মাশরাফি বিন মুর্তজা-এক আকাশের নাম। যেখানে বেদনার মেঘ জমে, ভালোবাসার রোদ উঠে।
এই বেদনার মেঘ, ভালোবাসার রোদ ঠিক আগের মতোই আছে। তবে সেসবের অনুসরণকারীদের তালিকাটা দ্বিখন্ডিত হয়ে গেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের অন্যতম আলোচিত চরিত্র মাশরাফি। দেড় যুগের ক্রিকেট ক্যারিয়ারে অনেকবারই দেশজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন তিনি। এবার ২২ গজের পারফরম্যান্স বহির্ভূত ঘটনার কারণে তার প্রতি মানুষের নজর ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। রাজনীতিতে নাম লেখানোর কারণে তার তুমুল জনপ্রিয়তায়ও কিছুটা ভাটা পড়েছে। তারপরও আষ্টেপৃষ্ঠে লেপ্টে থাকা বিষম চাপের মাঝে ক্রিকেটের সঙ্গে আপোষ করছেন না মাশরাফি।
জীবনের পটে কিছু পরিবর্তন আসলেও নিজের আবেগ, আত্মার খোরাক ক্রিকেটেই নিমগ্ন আছেন তিনি। রোববার শুরু হতে চলা ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিতে প্রস্তুত মাশরাফি। রোববার সিরিজের প্রথম ওয়ানডে দিয়ে নতুন মাইলফলক স্পর্শ করবেন বাংলাদেশের ওয়ানডে অধিনায়ক।
বাংলাদেশের প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে ২০০তম ওয়ানডে খেলতে নামছেন নড়াইল এক্সপ্রেস। দেশের মাটিতে ২০১১ বিশ্বকাপ খেলতে না পারা মাশরাফির ক্যারিয়ারে সবচেয়ে বড় ক্ষত, যদিও তার পরের সময়টাতে ক্রিকেট বিধাতা অনেক পূর্ণতার প্লাবন বইয়ে দিয়েছেন তার ক্যারিয়ারে। মিরপুরে রোববার তেমনই এক অর্জনের ভারে সমৃদ্ধ হতে যাচ্ছেন তিনি।
ওয়ানডে ক্রিকেটের ৪৭ বছরের ইতিহাসে ৪,০৭০টি ম্যাচ হয়েছে, তাতে খেলেছেন ২,৪৭২ জন ক্রিকেটার। এদের মধ্যে ২০০ বা তার অধিক ম্যাচ খেলার রেকর্ড রয়েছে ৭৭ জনের। বিশ্বের ৭৮তম ক্রিকেটার হিসেবে রোববার ২০০তম ওয়ানডে খেলবেন মাশরাফি। আগের ১৯৯টি ম্যাচের মধ্যে ১৯৭টি বাংলাদেশের জার্সিতে, আর দু'টি ম্যাচ তিনি খেলেছেন এশিয়া একাদশের হয়ে।
ওয়ানডেতে সবচেয়ে বেশি ৪৬৩ ম্যাচ খেলার রেকর্ড ভারতের কিংবদন্তি শচীন টেন্ডুলকারের। চারশ’র বেশি ম্যাচ খেলেছেন মাহেলা জয়াবর্ধনে (৪৪৮), সনাৎ জয়াসুরিয়া (৪৪৫) এবং কুমার সাঙ্গাকারা (৪০৪)। বাংলাদেশের হয়ে ওয়ানডে খেলার দিক থেকে মাশরাফির খুব কাছাকাছিই আছেন মুশফিকুর রহিম, ১৯৫টি ম্যাচ খেলেছেন তিনি। তারপর সাকিব ১৯২, তামিম ১৮৩, মাহমুদউল্লাহ ১৬৫ ও আশরাফুল ১৭৫টি ম্যাচ খেলেছেন।
এমন অর্জনের পরিসংখ্যান অবশ্য মনে ছিল না মাশরাফির। তবে এসব মাইলফলক বিশেষ গুরুত্ব পায় না তার কাছে। এ প্রসঙ্গে বলেছেন,
‘আমার আসলে খেয়াল ছিল না। আমি আগেও বলেছি, এইগুলো আমাকে টাচ করে না। এগুলো আমার কাছে এত গুরুত্বপূর্ণও না। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ম্যাচটা জেতা। এইদিক থেকে ভালো লাগছে যে, বাংলাদেশের হয়ে ওয়ানডে ফরম্যাটে অন্তত ২০০তম ম্যাচ হচ্ছে। এটা অবশ্যই ভালো লাগবে একটা সময়, যখন মানুষ বলবে, তুমি বাংলাদেশের হয়ে ২০০টা ম্যাচ খেলেছো। এটা অবশ্যই একটা অর্জন।’
মাশরাফিকে ভুলে যাবে মানুষ?
রাজনীতিতে নাম লেখানোর পর গত ৪ ডিসেম্বর প্রথমবার আনুষ্ঠানিকভাবে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেছিলেন মাশরাফি। রাজনীতির কারণে গত কিছুদিন ধরে চলমান সমালোচনার তীরের আঘাত স্পষ্ট ছিল তার কথায়। অবলীলাক্রমে বলে দিয়েছিলেন, ক্রিকেট ছেড়ে দিলে মানুষ ভুলে যাবে মাশরাফিকে!
নিশ্চিতভাবেই এটি অধিনায়কের অভিমানের, খেদের কথা। কারণ, অব্যাহত সমালোচনায় দগ্ধ তিনি। অথচ সাকিব-তামিমরা বড় পারফরমার হলেও সন্দেহাতীতভাবেই বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ক্রিকেটার মাশরাফি। নেতৃত্বের গুণাবলী, সৎ মানসিকতা, সাধারণ জীবনযাপন, সাহসী চরিত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষের আবেগ, ভালোবাসা, শ্রদ্ধার অপর নাম নড়াইল এক্সপ্রেস। শেষ কয়েক সপ্তাহে হয়তো সেই জনপ্রিয়তা কিছুটা হ্রাস পেয়েছে, সেটা রাজনীতির কারণে।
কিন্তু ক্রিকেট ছেড়ে দিলে ক্রিকেটার মাশরাফিকে ভুলে যাবে মানুষ, কথাটিতে আপত্তি জানানোর মতো লোকের অভাব নেই বাংলাদেশে।
অধিনায়কের খেদোক্তিটি ছিল এমন,
‘আমার ক্যারিয়ার অবশ্যই শেষের দিকে। না আমি শচীন টেন্ডুলকার, না আমি ম্যাকগ্রা যে আমার কথা মানুষ স্মরণ রাখবে। আমি আমার মতো করেই ক্রিকেটটা খেলেছি। আমার স্ট্রাগলিং লাইফে যতটুকু পেরেছি, খেলেছি। তবে আমি সবসময় উপভোগ করেছি মানুষের জন্য কাজ করতে পারা। এটা আমার ছোটবেলার শখ ছিল বলতে পারেন।'
অপর এক প্রশ্নে মাশরাফি বলেছেন,
‘আমি বিশ্ব ক্রিকেটে আমি এমন কোনো সুপারস্টার না যে, আট মাস পর আমি যখন খেলা ছেড়ে দিব, তখন জনে জনে মানুষ স্মরণ করবে।’
আদৌ কি তাকে ভুলতে পারবে বিশ্ব ক্রিকেট, ক্রিকেটপ্রেমী মানুষরা?
তার হাত ধরেই ক্রিকেট বিশ্ব, বাংলাদেশ দেখেছে লড়াইয়ের অদম্য স্পৃহা। সাতটি অস্ত্রোপচারের পরও যিনি ২২ গজে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন, চিকিৎসকদের তাক লাগিয়ে দিয়ে দিব্যি খেলে যাচ্ছেন মাশরাফি। অথচ এই অস্ত্রোপচারের ভয়, ধকল সামাল দিতে না পেরে শেন বন্ডের মতো ক্রিকেটাররা বিদায় নিয়েছেন পেশাদার ক্রিকেট থেকে।
২০১৪ সাল, বাংলাদেশের ক্রিকেট ছন্নছাড়া এক পরিবারে রূপান্তরিত, হারের বৃত্তে মুহ্যমান। বছরের শেষ দিকে মাশরাফির হাতে নেতৃত্বের ভার তুলে দেয় বিসিবি। ভোজবাজির মতো দলটাকে বদলে দিলেন তিনি। সাফল্যের জিয়নকাঠি যেন তার হাতে। ২০১৫ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালের পর ২০১৭ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনালে খেলেছে বাংলাদেশ, সবই নড়াইল এক্সপ্রেসের নেতৃত্বেই। ২০১৫ সালে ঘরের মাঠে ভারত, পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকাকে ভূপাতিত করার মিশনেও নেতা ছিলেন তিনিই। সে সময় টানা ছয় ওয়ানডে সিরিজ জেতার রেকর্ড গড়েছিলো বাংলাদেশ।
অভিভাবক, ভাই কিংবা বন্ধু হয়ে বাংলাদেশ দলটাকে আগলে রাখার দায়িত্ব পালন করেছেন নিপুণ দক্ষতায়। দলের ভেতর, দেশের মাঝে প্রেরণাদায়ী, অনুকরণীয় এক চরিত্র তিনি। ক্রিকেটারদের আত্মবিশ্বাস যোগানো, বিপদে-আপদে পাশে দাঁড়ানো সব ভূমিকায় দেখা গেছে মাশরাফিকে। নিজের মস্তিষ্কের সবটা দিয়ে দল, তথা বাংলাদেশের সাফল্যের রাস্তা খুঁজেছেন তিনি।
দিনের আলোয়, সন্ধ্যায়, রাতে দেশবাসীকে অগুণতি রঙিন মুহূর্ত উপহার দেয়া ক্রিকেটার মাশরাফিকে কীভাবে ভুলবে বাংলাদেশের মানুষ?
কবে বিদায় নেবেন মাশরাফি?
২০১৯ বিশ্বকাপের পরই ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর পরিকল্পনার কথা অনেকবারই জানিয়েছিলেন মাশরাফি। তবে সম্প্রতি রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার পর তার ক্যারিয়ারে যত দ্রুত সম্ভব যতি চিহ্ন এঁকে দেয়ার আলোচনা ডালপালা গজিয়েছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ওয়ানডে সিরিজটাই দেশের মাটিতে তার শেষ সিরিজ কিনা, সেই প্রশ্ন উঠে এসেছে সঙ্গত কারণেই।
মাশরাফি অবশ্য সেই প্রশ্নে চূড়ান্ত কিছু বলেননি। বলেছেন, বিশ্বকাপের পর 'রিভিউ' করে দেখবেন কোথায় থামবেন।
ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে থাকা নড়াইল এক্সপ্রেস বলেছেন,
‘প্রথমত আমি বলেছি, আমার মাইন্ড সেটআপ বিশ্বকাপ পর্যন্ত ছিল। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির পর্যন্ত মনে হচ্ছিলো, আমি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির পর পারবো কিনা জানি না। তারপরও আমার ফিটনেস পারফরম্যান্স ঊনিশ পর্যন্ত চলছিলো বলেই আমি মোটামুটি এগিয়েছি। সেটাই বলছি, আমার বিশ্বকাপ পর্যন্ত মাইন্ড সেটআপ আছে। তারপর রিভিউ করার সুযোগ আছে, আমি যদি সেই অবস্থায় না থাকি, তাহলে অবশ্যই আমাকে কুইট করতে হবে। আর যদি থাকি, তাহলে অবশ্যই আমি চেষ্টা করবো, তার আগেও যেকোনো কিছু হতে পারে। ২০১১ বিশ্বকাপের পর আপনাদের এখানেই ৫০% বিশ্বাস করেছিলো যে, আমার ক্যারিয়ার শেষ। আল্লাহর রহমতে আরও সাত বছর ক্যারি করতে পেরেছি।’
রিভিউ করে বিশ্বকাপের পর মাশরাফি আর খেলবেন কি খেলবেন না, তা সময়ই বলে দিবে। ওয়ানডেতে দেশের সর্বোচ্চ উইকেট সংগ্রাহক এখন তিনি। এই ফরম্যাটে গত কয়েক বছরে দেশের সেরা বোলারও তিনিই। তাই শুধু নেতৃত্ব নয়, পারফরমার হিসেবেও ওয়ানডেতে মাশরাফি অপরিহার্য।
তার বিদায়ের পরও বাংলাদেশের ক্রিকেট এগিয়ে যাবে। তবে একজন আদর্শ অধিনায়ক, দেশপ্রেমে পরিপূর্ণ ক্রিকেটারের ছবি কল্পনা করলে ক্রিকেটপ্রেমীদের চোখে বারবারই ভেসে উঠবে লড়াকু এক মাশরাফির মুখ।
This article is in Bangla language. It is about Mashrafe Bin Mortaza, who is playing his 200th ODI matches against Windies. He is the first Bangladeshi cricketer who has reached this milestone.
Featured Image: BCB