বিজ্ঞান, বুদ্ধিমত্তা সাথে শিল্পের ছোঁয়া, সব এক করলে পাওয়া যায় দাবা! ক্ষুরধার মস্তিষ্কের এই খেলার সর্বোচ্চ অর্জন হলো বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়া। ক্লাসিক্যাল দাবায় ১৪ তম বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ভ্লাদিমির ক্রামনিক ২০০৫ সালের এক সাক্ষাৎকারে স্মরণ করেছিলেন তার পূর্ববর্তী সকল বিশ্ববিজেতাকে। সেই উইলহেল্ম স্টেইনিজ থেকে শুরু করে সেসময়ের সদ্য সাবেক হওয়া বিশ্বচ্যাম্পিয়ন গ্যারি ক্যাসপারভ পর্যন্ত সবার কথাই আলোচিত হয়েছে। রুশ চেস ম্যাগাজিন e3e5-এ প্রকাশিত সেই সাক্ষাৎকারের আজকে থাকছে প্রথম পর্ব। উপস্থাপক হিসেবে ছিলেন ইন্টারন্যাশনাল মাস্টার ভ্লাদিমির বারস্কি।
ক্রামনিক: দাবার পুরোনো ইতিহাস সম্পর্কে আমার জানার সুযোগ হয়েছে বলতে গেলে অনেক দেরিতে। রাশিয়ার এক মফস্বল তুপসে-তে জন্ম আমার। সেখানে তুলনামূলক নতুন দাবাড়ুদের নিয়ে চর্চা হত, এই যেমন কারপভ, ক্যাসপারভ প্রমুখ। আগেকার দাবাড়ুদের নিয়ে আমি পরে জেনেছি। তাই সাম্প্রতিকদের নিয়ে আলোচনাই আমার কাছে সহজ!
বারস্কি: তরুণ দাবাড়ুদের জন্য কি ধ্রুপদী দাবা বা দাবার আদি ইতিহাস জানা খুবই জরুরি?
ক্রামনিক: আমার মতে, একজন দাবাড়ু যদি ক্যারিয়ারে কিছু অর্জন করতে চায়, তবে এর সবটা জানা দরকার তার। এটা হয়তো আমি যুক্তিতাত্ত্বিক মানদণ্ডে ব্যাখ্যা করতে পারব না। তবে আমি মনে করি দাবার পুরো ইতিহাসে অভিজ্ঞ হওয়া বা একটা মোটামুটি দখল থাকা জরুরি। পুরো দাবার ইতিহাসেই তার বিচরণ করা উচিত।
বারস্কি: শুরু করতে হবে জোয়াকিন গ্রেকো থেকে … ?
বি.দ্র. জোয়াকিনো গ্রেকো ছিলেন সপ্তদশ শতকের একজন ইতালিয়ান দাবাড়ু।
ক্রামনিক: আসলে অত আগের খেলা মনে হয় তেমন জরুরি না, কারণ সেসময় দাবার শুধু প্রাথমিক বিষয়াদি ছিল বলতে গেলে। তবে ফিলিদরের খেলা বিশ্লেষণ করলে ভালো, আর অ্যান্ডারসন, মরফি এদের জানতে হবে নিজের দাবাড়ু সত্ত্বাকে পারফেক্ট করার জন্য।
[আসল শুরুটা হবে স্টেইনিজ থেকে।]
উইলহেল্ম দ্য এক্সপেরিমেন্টর (১৮৩৬-১৯০০)
উইলহেল্ম স্টেইনিজই প্রথম বুঝতে শিখেছিলেন যে, দাবা জটিল খেলা হলেও এরও কিছু না কিছু নিয়মকানুন বেধে দেয়া সম্ভব। তার আগের দাবাড়ুরা কোনো একদিকে শুধু ফোকাস করে যাচ্ছিলেন, যেমন ফিলিদর তার Pawns are the soul of a chess game নীতিতে অটল ছিলেন।
সম্প্রতি আমি চিগোরিন আর ল্যাস্কারের সাথে স্টেইনিজের ম্যাচগুলো সব পর্যবেক্ষণ করেছি। সেগুলো বিশ্লেষণ করে আমার মনে হয়েছে তিনি সব সমস্যার কমন কিছু সমাধান খুঁজে পেতে চেয়েছেন। আর খোলামেলাভাবে বলতে গেলে, অনেক ক্ষেত্রেই তিনি নিজ প্রিন্সিপল থেকে বিচ্যুতও হয়েছেন। খেলার গতিতেও তিনি বেশ ধীর খেলতেন, এটা তার অন্যতম ব্যাকফুটের জায়গা ছিল। উদাহরণস্বরূপ, চিগোরিনের সাথে ম্যাচের কথা বলা যায়। তিনি ইভান্স গ্যাম্বিট খেললেন, কিন্তু দ্রুতই সব পিস অষ্টম র্যাঙ্কে ফিরিয়ে আনলেন। এরকম পজিশনে আমি থাকলে রিজাইন করতাম, সেখানে তিনি ১, ১৫, ১৭ গেমে তিন তিনবার একই স্টাইলে খেললেন। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য ১.৫/৩ স্কোরও তুললেন। তিনি আসলেই একজন প্র্যাকটিশিয়ান ছিলেন।
তিনি গভীর চিন্তাশীল ছিলেন এবং অভিনব আর মৌলিক সব তত্ত্ব নিয়ে হাজির হতেন। উদাহরণস্বরূপ, কিং সম্পর্কে তার অভিমত ছিল, এটি যথেষ্ট শক্তিশালী এবং একাই নিজেকে ডিফেন্ড করতে সক্ষম। যদিও অনেক ক্ষেত্রেই এটি সত্য, তবে দাবার মৌলিক ভিত্তির সাথে সাংঘর্ষিকও বটে! স্টেইনিজের আগে দাবা শুধুই একটা খেলা ছিল, তিনিই প্রথম একে স্টাডি করেছেন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে সবসময় তার সব প্রচেষ্টাই ফলপ্রসূ হত না, এটা স্বাভাবিক। প্রথম বিশ্বচ্যাম্পিয়নের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধা রেখেই আমি বলতে চাই, স্টেইনিজ কোনো চেস স্কুল অফ থটের প্রতিষ্ঠা করে যাননি বটে, তবে তিনি ছিলেন একজন প্রকৃত এক্সপেরিমেন্টর। তিনি দেখিয়ে গিয়েছেন যে, দাবাও অনুশীলনের এবং গবেষণার বিষয়, চাইলে এখানেও কিছু প্যাটার্ন খুঁজে বের করা সম্ভব।
ইম্যানুয়েল দ্য আনক্যাটাগরিক্যাল (১৮৬৮-১৯৪১)
ল্যাস্কারকে আধুনিক দাবার আবিষ্কারক মনে করি আমি। স্টেইনিজের খেলাগুলো খেয়াল করলে আপনি দেখবেন, কিছুটা ঊনবিংশ শতাব্দীর ধাঁচ পাওয়া যায়, যা কিছুটা সেকেলে। পক্ষান্তরে ইম্যানুয়েল ল্যাস্কারের কিছু খেলা এমনও আছে যা দেখে বোঝার উপায় নেই কোনো সময়ের! একেবারেই হালের খেলার ফিল পাবেন। তিনি ট্যাকটিকাল এবং পজিশনাল অ্যাডভান্টেজকে আলাদা করে দেখতে পেরেছিলেন এবং এদের মধ্যে সম্পর্কও ধরতে পেরেছিলেন। ল্যাস্কার স্টেইনিজের থেকে দাবাড়ু হিসেবে শক্তিশালীও ছিলেন। তাদের মধ্যকার ১৮৯৪ সালের বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ ম্যাচটা বলতে গেলে একপেশেই ছিল। এখনকার মতো রেটিং সিস্টেমে তুলনা করতে গেলে বলতে হয় যেন ২৭০০ এবং ২৪০০ রেটিং-এর দুজন লড়ছেন। ম্যাচটা দেখে আমি অবাক হয়েছিলাম। ল্যাস্কার এমনভাবে স্টেইনিজকে গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন যে সেটাকে বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপের বদলে এক্সিবিশন ম্যাচের সাথেই তুলনা করা যায়।
দাবার ইতিহাসে ইম্যানুয়েল ল্যাস্কার আসলেই একজন বড়সড় ব্যক্তিত্ব ছিলেন, আমি তার ম্যাচগুলো মাঝেমাঝেই দেখি আর বিস্ময়াভিভূত হয়ে যাই। তিনিই প্রথম দাবায় মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির গুরুত্ব অনুধাবন করেন এবং এটা নিজের খেলায় কাজেও লাগান। এবং প্রতিপক্ষভেদে আলাদা আলাদা খেলার স্টাইলের ধারণাও তিনিই সামনে আনেন। তিনি এত জটিলভাবে খেলতেন যে, কোনটা সঠিক দাবা আর কোনটা ভুল দাবা এটা বুঝে ওঠাই দায় হয়ে যেত! ল্যাস্কার শিখিয়েছিলেন যে, আপনি চাইলেই খেলার ধরনও আমূল পাল্টে ফেলতে পারেন। তার খেলা কোনো ক্যাটাগরিতে ফেলা যেত না, তিনিই দাবা ইতিহাসের প্রথম আনক্যাটাগরিক্যাল দাবাড়ু! তিনি কোনো বদ্ধ কাঠামোয় বিশ্বাস করতেন না। এরকম খেললে ভালো আর এরকম খেললে খারাপ- এমন প্রথাগত চিন্তাধারা থেকে বের হয়ে আসা শিখিয়েছিলেন ল্যাস্কার, যা কিনা ছিল দাবার চিন্তাজগতকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে বড় এক পদক্ষেপ।
যেসময় ল্যাস্কার স্টেইনিজকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হন, তিনি সমকালীন বাকিদের এমনভাবে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন যে, এমন মনে হয় আর কখনোই সম্ভব নয়। একটা নতুন প্রজন্ম আসার আগপর্যন্ত ল্যাস্কার একরকম বাকিদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই থেকে গিয়েছিলেন। নতুন প্রজন্মের মধ্যে তারাশ-এর মতো খেলোয়াড়রা উঠে এসেছিলেন।
বারস্কি: তার বেশ কিছু ভালো প্রতিদ্বন্দ্বীও ছিল।
ক্রামনিক: হ্যাঁ, তা বটে। রুবিনস্টাইনকে আমরা ভুলে যেতে পারি না, দাবা বোর্ডে যিনি প্রায়শই দারুণ সব মাস্টারপিস তৈরি করতেন। এটা দুঃখজনক যে তিনি বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হতে পারেননি। তিনিও তার সময়ের থেকে এগিয়ে ছিলেন যা তার সেরা ম্যাচগুলো দেখলেই বলে দেয়া যায়।
ল্যাস্কার ২৭ বছর ধরে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ছিলেন, সেসময় চ্যাম্পিয়নশিপ ম্যাচ খেলা এখনকার মতো সহজ ছিল না। এজন্য অনেক শক্তিশালী আর প্রকৃতপক্ষে যোগ্য প্রার্থীই সুযোগ পেতেন না।
বারস্কি: তবে কাপাব্লাঙ্কা অবশ্য যোগ্য ক্যান্ডিডেটই ছিলেন!
হোসে রাউল দ্য জিনিয়াস (১৮৮৮-১৯৪২)
ক্রামনিক: কাপাব্লাঙ্কার ব্যাপারে বলতে গেলে বলতে হয় শুধুই জিনিয়াস! তিনি ছিলেন ব্যতিক্রমী এক দাবাড়ু যে কিনা পল চার্লস মরফির মতো, যেকোনো শতাব্দীতেই এমন প্রতিভা আবির্ভূত হতে পারে। হোক সেটা ঊনবিংশ শতক বা বিংশ। তিনি খেলাটার গতি ধরতে পেরেছিলেন। শৈশবে তার Capablanca Teaches Chess বইটি আমার বেশ লেগেছিল, জটিল নিয়মকানুন তিনি সহজ করে বুঝিয়েছিলেন।
তিনি ছিলেন ন্যাচারাল ট্যালেন্ট, কিন্তু তিনি তেমন কঠোর পরিশ্রম করেননি। অ্যালেখাইন বা ল্যাস্কারের মতো তিনি যদি দাবা বোর্ডে পর্যাপ্ত ঘাম ঝরাতেন, তবে তিনি আরও নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে পারতেন বলে হাইপোথেটিক্যালি বলাই যায়। তবে আমার মনে হয়, এই দুই সত্ত্বা মিউচুয়ালি এক্সক্লুসিভ, অর্থাৎ এই দুয়ের একত্রে মেলবন্ধন পাওয়া যায় খুবই কদাচিৎ। কঠোর পরিশ্রম এ ধরনের ন্যাচারাল ট্যালেন্টের সাথে ঠিক যায় না। হোসে রাউল কাপাব্লাঙ্কাকে আমরা তুলনা করতে পারি মোৎসার্টের সাথে, যার মিউজিক নিজেই একটা বিশেষণ। কাপাব্লাঙ্কা একদম স্পেশাল ছিলেন।
ল্যাস্কারকে যেবার তিনি হারান, ১৯২১ সালের তাদের সেই চ্যাম্পিয়নশিপ ম্যাচে ল্যাস্কারও কিন্ত খারাপ খেলেননি। আমার মতে এটাই ছিল প্রথম কোনো বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ ম্যাচ যেখানে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়েছিল। কাপব্লাঙ্কা ছিলেন তরুণ, প্রাণবন্ত এবং দুরন্ত। শেষ গেমে গিয়ে ল্যাস্কার কিছু ভুল করে বসেন, তাছাড়া পুরো ম্যাচই ছিল সমানে-সমানে লড়াই। ল্যাস্কারের আগের চ্যাম্পিয়নশিপের ম্যাচগুলোতে হয় তিনি প্রতিপক্ষকে গুঁড়িয়ে দিয়েছেন, নতুবা তারা ব্লান্ডারে ভরপুর খেলা খেলত। কিন্তু এই ম্যাচটা ছিল দারুণ, উভয়পক্ষই খুব সামান্য ভুল করেছেন এবং অসাধারণ একটা ম্যাচ হয়েছিল। ল্যাস্কার গ্রেট হতে পারেন, তবে কাপাব্লাঙ্কা ছিলেন ন্যাচারাল জিনিয়াস! সত্যি বলতে কী, এটা আমার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয়েছে যে, অ্যালেখাইন পরবর্তীতে কাপাব্লাঙ্কাকে হারাতে পেরেছিলেন।
বারস্কি: অ্যালেক্সান্ডার অ্যালেখাইনের অধ্যবসায়ই তাকে জিততে সাহায্য করেছে।
আগামী পর্বে আমরা যে ক'জন বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের সম্পর্কে জানবো মিখাইল বতভিনিক তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি বেশ কয়েক মেয়াদে দাবার রাজমুকুট ধরে রেখেছিলেন। রিটার্ন ম্যাচে মিখাইল তালকে হারিয়ে ১৯৬১ সালে তিনি বিশ্বচ্যাম্পিয়নের মুকুট আবারও ফিরে পান। ঐতিহাসিক এই ম্যাচের পর তিনি যে বক্তব্য দেন, সেটি পড়তে চাইলে ঘুরে আসুন:
This following article is the 1st part of the abridged translation of a 2005 interview of Vladimir Kramnik where he discusses all previous chess world champions of the time. The Russian original is here: January 17, 2005 V. Kramnik. "FROM STEINITS TO KASPAROV"
Feature Image: Maria Emelianova/Chess.com