেস, জোয়াকিম লো, জিদান, আনচেলত্তি, পেপ গার্দিওলা – ম্যানেজারের হটসিটে বসা সব তারকাদের অধীনেই খেলেছেন ক্রুস। জিদান আখ্যা দিয়েছিলেন ‘সবচেয়ে নিখুঁত’ হিসেবে, গার্দিওলা বলেছিলেন ‘মাঠে খারাপ সময়ে তার দেখা সবচেয়ে সাহসী খেলোয়াড়’। শিষ্যের বন্দনায় পঞ্চমুখ ছিলেন আনচেলত্তি, হেইঙ্কেসরাও। কারণ, মাঠে ক্রুসের অবদান খালি চোখে দেখা যায় না; তাকে দেখতে হলে আপনার তাকাতে হবে ক্রুসবিহীন কোনো ম্যাচের দিকে। আপনি বুঝে যাবেন, এখানে ক্রুস নেই। এখানে নেই এক জার্মান মেশিন।

টানা তৃতীয় চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের পর;  Image Credit: Getty Images

শেষটা করি আরেকটি পরিসংখ্যান দিয়ে। ২০১৪ বিশ্বকাপের পর বার্নাব্যুতে আগমন ঘটেছিল দুই বিশ্বকাপ তারকার। একজন হামেস রদ্রিগেজ, আরেকজন টনি ক্রুস। একজনের দাম ৮০ মিলিয়ন, অপরজনের ২৫ মিলিয়ন। একজনকে অভিবাদন জানাতে বার্নাব্যুতে আগমন ৪৫ হাজার দর্শকের। আরেকজনকে কত জানেন? সর্বসাকুল্য ৮ হাজার। আপনাকে নিশ্চিতভাবেই বলে দিতে হবে না, কোনজন হামেস আর কোনজন ক্রুস। আপনি মেনে নেবেন, অপরজন সবসময়ই যেন কিছুটা নিভৃতচারী।

তবে আপনাকে এটাও মানতে হবে, তিনিই এই প্রজন্মের সেরা মাঝমাঠের ত্রাণকর্তার অন্যতম। তাকে আপনি ‘ওয়েটার’ও ডাকতে পারেন, ‘স্নাইপার’ ডাকলেও আপত্তি নেই। তবে সবকিছু ছাড়িয়ে তিনি বরাবরই মাঝমাঠের চালিকাশক্তি, পুরো দলের খেলা নিয়ন্ত্রণ করা ‘ইঞ্জিন’, প্রিয় সাইবর্গ! 

This Bangla article about Toni Kroos, a german footbaler. The necessary references are hyperlinked in the article. 

Feature Image : Denis Doyle/Getty Images

Background Image: Getty Images

Related Articles