১৯ জুন, ২০১৭; অস্ট্রেলিয়ান ওপেনে দ্বিতীয় রাউন্ডে মুখোমুখি শীর্ষ বাছাই নোভাক জোকোভিচ ও ১১৭ নাম্বার র্যাঙ্কিংয়ে থাকা উজবেক টেনিস প্লেয়ার ডেনিস ইস্তোমিন। ৪ ঘন্টা ৪৮ মিনিটের সেই থ্রিলিং ম্যাচে নোভাক জোকোভিচকে হারিয়ে দিয়ে অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের ১১২ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অঘটনের জন্ম দেন এই উজবেক তরুণ। ইস্তোমিনের জয় সামাজিক মাধ্যমে তাকে অনেক জনপ্রিয় করে তোলে। তবে তার চেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পান ইস্তোমিনের মা। কারণ ইস্তোমিনের কোচের দায়িত্বে ছিলেন তিনিই।
একজন মানুষের জীবনের পুরোটা জুড়েই তার মায়ের প্রভাব থাকে। আজ আমরা টেনিসের এমন কিছু খেলোয়াড় সম্পর্কে জানবো, যাদের কোচও ছিলেন তাদের মায়েরাই।
ডেনিস ইস্তোমিন
ছোটবেলা থেকেই ইস্তোমিনের টেনিসের হাতেখড়ি মায়ের কাছে। একেবারে অল্প বয়সেই ছেলের হাতে র্যাকেট তুলে দেন মা ক্লদিয়া ইস্তোমিন। ১৯৮৬ সালে উজবেকিস্তানে জন্ম নেওয়া এই টেনিস খেলোয়াড় ২০০৮ সালে পেশাদার টেনিস খেলোয়াড়ে পরিণত হন। ২০০১ সালে এক গাড়ি দুর্ঘটনায় শঙ্কায় পড়ে ইস্তোমিনের ক্যারিয়ার। পা ভাঙা ছাড়াও পুরো শরীরে ৮০টি সেলাই দিতে হয় তাকে। র্যাকেট হাতে ফেরা হবে না বলেও জানিয়ে দেন ডাক্তার।
২ বছর টেনিস থেকে দূরে থাকতে হয় তাকে। তবে মায়ের অনুপ্রেরণা ও প্রচেষ্টায় আবারো টেনিসে ফেরেন ডেনিস ইস্তোমিন, যদিও পরবর্তীতে এতটা সাফল্য পাননি। ২০১২ সালে পৌঁছান নিজের সর্বোচ্চ ক্যারিয়ার র্যাঙ্কিং ৩৩ এ। উইম্বলডনে ইস্তোমিনের সর্বোচ্চ দৌড় চতুর্থ রাউন্ড পর্যন্ত। পুরো ক্যারিয়ার জুড়ে প্রায় সাড়ে পাঁচ মিলিয়ন ডলার প্রাইজমানি পাওয়া এই খেলোয়াড় তবুও কৃতজ্ঞ তার মায়ের কাছে। ইস্তোমিনের মতে, মায়ের অনুপ্রেরণা আর সাহস না থাকলে ১৪ বছর বয়সের সেই দুর্ঘটনা থেকে আর কখনোই টেনিসে ফিরতে পারতেন না তিনি।
মারাত শাফিন ও দিনারা শাফিনা
দুই ভাই-বোন মারাত ও দিনারা; দুজনই টেনিসে সাফল্যমন্ডিত এক ক্যারিয়ার পার করেছেন। আর তাদের দুজনেরই কোচের দায়িত্ব পালন করেছেন মা রাউজা ইসলানোভা। রাউজা ইসলানোভা অবশ্য আগে থেকেই রাশিয়ার জনপ্রিয় এক কোচ। ছোটবেলা থেকেই দুই ভাই-বোনের ট্রেইনারের দায়িত্ব পালন করেছেন রাউজা। পরবর্তীতে ২০০৩ সাল পর্যন্ত ফুল টাইম কোচের দায়িত্বও পালন করেন তিনি।
দুটি গ্র্যান্ডস্লাম জয়ী মারাতের প্রথম গ্র্যান্ডস্লামটি আসে মায়ের হাত ধরেই। ২০০০ সালের ইউএস ওপেন জয়ে মায়ের ভূমিকা ছিলো অনবদ্য। পাঁচ বছর পর মারাত জেতেন অস্ট্রেলিয়ান ওপেনও। মায়ের অধীনেই ৯ সপ্তাহের জন্য এটিপি ক্যারিয়ার র্যাঙ্কে শীর্ষে উঠেছিলেন এই টেনিস তারকা।
অন্যদিকে বোন দিনারা শাফিনা ক্যারিয়ারে কখনো গ্র্যান্ডস্লাম না জিতলেও নিজের সময়ের অন্যতম সেরা টেনিস তারকা ছিলেন। খেলেছেন তিনটি গ্র্যান্ডস্লাম ফাইনালও। মা কোচ থাকাকালীন সময়ে ২৬ সপ্তাহ ধরে ১ নাম্বার র্যাঙ্কিং ধরে রেখেছিলেন দিনারা।
ফুটবল খেলতে চাওয়া মারাত শাফিনকে টেনিসে এনেছেন তার মা-ই। সেই প্রসঙ্গে মারাত বলেন, "আমি সবসময় ফুটবলার হতে চেয়েছিলাম। ছোটবেলা থেকেই। কিন্তু একজন মা-ই জানেন তার ছেলে কীসে সেরা। আমার মা-ই আমাকে টেনিসে নিয়ে এসেছেন।"
মার্টিনা হিঙ্গিস
টেনিস ইতিহাসের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় মার্টিনা হিঙ্গিস। তবে ইনজুরি বাগড়া না দিলে আরো অনেক কিছু জিততে পারতেন চেকোস্লোভাকিয়ায় জন্ম নেওয়া এই খেলোয়াড়। ক্যারিয়ারে সর্বমোট ২২টি গ্র্যান্ডস্লাম জিতেছেন এই টেনিস কন্যা।
মার্টিনা হিঙ্গিসের বাবা-মা দুজনই ছিলেন পেশাদার টেনিস খেলোয়াড়। বাবা ক্যারল হিঙ্গিস ও মা মেলানি মলিটোরোভা- দুজনই চেকোস্লোভাকিয়ার পুরুষ ও নারী র্যাঙ্কিংয়ে প্রথমদিকে ছিলেন। তবে মার্টিনার বয়স যখন ৬, তখন তার বাবা-মায়ের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়।
পরবর্তীতে মার্টিনা হিঙ্গিস মায়ের কাছেই বড় হন। ছোটবেলা থেকেই মায়ের কাছ থেকে শেখেন টেনিসের নিয়মকানুন। পেশাদার খেলোয়াড় হওয়া পর্যন্ত হিঙ্গিসের ট্রেইনার হিসেবে কাজ করেন মেলানিই। মাত্র ২ বছর বয়স থেকেই র্যাকেট হাতে নেন তিনি। ১২ বছর বয়সে সবচেয়ে কম বয়সী খেলোয়াড় হিসেবে জুনিয়র গ্র্যান্ডস্লাম জেতেন হিঙ্গিস। তবে ২২ বছর বয়সে লিগামেন্ট ইনজুরির জন্য সাময়িকভাবে টেনিস থেকে বিরতি নেন। সেই সময়টাতেও মায়ের প্রভাব আর অনুপ্রেরণাই মার্টিনাকে কোর্টে ফিরতে সাহস জুগিয়েছে। মহিলাদের সর্বকালের র্যাঙ্কিংয়ে মার্টিনার অবস্থান নয়ে।
এক সাক্ষাৎকারে মার্টিনা হিঙ্গিস বলেন, "হিরো (HERO) লিখতে চারটা অক্ষর প্রয়োজন হলেও আমার হিরো লিখতে তিনটি অক্ষর প্রয়োজন। আর সেটি হলো মা (MOM)।"
অ্যান্ডি মারে ও জেমি মারে
ব্রিটিশ টেনিস তারকা অ্যান্ডি মারে এবং জেমি মারে টেনিসের দুই পরিচিত মুখ। অ্যান্ডি মারে এখন পর্যন্ত জিতেছেন তিনটি গ্র্যান্ডস্লাম। সেই সাথে এটিপি র্যাঙ্কিংয়ে এক নাম্বারে ওঠার জন্য তিনি জিতেছেন নাইটহুড উপাধিও। অন্যদিকে ভাই জেমি মারে ছিলেন ডাবলস র্যাঙ্কিংয়ে এক নাম্বারে। দুই ভাই মিলে ম্যানস ডাবলসে জিতেছেন দুটি গ্র্যান্ডস্লাম। জেমি মারে মিক্স ডাবলেও জিতেছেন আরেকটি গ্র্যান্ডস্লাম।
দুই ভাইয়ের এই সাফল্যের পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান তাদের মা জুডি মারের। জুডি মারে নিজেও ছিলেন টেনিস খেলোয়াড়। স্কটল্যান্ডে থাকাকালীন অবস্থায় ৬৪টি টাইটেল জিতলেও হোম সিকনেসের জন্য পরবর্তীতে আর পেশাদার টেনিস খেলোয়াড় হননি। তবে তার টেনিস প্রতিভা ছড়িয়ে দিয়েছেন দুই ছেলের মাঝে। নিজের প্রথম ক্যারিয়ার গ্র্যান্ডস্লাম জয়ের পর অ্যান্ডি মারে ছুটে গিয়েছিলেন দর্শক সারিতে বসে থাকা মায়ের কাছে। দুই ছেলে ছাড়াও জুডি কোচিং করিয়েছেন আরো অনেক টেনিস খেলোয়াড়কে। জুডি পরিচিত একইসাথে টেনিস জগতের অন্যতম সেরা মা এবং কোচ হিসেবে।
সেরেনা উইলিয়ামস ও ভেনাস উইলিয়ামস
উইলিয়ামস বোনদ্বয়কে বিবেচনা করা হয় টেনিস কোর্টে পা রাখা অন্যতম সেরা দুই বোন ও খেলোয়াড় হিসেবে। ক্যারিয়ারে দুই বোনই ছিলেন র্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে। সেরেনা ও ভেনাস মিলে জিতেছেন ৬১টি গ্র্যান্ডস্লাম। বড় বোন ভেনাস জিতেছেন ২৩টি আর ছোট বোন সেরেনা জিতেছেন ৩৮টি।
তাদের বাবা-মা ছিলেন টেনিস কোচ। পারিবারিকভাবেই টেনিসে হাতেখড়ি হয় দুজনের। প্রথমদিকে বাবা-মা দুজনই ছিলেন দুই বোনের ট্রেইনার। তবে ২০০২ সালে বাবা রিচার্ড উইলিয়ামসের সাথে তাদের মায়ের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার পর বাকি সময়টাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তাদের মা-ই। দুই বোনের ফুল টাইম কোচের দায়িত্বও পালন করেন মা ওরাসিন প্রাইস। প্রাইসের কোচিংকালে দুই বোন মিলে জিতেছেন ১২০টি ট্রফি। ভেনাসের ৪৯টি টাইটেলের বিপরীতে সেরেনা জেতেন ৭১টি।
কিছুদিন আগে মা হওয়া সেরেনা উইলিয়ামস নিজের মায়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে একটি খোলা চিঠি লিখেন এবং নিজের মাকে সুপার মম হিসেবে আখ্যা দেন।
This Bangla article is about the mother who was also coach of their children in tennis court. Necessary sources are hyperlinked in the article.
Feature Image: CNN