বিপিএল-সেরা হিসেবে শান্ত কি ঠিক পছন্দ ছিলেন?

ব্যর্থতার কানাগলি পেরিয়ে সাফল্যের রাজসড়ক।

মাত্রই শেষ হওয়া বিপিএলে নাজমুল হোসেন শান্ত যেন লিখলেন এমনই এক কবিতা। প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এক বিপিএলে ৫০০-এর বেশি রান, টুর্নামেন্ট-সেরা, দলও পৌঁছেছিল ফাইনালে – ২০২৩ সালের শুরুটা দুর্দান্তই হয়েছে এই বাঁহাতির। তবে এই যে সাফল্যের ফল্গুধারা, এর মধ্যেও সমালোচকদের মুখ থামানো গেল কি? রান করেছেন দেদারসে, কিন্তু কুড়ি ওভারের খেলাতেও তো তার স্ট্রাইকরেট মাত্র ১১৬.৭৪।

সেটাও এমন নয় যে, রান করার জন্য খুব দুরূহ উইকেটে খেলানো হয়েছিল তাকে। স্ট্রাইকরেটের হিসাবে নাজমুল হোসেন শান্তকে খুঁজে পেতে নামতে নামতে নামা লাগছে ৬৪ নম্বরে। বিপিএল ছাড়িয়ে বাইরের লিগগুলোতে খুঁজতে গেলেও দেখা যাচ্ছে, গেলবারের আইপিএলে কমপক্ষে ২০০ রান করেছেন, এমন ব্যাটারদের মধ্যে কেবল দু’জনই রান তুলেছেন এর চেয়ে কম স্ট্রাইকরেটে। আর গত পিএসএলে সর্বোচ্চ ৩৩ রানশিকারীর কেউই ব্যাট করেননি এত কম স্ট্রাইকরেট নিয়ে। প্রশ্ন তাই জাগছেই, শান্তকে পুরস্কৃত করার নামে টি-টোয়েন্টির সঙ্গে বেমানান ব্যাটিংকেই উৎসাহিত করা হলো কি না?

সময়টা ভালোই যাচ্ছে শান্তর। Image credit: Prothom Alo

এমনিতেই এ বছর বিপিএলটা বেশ রানপ্রসবা ছিল। ওভারপ্রতি রান উঠেছে ৭.৮৮ করে। অর্থাৎ, এই হিসাবে ২০ ওভার শেষে গড় সংগ্রহ হওয়ার কথা ১৫৭ রান। কিন্তু, কোনো দল যদি নাজমুল হোসেন শান্তর গতিতে খেলার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে তাদের থেমে যেতে হতো ১৩৯ রানেই। মানেটা দাঁড়াচ্ছে, টুর্নামেন্টের গড় স্কোরের চাইতেও শান্ত কম করেছেন প্রায় ১৮ রান। টি-টোয়েন্টিতে জয়-পরাজয়ের ব্যবধান যেখানে প্রায়ই এক অঙ্কের রান, সেখানে এই তফাৎ বেশ বিশালই।

তফাৎ ঘোচানোর জন্য টি-টোয়েন্টির উদ্বোধনী ব্যাটারদের কেমন ব্যাটিং করা উচিত, এরও একটা অলিখিত নিয়ম দাঁড়িয়ে গেছে এরই মধ্যে। এবং, এই গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ব্যাটাররা মোটাদাগে ভাগ হয়ে গিয়েছেন দুই দলে। প্রথম দল, উইকেটের মূল্য বিচার না করে যারা প্রথম বল থেকেই আক্রমণে যাবেন। পাওয়ারপ্লেতে ফিল্ডিংয়ের বাধ্যবাধকতার সুযোগ কাজে লাগাবেন। পৃথ্বী শ, জনি বেয়ারেস্টোকে বলা যেতে পারে এই ঘরানার আদর্শ নমুনা। নতুন বলের সুইংটা দেখে খেলবেন কী, প্রথম ১০ বলে তাদের স্ট্রাইকরেট থাকে ১৫০-এর ওপরে। উদ্দেশ্য পরিষ্কার, ‘দেখো ভাই, রান যা-ই করি, বল নষ্ট করব না। আমার পরে আরও ১০ ব্যাটার আছে। বল পেলে তো ওরাও রান করতে পারে।’

তা পিচের কারণেই হোক, কিংবা দলীয় পরিকল্পনা, বিপিএলে এমন ১৫০ স্ট্রাইকরেট নিয়ে ইনিংস শুরু করা ওপেনার দেখাই যায়নি একদম। এ বছর প্রথম ছয় ওভারে রান উঠেছে ওভারপ্রতি ৭.০৭ করে, স্ট্রাইকরেটের হিসাবে সংখ্যাটা ১১৭.৯।

ব্যাটারস্ট্রাইকরেটগড়
আনামুল হক১৩০.৬৪১
লিটন দাস১৩০.৪৪১.৫
রনি তালুকদার১২৪.২৬১.৫
তৌহিদ হৃদয়১১১.৪২৯.৪
নাজমুল হোসেন শান্ত১০৯.৬৯১
তামিম ইকবাল৯৫.৯২৩.২
টেবিল ১: বিপিএলের পাওয়ারপ্লেতে বাংলাদেশি ওপেনার কে কেমন?

শান্ত ধীরেসুস্থে ইনিংস শুরু করেছেন, এর প্রমাণ ওপরের ছবিটাই। প্রথম ১০ বলে তার স্ট্রাইক রেট যেমন ১০০-ও ছোঁয়নি। তবে, ধীরগতির শুরুর পরেও শান্ত যে কাজটা করেছেন, তিনি উইকেট দেননি। ১৫ ইনিংসে শুরুর ৬ ওভারে আউট হয়েছেন মাত্র তিনবার। এ কারণে তাকে ঠাঁই দেওয়া যায় টি-টোয়েন্টি ওপেনারদের দ্বিতীয় শ্রেণিতে। ডেভন কনওয়ে, রবিন উথাপ্পা, রুতুরাজ গায়কোয়াড়রাও এই তালিকায় আসেন, আর ‘স্বপ্নের নায়ক’ হিসেবে বিবেচিত হন রাজস্থান রয়্যালসের জস বাটলার।

তারা ইনিংসের প্রথম দিকে খুব একটা চড়াও হন না বোলারদের ওপর, বলপ্রতি রান তোলার দিকেই থাকে মনোযোগ। তবে, উইকেটে সেট হয়ে গেলেই ধরা দেন সংহারক হয়ে। ইনিংস যত লম্বা হয়, স্ট্রাইকরেট বাড়ে পাল্লা দিয়ে। গেল আইপিএলে ডু প্লেসি যেমন ইনিংসের প্রথম ৬ ওভারে রান করছিলেন ১০৪.৬৯ স্ট্রাইকরেটে। কিন্তু, পরের ওভারগুলোতে রান তুলেছেন ১৫২.৫৭ স্ট্রাইকরেটে, রানও করেছেন প্রায় পৌনে চারশ’। এক পাশ থেকে উইকেট আটকে দলকে ধ্বসের হাত থেকে বাঁচাচ্ছেন, অন্য পাশে শেষে ঝড় তুলে এনে দিচ্ছেন বড় সংগ্রহও — টি-টোয়েন্টিতে এমন ওপেনারের কদরও বড় কম নয়।

পাওয়ারপ্লেতে ধরে খেলাটা সমস্যা হতো না, যদি শান্ত পরে গিয়ে রান তোলার গতি ত্বরান্বিত করতে পারতেন বাটলার, রুতুরাজ, ফ্যাফ ডু প্লেসিদের মতো। শান্ত কি সেই কাজটাও করতে পেরেছেন ভালো করে? সেটাও বলা যাচ্ছে না। সাবধানী পাওয়ারপ্লে শেষে শান্ত ঢুকে পড়েছিলেন আরও খোলসে, অন্তত পরের ৩০টা বল।

বলস্ট্রাইকরেট (মোট ডেলিভারি)
১-১০৯৮.৬ (১৪৪)
১১-২০১৩১.৪ (১২১)
২১-৩০৯৬.৩ (৮২)
৩১-৪০১২০.৩ (৫৯)
৪১-৫০১৫০ (২০)
৫১-৬০২০০ (১০)
৬১-৬৬২৫০ (৬)
টেবিল ২: ইনিংসের কোন পর্যায়ে শান্ত কেমন?

ওপরের ছবিটাতেই পরিষ্কার, কেবলমাত্র ৪০-এর বেশি বল খেলার পরই গিয়ার পাল্টেছেন শান্ত। সমস্যাটা হচ্ছে, শান্ত ৪০-এর বেশি বল খেলেছেন মাত্র চারটা ইনিংসেই, পুরো টুর্নামেন্টে মাত্র ৩৬ বল। তবে এর আগ পর্যন্ত এমনই ধীরগতিতে খেলেছেন যে তখন তাকে ছুটতে হয়েছে চলতে শুরু করে দেওয়া ট্রেনের পিছু পিছু, আয়েশ করে আসনে আর গেড়ে বসতে পারেননি।

পাল্টা যুক্তি হতে পারে, কয়েকদিন তো শান্ত দ্বিতীয় ইনিংসেও ব্যাট করেছেন। সেদিন লক্ষ্য কম থাকলে তার কী এমন তাড়াহুড়ো লেগেছে যে ধুমধাড়াক্কা ক্রিকেট খেলবেন? 

অকাট্য যুক্তি, সন্দেহ নেই। যুক্তি খণ্ডনের একটা উপায় হতে পারে শান্তর প্রথমে ব্যাট করা ইনিংসগুলোকে বিবেচনায় নেওয়া। আগেই বলা হয়েছে, রানপ্রসবা বিপিএল দেখা গেছে এবার। প্রথমে ব্যাট করে জয় পেতে চাইলে যেমন গড়ে করতে হয়েছে ১৭৬.৬৫ রান। 

টুর্নামেন্টে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নয়বার আগে ব্যাট করেছে সিলেট স্ট্রাইকার্স। আর আসরে তাদের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা এটাকেই বলতে হবে। পরে ব্যাট করে একবারও হারেনি দলটি, পাঁচটা পরাজয়ের প্রত্যেকটির স্বাদই মিলেছে শুরুতে ব্যাট করে।

দল বলেছিল ধরে খেলতে, তাই বলে কি একটু বেশিই ধরে খেললেন শান্ত? Image credit: Prothom Alo

এই ৯ ম্যাচে শান্তর স্ট্রাইকরেট বেড়েছে কিছুটা, তবে সেটাও ১২২.১৪-এর বেশি নয়। এই ম্যাচগুলোতে ৩৩১ রান করতে শান্ত যা বল খরচা করেছেন, তাতে ম্যাচপ্রতি গড়ে বল খেলেছেন ৩০.১১টি। তিনি যে গতিতে রান করেছেন, তাতে অ্যাভারেজ উইনিং স্কোর অব্দি পৌঁছাতেও বাকিদের রান করতে হতো ওভারপ্রতি ৯.৩৪ হারে। এর সঙ্গে যোগ করুন, শান্তর ইনিংস উদ্বোধনের সঙ্গী তৌহিদ হৃদয়ের শম্বুক গতির সূচনার কথাও, তিনিও তো পাওয়ারপ্লেতে ১০৯ স্ট্রাইকরেটেই ব্যাট করেছেন। সিলেটের ‘আর কিছু রানের’ আক্ষেপ থেকে যাওয়ার কারণও বোধহয় ওপেনারদের এমন মন্থর সূচনাই।

তবে শান্ত যা পারেননি, তৌহিদ হৃদয় ঠিক সে কাজটাই করেছেন। মন্থর শুরুর পরও তাই তার টুর্নামেন্ট শেষ হয়েছে ১৪০-এর বেশি স্ট্রাইকরেট নিয়ে। খেলেছেন টি-টোয়েন্টির নিখুঁত কিছু ‘অ্যাঙ্করিং নক’। এই বিবেচনাতেই ম্যাচপ্রতি প্রভাব বা ইমপ্যাক্ট বিচারের যে কাজটা ইএসপিএন ক্রিকইনফো করে থাকে, সেখানে তৌহিদ হৃদয়কে রাখা হয়েছে ৩২ নম্বরে। সবার ওপরে যে নামটা, এর নেপথ্যেও প্রায় ১৭৫ স্ট্রাইকরেটে ৩৭৫ রান করারই সবচেয়ে বড় ভূমিকা। অথচ, সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহক শান্ত নেই শীর্ষ পঞ্চাশেও।

দলীয় পরিকল্পনা শান্তর চেয়ে তৌহিদ হৃদয়ই কাজে লাগিয়েছেন ভালো। Image credit: Prothom Alo

এমন ভূঁড়িভূঁড়ি রান করেও কেন শান্তর পারফরম্যান্স অন্যদের মতো প্রভাব রাখতে পারেনি, এর ব্যাখ্যা বিশ্লেষকেরা দেন খুব সহজেই, টি-টোয়েন্টি রান করার নয়, বরং দ্রুত রান করার খেলা। তাদের হিসাবটাও স্পষ্ট, টেস্ট ক্রিকেটে প্রতি ব্যাটার যেখানে গড়ে বল খেলেন ৬২টা (হ্যাঁ, আধুনিক জমানাতেও টেস্ট ইনিংস গড়ে ১০০ ওভার টেকে), ওয়ানডেতে ৩০টা, সেখানে টি-টোয়েন্টিতে প্রতি উইকেটে বরাদ্দ মোটে ১২ বল। ব্যাটারদের কাছে চাহিদাও তাই উইকেট আঁকড়ে থাকা নয়, বরং ধরাছোঁয়ার বাইরের একটা স্কোর গড়ে দেওয়া।

যা দিতে পারছিলেন না বলেই তামিম ইকবাল, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ কিংবা মুশফিকুর রহিমকে ঘিরে সমালোচনার ঝড় উঠত নিয়মিত। ‘স্ট্রাইকরেট বাড়াতে হবে’ — গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে ক্রিকেট-পাড়ায় এমন শোরও উঠেছিল ভালোরকমে। তখন ব্যাটারদের অভয় দিতে খালেদ মাহমুদ সুজন এটা পর্যন্ত বলেছিলেন,

‘১৮০-এর লক্ষ্যে খেলতে নেমে ১০০ রানে অলআউট হলেও সমস্যা নেই।’

– খালেদ মাহমুদ সুজন

সুজন অবশ্য নতুন কিছু বলেননি, টি-টোয়েন্টির মূল মন্ত্র দ্রুতগতিতে রান তোলা, যার অর্থই বেশি বেশি ঝুঁকি নেওয়া। তা ঝুঁকি নিতে গিয়ে কয়েকদিন তো পা ফসকাতেই পারে।

কিন্তু, শান্ত যেরকম ব্যাটিং দিয়েই হয়ে গেলেন টুর্নামেন্ট-সেরা খেলোয়াড়, তাতে তো সন্দেহ হয়ই, ভালো স্ট্রাইকরেটে বাংলাদেশের ব্যাটাররাও ব্যাট করুন, এটা কি নীতিনির্ধারকরাও চান?

This article is in Bangla language. This article is an an analysis on the baffling decision to nominate Nazmul Hossain Shanto as the recently concluded BPL's player of the tournament. Necessary hyperlinks and images are attached inside.

Featured image © Prothom Alo

Related Articles

Exit mobile version