Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

যেসব কারণে সৌদি আরবের কাছে পা হড়কালো আর্জেন্টিনা

সৌদি আরবকে বড় ব্যবধানে উড়িয়ে দিয়ে কাতার বিশ্বকাপের শুভসূচনা করবে আর্জেন্টিনা, এমনটাই হয়তো ভেবেছিলেন তাদের খেলোয়াড়দের থেকে শুরু করে ভক্ত-সমর্থকরাও। ম্যাচের শুরুতেই মেসির পেনাল্টিতে এগিয়ে যাওয়ার পর গোলের ব্যবধান কততে গিয়ে ঠেকতে পারে, সেটা নিয়েও ভাবতে শুরু করেছিলেন অনেকে। কিন্তু ম্যাচ শেষে হলো ঠিক তার উল্টোটাই। সৌদি আরবের কাছে ২-১ গোলের ব্যবধানে হেরে কাতার বিশ্বকাপের প্রথম অঘটনের স্বীকার হলো আর্জেন্টিনা!

টানা ৩৬ ম্যাচ ধরে অপরাজিত আর্জেন্টিনা দল হয়তো স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি, সৌদি আরবের কাছে হোঁচট খেয়ে তাদের বিশ্বকাপের যাত্রা শুরু হবে। ছুটতে থাকা আর্জেন্টিনার জয়রথ থামিয়ে দিলেন সৌদি আরবের ফরাসি কোচ হার্ভে রেনার্দ। প্রথমার্ধ পর্যন্ত সব কিছু ঠিকঠাক থাকলেও দ্বিতীয়ার্ধে যেন খেলাটাই ভুলে গেল আর্জেন্টিনা!

আজকের এই পর্বে আমরা আর্জেন্টিনার বাজে পারফরম্যান্সের কারণ এবং সৌদি আরব কোচের অসীম সাহসিকতায় ম্যাচ জিতে নেওয়ার কৌশল নিয়েই আলোচনা করবো।

দু’দলের শুরুর একাদশ; image credit: Wyscout

ম্যাচের শুরুতে আর্জেন্টিনার কোচ লিওনেল স্কালোনি তার দলকে ৪-৪-২ ফর্মেশনে খেলতে নামান। অন্যদিকে, সৌদি আরবও ৪-৪-২ ফর্মেশনে খেলতে নামে। রক্ষণ থেকে বিল্ডআপের সময় আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়রা ২-৩-৫ ফর্মেশনে রূপান্তরিত হচ্ছিল। কিন্তু দুই ফুলব্যাক মলিনা এবং তাহলিয়াফিকো উভয়ই টাচলাইনের আশেপাশে পজিশন নেওয়ায় মাঝমাঠে প্যারাদেস একেবারেই একা হয়ে পড়ছিলেন। ফলে সৌদি আরবের দুই ফরোয়ার্ড সালেহ আল সেহরী এবং সালমান আল ফারাজ খুব সহজেই তাকে ম্যান মার্ক করে বাকিদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখতে পারছিলেন।

উপরের ছবিতে প্যারাদেসকে সৌদি আরবের দুই স্ট্রাইকারের ম্যান মার্ক করে রাখার ব্যাপারটা খুব স্পষ্টভাবেই দেখা যাচ্ছে৷ তবে এ সমস্যার সমাধান করতে স্কালোনি খুব একটা সময় নেননি।

image credit: Author

ম্যাচের কিছু অংশ অতিক্রান্ত হওয়ার পর প্যারাদেস দুই সেন্টারব্যাকের মাঝে এসে বিল্ডআপে অংশ নিতে শুরু করেন। এসময় অপর মিডফিল্ডার ডি পল সৌদি আরবের রক্ষণ এবং মাঝমাঠের মধ্যকার বিটুইন দ্য লাইনে পজিশন নেন। কিন্তু সৌদি আরবের মিডফিল্ডারদের আঁটসাঁট অবস্থানের কারণে রক্ষণের বাকি খেলোয়াড়দের পক্ষে তার সাথে পাসিং চ্যানেল তৈরি করাটা বেশ কঠিন কাজ হয়ে পড়ে। এই সমস্যার একটা সমাধান হতে পারত যদি দুই ফুলব্যাকরা হাফস্পেসের দিকে চেপে এসে বাড়তি পাসিং অপশন তৈরি করতেন। এতে করে সৌদি আরবের ওয়াইড মিডফিল্ডাররা বাধ্য হয়ে তাদের মার্ক করতে সরে আসতেন; সেই সুযোগে প্যারাদেসের পক্ষে ডি পল কিংবা মেসিকে খুঁজে নেওয়াটা তুলনামূলকভাবে অনেক সহজ হতো।

কিন্তু দুই ফুলব্যাকই দুই উইঙ্গার পাপু গোমেজ এবং ডি মারিয়ার পাশে একই ভার্টিক্যাল লাইনে অবস্থান করায় রোমেরো-প্যারাদেস-ওটামেন্ডি ত্রয়ীর কাছে বিল্ডআপের সময় পাসিং অপশন ছিল একেবারেই সীমিত। ফলে ডিফেন্ডারদের অনেকটা বাধ্য হয়েই প্রতিপক্ষের ডিফেন্সলাইনের পেছনের ফাঁকা জায়গা লক্ষ্য করে লং বল ছাড়তে হয়। আর্জেন্টিনার ডিফেন্ডারদের মধ্যে কারোরই লং পাসিং সামর্থ্য ভালো না থাকায় তারা বারবারই বল ছাড়তে অনেকটা সময় নিয়ে ফেলছিলেন; যে কারণে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লং পাসগুলোর শেষ পরিণতি  হয় অফসাইডের মাধ্যমে।

image credit: getty images

আর্জেন্টিনার মতো দলের বিপক্ষে সৌদি আরব হাইলাইন ডিফেন্স করবে এই কথা ম্যাচের আগে কেউ বললে সেটা বিশ্বাস করার মতো মানুষ খুব কমই খুঁজে পাওয়া যাবে। কিন্তু তাদের কোচ হার্ভে রেনার্দ সেই সাহস দেখিয়েছেন, যার ফলও সৌদি আরব পেয়েছে ভালোভাবেই। ম্যাচের প্রথমার্ধে সৌদি আরবের ফরোয়ার্ড খেলোয়াড়রা আর্জেন্টিনার ডিফেন্ডার কিংবা প্যারাদেস – কাউকেই খুব একটা প্রেস করেনি। যে কারণে আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়রা খুব সহজেই ফরোয়ার্ডদের দিকে লং বল বাড়াতে পেরেছে। 

আর্জেন্টিনার অফসাইডের ম্যাপ; image credit: Opta Analyst

কিন্তু সৌদি আরবের কমপ্যাক্ট হাইলাইন ডিফেন্স এবং আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়দের দেরিতে পাস বাড়ানো, দুইয়ে মিলে ম্যাচের প্রথমার্ধেই আর্জেন্টিনা অফসাইডের ফাঁদে পড়েছে ৭ বার; বাতিল হয়েছে তাদের তিন-তিনটি গোল!

মডার্ন ফুটবলে হাইলাইন ডিফেন্সের সাথে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত। কিন্তু এর মধ্যেও সৌদি আরবের হাইলাইন ডিফেন্ডিং ছিল অনেকটা ব্যতিক্রম। সৌদি আরব প্রায় পুরো ম্যাচেই মিডব্লক ডিফেন্ডিং করেছে। এ সময় তাদের ডিফেন্ডার এবং ফরোয়ার্ডদের মধ্যে গড় দূরত্ব ছিল মাত্র ২০ মিটারের কাছাকাছি; যে কারণে আর্জেন্টিনার মিডফিল্ডাররা বিটুইন দ্য লাইনে একেবারেই স্পেস বের করতে পারেনি – যার কারণে বাধ্য হয়েই তাদের লং পাস খেলতে হয়েছে। 

ম্যাচে দু’দলের বিভিন্ন ডিফেন্সিভ ব্লকে লাইনগুলোর মধ্যবর্তী দূরত্ব: image credit: Ben Griffis/ Twitter

ম্যাচের দ্বিতীয়ার্ধে সৌদি আরবের খেলার ধরনে বেশ খানিকটা পরিবর্তন আনেন রেনার্দ। প্রথমার্ধে সৌদি আরবের ফরোয়ার্ডরা প্রেস না করাতে আর্জেন্টিনা নিজেদের অর্ধ থেকে প্রচুর লং বল খেলার সুযোগ পেয়েছে। প্রথমার্ধে হাইলাইনের মাধ্যমে আর্জেন্টিনার ফরোয়ার্ডদের বারবার অফসাইডের ফাঁদে ফেললেও এভাবে আর্জেন্টিনাকে খুব বেশি সময় আটকে রাখা যাবে না সেটা রেনার্দ বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন। এ কারণে দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই পরপর দুই গোল পেয়ে যাওয়ার পর তিনি তার ফরোয়ার্ডদের দিয়েও প্রেস করাতে শুরু করেন। 

সৌদি আরবের মিড ব্লকে ডিফেন্ডার এবং ফরোয়ার্ডদের মধ্যকার দূরত্ব ছিল অবিশ্বাস্য রকমের কম!: image credit: Ben Griffis/ Twitter

তখন আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়দের জন্য বল প্রোগ্রেস করার কাজটা আরো অনেক বেশি কঠিন হয়ে পড়ে। স্কালোনি প্যারাদেসের জায়গায় এনজো ফার্নান্দেসকে সাবস্টিটিউট করলে ডি পল নিচে নেমে বল ডিস্ট্রিবিউট করতে চেষ্টা করে। এ সময় মেসি ডানপাশের হাফস্পেসে এসে বিটুইন দ্য লাইনে অপারেট করতে শুরু করে। ম্যাচের ৬০ থেকে ৭৫ মিনিট – এ সময়টাতে রাইট উইং দিয়ে মেসি ডি মারিয়ার যুগলবন্দীতে আর্জেন্টিনা বেশ কয়েকটি আক্রমণ গড়ে, কিন্তু তাদের সব প্রচেষ্টাই সৌদি আরবের গোলকিপার মোহাম্মদ আল ওয়াইসের একের পর এক অতিমানবীয় সব সেইভের সামনে ব্যর্থ হয়।

image credit: AFP

দুই পাশের উইংয়ে দুই বিপরীত পায়ের ফুটবলার থাকায় উইং এরিয়ায় বল গেলেই আর্জেন্টিনার খেলা অনেকটা ধীরগতির হয়ে গেছে। আনহেল কোরেয়ার মতো দ্রুতগতির ফুটবলারকে স্কালোনি কেন এমন পরিস্থিতিতে মাঠে নামালেন না, সেটা নিয়েও বড় প্রশ্ন থেকেই যায়। সেন্টার এরিয়া ব্লক হয়ে থাকায় আর্জেন্টিনা ডি মারিয়াকে দিয়েই বল সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু প্রতিবারই ডি মারিয়া বা’পায়ে বল রিসিভ করে টার্ন করতে কিছুটা বাড়তি সময় নিয়ে ফেলছিলেন, যে কারণে আর্জেন্টিনার খেলার গতিও কমে যাচ্ছিল। আবার সৌদি আরবের লেফটব্যাক ইয়াসের আল সেহরানিও ডি মারিয়াকে কড়া মার্কিংয়ে রাখার চেষ্টা করেছেন, টাচলাইনের আশেপাশে তাকে অন্তত ফ্রিতে অপারেট করার সুযোগ দেননি। যে কারণে আর্জেন্টিনার আক্রমণ বারবারই বাধাগ্রস্ত হয়েছে, পুরো ম্যাচে একটাও সলিড কাউন্টার অ্যাটাকে যাওয়ার সুযোগ পায়নি।

প্রথমার্ধে আর্জেন্টিনার বামপাশ ছিল একেবারেই নিষ্প্রভ। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে লেফট উইংয়ে আকুনা আসার পর বামপাশ দিয়েও আর্জেন্টিনা আক্রমণে উঠতে শুরু করে। কিন্তু জুলিয়ান আলভারেজ কিংবা এনজো ফার্নান্দেস – কেউই হাফস্পেসে এসে আকুনাকে পর্যাপ্ত সাপোর্ট দেননি; যে কারণে লেফট উইংয়ে আকুনাকে বারবারই প্রতিপক্ষের একাধিক ফুটবলারের মুখোমুখি হতে হয়েছে। যে কারণে সেইদিকের আক্রমণগুলোও খুব একটা ফলপ্রসূ হয়নি।

গত ম্যাচে আরেকটি জিনিস বেশ চোখে পড়েছে, আর্জেন্টিনার মিডফিল্ডাররা খুব বেশি লম্বা না হওয়ায় তারা সাধারণত প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের সাথে সরাসরি এরিয়াল ব্যাটেলে না গিয়ে তাদের প্রেস করে বলের দখল নিতে বাধা দেয় এবং সেকেন্ড বল জিতে নেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু সৌদি আরবের সাথে আর্জেন্টিনার মিডফিল্ডাররা সরাসরি এরিয়াল ব্যাটেলে জড়িয়েছেন, যেখান থেকে তারা মাত্র ৪০ শতাংশ সময় এরিয়াল ব্যাটলে জিততে পেরেছেন। কিন্তু এভাবে বারবার এরিয়াল ব্যাটলে পরাজয় তাদের আক্রমণে ক্রমাগত ব্যাঘাত ঘটিয়েছে। 

ম্যাচের প্রতি মুহূর্তের অ্যাটাকিং থ্রেটের চার্ট; image credit: Opta Anlayst

গত ম্যাচের প্রায় পুরোটা সময়ই আর্জেন্টিনা আক্রমণ করে গিয়েছে। কখনো অফসাইডের ফাঁদ, কখনো সৌদি আরবের গোলকিপার চীনের প্রাচীর হয়ে আর্জেন্টাইন ফুটবলারদের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। আর্জেন্টিনার প্রথম গোলের পর আর সেকেন্ড হাফের শুরুর দিক – এই দুটি সময়ই সৌদি আরব আর্জেন্টিনার রক্ষণে ভয় ধরিয়েছে। আর এতেই তারা আর্জেন্টিনার কাছ থেকে জয় ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হয়ে গিয়েছে। বাকি সময় ম্যাচের আধিপত্য ছিল আর্জেন্টিনার হাতেই। কিন্তু এরপরও গোল করে ম্যাচে ফিরতে পারেনি আলবিসেলেস্তেরা।

image credit: getty images

কাতার বিশ্বকাপে প্রথম অঘটন ঘটানোর পথে সবচেয়ে বড় ভুমিকা রেখেছেন সৌদি আরবের ফরাসি কোচ হার্ভে রেনার্দ। রেনার্দের সাহসী কৌশলগত পদক্ষেপগুলো আবারো প্রমাণ করে দিল যে ভাগ্য সবসময় সাহসীদের পক্ষেই থাকে। বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচেই তার দল যা করেছে, তাতে নিশ্চিতভাবেই তিনি ঠাঁই করে নেবেন ইতিহাসের পাতায়!

অন্যদিকে, প্রথম ম্যাচেই ছন্দ হারানো আর্জেন্টিনার জন্য তৃতীয়বার বিশ্বকাপ ছোঁয়ার পথটা মসৃণ থেকে অনেকখানি জটিল হয়ে গেল। সব সমীকরণের মারপ্যাঁচ এড়িয়ে পরের দুই ম্যাচ জেতাটাই এখন মেসিদের সামনে সবচেয়ে সহজ পথ। তা না হলে হয়তো বা স্বপ্নের বিশ্বকাপ চিরঅধরাই রয়ে যাবে মেসির জন্য,  আর গোটা আর্জেন্টাইন সমর্থকদের আক্ষেপ বাড়তে বাড়তে পাহাড় সমান হয়ে উঠবে। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে টিম আর্জেন্টিনা চাইবে বিশ্বমঞ্চে আরেকবার নিজেদের সামর্থ্যের প্রমাণ দিতে। 

বিশ্বকাপে টিকে থাকতে হলে আর্জেন্টিনাকে পরের দুই ম্যাচে জিততেই হবে। বিশ্বকাপজয়ের মিশনে এসে আরেকবার হতাশা নিয়েই ফিরতে হয় কি না, মেসি বাহিনীকে সেটা এখন সময়ই বলে দেবে।

This article is in Bangla language. It is about the reasons behind Argentina's loss against Saudi Arabia

Featured Image: Getty Images

Related Articles