একটি ফুটবল দলের কাছে তাদের জার্সিটি হলো তাদের পরিচয়ের বাহক। এতে মিশে থাকে আবেগ, ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ। মাঠে সেই জার্সি পড়ে নিজেদের উজাড় করে দেন খেলোয়াড়েরা। তবে অনেক সময় এই জার্সি আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায় আরো বড় কিছু হয়ে। এমনই এক গল্প বলব আজ।
২০২১-২২ মৌসুমের জন্য আয়াক্স তাদের তিনটি জার্সি উন্মোচন করে। তাদের মধ্যে তৃতীয় জার্সি হিসেবে যেটি ব্যবহৃত হবে, সেটি রাতারাতি ফুটবল সমর্থকদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে যায়। পুরোপুরি কালো রঙের এই ভি-গলা জার্সিটির কাঁধে এবং হাতায় হলুদ, সবুজ ও লাল - এই তিন রঙের তিনটি আলাদা সেলাই করা ডিজাইন ছিল। এই তিনটি রঙ ক্যারিবীয় অঞ্চলের রাস্তাফারি সম্প্রদায়ের সাথে সম্পৃক্ত। সচরাচর নেদারল্যান্ডের এই ক্লাবটির জার্সি আমস্টারডামের বাইরে তেমন একটা বিক্রি হয় না। তবে বব মার্লের সম্মানে বানানো আয়াক্সের এই তৃতীয় জার্সিটি ফুটবল বিশ্বে রেকর্ডসংখ্যক বিক্রি হয়েছে। বিক্রির প্রথম দিনেই এই জার্সিটি প্রথমদিনে সর্বাধিক বিক্রির রেকর্ড করে এবং পরবর্তীতে আমস্টারডাম ছাড়িয়ে সমগ্র ফুটবল বিশ্বেই ফুটবল পাগলদের দরবারে পৌঁছে যায়।
কিন্তু এই সুন্দর জার্সিটি পড়ে মাঠে খেলার অনুমতি আয়াক্স পায়নি। বলা যায়, এই জার্সিটির আসল ডিজাইনটি পরে তারা মাঠে নামতে পারবে না।
আপনারা আয়াক্সের জার্সিটির পিছনের দিকে কলারের নিচে খেয়াল করে দেখবেন তিনটি ক্রস চিহ্ন রয়েছে। এই তিনটি ক্রস আমস্টারডামের পতাকাকে প্রতিনিধিত্ব করে। তাদের এই নতুন জার্সিতেও তারা এই তিনটি ক্রস চিহ্ন ব্যবহার করে। কিন্তু ক্রসগুলোকে তারা লাল, হলুদ ও সবুজ রঙে রূপায়িত করে, এবং রঙের সাথে সামাঞ্জস্য রেখে ক্রসগুলোর উপরে একটি করে পাখির ছবি বসায়। এই ডিজাইন, রঙ এবং পাখিগুলোই ছিল বব মার্লেকে উদ্দেশ্য করে বানানো। এই তিনটি পাখি মার্লের একটি বিখ্যাত Reggae Anthem-কে প্রতিনিধিত্ব করে। Raggae হলো গানের একটি জেনেরা, যেটার উৎপত্তি গত ষাটের দশকে জ্যামাইকাতে। ইংরেজি Rags শব্দ থেকে এটি এসেছে। আয়াক্স যে গানের প্রেক্ষিতে তাদের জার্সি ডিজাইন করেছে, সেটি হলো 'Three Little Birds'।
বেরসিক উয়েফার নিয়ম অনুযায়ী জার্সিতে এই পাখিগুলো ব্যবহার করা যাবে না। সেখানে নিয়ম হলো, জার্সিতে কোনোরকম আনঅফিসিয়াল প্রচারণা করা যাবে না, আবার এমন কোনো কিছু ব্যবহার করা যাবে না যেটি ক্লাবের সাথে সংশ্লিষ্ট নয় এবং সেটি অন্য কোন কিছুকে পরিষ্কারভাবে প্রতিনিধিত্ব করে। তাই আয়াক্সের মাঠে খেলার জার্সিগুলো হতে হবে পাখি ছাড়া। এ নিয়ে উয়েফার মন্তব্য ছিল যে,
“আয়াক্সের জার্সির পাখিগুলো বব মার্লের গানের সম্মানে করা। এটি আয়াক্স দলের নিজস্ব কিছু নয়। এটি আর্টিকেল ১৩'তে থাকা সরঞ্জাম-সংক্রান্ত নিয়মগুলোর বিপক্ষে যায়। এইজন্য উয়েফার সকল প্রতিযোগিতায় এই পাখিসহ ক্রসগুলো জার্সিতে থাকবে না।”
উয়েফা তাদের ক্লাবগুলোর জার্সির ব্যাপারে খুবই সচেতন। জার্সিটির সাইজ এবং জার্সিতে কী কী থাকতে পারবে, কতগুলি থাকতে পারবে, সবগুলোই তাদের নিয়মমাফিক। জার্সিতে শুধুমাত্র দু'টি ব্যাজ লাগানোর অনুমতি রয়েছে — একটি জার্সি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের, অন্যটি ক্লাবের নিজস্ব মনোগ্রাম। এর বাইরে টুর্নামেন্ট অনুযায়ী বা বিশেষ কোন ব্যাপার, যেগুলোয় সব ক্লাবই অংশ নেয় সেই অনুযায়ী অতিরিক্ত ব্যাজ লাগাতে পারবে। যেমন শোক উপলক্ষে কালো ব্যাজ ধারণ, চ্যাম্পিয়নস লিগের ব্যাজ লাগিয়ে সেই টুর্নামেন্টে খেলা। জার্সির দুই হাতা দুই রংয়ের হতে পারবে না। যদি হয়, তবে অবশ্যই হাতা এক রঙা হতে পারবে না, কোনো একটি ডিজাইন থাকতে হবে সেখানে।
আবার জার্সির সামনে এমনভাবে রং ব্যাবহার করা যাবে না যেটা লম্বালম্বি বা পাশাপাশিভাবে জার্সির পুরো অংশে নেই। এইরকম কিছু নিয়ম যদি গত শতাব্দীতে থাকত, তাহলে আমরা বেশ কিছু ক্লাসিক জার্সির স্বাদ থেকে বঞ্চিত হতাম। ১৯৯৭ সালের পোর্তোর ড্রাগনের ডিজাইন সম্বলিত জার্সিটির কথা আমরা এক্ষেত্রে বলতে পারি। তবে রিয়াল মাদ্রিদের ২০১৪ সালের ড্রাগন ডিজাইনের জার্সিটি পার পেয়ে গেছে শুধুমাত্র ড্রাগনের অবয়বটি জলছাপের মতো দেখতে বলে।
তবে জার্সির ডিজাইনে নাক গলানোয় আমরা উয়েফাকে এভাবে দোষারোপও করতে পারি না। কারণ, এটা নিশ্চিত করতে হয় যে খেলোয়াড়েরা যাতে মাঠে একে অপরকে কোনোরকম অসুবিধা ছাড়াই চিহ্নিত করতে পারে। মাঠে থাকা ২০ জন খেলোয়াড়ের জার্সি এজন্য এমন হতে হয়, যাতে করে দুই গোলরক্ষকের কারোর সাথেই যাতে না মিলে যায়। এমনকি টাচলাইনে থাকে কোচিং স্টাফ এবং অন্য খেলোয়াড়েরাও যাতে কাছাকাছি রংয়ের পোশাকে না থাকে, সেটিও রেফারি খেলার শুরুতেই নিশ্চিত হয়ে নেন।
আয়াক্সের জার্সিতে পাখিগুলো থাকতে না পারলেও ক্রসগুলো থাকবে। কারণ, ক্রসগুলো আমস্টারডামের পতাকা থেকে নেয়া আর আয়াক্স এই আমস্টারডামেরই একটি ক্লাব।
উয়েফা এই জার্সিটি নিষিদ্ধ করলেও আয়াক্সের এটি বিক্রি করা থেমে থাকেনি। আসলে আয়াক্স এই জার্সিটি বাজারে ছাড়ার আরো এক বছর আগেই উয়েফার কাছে এই ডিজাইনটি পাঠিয়েছিল। সেখানে উয়েফা পাখিগুলো নিয়ে আপত্তি করায় তারা নিজেদের খেলার জার্সিগুলো থেকে শুধু পাখিগুলো সরিয়ে ফেলে। বর্তমান সময়ে জার্সি প্রস্তুতকারকেরা এক বছর আগেই জার্সির ডিজাইন উয়েফাকে দেখিয়ে তার অনুমোদন নিয়ে আসে। শেষ সময়ে যাতে কোন ঝামেলা না হয়, সেজন্যই এই ব্যবস্থা। ডিজাইন নিয়ে উয়েফার কোনো আপত্তি থাকলে তা এই সময়েই সংশোধন করে ফেলা সম্ভব।
অ্যাডিডাসের তৈরি আয়াক্সের এই জার্সিটিও উয়েফার কাছে দেওয়ার আগেই তারা নিজেরাই জানত যে, উয়েফা এর অনুমোদন দেবে না। কারণ উয়েফার রুলবুকে পরিষ্কার করে বলা, কলারের নিচের অংশে শুধুমাত্র দলের পরিচয় বহন করে এমন কিছু থাকতে পারবে। এক্ষেত্রে চমকপ্রদ একটি কাজ করে অ্যাডিডাস। একই সাথে তারা এই জার্সিটি দুইরকম করে বানান। একটি সমর্থকদের জন্য বানানো হয়, অন্যটি শুধু মাঠে খেলার জন্য। দুইটি জার্সিতে পার্থক্য কোথায়? শুধু এই তিনটি পাখি থাকবে না।
মাঠে খেলার জার্সিতে যে পাখি নেই, এটি দর্শকেরা প্রথম খেয়াল করেন ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে ডাচ লিগে এইসি জুওলের সাথের খেলায়। ২-০ গোলে জেতা সেই খেলায় দর্শকরা পাখির ছবি সম্বলিত জার্সি পড়ে মাঠে এসে দেখেন মাঠে খেলোয়াড়রা যেটি পড়ে আছেন, তাতে কোনো পাখির ছবি নেই। তাদের পরিহিত জার্সিটি যে উয়েফা কর্তৃক নিষিদ্ধ, সেদিনই তা সামনে আসে। তবে এতে আয়াক্স বা অ্যাডিডাস কারোরই কোনো লস হয়নি, উল্টো জার্সি বিক্রি বেড়ে যায়। সেই সাথে ফ্যানরাও প্রচুর পরিমানে কিনে নেয় এটি। কিন্তু আয়াক্সের সাথে বব মার্লের সম্পর্ক কোথায় যে আয়াক্স তার সম্মানে একটি অফিসিয়াল ম্যাচ ডে জার্সিই বানিয়ে ফেলল?
এর জন্য আমাদের ফিরে যেতে হবে ২০০৮ সালে। সেই বছর আয়াক্স একটি প্রাক-মৌসুম প্রীতি ম্যাচ খেলে কার্ডিফ সিটির বিপক্ষে। সেটি ছিল ঐ মৌসুমে কার্ডিফের শেষ প্রাক-মৌসুম খেলা। খেলাটি শেষ হয় 0-0 গোলে। খেলার পর এতদূর আসা আয়াক্স সমর্থকদের আরো কিছু সময় মাঠে রাখার জন্য কার্ডিফ সিটির স্টেডিয়ামের সাবেক ঘোষক আলি ইয়াসিনকে স্টেডিয়ামের ঘোষণা মাইকে গান বাজাতে বলে কর্তৃপক্ষ। আলি ইয়াসিন যে গানটি বাজান, সেটি ছিল বব মার্লের গাওয়া 'থ্রি লিটল বার্ডস' গানটি।
এর আগে আয়াক্সের নিজেদের কোনো সংগীত ছিল না সমর্থকদের জন্য। এই দিনের পরে আয়াক্সের সমর্থকদের কাছে তাদের এনথেম হয়ে যায় 'থ্রি লিটল বার্ডস'। ভক্তরা সেদিন এই গানটি মাঠে খুবই উপভোগ করে। আয়াক্স সেদিন ওল্ড নিনিয়ান পার্ক থেকে জয় নিয়ে ফিরতে না পারলেও দর্শকরা সেখান থেকে নিয়ে যায় গানটি। সেদিনের এই অল্প সময়ের ঘটনাটি পরবর্তীতে বিশাল তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। দর্শকরা প্রতিটি খেলাতেই গ্যালারিতে আসত এই গানটি গাইতে গাইতে, খেলার আগেও দর্শকদের মুখে আয়াক্সের বন্দনার সাথে থাকত এই গানটি। তাই কিছুদিন পর এটিকে অফিসিয়ালভাবে ক্লাবের অ্যানথেম হিসেবে প্রতিটি খেলাতেই ইয়োহান ক্রুইফ অ্যারেনাতে বাজানো শুরু করে কর্তৃপক্ষ, যা এখনো চলছে।
বব মার্লের ছেলে কাই-মানি মার্লে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে এইকে এথেন্সের সাথে খেলার সময় হাফটাইমে মাঠে নেমে এসে দর্শকদের জন্য এই 'থ্রি লিটল বার্ডস' গানটি পরিবেশন করেন। কাকতালীয়ভাবে আয়াক্সও সেই ম্যাচটি জেতে ৩-০ গোলে। তার বাবার গান একটি ফুটবল দলের সমর্থকদের কাছে এত জনপ্রিয় হয়ে ওঠা নিয়ে তিনি বলেন,
“আমার বাবা ছিলেন খুব বড় একজন ফুটবল ফ্যান। তিনি যদি শুনতে পেতেন যে তার 'থ্রি লিটল বার্ডস' গানটি আয়াক্সের স্টেডিয়ামের সবাই একসাথে এভাবে গেয়েছে, তাহলে তার ছিল সেটি হতো অনেক বেশি কিছু।”
Dean Mouhtaropoulos
এটি সত্য যে বব মার্লে একজন বড় ফুটবল সমর্থক ছিলেন, স্কটিশ ক্লাব সেল্টিকের একজন ভক্ত ছিলেন তিনি। এমনকি এ-ও শোনা যায় যে ছোট থাকতে একজন মিডফিল্ডার হিসেবে তিনি পরীক্ষাও দিয়েছিলেন সেল্টিক পার্কে। এছাড়াও তার আরেক ছেলে রোহান মার্লের কাছ থেকে জানা যায়, তিনি যখন তার ব্যান্ড নিয়ে ইউরোপ ট্যুরে থাকতেন, তখন সেল্টিকের খেলাগুলো রেকর্ড করতেন এবং এরপর যখন ট্যুর শেষে বাসায় ফিরতেন, তখন এই পুরনো খেলাগুলো তার সন্তানদের সাথে জাঁকালোভাবে দেখতেন।
১৯৭৭ সালে যখন তার Exodus অ্যালবামের কাজ শুরু হয়, যার একটি গান ছিল এই Three Little Birds, তখন তিনি থাকতেন লন্ডনে। তার ব্যস্ত কর্মসূচিতে যে অল্প কিছু সময় বিরতি পেতেন, সেই সময়ে হেঁটে বেড়াতেন টেমস নদীর আশেপাশে। সেখান থেকে প্রায়ই যেতেন ব্যাটারসি পার্কে, তার ব্যান্ড দি ওয়েইলার্সকে সাথে নিয়ে। সেখানে তারা নিজেদের মধ্যেই ফুটবল খেলতেন। বর্তমানে সেই ৪২, ওকলে স্ট্রিটের বাইরে একটি নীল রঙের ফলক বসানো হয়েছে বব মার্লের জীবনের এই সময়গুলোকে স্মরণে রাখতে। এটি ছিল তার মৃত্যুর খুব অল্প কয়েক বছর আগের ঘটনা। এরপর ১৯৮১ সালে মাত্র ৩৬ বছর বয়সে তিনি পরপারে পাড়ি জমান।
বব মার্লে অমর হয়ে আছেন তার গানগুলোর জন্য। সংগীত অনুরাগীরা তাকে অমর করে রাখার দায়িত্ব নিয়েছিল। সেই তালিকায় এখন তাকে অমর করে রাখার দায়িত্ব নিজেদের কাছে নিয়ে নিয়েছে আয়াক্স সমর্থকরাও। তার মৃত্যুর ২৭ বছর পর তার গানকে আপন করে নিয়েছে আয়াক্স, যাদের স্টেডিয়ামে তার গান এখন প্রতিদিন হাজারো কন্ঠে ধ্বনিত হয়। অফিসিয়ালি না পারলেও আয়াক্স তাকে আন-অফিসিয়ালি জার্সিতে জায়গা দিতে পেরেছে, এটাও কি কম কিছু?
This article is in Bangla language. This is about the 'banned' jersey of Ajax and why FIFA banned it.
Featured Image Credit: Erwin Spek
Background Image Credit: Sportsify!
References:
2. https://www.mirror.co.uk/sport/football/news/ajax-bob-marley-shirt-banned-24974096
3. https://en.as.com/en/2021/09/13/soccer/1631561966_961886.html