কিংবা আউট হয়ে যখন ফিরলেন, তখন আপনার ছেলে পেছন বলে উঠলো, 'বাবা ইয়র্কারটা ভালো ছিল। তবে আরেকটু সামনে থেকে ব্লক করলেই বেঁচে যেতে।'
শুনতে কী অদ্ভুত, তাই না? দাদা খেলবে মাঠে আর গ্যালারিতে নাতি-ছেলেরা উৎসাহ দেবে! তাই কখনও হয় নাকি! ক্রিকেট হলো জোয়ানদের খেলা।
এই ভাবনাটা বোধহয় এবার শেষ হয়ে গেল। কারণ অস্ট্রেলিয়ায় দাদার বয়সই লোকেরা ক্রিকেট টুর্নামেন্টে অংশ নিতে যাচ্ছে। বাবার বয়সীদের সংখ্যা যদিও বেশি। কিন্তু ঘটনা সত্যি। অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত হচ্ছে বুড়োদের বিশ্বকাপ টুর্নামেন্ট, যেখানে অংশ নিচ্ছে ৫০ পরবর্তী বয়সের ক্রিকেটাররা।
১.
ট্রিনিদাদে ট্যাক্সি চড়ে কোনো একটি ক্রিকেট ম্যাচ দেখতে বের হয়েছিলেন স্টারলিং হ্যামম্যান। আদতে তিনি একজন ব্যারিস্টার, আবার বিখ্যাত ক্রিকেট কমিউনিটি স্টালওয়ার্টের সদস্যও বটে। এই অস্ট্রেলিয়ানের মাথায় হঠাৎ একটা ভাবনার উদয় হলো, বুড়োদের নিয়ে বিশ্বকাপ টুর্নামেন্ট করবেন। বুড়ো বলতে আসলেই বুড়ো। বয়স হতে হবে অন্ততপক্ষে ৫১ বছর। মানে ৫০ বছরের বেশি বয়স্ক ক্রিকেটাররা এই বিশ্বকাপে অংশ নেবেন। শুনলে হাস্যকর মনে হতে পারে, দুয়েকটা ঠোঁটকাটা শব্দ বের হয়ে আসতে পারে ঠোঁটের কোলে। তারপরও, ঘটনা কিন্তু সত্যি। তার চেয়েও বড় সত্যি হলো, এরই মধ্যে ২১ নভেম্বর থেকে সেই টুর্নামেন্ট মাঠেও গড়িয়েছে! চলবে তিন সপ্তাহ ধরে, অনুষ্ঠিত হবে ৩৪টি ম্যাচ।
হাসিঠাট্টার এই ভাবনায় অংশ নিচ্ছে আটটি আন্তর্জাতিক দল! স্বাগতিক অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে আছে নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, কানাডা, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা আর ওয়েলস।
আলোচনার বিষয় হলো, এই অদ্ভুত ভাবনার বাস্তবায়ন কীভাবে হলো? বুড়োদের বিশ্বকাপের সেই পেছনের গল্প নিয়েই গল্পের বয়ান। প্রথমত, হ্যামম্যান ক্রিকেট কমিউনিটির সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে জানতেন, বয়স হলেও সাবেক ক্রিকেটারদের মধ্যে ক্রিকেট নিয়ে যে প্রেম আর রোমাঞ্চ তার এতটুকুও কমেনি। আরও জানতেন সারাজীবন ক্লাব ক্রিকেট মাতিয়ে বেড়ানো মানুষগুলোর জাতীয় দলে তথা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতে না পারার যন্ত্রণা। এই ব্যাপারগুলো বিশ্বকাপ আয়োজনের ক্ষেত্রে হ্যামম্যানকে খুব করে প্রভাবিত করেছিল। সেই প্রভাবক শেষপর্যন্ত ধরা দিলো মাঠের ক্রিকেট হয়ে।
নতুন ধরনের এই টুর্নামেন্ট গড়াচ্ছে ওভালের নিউ সাউথ ওয়েলস ক্লাব মাঠে। পুরো আয়োজনের জন্য অনেক কিছু করার ছিল, যার প্রায় পুরোটাই একা করেছেন হ্যামম্যান। তার আশা, এই টুর্নামেন্ট ক্রিকেটের উত্তেজনা, রোমাঞ্চ, সম্মান, সততা; আরও একবার প্রমাণ করবে।
২.
বয়স্কদের নিয়ে ক্রিকেটের চল যে এই প্রথম, তা একেবারেই নয়। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে বয়স্কদের নিয়ে ক্রিকেট ম্যাচের আয়োজন করা হয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে, পুরোপুরি একটি বিশ্বকাপ টুর্নামেন্টের আয়োজনের মধ্যে দিয়ে টানা ২১ দিনে ৩৪টি ক্রিকেট ম্যাচের ভাবনা এবারই প্রথম। যদিও এটা ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি) কর্তৃক এখনও আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পায়নি, তবে প্রথম আসরেই অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া এই টুর্নামেন্টের স্বীকৃতি দিয়েছে। অস্ট্রেলিয়া জাতীয় দলের সাবেক ক্রিকেটার বেলিন্ডা ক্লার্ক বোর্ডের পক্ষ থেকে টুর্নামেন্টের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকেছেন। আরও ছিলেন কিংবদন্তি ট্রেভর চ্যাপেল। তিনি এই বুড়োদের বিশ্বকাপের টুর্নামেন্ট অ্যাম্বাসেডর।
পেশাদার ক্রিকেট ছাড়ার পরও অনেক ক্রিকেটার ৫০ বছর বয়স হওয়ার আগপর্যন্ত বিভিন্ন সময়, বিভিন্নভাবে ক্রিকেট ম্যাচ খেলেছেন। কিন্তু ৫০ বছরের বেশি হওয়ার পর ক্রিকেটে অংশ নেওয়ার ভাবনা একেবারেই নতুন। ৮ দলের এই টুর্নামেন্ট আয়োজন করা হচ্ছে অস্ট্রেলিয়ার ঘরোয়া ক্রিকেটের আদলে। সবগুলো দলের বেশিরভাগ ক্রিকেটারই নিজেদের সময়ে ছিলেন ক্লাব ক্রিকেটার। অস্ট্রেলিয়া, পাকিস্তান, ইংল্যান্ডে মাঝে মাঝে এই ধরনের 'প্রীতি ম্যাচ' অনুষ্ঠিত হলেও, নিউজিল্যান্ডের জন্য এটাই প্রথম। তাই দল গোছাতে তাদের একটু ব্যতিক্রম হতে হয়েছে। নিউজিল্যান্ড দলের নির্বাচক তারা যারা এখনও ক্লাব ক্রিকেট খেলছেন! অর্থাৎ, বড়দের দল গুছিয়ে দিয়েছে ছোটরা।
এই টুর্নামেন্টে পাকিস্তানের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ইজাজ আহমেদ। জাতীয় দল থেকে অবসর নেওয়ার আগপর্যন্ত তিনি খেলেছিলেন ৬০ টেস্ট আর ২৫০ ওয়ানডে ম্যাচ। দলে আরও তিনজন সাবেক জাতীয় দলের ক্রিকেটার রয়েছে। নিউজিল্যান্ডের নেতৃত্বে আছেন ১২ ওয়ানডে খেলা সাবেক ফাস্ট বোলার রিচার্ড পেট্রি। দক্ষিণ আফ্রিকা দলের ম্যানেজার রজার মল্টের ভাষায়,
'বেশিরভাগ সাবেক জাতীয় দলের ক্রিকেটার অথবা প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটার আর ক্রিকেট খেলতে আগ্রহী নন, অথবা তারা মাঠে নামার মতো ফিট নন। তিন সপ্তাহের টুর্নামেন্টে ঘাম ঝরানোর মতো অবস্থাও তাদের নেই।'
তিনি আরও বলেন,
'কিছু ক্রিকেটার এই টুর্নামেন্টের জন্য পেয়েছি, যারা আগ্রহী ছিল। কিন্তু তারা যখন বুঝলো টুর্নামেন্টে অংশ নেওয়া দলগুলোর বেশিরভাগ ক্রিকেটার ক্লাব থেকে আসা, তখন তারা নিজেদের সরিয়ে নেয়। ১৬ সদস্যের দলে অন্তত ১৩ জন নিজেদের ক্যারিয়ারে তাদের প্রাদেশিক দলের প্রতিনিধিত্ব করেছে। বেশিরভাগই প্রিমিয়ার লিগ ক্লাব ক্রিকেট খেলেছে।'
শ্রীলঙ্কা দল; Image Source: Marlon Von Hagt
অংশ নেওয়া বেশিরভাগ ক্রিকেটারের কাছে তিন সপ্তাহব্যাপী এই টুর্নামেন্টে অংশ নেওয়া এক স্বপ্নের মতো। ফিটনেস থাকুক আর না থাকুক, তারুণ্যের সেই ধার থাকুক আর না থাকুক, তাদের একটা স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে তাতেই তারা খুশি। ব্যাপারটি 'অনেক সম্মান' এর মতো।
নিউজিল্যান্ডের ম্যানেজার জিম মরিসনের মতে,
'এখানে আসা বেশিরভাগ ক্রিকেটারের সর্বোচ্চ সাফল্য ছিল প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট, অথবা স্থানীয় দলগুলোতে খেলা। সেই জায়গা থেকে এই বয়সে দেশের জন্য খেলতে পারা একটা বিশাল সম্মানের ব্যাপার। সবাই অনেক গর্বিত এবং দেশের জন্য নিজেদের সেরাটা দিতে বদ্ধ পরিকর।'
তিনি আরও বলেন,
'অনেকেই ক্রিকেট ছেড়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে, অনেকে ছেড়েও দিয়েছে। কারণ এই বয়সে ক্রিকেট চালিয়ে যাওয়ার কোনো কারণ তাদের সামনে নেই। কিন্তু এই টুর্নামেন্টে আসার পর হয়তো তারা আরও একবার ভাবছে, আরও একবার নিজেদের প্রমাণ করার সুযোগ পাচ্ছে। তারা আবারও নিজেদের ফিটনেসের দিকে নজর দিচ্ছে, নিজেদেরকে উৎসাহিত করছে। হয়তো যারা ৪০ বছর বসয়ে পা দিয়েছে, তারাও এখন থেকে ক্রিকেট চালিয়ে যাওয়ার একটা পথ খুঁজে পেল। নিজেদের বয়স ৫০ বছর হলেই তারা এখন নতুন করে শুরু করতে পারবে।'
৩.
৫০ বছরের উপরে এসে ক্রিকেট খেলাটা যেমন ঝক্কির, তেমনই টুর্নামেন্টে অংশ নিতে যে অর্থ প্রয়োজন তা জোগাড় করাও মুখের কথা নয়। যদিও এ ব্যাপারে দলগুলো নিজেদের বোর্ডের সঙ্গে বুঝিয়ে-শুনিয়ে চেষ্টা করেছে অর্থের যোগান দিতে। তাছাড়া আয়োজক দেশ হিসেবে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়াও খানিকটা সাহায্য করেছে একটু অন্যভাবে। যেমন, নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেট বোর্ডের ওয়েবসাইটে তাদের এই দলের স্কোয়াড ঘোষণা করা হয়েছে। দলকে দেওয়া হয়েছে ব্ল্যাক ক্যাপ ক্রিকেট কিটব্যাগ ও যাবতীয় অনুষঙ্গ। ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া দলগুলোর কিটব্যাগগুলোর শিপিং খরচ কমিয়ে দিয়েছে। বিভিন্ন পর্যায়ে স্পন্সরশিপ যোগাড় হয়েছে। অনেকে এখনও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তারপরও আর্থিক ঝামেলা রয়েই গেছে।
যেমন- দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতি ক্রিকেটারের পেছনে এই টুর্নামেন্টে খরচ হবে ৪,২০০ ডলার। তারপরও অস্ট্রেলিয়ার এই টুর্নামেন্টে আসতে পেরে তারা খুশি। যদিও ক্রিকেট দক্ষিণ আফ্রিকা (সিএসএ) এই দলকে আর্থিক সহযোগীতা দিতে রাজি হয়নি। কারণ তারা মনে করেছে, তাদের দেশকে প্রতিনিধিত্ব করার মতো মানসম্পন্ন হয়নি এই দল।
আনুষ্ঠানিক দলীয় ছবি; Image Source: Facebook
নতুন ধরনের এই টুর্নামেন্ট আরও একবার মনে করিয়ে দিল, নারী কিংবা পুরুষ অথবা বয়সের ফারাক; দিন শেষে চোখটা ক্রিকেটে থাকে, ক্রিকেটারদের দিকে নয়। বুড়োদের এই বিশ্বকাপে এটাও প্রমাণিত হলো, অপেশাদার ক্রিকেটাররাই এই খেলার হৃদয় হয়ে আছে। কেবল আনন্দ আর আনন্দ দানেই মিশে আছে ক্রিকেটের যথার্থতা। যারা এখানে খেলতে যাচ্ছে, আগামী ৩ সপ্তাহ তাদের আজীবনের ভালো লাগার রসদ হয়ে থাকবে তা সন্দেহাতীত। জয়টা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, তবে সবকিছু নয়।
This article is in Bangla language. It is a feature on 50s World cup arrangeing in Australia. 8 international team joinning there. Most of players are from international and club side. Its a new concept in cricket world.
Featured Image: sacricketmag.com
Download the Roar App
Share Your Reactions or Comments Below
fascinated1 Readers
informed0 Readers
happy0 Readers
sad0 Readers
angry0 Readers
amused3 Readers
Roar Media prides itself on producing original, refreshing, and thought provoking content which aims to capture the vibrancy of the South Asian region.