Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

জিডিই বারতোনি: যেখানে, যেভাবে তৈরি হয় বিশ্বকাপ

কেন লড়াই করছে এই ৩২ দল?

কেন লিওনেল মেসি, নেইমার কিংবা রোনালদো নিজেদের উজার করে দিতে চাচ্ছেন এই আসরে এসে?

একটি ট্রফির জন্য, বিশ্বকাপ ট্রফি।

সারা দুনিয়ায় সবচেয়ে কাঙ্খিত এবং লোভনীয় ট্রফিটির নাম বিশ্বকাপ ট্রফি। নাম বা দামের দিক থেকে যা-ই হোক, এটি ফুটবল বিশ্বের শ্রেষ্ঠত্বের প্রতীক বলেই একে নিয়ে এতো বেশী উন্মাদনা। তারপরও ট্রফিটির নিজস্ব একটা মাহাত্ম তো আছেই।

এখানে একটা মজা আছে। চার বছরে ফিফাাকে একটা করে রেপ্লিকা ট্রফি বানাতে হয়। কারণ, মূল যে ট্রফিটা আমরা দেখি, সেটা ভয়ানক সুরক্ষিত একটা সম্পদ। এটা জুরিখের সদরদপ্তর আর ফিফা ফাইনালের মাঠ ছাড়া আর কোথাও যায় না। এমনকি বিজয়ী দলও এই ট্রফি পায় না স্থায়ীভাবে। তাদেরকে এর বদলে বানিয়ে দেওয়া হয় একটা রেপ্লিকা ট্রফি। সেই রেপ্লিকাকে অবশ্য ‘নকল’ বলে মনে করার কোনো সুযোগ নেই। সেটাও মূল ট্রফির মতো সোনার পাতে মোড়ানো, একই আকার ও একই ওজনের একটা ট্রফি।

পালিশ চলছে সদ্য তৈরী ট্রফিতে। সোর্স: আল জাজিরা

 

তাহলে কোথায় কিভাবে এই ট্রফি তৈরী হয়? কোথায় তৈরী হয়েছিলো প্রথম বিশ্বকাপ ট্রফি?

এই সবকিছুর উত্তর ইতালির মিলান শহরের জিডিই বারতোনি নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানটির শিল্পী সালভিও গাজ্জানিগাই ১৯৭১ সালে ডিজাইন করেন বর্তমান ফিফা বিশ্বকাপ ট্রফিটি। সেই থেকে এই প্রতিষ্ঠানই দেখভাল করে আসছে এই ট্রফিটি। তারাই তৈরী করে সব রেপ্লিকা। আজ জানতো এই প্রতিষ্ঠানটি ও ট্রফিটির আদ্যোপান্ত।

 

ফিফা ট্রফির ইতিহাস

আমরা যে ট্রফিটা এখন দেখতে পাই, এটা আসলে বিশ্বকাপের দ্বিতীয় ট্রফি। ফিফা বিশ্বকাপে শুরু থেকে ব্যবহৃত হতো জুলেরিমে ট্রফি নামে একটা ট্রফি। একেবারে শুরুতে এর নাম ছিল ‘ভিক্টোরি’ বা ‘কোউপ ডু মোন্ডে’। ১৯৩০ সালে বিশ্বকাপ শুরু হলেও ১৯৪৬ সালে সাবেক ফিফা সভাপতি জুলে রিমের নামে এই ট্রফির নামকরণ করা হয়। এই ট্রফির ডিজাইন করেছিলেন ভাস্কর আবেল লাফলেউর।

১৯৩৮ সালে বিশ্বযুদ্ধের সময় ট্রফিটা ছিল বিজয়ী দল ইতালির কাছে। নাত্সী বাহিনীর হাত থেকে রক্ষার জন্য ফিফার সহ-সভাপতি অট্টোরিনো বারাসিস এটি ব্যাংক থেকে তুলে রোমে নিয়ে যান। লুকিয়ে রাখেন একটা জুতার বাক্সে। আবার ১৯৬৬ বিশ্বকাপের মাত্র চার মাস আগে লন্ডনে এক উন্মুক্ত প্রদর্শনী অনুষ্ঠান থেকে চুরি হয়ে যায় এই বিশ্বকাপ। সাত দিন পর খবরের কাগজে মোড়ানো অবস্থায় লন্ডনের নরউড অঞ্চলের সাবারবেন বাগান থেকে একে উদ্ধার করে পিকেলস নামের একটি কুকুর।

অতিরিক্ত লেগে থাকা ধাতু তুলে নেওয়া হচ্ছে। সোর্স: আল জাজিরা

 

কুকুরটির মালিক ডেভিড করবার্টকে অবশ্য এর জন্য ছয় হাজার পাউন্ড পুরস্কৃত করা হয়। আর ট্রফিটির বিনিময়ে ১৫ হাজার পাউন্ড দাবি করা চোরকে দেওয়া হয় দু’বছরের জেল। ১৯৭০ সালে তিনবার বিশ্বকাপ জয়ের পর এটা চিরতরে পেয়ে যায় ব্রাজিল। কিন্তু ১৯৮৩ সালের ১৯ ডিসেম্বর আবারও চুরি হওয়ার পর আর কোনো হদিস মিলেনি ট্রফিটির। ধারণা করা হয় ট্রফিটি এর মধ্যে গলিয়ে ফেলা হয়েছে। তাই আর সেটাকে খুজেও লাভ হয়নি।

১৯৭৪ সালে এসে বিশ্বকাপের ট্রফি বদলের সিদ্ধান্ত নেয় ব্রাজিল। সাতটি দেশ থেকে ৫৩টি ডিজাইন এসে জমা পড়ে। তবে সবাইকে পাশ কাটিয়ে বিজয়ী হয়ে যান জিডিই বারতোনির শিল্পী সিলভিও গাজ্জানিগা। প্রথমে এর পুরোটা সোনা দিয়ে তৈরির পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু নটিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিস্ট্রির অধ্যাপক মার্টিন পোলিয়াকফ মত দেন এত স্বর্ণ দিলে এর ওজন হবে প্রায় ৭০ কেজি। এত ভারী ট্রফি তুলতে তো ফুটবলার নয়, লাগবে ভারোত্তোলক। তাই ট্রফির উপরের গোল অংশটি ফাঁপা করে বানানোর সিদ্ধান্ত নেয় ফিফা।

ট্রফির মাহাত্ম

সিলভিও গাজ্জানিকা নিজেই বর্ণনা করেছেন এই ট্রফির মাহাত্ম:

‘ক্রীড়া ও বিশ্ব ক্রীড়ার যে সমন্বিত সুর, তাকে ধরতে গিয়ে আমি দুটো মৌলিক ছবি মাথায় রেখেছিলাম-একজন অ্যাথলেটের জয় ও বিশ্ব। আমি জানতাম, এই কাজটিতে এমন কিছু দৃঢ় লাইন থাকতে হবে, যাতে একজন ফুটবলারের জয় বোধায়, কিন্তু সেটা সুপার  হিউম্যানের ইগো ছাড়াই; একটা মানুষ তার জয়ে উল্লাস করছে। একজন ক্রীড়া নায়ক, যে বিশ্বকে জড়িয়ে ধরেছে। এটা একজন ক্রীড়াবিদের দিনের পর দিনের ত্যাগ ও পরিশ্রমকে চিত্রায়িত করবে এবং তার সতীর্থদের চিত্রায়িত করবে।’

ডিস্টিল ওয়াটারে ধুয়ে পরিষ্কার করা হচ্ছে ট্রফি। সোর্স: আল জাজিরা

 

এই ট্রফিকে বলা হয় অহংকার বর্জিত এক উল্লাসের দৃশ্য। এখানে দুই জন ফুটবলার দুই পাশ থেকে উঠে এসে হাতে হাত রাখার চেষ্টায় উল্লাস করছেন। তাদের হাতে বাঁধা পড়েছে বিশ্ব। এ যেনো ফুটবলেরই প্রতীক, এ যেনো বিশ্বকাপেরই প্রতীক।

ফিফা এমন একটা ভাতৃত্ব বোধ ও জয়ের স্লোগানই ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলো। তাদের সেই ফেয়ার প্লে ও জয়ের চেয়েও বড় খেলা; এই মূল বোধের সাথে ট্রফির এমন মিল হওয়াতে এই ট্রফিকে বেছে নিতে ফিার খুব একটা সময় লাগেনি।  

 

জিডিই বারতোনি

১৪.৫ ইঞ্চি লম্বা, ৬.১৪২ কেজি ওজনের একটা অসাধারণ শিল্প সম্মত ট্রফি; যা তৈরী হবে ১৮ ক্যারেট সোনা দিয়ে। কারা তৈরী করবে এটা।

যেহেতু গাজ্জানিগা নিজে এরকম একটা প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত, তাই তাদের প্রতিষ্ঠান জিডিই বারতোনিকেই ফিফা দায়িত্ব দিলো এই ট্রফি তৈরী করার।

জিডিই বারতোনি আগে থেকেই খ্যাত ছিলো বিভিন্ন মূলবান ট্রফি ও মেডেল তৈরী করার জন্য। সেই ১৯০০ সালে ইতালির মিলান শহরে যাত্রা শুরু করে হস্তশিল্প প্রতিষ্ঠান বারতোনি। ১৯৪৪ সালে এই প্রতিষ্ঠানটি কিনে নেন ড. এউগেনিও লোসা। তিনি এমিলিও বারতোনির সাথে মিলে প্রতিষ্ঠানটিকে এগিয়ে নেন। কয়েক বছরের মধ্যে অবশ্য প্রতিষ্ঠানটির পুরো মালিকা কিনে নেন ড. লোসা।

গ্যালভানাইজেশনের কাজ শুরু হবে। সোর্স: আল জাজিরা

 

১৯৬০ সালে এই প্রতিষ্ঠানটি রোম অলিম্পিকের সব মেডেল ও স্মারক সরবরাহের দায়িত্ব পায়। সেবার এই সব ডিজাইনের দায়িত্বে ছিলেন ভাস্কর এমিলিও গ্রেসো। এই ইভেন্টই বারতোনিকে পরিচিত করে তোলে বিশ্বব্যাপী। এরপর ইউরোপ ও আরবের বেশ কিছু দেশে বড় বড় ক্রীড়া ইভেন্টের দায়িত্ব পেতে থাকে তারা।

১৯৭১ সালে এই কোম্পানির ইতিহাস বদলে যায়। ফিফার আয়োজিত প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় তারা। আর সেখানে নতুন ফিফা বিশ্বকাপ ট্রফি তৈরীর জন্য বিজয়ী হয় ভারষ্কর সিলভিও গাজ্জনিগার ডিজাইন। আর এভাবেই তারা জড়িয়ে পড়ে ফিফার সাথে।

এরপর বিভিন্ন সময় তারা তৈরী করেছে ১৯৮০, ১৯৯২ অলিম্পিকের পদক। তৈরী করেছে ১৯৯০, ২০০৬ সালের বিশ্বকাপের মেডেলও। এ ছাড়া তারা তৈরী করেছে চ্যাম্পিয়নস লিগ, ইউরোপা লিগের ট্রফিও।

তৈরী হয় মেডেলও। সোর্স: আল জাজিরা

 

এখন যা হয়

প্রতি চার বছর বাদে বাদে জিডিই বারতোনিতে ফিরে আসে মূল ফিফা বিশ্বকাপ। এখানে সিলভিও গাজ্জনিগা যতদিন জীবিত ছিলেন, সরাসরি তার তত্ত্বাবধায়নে পরিষ্কার ও সংষ্কার করা হতো মূল ট্রফির। ট্রফি যেনো কিছু্তেই বিকৃত বা ক্ষতিগ্রস্থ না হয়, এটা দেখাটা এখানকার শিল্পী ও কর্মীদের মূল চ্যালেঞ্জ থাকে। অত্যন্ত যত্নের সাথে এই কাজ করার পাশাপাশি আরও একটা কাজ করতে হয় বারতোনিকে।

এখানেই তৈরী হয় রেপ্লিকা। অত্যন্ত যত্নের সাথে সেই রেপ্লিকা তৈরী করে ফিফার হাতে তুলে দেওয়া হয়।

 

Related Articles