আইপিএলে শিরোপা পেতে চাইলে কী করতে হবে? বিরাট কোহলি, এবি ডি ভিলিয়ার্স, ক্রিস গেইল আর মিচেল স্টার্কের মতো খেলোয়াড়দের দলে ভেড়াতে হবে? রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরু বলবে, যথেষ্ট নয়। তবে কি বছর বছর খেলোয়াড় বদলাতে হবে? কিংস ইলেভেন পাঞ্জাবের জবাবটা হবে, তা-ও নয়। গোটা দলের নামই বদলে ফেললে মিলবে সাফল্যের দেখা? দিল্লি ক্যাপিটালস যে তবুও শিরোপা জয়ের রাস্তার দেখা পাচ্ছে না।
ভুলটা কি শেষের ওভারগুলোতে করছি? নাকি ম্যাচের মধ্যভাগেই হাতছাড়া হচ্ছে ম্যাচের নাটাই? নাকি এসবের কিছুই নয়, ম্যাচের শুরুর ছয় ওভারেই নির্ধারিত হয়ে যাচ্ছে আমাদের ভাগ্য? কী করে পাওয়া যাবে সবচেয়ে বড় এই ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টের সাফল্যসূত্র, তা জানতে এরকম নানা প্রশ্নের উত্তরই দলগুলো খুঁজে ফিরছে হন্যে হয়ে। তাদের কাজকে সহজ করতে ক্রিকভিজও কাটাছেঁড়া করেছে বিগত কয়েক বছরে দলগুলোর পাওয়ারপ্লে পারফরম্যান্সকে। রোর বাংলার পাঠকদের জন্যে সে বিশ্লেষণই তুলে আনা হচ্ছে এ লেখায়।
***
টি-টোয়েন্টিতে সাফল্যের একদম সরল তরিকা যদি জানতে চাওয়া হয়, তবে সূত্র তো ঐ একটাই, 'পাওয়ারপ্লে কাজে লাগাও'। ব্যাটিংয়ের সময় উইকেট কম খুইয়ে যত পারো রান তোলো এই ছয় ওভারে, বল হাতে নতুন বলটায় উইকেট তোলো যথাসম্ভব।
২০১৭ থেকে করা এক হিসেবে দেখা যাচ্ছে, প্রথম ছ'ওভারে সবচেয়ে বেশি রান তুলেছেন কলকাতা নাইট রাইডার্সের ব্যাটসম্যানরা। শেষ তিন মৌসুমের পাওয়ারপ্লেতে ওভারপ্রতি তাদের রান তোলার হার ছিল ৮.৯০। কিন্তু অমন দ্রুতগতিতে রান তুলতে গিয়ে তারা গড়ে ২২.৩ বল অন্তর অন্তর উইকেট হারিয়েছিল ম্যাচের শুরুর পর্বে, যেখানে বাকি দলগুলো পাওয়ারপ্লেতে উইকেট খুইয়েছিল গড়ে ২৫.৩ বল তফাতে।
এ বিবেচনায় সানরাইজার্স হায়দরাবাদকেই সবচেয়ে সফল বলা চলে পাওয়ারপ্লেতে। শেষ তিন মৌসুমে ওভারপ্রতি ৮.৪০ করে রান তুললেও তারা উইকেট খুইয়েছে গড়ে ৩৬ বল পার্থক্যে। ৫০ রান, বিনিময়ে মাত্র ১ উইকেট, পাওয়ারপ্লের সবচেয়ে দারুণ ব্যবহারটা হায়দ্রাবাদই করেছে। এবং পাওয়ারপ্লের এই সাফল্যের পুরষ্কারটা মিলছে মৌসুম শেষে, শেষ তিন মৌসুমের প্রতিবারেই হায়দ্রাবাদ অন্ততঃ কোয়ালিফায়ার খেলেছে।
হায়দ্রাবাদের এই দলগত সাফল্যের আরও একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো, শেষ তিন মৌসুমের কোনোবারেই মিডল-অর্ডার থেকে ঠিকঠাক সমর্থনটা পায়নি তারা। মধ্যভাগের একাধিক খেলোয়াড় বদলে কিংবা নানা সমন্বয় চেষ্টা করেও কোনো লাভের মুখদর্শন হয়নি তাদের। একে তো শুরুতে ফিল্ডিং বাধ্যবাধকতার সুযোগ কাজে লাগিয়ে দ্রুত রান তুলে আনবার তাড়া, উপরি মিডল-অর্ডার ব্যর্থ হচ্ছে বলে উইকেটও খোয়ানো যাচ্ছে না; এমন বহুমুখী চাপ উতরে হায়দরাবাদের উদ্বোধনী ব্যাটসম্যানদের সাফল্য পাচ্ছেন বলে তাদের গুরুত্বও বেড়ে যাচ্ছে আরও। আইপিএলের ইতিহাসে চোখ বুলিয়ে দেখা যাচ্ছে, ম্যাচসংখ্যার দিক থেকে সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী উদ্বোধনী জুটিটা জমেছিল হায়দরাবাদের জার্সিতেই। ডেভিড ওয়ার্নার আর শিখর ধাওয়ান মিলে ২০১৪-১৭ সময়কালে একত্রে নেমেছিলেন ৪৮ বার, তাতে ৪৭.২৩ গড়ে হায়দ্রাবাদ পেয়েছিল ২,২২০ রান। এর মধ্যে ৬৪৬ রানই এসেছিল তাদের একত্রে খেলা শেষ মৌসুমে, যাতে ছিল তিনটি অর্ধশত আর দুইটি শতক ছাড়ানো উদ্বোধনী জুটি।
২০১৯ সালে শিখর ধাওয়ানকে দিল্লির ফ্র্যাঞ্চাইজির সঙ্গে লেনদেন করলেও হায়দরাবাদ আরেকটি দুর্দান্ত উদ্বোধনী জুটি পেয়ে গিয়েছিল সঙ্গে সঙ্গেই, এবারে রসায়নটা জমেছে পম আর অজির মাঝে। অস্ট্রেলিয়ান ডেভিড ওয়ার্নারের সঙ্গে ইংলিশ জনি বেয়ারেস্টো মিলে ২০১৯ সিজনে ইনিংসের প্রারম্ভিকা লিখেছিলেন ১০ বার, তাতেই ৭ বার বিনা উইকেটে পঞ্চাশ ছাড়িয়েছিল হায়দরাবাদের রান; এবং এদের মাঝে চারবার স্কোরকার্ডে শতরান উঠেছিল কোনো উইকেট না খুইয়েই। দু'জনের গড়া ৭৯ গড়ের জুটিতে খুব সম্ভবত ঠাহর করা যায় না, সর্বশেষ মৌসুমে প্রতিপক্ষের মনে কি ভয়ংকর ত্রাসই (ওভারপ্রতি রান তুলেছেন ৯.৮৪-করে) না ছড়িয়েছিলেন দু'জনে মিলে!
যেহেতু ক্রিকেট দলগত খেলা, আর তার অধিনায়কত্বে দল সাফল্যও পাচ্ছে বেশ, ডেভিড ওয়ার্নারকে নিয়ে আলাদা করে কিছু না বললেও চলে। কিন্তু তাতে যে ব্যাটসম্যান ডেভিড ওয়ার্নারের প্রতি মস্ত বড় এক অন্যায়ই হচ্ছে! ২০২০ আইপিএলের আগ অব্দি পাওয়ারপ্লে'তে প্রতিবার আউট হবার আগে ডেভিড ওয়ার্নার খেলেছেন ৭৪ বল, তাতে রান তুলেছেন ১০৪.৩৩; ওভারপ্রতি ৮.৬২ রান তোলার হারকেও নিশ্চয়ই খারাপ বলা যাবে না কোনোভাবেই।
ডেভিড ওয়ার্নারের নাম নেয়া হলো বলেই আরও দু'জন ব্যাটসম্যান চলে আসছেন সামনে। একজন হচ্ছেন গিয়ে জস বাটলার; ২০১৭ মৌসুমে মুম্বাই, পরের দু'বার রাজস্থানের হয়ে তিনি যেন হয়ে উঠেছিলেন ওয়ার্নারেরই প্রতিচ্ছবি। যদিও বা আউট হচ্ছেন ওয়ার্নারের চাইতে গড়ে ২১ বল আগে, কিন্তু মাঝের এই সময়টায় ওভারপ্রতি ৯.৯০ করে রান তুলছেন বলে পাওয়ারপ্লেতে ব্যাটিং গড়টা ৮৭ ছাড়িয়েছে তার।
আর অন্যজন সুনীল নারাইন, যিনি ইনিংস উদ্বোধনের দায়িত্ব পাচ্ছেন এই বছর চারেক হলো। বাকি দু'জনের পাশে তাকে বেমানানই ঠেকে অবশ্য, শুরুর ছয় ওভারে তার ব্যাটিং গড় যে মাত্র ২৩.৯৬। কখনো কখনো ইনিংসের শুরুর ওভারেই আউট হয়ে যান বলে ডিসমিসালপ্রতি বলের গড়টাও ১৪-য়ের বেশি নয়। কিন্তু যেটুকু সময় ক্রিজে থাকছেন, তাতেই ওভারপ্রতি ১১.০৯ রান তুলবার হার (এর চাইতে দ্রুতগতিতে পাওয়ারপ্লেতে রান তুলতে পারছেন না আর কেউ, দ্বিতীয় সর্বোচ্চর সঙ্গে ব্যবধান ১.১৯ রানের) কিংবা আইপিএল ইতিহাসের দ্বিতীয় দ্রুততম অর্ধশতক জন্ম দেবার রেকর্ডগুলো তো আর ফেলে দেয়া যাচ্ছে না। কলকাতা নাইট রাইডার্স যে কেন তাকে বারংবার ব্যর্থ হবার পরও ওপেনার হিসেবেই নামিয়ে যাচ্ছে, সে প্রশ্নের উত্তরটাও বোধকরি পাওয়া যাচ্ছে এই দুই তথ্যে।
স্পিনার হবার দরুণ পাওয়ারপ্লেতে নারাইন হাতে বল পান না খুব একটা; তবুও যা পেয়েছেন, বিচার করবার জন্যে তা পর্যাপ্ত না হলেও নারাইনের বোলিং পরিকল্পনার কিছুটা আন্দাজ পাওয়া যায় এর কল্যাণে। আইপিএলে শুরুর ছয় ওভারে কমপক্ষে ৯০ বল করেছেন, এমন স্পিনারদের সংখ্যা মাত্র ১২। পাওয়ারপ্লেতে উইকেট পেতে নারাইনকে অপেক্ষা করতে হয়েছে গড়ে প্রায় ২৯ বল, মোটে তিনজন বোলারের প্রতীক্ষাই ছিল তার চেয়ে বেশি। কিন্তু যখন চলে ব্যাটসম্যানদের বেদম প্রহার, সেই সময়ে তিনি ওভারপ্রতি রান দিয়েছেন সাতেরও কম। ক্রিকভিজ যে তাকে সর্বকাল সেরা টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটার ঘোষণা করেছে, তা তো ওই বিধ্বংসী ব্যাটের সঙ্গে এই রহস্যময় হাতের মনিকাঞ্চন যোগ ঘটেছে বলেই!
পরিসংখ্যান বলছে, আইপিএলের পাওয়ারপ্লেতে নারাইনের চাইতেও কম ইকোনমি রয়েছে মোহাম্মদ নবীর। এমনকি পাওয়ারপ্লেতে স্পিনারদের ঝাণ্ডাটা উঁচু করেছেন তিনি আর তারই দুই স্বদেশী রশীদ খান ও মুজিব-উর রহমান মিলেই। নবী যে তিন মৌসুম খেলেছেন আইপিএলে, তার পাওয়ারপ্লেতে রান দিয়েছেন ওভারপ্রতি ছয়েরও কম; অন্যদিকে স্পিনারদের ভেতরে রশীদ খান উইকেট তুলেছেন সবচেয়ে তাড়াতাড়ি।
***
পাওয়ারপ্লে বোলিংয়ের কথা বললে অবশ্য পেসারদের কথাই বলা উচিৎ বেশি করে। নতুন বলটা যে পেসারদের, এই ধ্যানধারণাকে কেন্দ্র করেই তো আবর্তিত হয় বেশিরভাগ দলের পরিকল্পনা। এক পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, আইপিএলে শেষ তিন বছরে পাওয়ারপ্লের ৭৬% ওভারই করেছেন পেসাররা; এর পূর্বের নয় মৌসুমে যা ছিল আরও বেশি, ৮৪ শতাংশ।
অ্যান্ড্রু টাই, উমেশ যাদব কিংবা মিচেল ম্যাকলেনাহানের মতো পেসাররা ম্যাচের এই ব্রাহ্মপর্বে মন দিয়েছিলেন উইকেট তোলার দিকেই; যদিও বা ওভারপ্রতি খরচ করেছেন আটের কাছাকাছি রান, কিন্তু ব্যাটসম্যানদের প্যাভিলিয়নে ফেরত পাঠানোর কাজটা সবচেয়ে দ্রুত করেছেন তারাই। অন্যদিকে জোফরা আর্চার আর জসপ্রীত বুমরাহর মতো পেসাররা ইনিংসের শুরুতে ডটের পরে ডট বল দিয়েই তুলেছেন ব্যাটসম্যানদের নাভিশ্বাস, দুজনেরই পাওয়ারপ্লে ইকোনমি রেট প্রায় ছয়।
এবং টাই-বুমরাহদের বাইরেও সাফল্য পেয়েছেন আরেক শ্রেণির বোলার, যাদের ফেলা চলে দীপক চাহারের ক্যাটাগরিতে। টাইয়ের মতো নিয়মিত বিরতিতে উইকেট পাননি তিনি, আবার বুমরাহর মতো কিপটেও ঠিক নন। তবে ২৬.০৩ গড়ে চাহার পেয়েছেন ২৬ উইকেট, সংখ্যাটি ২০১৭ আইপিএল হতে সর্বোচ্চ। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আইপিএলের সেরা পাওয়ারপ্লে বোলারের খেতাবটা চাহারকেই দিতে হচ্ছে।
কেননা, লেখার একদম শুরুর ছবিতে যদি ফেরত নিয়ে যাই পাঠকদের, দেখতে পাচ্ছি ব্যাটিং পাওয়ারপ্লেতে সবচেয়ে ধীরগতির শুরুটা করেছিল চেন্নাই-ই। তবুও যে চেন্নাই ২০১৮ মৌসুম শেষ করেছিল টুর্নামেন্ট জিতে এবং ২০১৯ মৌসুমেও ফাইনাল হেরেছিল একদম শেষ বলে, তা তো বোলিংয়ের সময় নতুন বলটার দুর্দান্ত ব্যবহার করবার কারণেই! শুরুর ছয় ওভারে তাদের চাইতে নিয়মিত বিরতিতে উইকেট তুলতে পারেনি আর কোনো দল, উইকেট তুলে বেশিরভাগ দিনই প্রতিপক্ষের রানটাও পাওয়ারপ্লেতে তারা আটকে রেখেছিল পঞ্চাশের কমে।
ম্যাচের এই পর্বে চেন্নাইয়ের চাইতে কম রানে প্রতিপক্ষকে বেঁধে রাখতে পেরেছিল মোটে দুইটি দল; সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদ এবং মুম্বাই ইন্ডিয়ানস। হায়দরাবাদের সাফল্যকীর্তন তো গাওয়া হয়েছিল শুরুতেই; এখন জানানো হচ্ছে, ২০১৭ এবং ২০১৯ সালে মুম্বাই ইন্ডিয়ানস মাসদুয়েকের আইপিএল-উৎসব শেষ করেছিল বিজয়ী বেশে।
প্রিয় পাঠক, 'পাওয়ারপ্লে জয় মানেই কি আইপিএল জয়?' প্রশ্নের উত্তরটা খুব সম্ভবত পাওয়া গিয়েছে।
This article is in Bangla language. This article is an analysis on the performance of ipl teams during powerplay. Necessary hyperlinks are attached inside.
Featured image © BCCI