Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

আভিজাত্যের জয় নাকি নতুনের উত্থান

এমন ঘটনা এবারই প্রথম নয়। কোনো দল হয়তো টুর্নামেন্ট শুরুর পর হুট করে স্রোতের বিপরীতে কোনো ফেভারিট দলকে হারিয়ে আত্মবিশ্বাস পেয়ে যায়, কিংবা কোনো দল হয়তো সোনালি প্রজন্ম পেয়ে টুর্নামেন্টে ভালো করে। তবে ফুটবলের অতীত ইতিহাস লক্ষ্য করলে দেখা যায়, বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হবার জন্য ভালো দল, ভালো খেলোয়াড়ের পাশাপাশি ফুটবল ঐতিহ্যটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, ইংল্যান্ড, ইতালি, জার্মানি, ফ্রান্স, উরুগুয়ে, স্পেন আর নেদারল্যান্ড- এই কয়েকটি ঐতিহ্যবাহী ফুটবলের দলের মাঝে একমাত্র নেদারল্যান্ডেরই এখনো পর্যন্ত তিনটা ফাইনাল খেলেও কাপ পাওয়া হয়নি। এই কয়েকটি দল বাদে বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনাল খেলেছেই আর মাত্র ৩টি দল; হাঙ্গেরি, চেকোস্লোভাকিয়া আর সুইডেন। সেটাও সর্বশেষ ১৯৬২ সালের বিশ্বকাপে। তবে এরা কখনোই চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি।

চ্যাম্পিয়ন হতে না পারলেও প্রায় প্রতি বিশ্বকাপেই হিসেবের বাইরে থাকা কোনো দলের অন্তত সেমিফাইনাল খেলাটা মোটেও বিস্ময়ের কিছু নয়। বরং একমাত্র গত বিশ্বকাপটা বাদ দিলে তার আগের ৫টি বিশ্বকাপেই কোনো না কোনো নতুন দল ফেভারিট দলগুলোকে টপকে সেমিফাইনালে পৌঁছেছে। ১৯৯৪ সালের সুইডেন এবং বুলগেরিয়া, ১৯৯৮ সালের ক্রোয়েশিয়া, ২০০২ সালের তুরস্ক এবং দক্ষিণ কোরিয়া, ২০০৬ সালের পর্তুগাল কিংবা ২০১০ সালের উরুগুয়ে– টুর্নামেন্ট শুরুর আগে কেউই ভাবেনি যে ঐতিহ্যবাহী অনেক দলকে টপকে এরা সেমিফাইনালে উঠবে। তাদের এই পর্যায় পর্যন্ত আসা কিংবা আসার ধাপগুলো অনেকটাই চমকের মতো ছিল। একটু লক্ষ্য করা যাক।

১৯৯৪ বিশ্বকাপে বুলগেরিয়া তাদের প্রথম ম্যাচটা হেরে যায় নাইজেরিয়ার কাছে, সেটাও ৩-০ গোলের বড় ব্যবধানেই। পরের ম্যাচে গ্রিসকে হারালেও কেউ ভাবেনি যে শেষ ম্যাচে আর্জেন্টিনাকে তারা হারাতে পারবে। তবে টুর্নামেন্টের মাঝপথে ম্যারাডোনাকে হারিয়ে মনোবল হারানো আর্জেন্টিনাকে ২-০ গোলে হারিয়েই দ্বিতীয় পর্বে যায় বুলগেরিয়া। দ্বিতীয় পর্বে মেক্সিকোকে টাইব্রেকারে হারালেও সবাই ভেবে নিয়েছিল কোয়ার্টার ফাইনালেই থেমে যাবে তাদের পথচলা, ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন জার্মানির কাছে।

‘৯৪-এর বিশ্বকাপে জার্মানিকে হারিয়ে চমক দেখিয়েছিলো বুলগেরিয়া; Image Source: Fifa

৪৭ মিনিটে জার্মানি গোল করে এগিয়ে যাবার পর ৭৫ আর ৭৮ তম মিনিটে বুলগেরিয়ার পরপর দুই গোল করে ফিরে আসাটাই ছিল মূল চমক। তবে তাদের এই রূপকথা থেমে যায় সেমিফাইনালে, আরেক ঐতিহ্যবাহী দল ইতালির বিপক্ষে ২-১ গোলে হেরে।

১৯৯৮ সালের ক্রোয়েশিয়া যেন আরেকটু দুর্ভাগা। আর্জেন্টিনার গ্রুপ থেকে রানার্স আপ হয়ে নক আউট পর্বে ওঠে তারা। দ্বিতীয় পর্বে রোমানিয়াকে হারালেও আসল চমকটা দেখায় কোয়ার্টার ফাইনালে জার্মানিকে হারিয়ে। সেমিফাইনালে স্বাগতিক ফ্রান্সের বিপক্ষে প্রথমে গোল করে এগিয়েও যায়। কিন্তু সাথে সাথেই ম্যাচে ফেরত আসে ফ্রান্স। ২ গোল করে লিলিওঁ থুরাম ফাইনালে নিয়ে যায় ফ্রান্সকে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ফ্রান্সের জার্সি গায়ে থুরামের গোল ঐ ২টিই!

‘৯৮-এর বিশ্বকাপে চমক দেখানো ক্রোয়েশিয়া; Image Source: FIFA.com

২০০২ বিশ্বকাপের চমক ছিল মূলত সেনেগাল। ফ্রান্সের গ্রুপ থেকে পরের পর্বে উঠে আসায় গ্রুপপর্ব থেকেই বাদ পড়ে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স এবং আরেক সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন উরুগুয়ের মতো দল। কিন্তু কোয়ার্টারেই থেমে যায় তাদের রূপকথা তুরস্কের কাছে। দুর্দান্ত খেলেও সেই তুরস্ক ১-০ গোলে হেরে যায় সেমিফাইনালে রোনালদো-রিভালদো-রোনালদিনহোদের ব্রাজিলের কাছে। ২০০৬ সালে পর্তুগালের সোনালি প্রজন্ম নেদারল্যান্ডকে দ্বিতীয় পর্ব আর ইংল্যান্ডকে কোয়ার্টার ফাইনালে হারিয়ে সেমিফাইনালে আটকে যায় জিদানের ফ্রান্সের কাছে। ২০১০ সালের বিশ্বকাপে উরুগুয়ের যাত্রা শেষ হয় সাবেক চ্যাম্পিয়ন জার্মানির কাছে। প্রশ্ন হচ্ছে- প্রতিটা দলই সেমিফাইনালে এসে সাবেক কোনো চ্যাম্পিয়ন দলের কাছেই কেন বাদ পড়ছে?

এখন আজ থেকে শুরু হওয়া সেমিফাইনালেও কি আগের ঘটনাগুলোর পুনরাবৃত্তি ঘটবে নাকি ১৯৩৮ সালের বিশ্বকাপের পর প্রথমবারের মতো এমন দুটো দলের মাঝে ফাইনাল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে যারা এর আগে কখনোই বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলেনি? ১৯৩০ সালের বিশ্বকাপ ছিল ইতিহাসের প্রথম বিশ্বকাপ। কাজেই সেই টুর্নামেন্টের ফাইনালের মুখোমুখি দুই দল প্রথমবারই ফাইনাল খেলবে। এরপর ১৯৩৮ সালের দুই দলও নতুন ছিল। কিন্তু এরপর থেকে প্রতিটা বিশ্বকাপের ফাইনালে দুই দলের অন্তত একটি দলের বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলার পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল। এবার বেলজিয়াম আর ক্রোয়েশিয়া ফাইনাল খেললে প্রথম দুই বিশ্বকাপের পুনরাবৃত্তি আরেকবার ঘটবে। প্রশ্ন হচ্ছে, সেটা কি সম্ভব?

হ্যাজার্ড, লুকাকু এবং ডি ব্রুইনা- বেলজিয়ামের সোনালী প্রজন্মের তিন সেনানী; Image Source: Metro

অসম্ভব বলে আসলে কিছুই নেই, বিশেষ করে ফুটবলে। এই বিশ্বকাপেই যেমন প্রথমবারের মতো বিশ্ব দেখছে ব্রাজিল-জার্মানি-আর্জেন্টিনাবিহীন সেমিফাইনাল। সামনের ম্যাচ দুটোতে বেলজিয়াম আর ক্রোয়েশিয়ার জয় পাওয়ার জন্য তাই কোন কাজটা করতে হবে?

বড় দলের বিপক্ষে বড় ম্যাচে লড়াইয়ে জিততে হলে কিছু বিষয় নিজের পক্ষে থাকা প্রয়োজন। বড় দলগুলোর সুবিধা হচ্ছে তারা খারাপ সময়টাতেও দাঁতে দাঁত চেপে থেকে অল্প সুযোগ পেয়েও সেটা কাজে লাগিয়ে জিতে যেতে পারে। জার্মানি আর দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দল যখন বাঁচা-মরার ম্যাচে মুখোমুখি হয়, তখন দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দলকে জয় পেতে হলে নিজেদের সামর্থ্যের শতভাগ দিতে হয় এবং একইসাথে এটাও প্রার্থনা করতে হয় যাতে জার্মানি তাদের সামর্থ্যের অর্ধেকও খেলতে না পারে। এটাই বাস্তবতা। খারাপ সময়েও তারা সহজে হাল ছেড়ে দেয় না। কিন্তু তুলনামূলক ছোট দলগুলো তাদের অনভিজ্ঞতার কারণে একটা পর্যায়ে হাল ছেড়ে দেয়। এই বিষয়টাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ম্যাচের ফল নির্ধারণে ভূমিকা রাখে।

ক্রোয়েশিয়াও পেয়েছে সোনালি প্রজন্ম; Image Source: Premier League – TheFantasyFootball

বড় দলগুলোর বিপক্ষে জয় পাওয়ার জন্য আর একটি জিনিস খুব প্রয়োজন, সেটি হচ্ছে নির্দিষ্ট ম্যাচে তাদের চাইতে ভালো খেলার সাথে সাথে অল্প একটু ভাগ্যের সহায়তা। বেলজিয়াম বনাম ব্রাজিল ম্যাচে বেলজিয়াম সেই সহায়তাটুকু পেয়েছে। বিশেষ করে শেষের ২০ মিনিট ব্রাজিল যেভাবে আক্রমণ করে চলেছিল তাতে আরেকটা গোল পেয়ে ম্যাচে ফেরত আসাটা খুব অস্বাভাবিক ছিল না। বেলজিয়াম গোলরক্ষক কর্তোয়ার অসাধারণ কিছু সেভ এবং ব্রাজিলিয়ানদের তার চাইতেও অসাধারণ কিছু মিস তাদেরকে ম্যাচে ধরে রেখেছে। অবশ্য ম্যাচটা বেলজিয়াম হেরে গেলেও তাদের প্রতি অবিচার করা হতো। ২ গোলে এগিয়ে যাবার পর পিছিয়ে যাওয়া দল আক্রমণ করা আর এগিয়ে থাকা দলের ডিফেন্ড করাটাই স্বাভাবিক। সমস্যা হচ্ছে একটা গোল পরিশোধ করার পর ব্রাজিল যতটাই আশাবাদী হয়ে উঠেছিল, বেলজিয়াম যে ঠিক ততটাই স্নায়ুচাপে ভুগছিলো। এমন ঘটনা সেমিফাইনালে ফ্রান্সের বিপক্ষেও ঘটার সম্ভাবনা প্রবল। সেদিন স্নায়ু শীতল রাখতে না পারলে জয় পাওয়াটা খুব দুরূহ হবে।

ক্রোয়েশিয়ার জন্য কাজটা তুলনামূলক সহজ। ফ্রান্সের তুলনায় ইংল্যান্ড অবশ্যই তুলনামূলক সহজ প্রতিপক্ষ। তাছাড়া টুর্নামেন্টে ইতিমধ্যেই দুটো নক আউট ম্যাচেই ভাগ্য তাদের উপর থেকে মুখ ফেরায়নি। পর পর দুই ম্যাচে টাইব্রেকারে জয় সেই সাক্ষ্যই দেয়। আর মাত্র একটা ম্যাচে ভাগ্য মুখ ফিরিয়ে না নিলেই ভালো খেলেই ইংল্যান্ডকে হারিয়ে তাদের পক্ষে ফাইনাল যাওয়া সম্ভব।

কথা হচ্ছে ফ্রান্স আর ইংল্যান্ড কি হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবে? দুর্দান্ত একটা প্রজন্ম নিয়েও গত ইউরোর ফাইনাল থেকে ফ্রান্সকে ফিরতে হয়েছে খালি হাতে। এবারের দলটা আরও দুর্দান্ত।

গ্রিজম্যান, এমবাপ্পে, জিরুঁ, কান্তে, পগবা, উমতিতি- এমন একটা স্কোয়াড পাওয়া যেকোনো কোচের জন্য স্বপ্নের মতো। ফর্মের বিচারেও তারা এই মুহূর্তে বেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে।

গ্রিজম্যানও ধীরে ধীরে ঔজ্জ্বল্য ছড়াচ্ছে; Image Source: YouTube

আরেক সাবেক চ্যাম্পিয়ন দল ইংল্যান্ডের সামনেও রয়েছে কাপ জয়ের সুবর্ণ সুযোগ। বেকহাম, জেরার্ড, ল্যাম্পার্ড, রিও ফার্দিনান্ড, ওয়েন রুনি- এরকম দুর্দান্ত স্কোয়াড নিয়েও এর আগের অনেক বিশ্বকাপে তারা হেরে গিয়েছে তাদের চেয়েও সেরা দলের মুখোমুখি হয়ে।

২০০২ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড কোয়ার্টার ফাইনালেই বাদ পড়েছিলো দুর্ধর্ষ ব্রাজিলের মুখোমুখি হয়ে। ২০০৬ বিশ্বকাপে বাধ সাধলো জার্মানি। এসব কারণেই কি না বেলজিয়ামের বিপক্ষে গ্রুপপর্বের শেষ ম্যাচে ইচ্ছে করেই হয়তো হেরে গিয়ে গ্রুপ রানার্স আপ হয়ে গেলো ইংল্যান্ড। স্পেন বাদে আর কোনো বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন দলই ছিল না এ পাশে। দ্বিতীয় পর্বে স্পেনও রাশিয়ার কাছে হেরে গিয়ে ইংল্যান্ডের হয়তো আরেকটু সুবিধেই করে দিল। তবে সুবিধে শুধু পেলেই হয় না, সেটাকে কাজেও লাগাতে হয়। আগামীকালই দেখা যাবে ইংল্যান্ড সেটা কতটুকু কাজে লাগাতে পারে।

ইংল্যান্ডের আশা হ্যারি কেইন; Image Source: FOX Sports Asia

চারটা দল, প্রতি দলের সামনে মাত্র দুটো ম্যাচ। আগামী চার বছরের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন উপাধি পাওয়ার জন্য সামনের এই দুইটি ম্যাচই গুরুত্বপূর্ণ। পরীক্ষায় ৭০ পাওয়া একজন ছাত্রকে ৯০ পাওয়ার জন্য যতটা শ্রম দিতে হয়, ৯০ পাওয়া ছাত্রকে ৯৩ পেতে তার চেয়ে বেশি শ্রম দিতে হয়। এই মূহুর্তে এই চারটি দলের অবস্থাই অনেকটা এমন। বাছাইপর্ব থেকে শুরু করে প্রস্তুতি ম্যাচ কিংবা টুর্নামেন্টের শুরু থেকে এই পর্যন্ত আসার জন্য যে শ্রমটা দিতে হয়েছে, বাকি দুটো ম্যাচে জয় পেতে হলে তার চেয়ে বেশি শ্রম দিতে হবে। আগের ইতিহাস লক্ষ্য করলে ফাইনালটা ইংল্যান্ড আর ফ্রান্সের মাঝেই হবার কথা। কিন্তু এই বিশ্বকাপ এখন পর্যন্ত এতটাই চমক দেখিয়েছে যে সম্পূর্ণ নতুন দুই ফাইনালিস্ট দেখলেও দর্শকরা অবাক হবে না নিশ্চিত। এখন দেখার বিষয় হচ্ছে বিশ্বকাপটা অভিজাত কোনো দেশেই যায় নাকি নতুন কোনো দেশ অভিজাতের স্বীকৃতিটা পায়। অপেক্ষার শুরুটা আজ থেকেই, শেষ হবে আর মাত্র ৬ দিন পরেই।

ফিচার ইমেজ: Fox Sports

Related Articles