Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মানজারুল ইসলাম রানা: এক যোদ্ধার চিরপ্রস্থানের আখ্যান

ফাল্গুনের রঙ লেগেছে তখন বাংলাদেশের প্রকৃতিতে। শীতবুড়োর বিদায়ে তখন বাঙালির মনে ফূর্তির আমেজ। সে সুখেরই ছোঁয়া যেন লেগেছিল কৃষ্ণচূড়ার ডালেও। কিন্তু রানার মনে বিন্দুমাত্র শান্তি নেই, তার যে বিশ্বকাপ খেলার বড্ড শখ ছিল। শেষরক্ষা হয়নি, সেবারের বিশ্বকাপের মূল দলে আর সুযোগ পাওয়া হলো না। সে কারণে মন খারাপটা দূরে সরানোর জন্যই হয়তো প্রিয় বন্ধু সেতুকে ডাকলেন, “চল ব্যাটা, আব্বাসের চুইঝাল খেয়ে আসি!” খুলনায় আব্বাসের চুইঝালের নাম শুনলে সে লোভ সামলানো কঠিন। কেউ কেউ বলেন, এই চুইঝাল খাওয়ার পর মরলেও নাকি দুঃখ নেই। শুরুতে কিছুটা গাইগুঁই করলেও শেষমেশ সেতুও তাই রাজি হয়ে গেল।

সেতুর আলমারিতে গত এগারো বছর ধরে ওঠেনি নতুন কোনো ট্রফি; Source: BDNews24.com

তারা চুইঝাল খেতে পারেনি সেদিন, রওনা দিয়েছিল অন্য ভুবনের দিকে। বড্ড তাড়াহুড়ো ছিল কিনা, তাই হয়তো খুলনার রাস্তাকে রক্তশিমুলের রঙে রাঙিয়ে তারা দুজনে চললো অসীমের উদ্দেশ্যে। বিশ্বকাপটা খেলা হলো না রানার, ফেরা হলো না জাতীয় দলের ড্রেসিং রুমেও। দু’একটা ব্যাপার এদিক-সেদিক হলে হয়তো সেদিন বাংলাদেশ দলের অংশ হয়ে থাকতে পারতো ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জেও। সেখানে না হলেও একটা সম্ভাবনা ছিল ‘এ’ দলের হয়ে শ্রীলঙ্কা সফরে যাওয়ার, সেখানেও তার যাওয়া হলো না। ফিরে এলেন খুলনায়, নিজের বাড়িতে।

মানজারুল ইসলাম রানা, ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ প্রয়াত টেস্ট ক্রিকেটার। আর্চি জ্যাকসনের ৭০ বছরেরও পুরোনো রেকর্ড ভেঙে সেদিন গড়েছিলেন বিষাদের নীলাভ রঙে মাখা এক ‘কীর্তি’। বাইকে চড়ে নিজের অন্তিমযাত্রায় বেরোনোর মুহূর্তে তার বয়স ছিল মাত্র ২২ বছর ৩১৬ দিন। মায়াভরা চাহনির সাথে ঠোঁটের কোণে জমিয়ে রাখা নিষ্পাপ এক টুকরো হাঁসি যে কারও মনে সঞ্চার করতো গভীর এক মায়ার, সে বাঁধন ছেঁড়াটাও খুব সহজ ব্যাপার ছিল না। যেখানেই থাকতো, গোটা পরিবেশটা মাতিয়ে রাখতো। সেই উচ্ছ্বল- প্রাণোচ্ছ্বাসে ভরা রানার মুখে সেদিন হাসি ছিল না, ছিল আক্ষেপের রক্তিম বর্ণ।

এই জার্সি পরেই নিয়মিত মাঠ মাতিয়েছেন রানা; Source: Facebook

রানার সঙ্গে মাশরাফির পরিচয়টা হয়েছিল খুলনায়। যতদূর মনে পড়ে মাশরাফির, তাতে অনূর্ধ্ব-১৭ খুলনা পর্যায়ের কোনো এক ম্যাচ খেলতে গিয়েই প্রথমবারের মতো পরিচয় হয় তাদের। এরপর যত দিন গেছে, দুজনের সখ্যতাও বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। দুজনের সঙ্গে যোগ হয়েছিলেন সৈয়দ রাসেল এবং মুরাদ খান, পরে সে আড্ডায় নাম লিখিয়েছিলেন আরেক বাঁহাতি স্পিনার আব্দুর রাজ্জাকও। কিশোর বয়সের দুরন্ত রানা এই চক্রে বাঁধা পড়ে তাই বড় হয়েও দুষ্টুমি থামাননি, বরং দেশ ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গিয়ে দস্যিপনায় মেতেছেন হরহামেশাই! ততদিনে কোচ ডেভ হোয়াটমোরের আস্থাটুকুও অর্জন করে ফেলেছেন, বাংলাদেশ তখন তার মধ্যমে স্বপ্ন দেখছে আন্তর্জাতিক মানের এক অলরাউন্ডারকে।

“ওর দলে আসার পরের দিনগুলোর কথা আজও মনে পড়ে আমার”, স্মৃতিচারণে মত্ত হয়ে পড়েন হোয়াটমোর, “ওকে দেখেই খুব পছন্দ হয়ে গিয়েছিল, তাই জাতীয় দলেও নিয়ে নিয়েছিলাম। ও আমার কাছে সবসময়ই বিশেষ একজন হয়ে থাকবে, আমার হৃদয়ের মণিকোঠায় আজীবন হয়ে থাকবে সমুজ্জ্বল!” আরেকটু তলিয়ে জানতে চাওয়া হলো, রানার বিশেষত্বটা কোথায়। হোয়াটমোরের ভাষায় সেটা হলো, “ওর হাঁসি। সিংহহৃদয় একটা খেলোয়াড় ছিল সে। ব্যাটিং-বোলিং-ফিল্ডিং তো আছেই, ড্রেসিংরুমেও ওর জুড়ি মেলা ভার। দলকে এত কিছু দিয়েছে ও, একটা মুহূর্তও হাঁসি সরেনি মুখ থেকে!”

স্নেহের শিষ্যের অকাল প্রয়াণে ব্যথিত কোচ ডেভ হোয়াটমোর গিয়েছিলেন রানার বাড়িতে; Source: Cricinfo

তবে দিনগুলো ঠিক সরল পথে চললো না। ২০০৫ সালেও যে রানা ছিল বাংলাদেশ দলের প্রাণ, ২০০৬ সালের শেষ নাগাদ হঠাৎ যেন ফর্মটা পড়তির দিকে চলে গেল। দৃশ্যপটে যখন সাকিব আল হাসানের আবির্ভাব, বাঁহাতি অলরাউন্ডারের ইঁদুরদৌড়ে কিছুটা যেন পিছিয়ে পড়লেন রানা। কেনিয়া সিরিজের পর ব্যর্থতার দায় নিয়ে দল থেকে বাদ পড়লেন, এরপর আর ফেরার সুযোগটুকুও পেলেন না। মাঝেমধ্যে আক্ষেপভরা কণ্ঠে মাশরাফিকে ফোন দিয়ে বলতেন, “দোস্ত, আর কি চান্স পাবো না?” মাশরাফি সাহস যোগাতেন, “পাবি, অবশ্যই পাবি। একটু প্র্যাকটিসে মন দে।”

বন্ধুর কথা শুনেছিলেন রানা, মন দিয়েছিলেন ক্রিকেটেই। রানা তখন খুলনার অধিনায়ক, জাতীয় লীগে ম্যাচ শেষ করেই চলে গিয়েছিলেন খুলনাতে। সেখানে গিয়ে আবার নেমে পড়লেন স্থানীয় ক্রিকেটে একটি ম্যাচ খেলতে। সে ম্যাচে ছিলেন বর্তমানে বাংলাদেশ ক্রিকেটে অতি পরিচিত আরেকজন, নুরুল হাসান সোহান। সে ম্যাচের কথা মনে করতেই তার মনে পড়ে সেই মুহূর্তগুলো, “জানেন, রানা ভাই জীবনের শেষ ইনিংসে আমার সাথে ব্যাট করছিল। আমিও সেদিন নটআউট ছিলাম, রানা ভাইও নট আউট ছিল। কিন্তু রানা ভাই তো…”

ম্যাচ শেষে একটি মোটরসাইকেলে সেলিম ও সেতু, আরেকটি মোটরসাইকেলে রানা ও শাওন চেপে বসলেন; উদ্দেশ্য চুকনগর। রাস্তার মাঝপথে শাওনের খুনসুটিতে বিরক্ত হয়ে সেলিমের বাইক থেকে সেতুকে নিয়ে এলেন নিজের বাইকে, সাথে হাত ধরাধরি করে এলো বুঝি মৃত্যুও। বাইকের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মাইক্রোবাসের সঙ্গে সংঘর্ষ, তারপর ইলেকট্রিক পোলের সঙ্গে আরেকটি ধাক্কা। নিমেষেই সব শেষ, পেছনে ফিরে এসে সেলিম-শাওন আবিষ্কার করলেন রানা ও সেতুর রক্তাক্ত নিথর শরীর দুটো। দিনটাকে আজও মেনে নিতে পারেন না মাশরাফি, “ওরা বারবার নিষেধ করছিল… রানাকে আমিও কতবার বলেছি, তুই ভাই জোরে গাড়ি চালাস না। শুনলো না কোনো কথা।”

নিঃসঙ্গ ক্যাপটিই যেন বলে দেয় না বলা অনেক বেদনার গল্প; Source: Cricinfo

খবরটা সবার আগে পেয়েছিলেন দলের অধিনায়ক হাবিবুল বাশার। গোটা দল তখন ত্রিনিদাদের পোর্ট অব স্পেনে। পরের দিন ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে বিশ্বকাপের যাত্রা শুরু, শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি চলছে জমিয়ে। ঠিক এমন সময়ে হঠাৎ একটি ফোনকলে স্তব্ধ হয়ে যান বাশার। খুলনার শোকের মাতম তখন ছড়িয়ে পড়লো ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জেও। বিশ্বকাপের আগে দেশ ছাড়ার সময় অধিনায়ক হাবিবুল বাশারকে রানা বলেছিলেন, “সুমন ভাই, একটা ম্যাচে কিন্তু জিততেই হবে।” সে কথাই যে হবে শেষ স্মৃতি, তা কি দূরতম ভাবনাতেও আনতে পেরেছিলেন বাশার! তবু তাতে কিচ্ছু যায়-আসে না আর, সংবাদটা যে দলকে জানাতেই হবে। বুকে পাথর চেপে সে দায়িত্ব পালন করলেন অধিনায়ক, জলোচ্ছ্বাস হয়ে সে সংবাদ ড্রেসিংরুমকে ভাসিয়ে নিলো আবেগের সমুদ্রে। তবে সেখানে ছিলেন না মাশরাফি, তাকে জানানো হয়েছিল সবার পরে। সংবাদটা পেয়ে বুকফাটা আর্তনাদ বেরিয়ে এসেছিলো তার মুখ থেকে, “রানা, এটা তুই কী করলি?” সে রাতে ঘুমাতে পারেননি কেউ, একটা রুমে কোনোমতে এ কোনে ও’ কোনে পড়ে ছিলেন সবাই মিলে।

পরদিন ম্যাচ শুরুর আগে সকালবেলায় টের পাওয়া গেলো, মাশরাফির গায়ে জ্বর। ডাক্তার দেখলেন, শরীরের তাপমাত্রা ১০৩ ডিগ্রি ফারেনহাইট ছুঁয়ে ফেলেছে। অধিনায়ক হাবিবুল বাশার কাঁধে হাত রেখে একবার জিজ্ঞেস করলেন, “ম্যাশ, পারবি?” চোয়াল শক্ত হয়ে এলো মাশরাফির, “না পারলেও খেলতি হবে সুমন ভাই। রানার জন্য খেলতি হবে।” বন্ধুবিয়োগের সে শোক রূপ নিলো শক্তিতে। রানার দুই বন্ধু মাশরাফি-রাজ্জাকের বোলিংয়ের তোপে মাত্র ১৯১ রানেই গুটিয়ে গেলো শচীন-সৌরভ-দ্রাবিড়-লক্ষ্মণদের নিয়ে গড়া ভারতের ভয়াবহ ব্যাটিং লাইনআপ। হাবিবুল বাশার রেখেছিলেন রানার কথা, তারই নেতৃত্বে ভারতের বিপক্ষে দাপুটে এক জয় তুলে নিয়েছিলো বাংলাদেশ। সে ম্যাচে বাংলাদেশের জার্সি পরে নামা এগারোজন যোদ্ধার সঙ্গে অস্ফুটে ছিলেন রানাও, ছিলেন সকলের হৃদয়ে।

ম্যাচে খেলতে নামার আগে রানা-সেতুর মৃত্যুতে দুই দলের নীরবতা পালন; Source: Cricinfo

ছয় টেস্টে একটিমাত্র ফিফটিসহ ২৫.৭০ গড়ে ২৫৭ রান, সাথে ৮০ গড়ে মাত্র পাঁচটি উইকেট। সে তুলনায় ওয়ানডে ক্যারিয়ারটা একটু দেখার মতো, ২৫ ম্যাচে ২০.৬৮ গড়ে একটি ফিফটিসহ ৩৩১ রানের পাশে ৩০ গড়ে ২৩টি উইকেট। ক্যারিয়ারটা যে পরিসংখ্যানগত দিক থেকে খুব বর্ণাঢ্য ছিল, তা দাবি করা যায় না। কিন্তু এই পরিসংখ্যান বোঝাতে পারে না রানার গুরুত্বটা, বোঝাতে পারে না জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজে ০-২ ব্যবধানে পিছিয়ে থাকা বাংলাদেশ কীভাবে রানার কাঁধে চেপে জিতেছিল ৩-২ ব্যবধানে। বোঝাতে পারে না বাংলাদেশ ক্রিকেটের হাহাকার, বোঝাতে পারে না একটি জাত অলরাউন্ডারের সন্ধানে হা-হুতাশ করতে থাকা একটি দলের জন্য রানার দেখানো রঙিন স্বপ্নের তাৎপর্য। “পরিসংখ্যান একটা আস্ত গাধা” বলে একটা প্রবাদ রয়েছে বটে, তবে রানার ক্ষেত্রে সেটা রীতিমতো নির্মম রূপ ধারণ করে!

রানাকে দেওয়া কথা রেখেছিলেন হাবিবুল বাশার, জিতেছিলেন ম্যাচ; Source: Facebook

সামান্য একটু আলোর উপস্থিতি ঠাহর করতে পারলেও ঘুমাতে পারতেন না রানা। ঘরের আলো তো নয়ই, পাঁচ তারকা হোটেলের করিডোরে জ্বলতে থাকা মিষ্টি আলোটুকুও যদি কোনোক্রমে রুমে আসে, ঘুম হতো না তার। তার অন্ধকার চাই, গাঢ় অন্ধকার। তাই বোধহয় সবাইকে ছেড়ে পাড়ি জমালেন পরলোকে, সেখানে কবরের নিকষ অন্ধকারে বেশ শান্তিতে ঘুমিয়ে আছেন তিনি। দিন গড়িয়ে যায়, মাস পেরিয়ে বছর গড়ায়। আর আমাদের আক্ষেপ বাড়ে, আমাদের একজন রানা ছিল! তিনি আমাদের বহুল প্রতীক্ষিত সেই অলরাউন্ডার হতে পারতেন কিনা, বলা মুশকিল। তবে সে সম্ভাবনা যে পুরোদমে ছিল তার, এ বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ জাগার অবকাশ নেই। তিনিই প্রথম বাংলাদেশি খেলোয়াড়, যিনি আইসিসি উদীয়মান তারকা তালিকায় প্রথমবারের মতো জায়গা করে নিয়েছিলেন। কেভিন পিটারসেন, ইয়ান বেল, গৌতম গম্ভীর, এবি ডি ভিলিয়ার্সের মতো নামের পাশে শেষ অবধি জিততে পারেননি বটে, তবে এ স্বীকৃতিই প্রমাণ করে তার সামর্থ্য। কে জানে, সময় পেলে হয়তো আকাশ ছুঁতে পারতেন।

কেভিন পিটারসেন, ইয়ান বেল, গৌতম গম্ভীর, এবি ডি ভিলিয়ার্সের নামের পাশে জ্বলজ্বল করছে রানার নামটাও; Source: Facebook

রানার স্বপ্ন ছিল বিশ্বকাপে খেলবেন একদিন, বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করবেন লাল-সবুজ জার্সিটা গায়ে চড়িয়ে। সেদিন পোর্ট অব স্পেনে মাঠে ছিলেন রানাও, সতীর্থদের হৃদয়ে মিশে গিয়ে হয়ে উঠেছিলেন জয়ের উপলক্ষ। আমরা সেদিন রানার জন্য খেলেছিলাম, রানার জন্য জিতেছিলাম। কোনোদিন যেখানে আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার সুযোগ পাননি, তার স্মৃতিকে ধরে রাখতে খুলনার সেই শেখ আবু নাসের স্টেডিয়ামের একটি স্ট্যান্ডের নাম বদল করে রাখা হয়েছে ‘মানজারুল ইসলাম রানা স্ট্যান্ড’। যে স্টেডিয়ামের কোল ঘেঁষা এক বাড়িতে বেড়ে উঠেছেন রানা, আজ সেখানে শুধুই শূন্যতা। আর বুকের এক কোণে জমে থাকা একগুচ্ছ বেদনার নীলপদ্ম, সেখানে আজও আক্ষেপ আর ভালোবাসার পদচারণা অবিরত।

Featured Image Source: Cricinfo

Related Articles