Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

সত্যিই কি ‘পাতানো’ ছিল ১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপ?

বিশ্বকাপ মানেই একটা মাস ক্রীড়াজগত কেবলই ফুটবলময়। আসলে কি শুধু এই একমাসই আমেজ? না। কোনো কোনো বিশ্বকাপ নিয়ে আলোচনা চলে বহুদিন। ১৯৯৮ সালের ফ্রান্সে আয়োজিত বিশ্বকাপ অনেকটা সেই রকমই। প্রচন্ড শক্তিশালী ব্রাজিলের ৩-০ গোলে ফাইনালে ধরাশায়ী হওয়া বা রোনালদোর রহস্যময় ইনজুরি আজও আলোচনার বিষয়। সম্প্রতি সেই আগুনে নতুন ঘি ঢেলেছেন ফ্রান্সের সাবেক লিজেন্ড মিশেল প্লাতিনি এই বলে যে, ফ্রান্স বিশ্বকাপের ফিক্সচার ছিল পাতানো! চলুন শুনে নেয়া যাক প্লাতিনির বক্তব্য।

প্লাতিনির বক্তব্য

“আমরা যখন সূচী প্রণয়ন করি তখন হালকা চাতুরির আশ্রয় নিয়েছিলাম। ফ্রান্স-ব্রাজিল ফাইনাল! এটাই ছিল সবার স্বপ্নের ম্যাচ। আমরা যদি প্রথম হতাম নিজেদের গ্রুপে আর সেই সাথে ব্রাজিলও, তবে আমাদের মধ্যে ফাইনালের আগে দেখা হওয়া সম্ভব ছিল না।” রেডিও স্টেশন ফ্রান্স ব্লিউ স্পোর্টসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন। হাসতে হাসতে আরো বলেন, “আমরা ছয় বছর শুধু আয়োজনেই পার করিনি, কিছু দুষ্টুমিও করেছিলাম! আপনি কি ভাবছেন অন্য স্বাগতিক দেশ সবাই সাধু?”

ব্রাজিল ও ফ্রান্স ছিল সেই সময়ের শীর্ষ দুই দল; Image Source: FIFA.com

আসলে কী হয়েছিল?

বিশ্বকাপের আগে যখন ড্র হয় তার ঠিক দুদিন আগে ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফা ঘোষণা করলো যে, ফ্রান্স ও ব্রাজিল যথাক্রমে গ্রুপ সি ও এ তে থাকবে আর বাকি ফিক্সচার এমনই ছিল যে, তাদের দুই দলের ফাইনালের আগে দেখা হবে না যদি গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়। সাধারণত বিশ্বকাপ ড্র দৈবচয়নে হয়ে থাকে, কিন্তু সেবার ভেতরে ভেতরে যা হয়েছিল তা ছিল গোটাটাই পূর্ব পরিকল্পিত।

কেন এসব করা?

১৯৯৮ সালে র‍্যাংকিংয়ের শীর্ষ দুই দল ছিল রোনালদোর ব্রাজিল আর জিদানের ফ্রান্স। ২৪ বছরের বিশ্বকাপ খরা ১৯৯৪ সালে দূর করার পর থেকেই ব্রাজিল অদম্য। কোপা আমেরিকা, কনফেডারেশন কাপ সব কিছুই জিতে নিচ্ছিল দুর্দম্যভাবে। আর ফ্রান্সে তখন প্লাতিনি পরবর্তী স্বর্ণযুগ চলে। জিদান, পেতিত, থুরামদের ফ্রান্স যে কাউকে ভয় জাগানিয়া দল। কিন্তু তখনও ফ্রান্সের বিশ্বকাপ ভাঁড়ারে ভবাণী! আবার স্বাগতিক দেশ হিসেবে ফ্রান্স তো যুক্তরাষ্ট্র, দ. আফ্রিকার মতো দেশ নয় যে, বিশ্বকাপের দাবিদার নয়।

ফ্রান্সের জেতার মতো রসদ ছিল। কিন্তু ফাইনালের আগে সেই সময়ের ‘রেফারেন্স’ দল ব্রাজিলের সাথে দেখা হওয়ার মানে হলো বাদ পড়ার একটা বড় সম্ভাবনা থাকা। আর সম্ভাবনাময় স্বাগতিকদের বাদ পড়ে যাওয়া মানে গোটা বিশ্বকাপের আর্থিক নানা দিকেই ধ্বস নামা। তাদের পরিকল্পনাও ছিল সফল। ফাইনালেই দেখা হয় ব্রাজিল ও ফ্রান্সের মধ্যে। সেই ফাইনালে গোল করা আর্সেনাল লিজেন্ড এমানুয়েল পেতিত যা বললেন তা আরো ভয়ঙ্কর।

পেতিত একজন ফ্রেঞ্চ লিজেন্ড; Image Source: foxsports.com.br

পেতিতের বক্তব্য

পেতিত গোড়া থেকেই মুখচোরা। একবার এমনও বলেছিলেন যে, ফ্রান্স জার্মান উপনিবেশে থাকলেই ভালো করতো! পেতিত ২০১৬ সালের এপ্রিলে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “এটা কি পাতানো ছিল? আমি নিজে আজ দেড় যুগ পরেও প্রায়ই ভাবি। আমরা কি আসলেই জিতেছিলাম?” একটু থেমে বলেন, “বুঝতে পারি না। আমরা খেলোয়াড়রা মাঠে সর্বস্ব দিয়েছিলাম। আসলেই সব করেছিলাম জেতার জন্য। কেউ কি পর্দার আড়াল থেকে আমাদের কাজটি সহজ করে দিচ্ছিল? আমরা কি আসলেই কারো হাতের পুতুল ছিলাম? আর্থিক দিকের সাফল্য নিশ্চিত করতে আমরাই কি তাদের হাতের পুতুল ছিলাম না?” বলা বাহুল্য, ফাইনালে রোনালদোর রহস্যজনক অসুস্থতার নানা গুজবের একটি ছিল ‘পরিকল্পিতভাবে বিষ প্রয়োগ’, যদিও এর স্বপক্ষে সুদৃঢ় প্রমাণ নেই।

কিভাবে করা হয়েছিল?

সব বিশ্বকাপেই মোটা দাগে দুটি গ্রুপ করা হয়। প্রতি ভাগে ১৬টি করে দল থাকে, মানে ৪টি করে গ্রুপ। একভাগের চার গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন দল অন্য দলের চার গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন দলের সাথে ফাইনালের আগে  খেলতে পারে না। এর আগবধি সাধারণত একভাগে A, B, C, D ও অপরভাগে E, F, G, H । অথবা একভাগে A, C, E, G  ও অপরভাগে B, D, F, H । কিন্তু ফ্রান্স বিশ্বকাপে করা হলো এক ভাগে A, D, E, H ও অপর ভাগে B, C, F, G। সেই সাথে ব্রাজিলকে গ্রুপ A ও ফ্রান্সকে গ্রুপ C-তে দেয়া হলো।

(বাম থেকে) মিশেল প্লাতিনি ও সেপ ব্লাটার; Image Source: The National

এখন এটা কি কেবল ফ্রান্সের একার সিদ্ধান্ত ছিল? না। ড্র এর আগে ফিফার সাথে আয়োজক কমিটির একটি বৈঠক বসে। সেখানে প্লাতিনির সাথে আরেক ফরাসি আয়োজক কমিটির সভাপতিও ছিলেন। ছিলেন সেই সভাপতির ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি ফিফা কমিটির চেয়ারম্যান জোহানসন। সুতরাং বলা বাহুল্য, প্লাতিনির পক্ষে প্রভাব খাটানো খুব একটা কঠিন কিছু ছিলো না। বলে রাখা ভালো, বহু পাপের পাপী সাবেক ফিফা সভাপতি সেপ ব্লাটারও তখন বহাল তবিয়তে! এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগবে, বাকি ড্র-ও কি পাতানো ছিল? এ নিয়ে খুব বেশি কিছু একটা জানা যায় না। তবে পেতিত ও প্লাতিনির ঠারেঠোরে দেয়া বক্তব্য আমলে নিলে পাতানো হলেও তা কি খুব আশ্চর্য কিছু ?

ফ্রান্সের গ্রুপে বাকি তিন দল ছিলো ডেনমার্ক, দ. আফ্রিকা ও সৌদি আরব। অন্যদিকে ব্রাজিলের গ্রুপে ছিল নরওয়ে, স্কটল্যান্ড ও মরক্কো। নকআউট পর্বে ফ্রান্স হারায় প্যারাগুয়ে, ইতালি ও ক্রোয়েশিয়াকে আর ব্রাজিল হারায় চিলি, ডেনমার্ক ও হল্যান্ডকে।

ফ্রান্স ভুল কী করেছিলো?

সেই সময়ে ব্রাজিল দলই ছিল ‘রেফারেন্স’ দল; Image Source: Mic

ফ্রান্স যা করেছিল তা হলো খুব সন্তর্পনে তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীর সাথে আগেই দেখা হওয়ার সম্ভাবনাকে নষ্ট করে দিয়েছিল। টুর্নামেন্টে নিজেদের দেশকে শেষ দিন অবধি টিকিয়ে রেখে আর্থিক ও জাতীয়তাবাদী পুরো লাভটাই নিতে চেয়েছিল কুশীলবরা।  সেই আমলে ব্রাজিল দল আসলেই এড়িয়ে চলার মতো ভয়ঙ্কর ছিল। আর সদ্য বিশ্বকাপ, কোপা আমেরিকা, কনফেডারেশন কাপ জিতে আসা পোড় খাওয়া দলের সাথে আনকোড়া ফ্রান্সের মাঝ পর্যায়ে দেখা হওয়ার চেয়ে ফাইনালে দেখা হওয়াই ভালো ছিলো, কারণ ফাইনাল মানেই আলাদা এক হিসেব। কেবল ফ্রান্সই কি এমন করেছিল?

মোটেও না। ১৯৭৮ সালে আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপের বিতর্ক ফুটবল আলোচনায় এক চিরন্তন বিষয়। ১৯৯৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিজেদের প্রায় পুরো গ্রুপপর্বের সূচীজনিত নিয়ন্ত্রণ ছিল। ১৯৯০ সালে ইংল্যান্ড নিজেদের এমন ভেন্যু দিয়েছিল যেখানে তাদের বিখ্যাত সমর্থকগোষ্ঠী ‘বার্মি আর্মি’দের প্রাচুর্য ছিল।

১৯৭৮ সালের বিশ্বকাপও ছিল প্রচন্ড বিতর্কিত; Image Source: Al Arabiya

কিন্তু ফ্রান্সের সাফল্য কোনো অংশেই কম কৃতিত্বের ছিল না। জিদানদের দল অনেক অসাধ্যই সাধন করেছিল। ভেঙ্গেছিল ইতিহাসের বাঁধা। ঘরের মাঠে খেলা নিঃসন্দেহে দারুণ ব্যাপার, কিন্তু একইসাথে মারাত্মক চাপের ব্যাপারও বটে। ২০০৬ সালে জার্মানি ভেঙে পড়েছিল নিজের দর্শকদের সামনে স্নায়ুচাপের সময়ে, ব্রাজিল দুবারই কাঁদিয়েছিল নিজেদের জনতাকে। ফ্রান্স স্নায়ু ধরে রেখে হারিয়েছিল সেই সময়ের অদম্য ব্রাজিলকে। ফ্রান্স ফুটবলে এটা ছিলো এক নতুন দিগন্ত। আজকে ফ্রান্সের অনেক তারকার বেড়ে ওঠা সেই সময়কে মনের অলিন্দে ধারণ করে। তবে কি এই দায়কে লঘু করে দেখব আমরা?

এটা চিরন্তন সত্য যে, স্বাগতিকরা কিছু সুবিধা নেবেই। ক্রিকেটে পিচ হোক আর ফুটবলে ট্রাভেল শিডিউল। কিন্তু ইচ্ছাকৃতভাবে কেবল বাণিজ্যিক স্বার্থ সিদ্ধি করতে করা এমন যেকোনো কু-পরিকল্পনা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। যখন একটি দেশের ইতিহাসের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় নিজেই তাদের ‘অল্প দুষ্টুমির’ ফিরিস্তি দেন আর সেই দেশকে বিশ্বকাপ এনে দেয়া, ফাইনালে গোল করা খেলোয়াড় নিজেদের ‘অন্যের হাতের পুতুল’ ভাবেন, তখন সেই বিশ্বকাপ নিয়ে মনে সন্দেহের যতিচিহ্ন পড়া খুবই স্বাভাবিক।

সবার আশা, ২০১৮ বিশ্বকাপ হোক তেমন সকল বিতর্কের উর্ধ্বে। ফাইনাল নির্ধারিত হোক মাঠে, বলের দ্বারা, গোলের দ্বারা। কোনো চার দেয়ালের মাঝে চায়ের কাপ সামনে রেখে দুরভিসন্ধিকারীদের মস্তিস্ক দ্বারা না।

ফিচার ছবিসত্ত্ব: eurosport.fr

Related Articles